বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬ টার জ্যাম... ৬টার মধ্যেই আমার ধানমন্ডিতে থাকার কথা। আর আমি এখনও মিরপুর ১০ এর জ্যামে আটকা।
বিরক্তি ভুলতে কানে হেডফোন ঢোকালাম।
“অবাক ভালবাসা”...
সেই ভয়ংকর সোলোটা শুরু হল... গিটার বাজছে- আর আমার কানে গেঁথে যাচ্ছে একের পর এক শব্দের বর্শা...
আমার মাথার সবগুলো তার একটা একটা করে ছিঁড়তে শুরু করলো... নাহ... এ কোনো যন্ত্রণা নয়- এ হল এক মুক্তি... মাথার ভেতরে জীবন নামক এক সমস্যার ২৪ বছর ধরে তিলে তিলে তৈরী করা জটা পাকানো প্রত্যেকটা চিন্তার থ্রেড আজকে একে একে ছিঁড়ে যেতে শুরু করল... আমি মুক্ত হচ্ছি- আমি আস্তে আস্তে মুক্ত হচ্ছি কালো মগজটার ভেতরে বাসা বাঁধা প্রত্যেকটা যন্ত্রণা থেকে... আমি আনন্দে চোখ বুঁদলাম...
একসময় সমুদ্র ফুঁসে উঠলো গানের ভেতরে... আর শব্দের ওই তীক্ষ্ণ ফলাগুলো আমার মস্তিষ্ককে গলাতে শুরু করলো বিন্দু বিন্দু করে... গলে পরা ওই মগজ জমা হতে থাকলো আমার বুকের নিচের দিকটাতে- ফোঁটায় ফোঁটায় তারা সৃষ্টি করলো বিশাল এক সমুদ্র...
সব আলো নিভে যাক- আঁধারে
শুধু জেগে থাক ঐ দূরের তারা রা,
সব শব্দ থেমে যাক- নিস্তব্ধতায়,
শুধু জেগে থাক এই সাগর- আমার পাশে
আহা হা হা আহা হা……………
আমি সব আলো নেভালাম। আর সমুদ্র ছাপিয়ে গেল আমার বুকের ওই ছোট্টো কুঠুরীটাকে... উত্তাল ঢেউ এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল আমার সমস্ত শরীরকে...
আমি একটা সাগর... হ্যাঁ, সত্যিই তাই... আমি আবছাভাবে চোখ মেললাম- শান্ত ঢেউ বয়ে চলছে আমার হাতের উপর দিয়ে, ঢেউ ভেঙ্গে চলছে আমার পিঠ, পেট আর গালের তল বেয়ে... ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমার নখের গোড়ায় এসে... আমি বন্ধ চোখে হারিয়ে গেলাম আমার নতুন ওই সত্ত্বাটার ভেতরে...
আলো আধারীর এক অদ্ভুত মায়া আমাকে ঘিরে রেখেছে আজ রাতে- পূর্ণিমার চাঁদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে আমি উদ্বেলিত হয়েছি তাকে পাবার আশায়- গত হাজার বছরের মত আজকেও...
একটু পর গানের সুরে সুরে আমার সমুদ্র শরীরে জেগে উঠলো একটা শান্ত মায়াবী দ্বীপ...
আমি এই দ্বীপকে চিনি- এর নাম সেন্ট মার্টিন...
শহুরে জীবনের ক্লান্ত দিনগুলোর শেষে প্রতিরাতে শুণ্য বিছানায় হাতড়ে বেড়ানো ওই জাদুময় দ্বীপটা আজ জেগে উঠেছে আমার নিজেরই দেহের ভেতরে- বুকের একটু বামপাশে... কি অদ্ভুত না? আজ আমি এই সৌন্দর্যের অংশ নই- আজ এই সীমাহীন সৌন্দর্যই আমার ছোট্টো একটা অংশ...
একসময় আমার বুকের ওই দ্বীপটাতে একটা নারিকেল গাছ জন্মালো। তার হাত ধরে মুহুর্তে শত শত নারিকেল গাছ ভরিয়ে তুললো আমার বিশাল বেলাভূলিটাকে... আমার খুব নিজের ভেতরে মানুষ হয়ে হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছে করলো কেন জানি... প্রথম জন্ম নেয়া ওই নারিকেল গাছটার নিছে টুপ করে জন্ম হল আমার আরেকটা স্বত্বার...
শুভ্র বালির সৈকতে-
এলোমেলো বাতাসে- গীটার হাতে
নিস্তব্ধতা চৌচির, উম্মাদ ঝংকারে কাঁদি
অবাক সুখের কান্না- যেন চুনি হীরা পান্না
সাগরের বুকে- আল্পনা এঁকে দিয়ে যায়-
অবাক ভালোবাসায়…….
অবাক ভালোবাসায়……
আমার আশপাশে আর কোন মানুষ নেই... আমি একা একা পায়ে চাঁদের আলোতে হেঁটে বেড়াচ্ছি সেই চির আরধ্য স্বর্গটাতে... খোলা পায়ে ঐ বালুর পাড় ঘেঁষে আমি তন্ময় হয়ে দেখছি ওই আমাকেই- আমি একটু পরপর এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছি আমার ওই নগ্ন পা’দুটিকে... আমি ঠান্ডা বাতা হয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছি আমার আরেকটা ছোট্টো শরীরকে, বিনি কেটে দিচ্ছি নিজেরই চুলের গোড়ায়...
আজ আমাকে আর শূণ্যতা গ্রাস করছে না- প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার ওই আজন্ম ব্যার্থ স্বপ্নে আজ আর আমার মন আর আঁধারে ডুবে যাচ্ছে না। আজ আমি হাঁটছি- আমার নিজের ভেতরে- আমি নোনা পানি হয়ে দেখছি আমার নিজের পথচলাকে, আমি ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছি আমার নিজের বেলাভূমিতে, আমার মায়াবী আলো উদ্ভাসিত করে রেখেছে আমার নিজের সারা শরীরকে...
ওহ... আমি আমার জীবনে এতটা পরিপুর্ণতা কখনো অনুভব করিনি... আমি আজ নিখাঁদ, আর কোন অতৃপ্তি নেই আমার মনে, নেই কোন কালো চিন্তা... আমি আজ মিলে মিশে একাকার হয়ে আছি এই পুরো সৃষ্টিলীলার মাঝে, আমি আজ সবকিছু... সবকিছুই আজ আমি...
.
.
অবাক ভালবাসাঃ https://youtu.be/tijeIi3CFpA
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭