কয়েকদিন যাবত নির্দয়ভাবে রোহিঙ্গাদের পায়ে ঠেলার পর শিশুদের হঠাৎ মর্জি পরিবর্তনের ন্যায় এখন আচানক সবাই যেন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নরম হয়ে গেছে। রোহিঙ্গাদের ফিলিপাইন কতৃক আশ্রয় দেয়ার ঘোষণার পর এতোদিন তাদের পায়ে ঠেলা মালয়শিয়া এবং ইন্দোনেশিয়াও তাদের আশ্রয় দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তুর্কী প্রজাতন্ত্র সাগরে ভাসমান ছিন্নমূল রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে জাহাজ পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে। আর এদের সকলকে পেছনে ফেলে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জামেহ প্রস্তাব দিয়েছেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের গাম্বিয়ায় স্হায়ী প্রত্যাবাসনের।
এসব মাছের মায়ের অশ্রু বিসর্জনকে আমার একটা সুদূরপ্রসারী ও সংঘবদ্ধভাবে পাতা ফাঁদ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছেনা। রোহিঙ্গাদের আরাকান থেকে সরানো মানে সে অঞ্চল থেকে মুসলিম জনবসতি উৎখাতের প্রচেষ্টা সফল হয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে আরাকান হবে দ্বিতীয় আল উন্দুলুস বা স্পেন। ফাঁদটা ছিলো এমন যে, এতোদিন রোহিঙ্গাদের সাগরে ফেলে রেখে নির্মমভাবে একধরণের চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে তাদের উপর, যারা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায়। এই চাপটা সমন্বিতভাবে বৈশ্বিক মুসলিম আবেগের উপরও আরোপ করা হয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে এখন অনেকেই তাদের ন্যূনতম প্রাণ রক্ষার স্বার্থে হলেও তাদের অন্যত্র আশ্রয়ের প্রস্তাবে রাজী হবে।
কিন্তু খবরদার! এমনটা হলে তা হবে সীমাহীন ভুল। শত শত বছর ধরে যে ভূখণ্ডকে মুসলিমরা আবাদ করেছে, সে ভুখণ্ড থেকে তাদের প্রত্যাবাসন করার কোন অধিকার কারো নেই। আর বাংলার প্রেক্ষিতেও যদি ব্যাপারটা দেখি, তবে বাংলা এমনিতেই তিনদিকে অমুসলিম অধ্যুষিত একটি মুসলিম ছিটমহলের মতো, যার পূর্ব ও পশ্চিমে প্রায় হাজার কিলোমিটারের মধ্যে কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র নেই। ফলে নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে হলেও বাংলাদেশকে অত্র অঞ্চলে মুসলিম জনসংখ্যার ভারসাম্যে অন্তত স্হিতাবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে। কারণ এটা আমাদের ধর্মীয় পরিচিতিই, যা আমাদের ১৯৪৭ সালে একটি আলাদা মানচিত্র, এবং তার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রাপ্তির পেছনে মুখ্য অণুঘটকের কাজ করেছে। আর এই প্রাপ্তি ছাড়া আজ আমাদের যা কিছু অর্জন, তা কখনোই আসতো না। আমাদের কাছে স্বীয় ধর্মীয় পরিচিতি ছাড়া আর কোন ট্রাম্প কার্ড নেই আশেপাশের ভূখণ্ডসমূহ থেকে নিজেদের পৃথক রাজনৈতিক সত্বা নিশ্চিত রাখার।
ফলে যদি প্রাণ বাঁচানোর নামে আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ আরো একা হয়ে যাবে। ইতিহাসের সাথে এমন বেঈমানির পরবর্তী সাজা নিপতিত হবে আমাদেরই উপর।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের চূড়ান্ত ব্যবস্হা হিসেবে সামরিক পন্হা অবলম্বনই আমার কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। দারিদ্র আর পাশবিকতার কষাঘাতে জর্জরিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে নিজস্ব তেমন কোন শক্তিশালী প্রেশার গ্রুপ এখনো গড়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় যেসব রোহিঙ্গা আরাকানের বাইরে গেছে, তাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসনের পাশাপাশি তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। যাতে তারা ফলপ্রসূভাবে নিজ ভূমিকে শত্রুমুক্ত করার ব্রতে আত্মনিয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি আরাকানে বিদ্যমান রোহিঙ্গাদের আর একজনকেও যেন আর বের হতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে বার্মাকে আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র চাপে রাখতে হবে। আরাকানে সশস্ত্র রোহিঙ্গা অভ্যুত্থানে ইন্ধন যোগানোর পাশাপাশি চতুর্দিক থেকে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক পন্হায় দেশটিকে তীব্র চাপ প্রয়োগের সিলসিলা জারী রাখতে হবে।
রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটাতে হবে, যাতে তারা নিজেদের স্বাধীনতার রূপরেখা প্রণয়ন ও নিজ জনগণের বৈধ রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে যাবতীয় দরকষাকষিমূলক কাজে সামনে থাকতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন একটি অস্হায়ী প্রবাসী আরাকান সরকার গঠন। রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা অর্জনের এসব তৎপরতার পেছনে সরবে ও নীরবে ভূমিকা রাখতে হবে বাংলাদেশকে। এসব ছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার কোন বাস্তবানুগ সমাধান যেমন হবে না, তেমনি অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় থাকা অমুসলিম জনগোষ্ঠী দ্বারা ঘিরে থাকা মুসলিম ছিটমহলগুলোর বিলুপ্তি ঘটবে। আজ আরাকানে যা ঘটছে, কাল একই ঘটনা শ্যামদেশের তিন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নারাথিওয়াত, পাত্তানি ও ইয়ালা, এবং ফিলিপাইনের মোরো মুসলিম অধ্যুষিত মিন্দানাও অঞ্চলেও ঘটবে...!