মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টার মত টানা একটা রুমে কাটানোর পর সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হলাম। সাগুফতায় একটু চা-বিড়ি খাবো।
গত পরশুদিনের ঘটনা।
জীবনের প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা চেপে রেখে এক চুমুক করে চা খাচ্ছি, আর এক ঢোক করে ধোঁয়া ছাড়ছি। হঠাৎ পাশ থেকে কে জানি বলল-
“ভাই একটু আগুনটা দিবেন?”
“ম্যাচ নাই- এইটা দিয়েই ধরান”- বলে বিড়িটা নিয়ে পাশে ঘুরতেই দেখি চিকন, এক্কেবারে সাদা লোমে ঢাকা একটা হাত- চারটার মত আঙ্গুল আর বড় বড় নখ- আর যাই হোক- এ হাত মানুষের হতে পারে না। আমি চমকে উঠলাম। উপরে তাকিয়ে দেখি হাতের মালিক একজন কুকুর।
প্রথমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম- যাই হোক অ্যাটলিস্ট অ্যাবনরমাল কিছু না। এরকম হাত কুকুরের হলে ব্যাপারটা ঠিক আছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল কুকুরের তো এভাবে বিড়ি খাওয়ার কথা না। ইনফ্যাক্ট সে কথাই বা কিভাবে বলছে? যাই হোক, ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর থেকে দিনকে দিন বুঝতে পারছি যে পৃথিবীকে আগে যেমনটা ভাবতাম- এটা আসলে মোটেও সেরকম না- কোন কিছুই আসলে আমি আগে জানতাম না। প্রতিদিন নতুন নতুন অবাক করা কত কি দেখছি এখন- এটাও হয়ত সেরকমই...
আমি তাকে বিড়ি দিলাম। সে দুই বিড়িতে জোড় করে চুমোচুমি করিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। আমি আমার বিড়ি ফেরত নিলাম।
“থ্যাঙ্কস ম্যান”
“ইটস ওকে ব্রো”
কুকুরটা আমার পাশে বসে হাত বাড়ালো-
“বাই দ্যা ওয়ে, আমি জনি”
“ওহ, আমি সিয়াম।”
“একা একা এরকম নিরস মুখে বিড়ি খাচ্ছ? মন খারাপ নাকি?”
আমি বিড়িতে বিশাল একটা টান দিয়ে একটা সিনেম্যাটিক ভঙ্গিতে উপরের দিতে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়াতে ছাড়তে বললাম-
“হুহ... আর মন... এক সপ্তাহ ধরে কুত্তার মত মাইনষের দ্বারে দ্বারে কাজ খুঁজতেছি... কোন লাভ নাই...”
বেশ কিছুক্ষণ কোন কথা নাই। আমি একটু থতমত খেয়ে সিনেম্যাটিক ভঙ্গি ঝেড়ে ফেলে জনির দিকে তাকালাম- দেখি সে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন থেকে কে জানি বলে উঠলো-
“দ্যা-ট ওয়াজ ফাকিং রেসিস্ট...”
আমি পেছনে ঘুরে দেখি আরেকটা কুকুর- বেঞ্চিতে বসে একইরকম সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি হুট করে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম।
“ওহ, শিট... সরি ম্যান- আমি আসলে ঠিক ওভাবে মীন করিনি। আই মীন- জাস্ট ফ্রেজ হিসেবে আরকি...”
লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল তখন আমার। শিট... এভাবে কেউ বলে!!
“মানে ভাই, আমি তো আগে কখনো এভাবে অন্যদের সাথে কথা বলিনি মানুষ ছাড়া- ”
আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। নতুন কুকুর আমার কথা কেড়ে নিল-
“মানে তোমরা নিজেরা নিজেরা থাকলে এভাবে আমাদেরকে নিয়ে ফান কর? ছিঃ... লজ্জা হওয়া উচিৎ তোমার। ”
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। সেম এই টাইপের একটা কথা মনে হয় কোন একজন মেয়েও আমাকে বলেছিল। মানুষ মেয়ে। তখনও মনে হয় কিছু বলতে পারিনি আমি। আমি আস্তে করে মাথাটা নিচু করে ফেললাম-
“আমি খুবই লজ্জিত...”
“বাদ দাও- ইটস ওকে। এ, রকি হুদাই ত্যানা প্যাঁচাইস না। বাদ দে” জনি বলল।
বুঝলাম অপরজনের নাম রকি।
“ওকে... প্যাঁড়া নাই...” রকি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
এরপর আস্তে আস্তে আমাদের গল্প শুরু হল। রকি জনির ল্যাংটা কালের বন্ধু। শুরুতে রকিকে অস্বস্থিকর লাগলেও পরে বুঝলাম সে জোস... খুবই জোস। বামপন্থী রাজনীতি করে, আবার র্যাপারও। প্রায় সব বিষয়েই প্রচুর জ্ঞান- কিন্তু আবার কথা বার্তায় খুবই সার্কাস্টিক। সামনের মাসে নিউজিল্যান্ড যাচ্ছে- অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে। আর জনি মোটামুটি আমাদের মতই- নরমাল। তার ইচ্ছা দেশে থাকার। এখানে অপুর্চুনিটি কম। তবে সে র্যাবের ডগ স্কোয়াডে একটা ভাল জব ম্যানেজ করে ফেলেছে। তো সে এখানেই হ্যাপী। আমার বর্তমান দূরাবস্থার কথা শুনে সে বললো-
“সিয়াম, দেশে আর কিছুদিন দেখ। কিন্তু বেশী টাইম ওয়েস্ট কোরো না- বাইরে চলে যাও...”
“হুম... আমিও ভাবছি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে একটু পড়ালেখা করবো”
“ওয়াও! ভাল তো- ট্রাই কর এখন থেকেই- ফান্ড পাবা। মানুষের প্রচুর ফান্ড”
রকি হুট করে আবার জয়েন করলো-
“ওহ, এ.আই. এর কথা শুনে একটা জিনিস মনে হল- সেদিন তোমাদের বুয়েটেরই কার জানি একটা স্ট্যাটাস পড়লাম ফেসবুকে। বোকাচোদার ধারনা এখনকার মেশিন লার্নিং এর যে ট্রেন্ড, সেটা নাকি মানুষের মস্তিষ্ককে আসলেই মিমিক করে। হাহাহা...”
দুইদিন আগে ঠিক এই টাইপ একটা স্ট্যাটাস আমিও দিসি। একটু অস্বস্থি নিয়ে নড়েচড়ে বসলাম-
“তা তোমার কি মনে হয়? করে না?”
“নিউরাল নেটের প্রবলেম সল্ভের সময় কম্পিউটার অজস্র বিশাল বিশাল ম্যাথম্যাটিক্যাল অপারেশন চালায়। মানুষ কম্পিউটারের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি ওই কাজ করতে পারে। কিন্তু দুইটা সংখ্যা গুন করতে তাদের খবর হয়ে যায়। কম্পিউটারের ডিরেক্ট অংক করা আর এইসব বালছাল করা – দুইটাতেই যে টাইম লাগে, তা তাদের প্রোসেসিং পাওয়ারের সাথে ম্যাচ করে। কারন বিল্ডিং ব্লক সেইম- অ্যারিথমেটিক। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে দুইটা ক্ষমতা এক জায়গায় ম্যাচ করে না”
“কারন মানুষের ব্রেন হাইলি প্যারালাল- সিকুয়েনশিয়াল ম্যাথে প্যারালাল কোর থেকে কোন লাভ নাই, নিউরাল নেটে আছে। কম্পিউটারের সিঙ্গেল কোরের ক্ষমতা মানুষের ব্রেনের সিঙ্গেল কোরের থেকে হয়ত অনেক বেশী। কিন্তু এরকম হিউজ প্যারালাল সেটাপ আর কারো নেই- আর এত অল্প জায়গার মধ্যে- সিলিকন বেজড টেকনোলজিতে সম্ভব না... ”
“সিরিয়াসলি সিয়াম? ইউ বিলিভ দ্যাট? এতটা অসামঞ্জস্যতা? আর যে অংক পারে না- সেও ছবি দেখে জিনিস চেনে- এটা অবশ্যই আলাদা দুইটা প্রোসেস।”
“কারন আমাদের এই “ছবি চেনার” হিসাবনিকাশ সব সাবকনশাসলি হয়- কম্পিউটারে যেটাকে “বিল্ট-ইন লাইব্রেরি” বলে।”
“ওয়াও! লাইব্রেরির কোড তাইলে রান করে কে? এই কনসেপ্ট নিয়ে এ.আই. পড়তে যাবা? বিসিএস দাও এর থেকে। হাহাহা...”
আমার কান পর্যন্ত লাল হয়ে গেল রাগে। দাঁত কিড়মিড় করে বললাম-
“আ-মা-র লা-ই-ব্রেরি রান করে সাবকনশাস মাইন্ড- যে-টা-র উপর আমার কোন কন্ট্রোল নাই। সাবকনশাস মাইন্ড অংক ভাল পারে- কনশাস মাইন্ড পারে না। আর তাই কনশাসলি অংক করতে গেলে ঝামেলা হয়। অ্যাস সিম্পল অ্যাস দ্যাট।”
“ওহ... ফাক ইউ গাইস। লীভ ইট। লুক দ্যাট অ্যাস... ওহ মাই মাই...”
জনির কথা শুনে আমি রাস্তার দিকে তাকালাম- একটা নেড়ি কুত্তা হেঁটে যাচ্ছে...
বাল...
যাই হোক। আমি হতাশ হয়ে বিড়িতে মনোযোগ দিলাম। দুই পাশে জনি আর রকি উহ আহ করে চলেছে... আমি কি করবো? ওদের সাথে জয়েন করবো? নাকি ওই কথাটাই ওদেরকে শুনিয়ে দিব যেটা কোন একটা মেয়ে জানি আমাকে শুনিয়েছিল অনেক বছর আগে? আমি কনফিউসড।
“হেই সিয়াম, চল পিছে পিছে হাঁটি- দোলন টা দেখনা শুধু- গ্রাফে প্লট করলে নিশ্চিত একটা বাটারফ্লাই হবে”
আমি এক মুহুর্তে বুঝে গেলাম মানবসমাজে লুইচ্চা ছেলেদেরকে কেন কুকুরের সাথে তুলনা করা হয়...
“আমি এখন কুত্তার পাছা দেখার জন্য এখান থেকে উঠে যাবো? সিরিয়াসলি?”
আমি মোটামুটি চিৎকার করলাম এবং বুঝলাম- ভুল করেছি...
“হো-য়া-ট ডু ই-উ মীন বাই কুত্তার পাছা?”
জনি আর রকি একসাথে আবার সেই সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে...
আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম- “সরি ব্রো। ওই দেখ- চার ছক্কা হই হই...”
হ্যাহ...হ্যাহ...হ্যাহ... কই...কই...কই... ? লিটারেলি লালা পড়তেছে দুইটার মুখ দিয়ে... শালা বাইঞ্চোদ... হাহাহা... আমার হাসিই পেল ওদের কান্ড দেখে...
আমরা হাঁটছি। আর দেখছি। হুম- ইউ রেড রাইট- “আমরা” দেখছি। সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে- কথাটা সত্যি। আমার মত দুর্বল চিত্তের মানুষের জন্য আরো বেশী সত্যি। আমার এখনো অবাক লাগে ভাবতে- কিভাবে করে জানি ওই দোলনের ব্যাপারটা আমারও ভাল লেগে গেল সেদিন- কমবয়সি একটা মেয়ে কুকুর- কি সুন্দর জগিং করছে। কুকুরের জগিং এ একটা অসাধারন ছন্দ থাকে, যা মানুষের জগিং এ থাকে না। সেই ছন্দে আটটা নিপল- একবার ডানদিকে ছুটে যায়- একবার বামদিকে ছুটে যায়- তারপর আবার ডানদিকে ছুটে যায়- তারপর আবার বামদিকে ছুটে যায়... আহা... অসাধারণ একটা দৃশ্য...
[হুম। আনলাইক রকি অ্যান্ড জনি- আই অ্যাম মোর অফ এ বুব গাই...]
এসব দেখতে দেখতে কখন যে জনি আর রকিকে পাশ কাটিয়ে সামনে চলে গেছি আমি জানি না। হুট করে সামনের মেয়ে কুকুরটা থামলো। থেমেই পেছন দিকে ঘুরলো সে। আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। সে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে সোজা হেঁটে আসতে লাগলো। রাস্তার এই জায়গাটা বেশ নির্জন। অন্যদিকে মেয়ের মুখে মুচকি একটা হাসি... তবে কি... তবে কি... আমার বুক ধক ধক করতে থাকলো উত্তেজনায়। মানিব্যাগে কনডম থাকার কথা। আচ্ছা, সাথে তো রকি জনিও আছে- তাহলে কি......
আমি পেছন দিকে ঘুরতে যাব ঠক তখনই পিঠে চোখা কি জানি ঠেকলো।
“নাহ সিয়াম। আজকে কোন থ্রীসাম ম্রিসাম হবে না... টাকা পয়সা যা আছে বের কর।”
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি জাস্ট তব্দা খেয়ে গেলাম। মেয়ে কুকুরটা এসে আমাকে সামনে থেকে আড়াল করলো। আর পেছনের দুই পাশ থেকে জনি আর রকি।
“মানে... এই সবকিছু জাস্ট এইটার জন্য?” আমি তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
“রোজা রমজানে কেউ খাওয়ায় না সিয়াম। রাস্তায় তেমন ভাল কিছু কুড়ায়ও পাই না। সব কিনে খাওয়া লাগে... কিচ্ছু করার নাই আমাদের..”
“স্বামী বিদ্যাশ। হাহাহাহাহা” মেয়েটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে শুরু করলো। তার সাথে যোগ দিলো বাকি দুজনও। আমি ম্যানিব্যাগ থেকে সব টাকা বের করে মেয়েটার হাতে দিলাম। রকি আমার হাত থেকে পুরো ব্যাগটাই ছিনিয়ে নিল-
“আরে- পুরাটাই দাও না... ভিতরে দেখি দুইটা কনডমও আছে। বাহ... থ্রিসাম তোমার হবে না- কিন্তু তোমার কল্যাণে বাকিদের কিন্তু ঠিকই হবে...”
“আমরা দুইটা কুত্তা- আর সাথে একটা বিচ- পারফেক্ট কম্বো। এক্সট্রাটা সিয়াম তুমিই ছিলা। মেনে নাও...” এখন জনিও প্রচন্ড সার্কাস্টিক। তারা আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই একে অপরকে চুমু খেতে শুরু করলো- আমাকে দেখিয়ে দেখিয়েই। মেয়েটা আস্তে করে একসময় হাঁটু গেঁড়ে বসে গেল... আমি আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাথা নিচু করে ঘুরে বাসার দিকে হাঁটা দিলাম।
আমার শুণ্য আকাশে সেদিন ছিল একরাশ চিকমিকে তারা, শুণ্য পকেটে নিজের শুণ্য দুটো হাত, আর শুণ্য হৃদয় নিঙরে থেকে থেকে বের হচ্ছিল টুকরো টুকরো ভারী কিছু নিঃশ্বাস। আর এর সবকিছুর ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছিল ত্রিমাত্রিক প্রেমের বহুমাত্রিক এক মন খারাপ করা গান...
আহহহ... উহহহম্মম.. আহহহহ...
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৭ দুপুর ২:৫০