১৩-১৪ বছর আগের কথা।আমার বয়স তখন ১১ কি ১২ বছর।শতছিদ্রের টিনের চালা আর ভাঙ্গা বেড়ার এক ঘরের একপাশে থাকি আমি আর আমার ৩ বছরের বড় ভাই।শোলার পার্টিশনের ওপাশে বাবা মা সাথে আমার ছোট ভাই।ওর বয়স তখন ৬-৭।তখনও প্রতিবছর নিয়ম করে দুইবার ঈদ আসে।রোজার ঈদে কাপড় আসে।তবে পুরা সেট নয় কারও সার্ট কারও পান্জাবী কারও বা শুধু জুতো। কোনভাবে ঈদটা কেটে যায়। কিন্তু কোরবানীর ঈদটা এই ভাঙ্গা বেড়ার পরিবারের জন্য আসে কষ্ট আর হাহাকারের প্রতীক হয়ে।
কাপড়চোপড়?
না ওটা কিছু নয়।এখনও গ্রামে কোরবানী ঈদে নতুন কাপড় কেনার ছল খুব একটা নাই তখন তো আরও কম।সমস্যাটা অন্যখানে।
ঈদের নামাজ পড়ে এসে দেখতাম চারপাশে সবাই গরু/ ছাগল কোরবানী দিচ্ছে। তখন আমরা বসে থাকতাম চুপচাপ।না আমার ছোট ভাই বসে থাকত না। দৌড়াত।পরে কান্নাকাটি করত।কিভাবে জানি সন্ধ্যায় কিছু মাংস আসত।সবাই বুঝত কিভাবে আসত শুধু ছোট পারতনা।অন্যরা খেত খেতে হবে বলে আর সে খেত উৎসাহ নিয়ে। আর আমি? না ভুল করেও না। আমার আত্মসম্মানবোধ ছোটবেলা থেকেই মাত্রার চেয়ে বেশী।
এই এখনও কেউ যদি আমাকে বলে, "চা খাবেন?" আমি সরাসরি না করে দেয়।
এক কোরবানীর দিন ভীষন ঝামেলা বাজল। ছোট খুব কান্নাকাটি করছে আমাদের কোরবানী দিতেই হবে।মাটিতে সমানে গড়াগড়ি চলছে ওর।
হঠাৎ বড় ভাই বলল, "ঠিক আছে আমরাও এবার কোরবানি দিব।"
আব্বা আম্মা ওর দিকে থাকাল অবাক হয়ে। আমি নিশ্চুপ অবস্থা বুঝার চেষ্টা করছি।
ভাইয়া বলল, "আমরা একটা মোরগ কোরবানি দিব।"
আমার এখনও মনে আছে কথাটা বলার সময় ওর গলা ভেঙ্গে যাচ্ছিল।ছোট খুবই খুশি।একটা কিছু তো কোরবানি হচ্ছে।কতক্ষন পর অবশ্য ওর আনন্দ মিলিয়ে যায়।
কে জানি ওকে বলেছিল, "দুর পাগল মোরগ আবার কোরবানি হয় নাকি।তোরা তো গরীব তোদের আবার কিসের কোরবানি?"
তবে সে সন্ধ্যায় আমি মাংস খেয়ে যে মজা পেয়েছিলাম তা ভুলিনি অনেকদিন। এখন প্রায় প্রতিদিন মোরগ জবাই হচ্ছে বাসায়। কয়েক পদের মশলা দিয়ে কতরকমের মোরগের রান্না।কিন্তু ১২ বছর আগের আলু দিয়ে মরিচ হলুদ দিয়ে রান্না করা মাংসের স্বাদ এখন কেন আমি পাই না?
এর পরের বছর ঈদের আগে থেকেই শুরু হল গন্ডগোল।ছোটর এক কথা গরু না হোক ছাগল কোরবানি করতেই হবে।
টাকা?
আমি কিচ্ছু জানি না।
ঈদের আগের রাত পর্যন্ত কিছুই কেনা হয়নি।হবে কিভাবে? বাবার ছোট একটা মুদী দোকান অবশ্য তখন ছিল। কিন্তু তার ইনকাম দিয়ে আর যাইহোক ছাগল কেনা যায় না।রাত ৮টার দিকে বাবা হাজির।হাতে দড়ি সাথে একটা পিচ্চি ছাগল।আমরা অবাক। মা ক্ষেপে আগুন।
কিভাবে আসল?
দোকানের টাকা থেকে।
তাহলে দোকানের মাল আসবে কিভাবে?
অনেক বকাঝকা খেল বাবা।
শেষে একটা কথাই বললেন, "কার জন্য এসব? কার আনন্দের জন্য আমরা কষ্ট করছি?"
সেই ঈদ ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের।এই এখন কোরবানির জন্য বড় বড় ষাড় কিনি মা গরু খেতে পারে না বলে সাথে ছাগলও। কত আয়োজন তবু সেই আনন্দ আর কেন খুজে পাইনা?
আমি এখন ঈদের আগে হাজার হাজার টাকার কাপড় কিনি। ননব্যান্ড কিছুই পড়ি না।
আমার ছোটটা বলে, "ভাই তোমার মাঝে লোকদেখানো স্বভাব আছে।"
আমি আস্তে আস্তে বলি, "আমি প্রতিশোধ নিচ্ছি!
"সে অবাক হয়।বলে, "কিসের প্রতিশোধ?"
আমি উত্তর দেয় না। আমার ঠোট কাপে।
প্রতিবছর কোরবানীর মাংসের গরীবদের ভাগটা আমার ছোটটা দেয়। সিরিয়াল লেখে, নাম ডাকে, তারপর সুন্দর করে দিয়ে দেয়। আমি একবারও ঐদিকটায় যায় না।গতবছর ওর বন্ধুরা আসলে সে আমাকে খাতা ধরিয়ে চলে যায়।আমি নাম ডাকতে যাই। হঠাৎ আমি ভয় পাই।কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে চলে যাই আমি।সামনের লোকগুলো দেখে আমার মনে হয় আমিও তো এদের কাতারে থাকতে পারতাম।এসবই ভাগ্যের ষড়যন্ত্র!তাই আজ আমি দাতার কাতারে।এ ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়!পারিনি আমি ওখানে আর দাড়াতে।কোনমতেই না।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১০ রাত ১০:৪২