মাহি এবং...(অনিয়মিত পার্ট)
দুইঃ
বাবা এয়ারপোর্ট-এর ভেতর ঢুকে যাওয়ার পরেও তাকে আমরা দেখছিলাম কাঁচের এপার থেকে। মোটা কাঁচ। বাইরের কোন শব্দ ভেতরে যায়না। ভেতরেরটাও বাইরে আসেনা। আম্মা দেখি হঠাৎ করেই ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে কিছু একটা লিখে এয়ারপোর্ট-এর সেই কাঁচে চেপে ধরছে। আব্বাও কথা থেকে যেন কাগজ কলম জোগাড় করে আম্মার উত্তর দিচ্ছেন। একই উপায়ে। বাবা কখন চলে গিয়েছিলো, আম্মা কতখানি কেঁদেছিলেন তাঁর কিচ্ছু আমার স্মৃতিতে নেই। কিন্তু প্লেনগুলোর ছবি মনে গেঁথে আছে। আমার বাবাকে আমার শৈশব থেকে কেড়ে নেয়ার যন্ত্র।
কয়েকদিন পরেই আমরা খুলনায় চলে আসি। বাবার কথা ভুলে যাই খেলার তোড়ে। আম্মা নতুন নতুন স্বপ্ন দেখেন সচ্ছলতার। আমারা খুব বেশি সচ্ছল ছিলামনা সেসময়। আম্মার যে চাকরি তাতে করে সন্মান নিয়ে বেঁচে আছি সবাই। সবাই বলতে আমি আর আম্মা। থাকি পূর্ব বানিয়াখামারের একতলা এক বাসায়, এক রুমের এক কামরায়। সাথে টুনি এক রান্নাঘর আর বাথরুম কাম টয়লেট। বাসার সামনে বিশাল বড় এক বস্তি। বস্তি বলতে আমরা বুঝতাম কিছু ছাপরা গোলপাতা আর টিনের ঘর। সবগুলো পাশাপাশি। একটা রুমের সাথে আর এক রুমের মাঝে শুধুই বাশের ব্যাড়ার একটা দেয়াল। আমাদের ওই অঞ্চলের রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, ফেরিওয়ালা ইত্যাদি কম আয়ের পেশাওয়ালা মানুষের বাস ছিল সেখানে। তাও প্রায় ৫০০/৬০০ মানুষের বাসতো হবেই।
বস্তির পরিবেশও তাই ছিল অনেক অন্যরকম। সারাদিন কোন না কোন শব্দ আসতো সেখান থেকে। নানান ধরনের আওয়াজে। কখনো কেউ সস্তা সাউন্ড বক্সে হয়তো বাজাচ্ছে কোন বাংলা ছিনেমার জনপ্রিয় গান।। কেউ একজন, সম্ভাবত সেই সময়কার কোন সদ্য প্রেমে পড়া যুবক প্রায়দিন সকালে বাজাতো, “শিশুকাল ছিলাম ভালো যৌবন কেন আসিল, বাগিচায় ফুল ফুটিল কোকিল কেন ডাকিল”...। আমি প্রতিদিন একই সময় এই গানটা শুনতাম। গালি, খিস্তি আর ঝগড়া ছিল ওই বস্তির প্রতি মুহূর্তের একটা প্রয়োজনীয় বিষয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখতাম জামাকাপড় ছাড়া একদম উদম হয়ে সারা বস্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায়ই দেখতাম একটু যারা বয়স্ক, বিশেষ করে মহিলারা এক গাল পান মুখের ভেতর নিয়ে তাঁর গেটের সামনে বসে কোন অল্প বয়স্ক মেয়েকে শোনাচ্ছে তাঁর যৌবনের গল্প। তাঁর গ্রামের কথা। কত বিঘা জমি ছিল তাদের। ছিল বিশাল এক মাছ ভরা পুকুর আর গোয়ালভরা সব স্বাস্থ্যবান গরু। ব্যাইন্যা কালে (সকাল বেলা)ক্যামনে নির্লজ্জ মাইনসের নাহান পাশের গেরামের ছমেদ মাতবরের পোলা সুরিশার তেল দিয়া মাথাডা এক্কালে ইস্তিরি কইরা আমাগো খালপাড়ে ঘুরঘুর করতো। মুইতো তহন এই ছোড্ডডা। অতো কিছু কি আর বুঝি? ঘাড়ের দুই পারশে দুইডা বেনি, হ্যাও আবার পলাশপোলের হাড থেইকা কিন্যা আনা রঙ্গিন ফিতা দিয়া বান্ধা। বোজ্জস, হেই সময় পলাশপোলের হাডে বাজার করতে যাইতো গেরামের পয়শাওলা গেরস্থরা। হেই চুলের বেনি দুলাইয়া দুলাইয়া যাইতাম ইশকুলে। একদিন আমার এক সইয়ে কইলে, ছমেদ মাতবরের ওই পোলাডার কথা। সে নাহি আমারে ভালা পাইছে। একখান পত্র দিতে চায়। আমিতো লজ্জায় খান...। এই পর্যন্ত বলে মহিলাটা খুব আয়োজন করে পানের পিক ফেলে। ঘরের বাইরে। সেখানে অলরেডি আরও অজস্র দাগ সহ দাড়িয়ে আছে মাটি আর বাশের এক পূর্ণবয়স্ক দেয়াল। তারপর ধীরে ধীরে গল্প মর নেয় ট্রাজেডিতে। অল্পবয়স্ক মেয়েটা তখনো হা করে শুনছে সেই কথাগুলো। সাথে পেছনে দাঁড়ানো আমি। আমি ওই বস্তির পরিবেশ মনে মনে ঘৃণা করতাম। কিন্তু ঘুরে বেড়াতাম ওর ভেতরেই। আমি দারুন ভয় পেতাম। শুধু মনে হতো, যদি একদিন আমাদেরকেও এভাবে থাকতে হয়...। ভয়ে মাঝে মাঝে আঁকড়ে যেতাম। তারপরেও সেই ভয়ের জগতেই ঘুরে বেড়াতাম। নিজে নিজেই শিখলাম, সাহসী মানুষেরা আসলে সবচেয়ে ভীতু, তারা শুধু সাহস করে ভয়ের মুখোমুখি হয়।
এখানে আমার শৈশবের একটা লম্বা সময় কেটেছে। এই বাসাতেই একটা দারুন মজার ঘটনা আছে।
“আব্বা তখন ব্যবসা করছেন। কখনো ঢাকাতে তো কখনো বেনাপোলে। অনেকদিন পরপর হঠাৎ করেই উনি আসেন আর হঠাৎ করেই চলে যান। নতুন ব্যবসা। অনেক সময় দিতে হয়। এরকম বাবার অনুপস্থিতির একদিন, সারাদিন আমি আর মা বাইরে ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসলাম ঘরে। আম্মা ঘরের তালা খুলবেন এমন সময় কি মনে করে যেন আমি গেলাম জানালার কাছে। দরজা এবং জানালা দুই দেয়ালে। আম্মা খুবই সাবধানী মানুষ। ঘর থেকে বের হবার সময় উনি খুব লক্ষ্য রাখেন যেন দরজা, জানালা ঠিকভাবে বন্ধ করা হয়।
সেখানে দেখি জানালা খোলা। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মা ঘরে চোর এসেছিল।জানালা খোলা। আম্মা দৌড়ে চলে আসলেন জানালার কাছে। আমি তখনো প্রবল বেগে চিৎকার করে যাচ্ছি। মা চোর এসেছে। এমন সময় দেখি আমাদের ঘরের শোকেসের উপর ২টা মিষ্টির প্যাকেটের মত বাক্স। আমি আরও জোরে চিৎকার করে উঠলাম, “মা চোরটা মিষ্টি নিয়ে এসেছে”।
আম্মা বেশ ভয় পেয়ে গেলেন। দরজা আর খোলেননা। আমার চিৎকারে আশেপাশের বেশ কিছু মানুষ জড় হয়ে গেছে। তাদের উপস্থিতিতে সাহস করে আম্মা দরজার তালা খোলেন। সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকে সব কিছু চেক করে দেখেন যে কোন কিছু খোয়া গেলো কিনা। আমি তখন বিশাল ডিটেকটিভ। ঘরের কোনা কাঞ্চিতে , টয়লেটে চোর খুঁজছি।
খুঁজতে খুজতেই চোর পেয়ে গেলাম। খাটের নিচে। অন্ধকারে মশার কয়েল জ্বালিয়ে মারাত্মক আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। আমি তারস্বরে চিৎকার করে যাচ্ছি, “খাটের নিচে চোর। আম্মা খাটের নিচে চোর ঘুমাচ্ছে।”
চোর বেচারা আমার চিৎকারে তড়িঘড়ি ঘুম ভেঙে খেলো খাটের সাথে মাথায় বাড়ি। লোকজন চলে এলো লাঠিসোঁটা নিয়ে। বিশাল কেওয়াজ। তার ভেতর ধীরে ধীরে বের হলেন চোর। খানদানি মোচওয়ালা চোর। পৃথিবীর সবচেয়ে স্মার্ট এবং রোম্যান্টিক চোর। আমার বাবা।
উনি আমাদের সারপ্রাইজ দেবেন বলে দুম করে চলে এসেছেন। আব্বার কাছে ঘরের একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। সেটা দিয়েই দরজা খুলে ঢুকেছেন। ইলেক্ট্রিসিটি ছিলোনা বলে জানালা খুলে চুপচাপ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন খাটের নিচে। শুধু ভুল করে মিষ্টির প্যাকেটটা রেখেছেন শোকেসের ওপর। আশেপাশের যারা লাঠিসোঁটা নিয়ে এসেছিলেন চোর মারতে তারা সবাই দেখি কেমন কেমন করে হাসি দিয়ে আলোচনা শুরু করলেন যে, তারা আগেই বুঝেছিলেন যে ভাইই এসেছেন ঘরে। তারপরেও শুধু সাবধানতার জন্য লাঠি আনা, আর কি...। আমারা আসলেই দারুন সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছিলেন আব্বা নিজে।
সেই হাসিখুশি বোকাসোকা মানুষটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাজার মাইল দূরে চলে গেলেন। সাথে নিয়ে গেলেন আমাদের এক অদ্ভুত সুন্দর জগৎ। আম্মার বোধ হয় আর দিন কাটতে চায়না। হঠাৎ করেই আম্মা সেই সময় দারুন গম্ভির হয়ে গেলেন। আমি তখন একদম পিচ্চি কিন্তু তারপরেও স্মৃতিগুলো মারাত্মক রকম স্পষ্ট হয়ে আছে মানসপটে। চোখ বন্ধ করলেই ঘ্রান পাই।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৪