লেখালেখির সময়টাতেই আমি নিজেকে সবচেয়ে জীবিত অনুভব করি। তাই বেঁচে থাকা ও লেখালেখি আমার কাছে সমার্থক। এটা ঠিক যে লেখালেখি অক্সিজেন না, লেখালেখি ছাড়াও আমি শারীরিকভাবে বেঁচে থাকব, কিন্তু সেই বেঁচে থাকা হবে অর্থহীন-মূল্যহীন, তৃষ্ণার্ত হয়ে বেঁচে থাকার মতো, গলায় ফাঁস লাগিয়ে বসে থাকার মতো। তেমন জীবন আমি চাই না।
লেখালেখিতেই আমার মুক্তি। প্রথম যেদিন আমি লেখার জন্য কলম ধরেছিলাম, সেদিন থেকে আমার জীবন আমূল পাল্টে গেছে। শব্দের প্রতি, ভাব প্রকাশের প্রতি আমার ভালবাসা আমাকে পাগল করে দিয়েছে। আমার ধমনীতে যেন রক্ত নয়, বর্ণস্রোত প্রবাহিত হয়। আমার লেখালেখি আমাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। আমি অনেকবার মানসিকভাবে মরতে বসেছিলাম, আমার লেখক সত্ত্বা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
লেখালেখিই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই পৃথিবী আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, প্রতিদানে লেখালেখি ছাড়া আমার আর দেবার কিছুই নেই। আমার চারপাশের বিচিত্র সৌন্দর্যকে আমি শব্দবন্দি করতে চাই, যেন কখনও হারিয়ে যেতে না পারে। সমস্ত কলুষতাকে আমি শব্দের পবিত্র স্নানে নিষ্পাপ করে দিতে চাই, যেন আগামীর পৃথিবীটি আরও সুন্দর হয়। পৃথিবীর প্রতি, পৃথিবীর মানুষের প্রতি, প্রতিটি প্রাণীর প্রতি আমার যে অপরিসীম ঋণ তা শব্দের বিনিময়েই আমাকে স্বীকার করতে হবে। অন্য কোন ভাষা আমার জানা নেই।
একজন শব্দকর্মী হিসেবে, একজন শিল্পী হিসেবে, পৃথিবীর সৌন্দর্য মুকুটে আমি আলাদা করে যদি কোন পালক জুড়ে দিতে পারি, সেটাই হবে আমার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। কিন্তু সব সময় যে আমি শিল্প সৃষ্টি করি বা করতে পারি তা কিন্তু নয়। প্রকৃতির মতো আমারও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু প্রকৃতিপালক যখন চান তখন শিল্প আপনা থেকেই জন্ম নেয়। কখনও এটাই যথেষ্ট, কখনও আলাদা আরাধনার প্রয়োজন পড়ে।
আমার এই চেষ্টা হয়তো খুব সামান্য। নেহাত কিছু শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু শব্দ খুবই শক্তিশালী। শব্দ আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে। আমাদের অনুভূতি, চিন্তা, কল্পনা শব্দের মাধ্যমেই তো প্রকাশ পায়। শব্দের মাধ্যমেই আমরা ভালবাসার কথা জানায়, শব্দ দিয়েই আমরা পরস্পরের গল্প জানতে পারি।
আমি অভিভূত হয়ে যায় যখন কেউ খুব আগ্রহ নিয়ে আমার লেখা পড়েন, উপভোগ করেন এবং প্রতিক্রিয়া জানান। এমনকি কখনও মন্দ লিখলেও বলেন 'ভালো হয়েছে'। যা আমার জন্য সবকিছু। আমার কঠিন সময়ে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। আমার পরম সৌভাগ্য, ব্লগ নামে এমন একটি স্থান আমার আছে যেখানে আমি সে সব কথা বলতে পারি যা হয়তো না বলাই থেকে যেত। এমন একটি স্থান আমাদের আছে যেখানে আমরা সে সব কথা শুনতে পারি যা শোনা খুব প্রয়োজন।
ভেবে দেখুন, আপনি আমার লেখা পড়ছেন, আমার সৌভাগ্যক্রমে হয়তো কোন একটি শব্দ, কোন একটি কথা আপনার ভেতরে একটা আলোড়ন তুলতে পারে। হয়তো আমার কোন লেখায় আপনার মনের কথা খুঁজে পেতে পারেন, দেখতে পারেন আপনার বা অন্য কারও প্রতিবিম্ব। আমার ভাগ্য যদি সুপ্রসন্ন হয়, হয়তো কোনভাবে আমি আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারি। একজন লেখকের এই তো চাওয়া-পাওয়া, দেনা-পাওনা। লেখকের আর কি প্রয়োজন? মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি আবশ্যক না। দায়িত্ব ও কর্তব্য, জীবন ও শিল্পবোধ এসবের অপেক্ষা রাখে না।
লেখার জন্য কাগজ-কলম বা কী-বোর্ড নিয়ে যখন দীর্ঘক্ষণ বসে থাকি অথচ মাথাটা থাকে ফাঁকা, একজন লেখকের তখনকার বিভীষণ অনুভূতি অন্য কেউ কখনও বুঝবে না! আবার নিজেকে যখন লেখালেখিতে প্রাণ খুলে উজাড় করে দিতে পারি তখন একজন লেখকের চেয়ে সুখী মানুষ পৃথিবীতে মনে হয় আর কেউ হয় না!