অবিশ্বাষীরা বরাবরই এই দাবী উড়িয়ে দিয়ে আসছে এবং তাদের কথা হল এই কাপড়টি যীশুর কফিনের কাপড় নয় কাপড়ের ছবিটাও যীশুর নয়।বরং এটা মধ্যযুগের কোন চতুর শিল্পীর তৈরী চিত্রকর্ম।
কাপড়টির পজেটিভ ইমেজ।
কাপড়টির নেগেটিভ ইমেজ।(একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য এই কাপড়ের পজেটিভ ইমেজের চেয়ে নেগেটিভ ইমেজ অধিক পরিষ্কার ও স্পষ্ট।)
চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে এই কাপড়টি জনসাধারনের নিকট প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। তখন দুই মিলিয়নের ও বেশী ভিজিটর তুরিন গিয়েছিল কাপড়টি দেখার জন্য।এতেই বুঝা যায় বিশ্বাষীদের নিকট এর গুরুত্ব কতটুকু।
কাপড়ে প্রাপ্ত ছাপ থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরী করা কথিত যীশুর মুখচ্ছবি।
কেন এই বিশ্বাষ?-এই কাপড়টিতে একটি আঘাতপ্রাপ্ত দেহের ছাপ আছে যা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একজন ক্রশবিদ্ধ লোকের ছবি বলে মেনে নেওয়া হয়।ছবিটিতে যীশুর মৃত্যুকালীন প্রাপ্ত সকল আঘাতের ছাপ স্পষ্টতই রয়েছে। যীশুর মাথায় বসানো কাটার মুকুট এর ক্ষত এবং তা থেকে ঝড়া রক্তের ছাপ, তার হাতে পেরকবিদ্ধ ক্ষতচিহ্ন এবং তার দেহে নিক্ষেপ করা বলমের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষত ও রক্তধারা নমুনা লক্ষ্য করা যায়।
তাছাড়া এই কাপড়ে প্রাপ্ত ময়লা কণার সাথে মাইক্রোস্কপিক পরীক্ষায় জেরুজালেমের প্রাচীন সমাধিস্তম্ভের মাটির কণার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। তবে মূল রহস্যটা হল এই ছবির গঠন।বিশ্বাষীরা বরাবরই দাবী করে যীশুর পুনরুত্থান এর সময় তার দেহ থেকে নির্গত প্রভায় আলৌকিকভাবে কাপড়টিতে যীশুর দেহের ছাপ পড়েছে।এখন আপনি যদি মনে করেন এই কাপড়টি ভুয়া তবে আপনাকে প্রমাণ করতে হয় কিভাবে এই ছবিটি কাপড়ে আকা হয়েছে।বহুকাল ধারনা করা হত আইরন অক্সাইড এর মাধ্যমে এই ছবিটি আকা হয়েছে।কিন্তু অধিকতর পরীক্ষা নিরীক্ষায় তা ভুল ধারনা বলে প্রমাণিত হয়। সত্যি বলতে কি কাপড়টিতে যে রক্ত পাওয়া গেছে তা আসলেই মানুষের দেহের রক্ত।এছাড়াও নানা থিওরীর কথা আলোচিত হয়েছে ছবিটি আকার পিছনে যদিও মধ্যযুগীয় কোন টেকনোলজিই নিশ্চিতভাবে সমর্থন দেয় না ছবিটি আকাতে।ইদানিং বেশীরভাগ গবেষকই ধারনা করছেন ছবিটি রেডিয়েশন এর ফলে তৈরী। যা বিশ্বাষীদের বিশ্বাষের পালে হাওয়া দেয়। তাছাড়া অতিসম্প্রতি আবিষ্কার হওয়া একটি রিভার্স ফটোগ্রাফি ও কিছু 3-D ইমেজ গঠন বিশ্বাষীদের আরও সমর্থন দেয় কাপড়টিকে যীশুর কফিনের কাপড় মনে করাতে।
ধর্মীয় সংস্থাসমূহের ভূমিকা-রোমান ক্যাথলিক চার্চ বা ভ্যাটিকেন সিটি আজও আনুষ্টানিকভাবে কাপড়টি এবং যীশুর ছবিটির সত্যতা ঘোষনা দেয়নি। কিন্তু তারা এটি কোন জালিয়াতি কিনা তাও স্বীকার করে না।(পোপ দ্বাদশ পিয়াস এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম) যদিও ১৯৪০ সালে ক্যাথলিক চার্চ কৃর্তপক্ষ কাপড় থেকে প্রাপ্ত যীশুর মুখালম্বনে একটি মেডেল তৈরী করে।
আমার কাছে এদের ভূমিকা অনেকটা ধরি মাছ না ছুই পানি টাইপ মনে হচ্ছে।
শেষ হয়েও হল না শেষ- যেকোন প্রাচীন বস্তুর বয়স নির্ধারনে রেডিওকার্বন ডেটিং টেস্ট(c-14) হল সবচেয়ে বিশ্বাষযোগ্য পরীক্ষা।১৯৮৮ সালে এই কাপড়টির একটি নমুনাতে c-14টেস্ট করা হলে কাপড়টি ১২৬০-১৩৯০ খ্রিস্টাব্দর মাঝে তৈরী বলে জানা যায়। যা যীশুর মৃত্যুর আরও ১২০০ বছর পরের ঘটনা।কাপড়টি যে ভূয়া তা সবাই তখন মেনে নিলেও বিশ্বাষীরা দাবী করে বসে, যে নমুনাটি নেওয়া হয়েছিল তা মূল কাপড়ের অংশ নয়। এটি মধ্যযুগে কাপড়টিতে করা রিপেয়ারিং এর অংশ। সত্যি সত্যি কিন্তু ১৫৩২ সালে আগুনে হালকা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার পর কাপড়টি রিপেয়ার করা হয়েছিল।
তবে আমার কথা হল যদি এই টেস্ট ভুলই হয় তাহলে এখন আবার টেস্ট করতে দিচ্ছে না কেন চার্চ কৃর্তপক্ষ? তারা কোন সত্য গোপন করতে চাচ্ছে?
কেন কাপড়টি এবং ছবিটি ভূয়া?-
১-কাপড়টিন বুনন কৌশল পরীক্ষা করে টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন যীশুর মৃত্যুর সময় মানুষ এই ধরনের বুননের সাথে পরিচিত ছিল না। তার মৃত্যুর আরও কমপক্ষে ১ হাজার বছর পর মানুষ এই ধরনের বুনন শিখে।
২-বাইবেল এর বর্ননায় পাওয়া যায় যীশুর মৃত্যদেহ আচ্ছাদনে একাধিক কাপড় ব্যবহৃত হয়েছে। মাথা আলাদা কাপড়ে আচ্ছাদিত।(জন ২০:৫-৭)কিন্তু এই কাপড়টিতে যীশুর সমস্ত দেহ দেখানো হয়।এটা যে পুরা ভূয়া তা নিয়ে আর কি বলা লাগে?(প্রসঙ্গত লুক ও মার্ক এর বর্ননায় একটি কাপড়ের উল্লেখ্ আছে। কিন্তু লুক এর বর্ননায় পিতর তিন দিন পর যখন যীশুর মৃত্যদেহ দেখতে যায় তখন সে লাশ পায়নি সেখানে শব আচ্ছাদনকারী কাপড়ের টুকরোসমূহ পেয়েছিল। একটি কাপড় নয়। যার ফলে জন এর বর্ননাই বিশ্বাষযোগ্য হিসাবে ধরা হয়।)
৩-যীশুর ক্রশবিদ্ধকরন এর সময় প্রতক্ষ্যদর্শীদের বর্ননায় বলা আছে তার মৃত্যু বেলা তিনটার দিকে হয়। দেহটি সন্ধ্যা পর্যন্ত ঝুলানো থাকে। লাশ নামানো হয় সন্ধ্যার পর। এই দীর্ঘসময়ে ক্ষত এর মাধ্যমে দেহের রক্ত বের হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই কাপড়টিতে রয়েছে প্রচুর রক্তের ছাপ।ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা এত রক্তপাত মৃত্যদেহ থেকে হওয়ার কথা না।কাপড়টিতে রক্তের আধিক্য এবং রক্তের ছড়িয়ে পড়ার তীব্রতার লক্ষন দেখে তাদের ধারনা এটি কৃত্রিমভাবে করা হয়েছে।
৪-মেডিকেল বিশেষজ্ঞদের মতে মানুষের মৃত্যদেহ আধঘন্টা পর থেকে শক্ত হতে শুরু করে যা তিনঘন্টার মাঝে শক্ত হয়ে যায়।
যীশুর ক্রশবিদ্ধকরনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ছবি হল এটি।
এখানে লক্ষ্য করা যায় দুই হাত দুইদিকে বিস্তৃত।কিন্তু কাপড়ের উপর ফুটে উঠা যীশুর ছবিটি দেখুন।
এক হাত দ্বারা আরেক হাত ঢাকা।যীশুর লাশ দাফন মুত্যর কমপক্ষে ৪-৫ ঘন্টা পর হয়েছে।রিগোর মোর্টিস এর পর হাত এই ভঙ্গীতে রাখতে হলে কোন রিস্টব্যান্ড ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ এই কাপড়ের ছাপে নাই। যা দেখে অনেকেই ধারনা করেন এই ছবিটি জীবন্ত কোন মানুষকে মডেল করে বানানো হয়েছে।
৫-১৩৫৭ সালে প্রথম আনুষ্টানিকভাবে কাপড়টি প্রকাশ করা হলেও এটি সম্পর্কে ১৩৫৩ সাল থেকেই জানা যায়।১৩৫৬ সালে ফ্রান্সের বিশপ পোপকে এক চিটিতে লেখেন এই কাপড়টি একটি চিত্রকর্ম এবং যে শিল্পী এই ছবিটি একেছে তাকে তারা সনাক্ত করতে পেরেছেন।
৬-পনের শতকের শেষ বা ষোল শতকের প্রথমদিকে যারা এই কাপড়টি দেখেছেন তাদের বর্ণনায় কাপড়টিতে রক্তের ছাপ আরও উজ্জল ছিল বলে উল্লেখ আছে যা এখন অনেক অন্ধকারচ্ছন্ন। এই বর্ণনা ছবিটি মধ্যযুগীয় জালিয়াতি ধারনাকে আরও প্রতিষ্টিত করে।
৭- সবচেয়ে বড় কথা হল ইটালির অর্গানিক কেমেস্ট্রির অধ্যাপক লুইজি গার্লসচিলি সম্প্রতি মধ্যযুগীয় প্রযুক্তির মাধ্যমেই তুরিনের কাপড়ের ছবির ন্যায় একটি চিত্রকর্ম তৈরী করেছেন যা কাপড়টি এবং ছবিটির জালিয়াতিকে নিশ্চিত করে।
তথ্যসুত্র-
১-http://www.world-mysteries.com/sar_2.htm
২-http://www.creationtips.com/shroud.html
৩-http://en.wikipedia.org/wiki/Shroud_of_Turin
৪-http://www.factsplusfacts.com/shroud-of-turin-carbon-14.htm
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১১ রাত ১০:০৮