কালকের বৃষ্টিটা খুবই বিরক্তিকর ছিল। সকাল থেকে পড়ছে তো পড়ছেই... বাইরে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। তো, এরকম একটা দিনেই মতি তার বান্ধবীকে নিয়ে এলো আমাদের বাসায়। আমাদের বাসায় আবার সকাল থেকেই অনেক ভীর। অনেক মানে অনেক। দুপুরে বাধ্য হয়ে আমার এক মামা- ট্রাফিক সার্জন - তাকে ফোন করে ডাকতে হয়েছিল। মামা আর তার কিছু কলিগ প্রত্যেক রুমের দরজায়, করিডোরে, বাথরুমের সামনে বাঁশি-লাঠি-বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে- মানুষের যাওয়া আসা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এর আগে হাঁটাই যাচ্ছিল না বাসার ভেতর। এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আছে।
তো যাই হোক, এরকম অবস্থায় মতির বান্ধবীর জন্য বসার ব্যবস্থা করাটা টাফ। আমি ভদ্রতা করে বিছানা থেকে উঠে তাকে সেখানে বসতে বললাম।
"না না, আমি একেবারে ভিজে গেছি। বিছানায় বসব না। এর থেকে আমি টেবিলের উপর বসি" - মতির বান্ধবী বলল। মেয়েটার নাম বাল আজকে মনেই পড়তেছে না। ধরা যাক তার নাম "মবা" - মতির বান্ধবী। না, এর থেকে "মোবি" হোক। "মবা" কেমন "মগা" বা "হাবা" -এরকম শোনাচ্ছে। এর থেকে মোবি কিউট। এটা আবার একটা কিউট জাপানীজ রোবটেরও নাম।
যাই হোক.. আমি মোবিকে খেয়াল করলাম। সারা শরীর ভেজা। চুলগুলো মাথায়, কপালে লেপ্টে আছে। চোখে মুখে সর্বত্রই একটা জলজ জলজ ভাব। মনে হচ্ছে যেন মাত্র পানি থেকে উঠে আসা কোন প্রাণী সে। কিন্তু আমি যতদূর জানি- মোবি একটা মানুষ। সুতরাং ওর ডাঙাতেই থাকার কথা। কিন্তু ডাঙায় থাকা কারো শরীর, চেহারা এরকম হওয়ার কথা না। বংশে পানিবাসী কেউ তো অবশ্যই আছে। নইলে এমন হত না- আমি শিওর।
"আচ্ছা, তোমার আম্মু কি পানিতে থাকেন?" আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। সে কোন একটা কারনে অনেকক্ষণ ধরে হাসল। মেয়েটা আসলেই উইয়ার্ড। যার বংশে পানীবাসী প্রাণী থাকে সে তো কিছুটা উইয়ার্ড হবেই। এই কারনেই মনে হয় মানুষ বিয়ের আগে ফ্যামিলি ট্যামিলি দেখে।
শিট ম্যান। আমি এই জিনিসটা আজকে ফার্স্ট আবিষ্কার করলাম। এর আগে কখনো বুঝতাম না। বংশ ফংশ দেখাটা হাস্যকর, ইলজিক্যাল এবং বাজে লাগত। কিন্তু জিনিসটা আসলে র্যাশনাল। ওয়াও! “সাইন্টিফিক রেসিজম” - একটা টার্ম আছে। হিটলার যেটা ব্যবহার করেছিল...
"নাহ..." মোবি এতক্ষণ পর উত্তর দিল। আচ্ছা, মোবির মা তাহলে পানিতে থাকে না। আচ্ছা, ওয়েট, এটাই তো আসলে হওয়ার কথা ছিল। একটা মানুষের ফ্যামিলিতে নরমালি অন্য কোন প্রানী থাকে না। আর তাই আমাদের কারো আম্মুই পানিতে থাকে না। ওয়াও! এটাও আমি ফার্স্ট আবিষ্কার করলাম আজকে। আমাদের কারো আম্মু পানিতে থাকে না। আচ্ছা, ডাঙাবাসী কারোও আম্মু কি পানিতে থাকে?
পৃথিবীতে জীবনের সূচনা হয়েছে পানিতে। সেখান থেকে ধাপে ধাপে জীবন ডাঙায় এসেছে। সুতরাং এই লম্বা যাত্রার কোন না কোন পর্যায়ে কিছু ডাঙাবাসী প্রাণী ছিলই যাদের "আম্মু" পানিতে থাকে/ ছিল। এখানে "আম্মু" শব্দটা আক্ষরিক অর্থে ব্যবহার করলাম। আমি যেই প্রাণীর জননকোষ থেকে জন্মেছি, সে-ই আমার আম্মু। এখানে আব্বুও আম্মু। সেইম জিনিস। দুইটাই "আম্মু"। এই "আম্মু"র কোন লিঙ্গ নাই। কোন প্রজাতির বাউন্ডারি নাই। আর তাই বিবর্তনের ধারায় এমন অনেক প্রাণীই পৃথিবীতে এসেছে, যাদের আম্মু ছিল অন্য কোন প্রাণী। ওদের মা-ছেলের সম্পর্কটা কেমন ছিল? ভাবতে অবাক লাগে না?
একটা হাস্যকর ডিবেট আছে- "ডিম আগে না মুরগী আগে"। "ডিম" বলতে যদি "যে ডিমের ভেতর মুরগী থাকে" ধরে নেই, তাহলে অবশ্যই ডিম আগে এসেছে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার প্রক্রিয়াটার মাঝে তেমন কোন ইউনিফর্ম মিউটেশনের চান্স নেই, যেটা আছে ডিম তৈরীর সময়। তাই অন্য কোন প্রাণীর পাড়া ডিমের ভেতর "মুরগী"র জন্ম হয়েছে সৃষ্টির কোন একটা পর্যায়ে। কিন্তু সেই প্রাণী কিন্তু পানিতে থাকত না।
চিন্তা যখন এই পর্যায়ে, তখন মতি বলে উঠল- "ব্যাঙ। ব্যাঙের আম্মু পানিতে থাকে" "এভাবে ভাবলে তো সব মাছের আম্মুও পানিতে থাকে। কিন্তু আমি আসলে চাচ্ছি এমন একটা মা-ছেলের পরিবার যেখানে মা পানিতে থাকে, কিন্তু ছেলে থাকে ডাঙায়।"
এরকম অবস্থায় হুট করে একটা জিনিস মাথায় আসল- যা আমার সবকিছুই ওলোটপালট করে দিল মুহুর্তের মধ্যেই-
এরকম সম্পর্ক সম্ভব। কিন্তু পরিবার না।
ধরলাম, আমার আম্মু পানিতে থাকে। সে বীচের কাছে এসে একটা ডিম পাড়ল। সেই ডিম থেকে আমি হলাম। সামহাউ আমার জিনোমে এমন কিছু চেঞ্জ আসলো, যার কারনে আমি পানিতে যেতে পারি না। ডাঙায় থাকা লাগে। মানে আমি আর আম্মু দুটো আলাদা প্রজাতি তো বটেই, প্রাইমারি আবাসস্থলও আলাদা। আম্মুর সাথে আমার সম্পর্কটা কেমন হবে তখন? আম্মু আমাকে চিনবে, ভালবাসবে, কিন্তু কাছে আসতে পারবে না। হয়ত সৈকতের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে সে আমার দিকে তাকিয়ে সাঁতার কাটবে আর কাঁদবে। আমি ক্ষুধার জ্বালায় হয়ত মায়ের কাছে ছুটে যেতে চাইবো, কিন্তু পারবো না। সে থাকে পানিতে, আর আমি থাকি ডাঙায়।
কতটা কষ্টের, কতটা কঠিন জীবন হবে এরকম একটা প্রাণীর। এরকম কন্ডিশনে মায়ের সাথে বাচ্চার সম্পর্ক টিকে থাকার চান্সও প্রায় জিরো। ধরলাম তবুও টিকে থাকল। বাচ্চা বড় হল, মা বুড়ো হল, তারা তো তখন জানে যে এই সম্পর্কটা আর কখনো পৃথিবীতে তৈরী হবে না। এই বাচ্চার বাচ্চারা হবে ডাঙাবাসী। তাদের মা-ও হবে ডাঙ্গার। আবার এই মায়েরও আর কোন বাচ্চার ডাঙাবাসী হওয়ারও তেমন কোন চান্স নেই। মিউটেশনের মারপ্যাঁচে তৈরী হওয়া অসহ্য ইউনিক তাদের সম্পর্কটা। তারা জানবে এটা পৃথিবীতে একবারই হয়েছে- শুধু তাদের মাধ্যমেই। কিন্তু এই ইউনিকনেসে তারা কোন আনন্দ পাবে না- শুধু বিষাদ পাবে। জমাট বাঁধা কালচে নীল রঙের বিষাদ।
ঠান্ডা আর করুণ।
জলজ মাতা যেদিন মারা যাবে, সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়বে তার ডাঙাবাসী সন্তান। কিন্তু কাছে যেতে পারবে না। একসময় লাশ স্রোতে ভেসে যাবে তার অথর্ব চোখের সামনে...
সেদিন আকাশজুড়ে ফেরেশতারা জমা হবে সে দৃশ্য দেখার জন্য। আর কোনদিন কোন জলজ প্রাণীর মৃত্যুতে এভাবে করে কোন ডাঙাবাসী প্রাণী কাঁদবে না...
.
.
আমার সবসময় মনে হত এই প্রকৃতিতে সবথেকে বেশী নিষ্ঠুর হল প্রকৃতি নিজেই। আজকে প্রথম আমার মনে হল এটা সত্যি না। প্রকৃতিতে এভাবে এত লম্বা লাফে প্রজাতি চেঞ্জ হয় না। আস্তে আস্তে হয়- কচ্ছপের মত। "উভচারী প্রাণী" বলে প্রাণীদের একটা জনরা আছে এই দুনিয়ায়। যারা জল আর স্থলের মাঝে ব্রীজ হিসেবে কাজ করে। যারা তাদের জলজ মায়ের সান্নিধে ছয় মাস থেকে ডাঙায় উঠে আসে- বাকি ছয় মাস বাচ্চার সাথে কাটানোর জন্য..
.
মতির বান্ধবীর আম্মু কি তাহলে উভচর কেউ? কচ্ছপ বা ব্যাঙ টাইপ কিছু? আচ্ছা, মতি তাহলে প্র্যাক্টিকাল সেন্সে ঠিকই বলেছিল তখন- ব্যাঙ। মোবির আম্মু আসলে একটা ব্যাঙ। নাউ এভরিথিং মেকস সেন্স।
.
যাক, মতির বান্ধবী। মতি তো ভাল জানবেই..
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৪০