আদি বাংলার ইতিহাস
(প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪৩
সুন্দরবন বাদে শাল এবং চিরসবুজ বনে উড়ন্ত কাঠবিড়ালির কমপক্ষে দুটি প্রজাতি বাস করত। এরা হচ্ছে লার্জ ব্রাউন এবং হজসন্স ফ্লাইং স্কুইরেল বা পিটাউরিস্টা পিটাউরিস্টা (Petaurista petaurista) এবং পিটাউরিস্টা ম্যাগনিফিকাস (Petaurista magnificus)| গেল দু’দশকে এদেরকে দেখা যাওয়ার নজির নেই। তবে এককালে, আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম চাষ বিভাগের বন-কর্মকর্তা মহালছড়ি থেকে প্রথম প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয় প্রজাতির নমুনা ধরা পড়ে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার গাছবাড়িয়া এলাকা থেকে।
বিন্টুরঙ, বিয়ার-ক্যাট, গেছো ভাল্লুক চিরসবুজ বনে ছিল। এ প্রাণীটি এখন কদাচিৎ দেখা যায়। একই অবস্থা হয়েছে বনরুই, পিঁপীলিকাভুক বা প্যাংগোলীনের। দেশের প্রায় সর্বত্র, সুন্দরবন বাদে, বনরুই দেখা যেত। এখন চিরসবুজ বন এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় এদের খুবই কম দেখা যায়।
খুরওয়ালা খরগোশ: ষাট সালের আগে সাভার এবং মির্জাপুরের গজারিবনে এ খরগোশ পাওয়া যেত। আশি সালের পরে খুরওয়ালা খরগোশ আর সেখানে দেখা যায়নি। এটি এখন অত্যন্ত বিরল প্রাণী। অমসৃণ খরগোশ, আসাম রেবিট বা হিসপিড হেয়ার নামে যে প্রাণীটি ঢাকা, টাঙ্গাইল, মোমেনশাহী, জামালপুর ও সিলেট জেলায় বিচরণ করত তাদের এখন দেখাই যায় না।
বানর হনুমানের মধ্যে দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে যশোর, কুষ্টিয়ার হনুমান, লজ্জাবতী বানর এবং চিরসবুজ বনের উল্লুক। প্যারাইলা বন্দর ১৯৮৫ সালে হারিয়ে গেল টেকনাফের প্যারা বন থেকে। শুকরাকার ব্যাজার বা হগ ব্যাজার, (Arctonyx collaris) বাচ্চা শূকরের মতো দেখতে ধূসর, কালো ও সাদায় মেশানো লম্বা লম্বা নখর এবং লেজযুক্ত প্রাণী বাস করে চিরসবুজ বন এলাকায়। পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবার ও শিকারের ফলে এদের সংখ্যা দারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
পাখি
সংখ্যাধিক্যের জন্য বাংলার আকাশ-বাতাস পাখি কুজনে মুখরিত ছিল, কিন্তু বর্তমানে সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গত দুতিন দশকে কমে গেছে দিনের শিকারি পাখি, রাতের শিকারি পাখি, ময়ূর গোত্রীয় পাখি হাড়গিলা এবং হাঁস। শিকারি পাখির মধ্যে বিভিনড়ব ধরনের শকুন দেখা যায় না বললেই চলে। তবে ভারত সংলগড়ব উত্তরবঙ্গে কদাচিৎ রাজশকুন দেখা যায়। বিরল হয়ে আসছে শংখচিল, মাচমোরাল বা উখোস, কুড়া বা বউল, ঈগল পাখি, বাজ এবং ফেলকন। রাতের শিকারি পাখির মধ্যে পেঁচার সংখ্যা খুবই কমে আসছে। লক্ষ্মী পেঁচা সম্ভবত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রজাতি। ভুতুম এবং হুতুম পেঁচার অবস্থাও তথৈইবচ। ময়ূর গোত্রীয় পাখির মধ্যে গত এক দশকে কয়েক প্রজাতির তিতির, কর্মী ময়ূর এবং কাট ময়ূরের সংখ্যা কমেছে। ৮০ কালো তিতির ১৯৮৮ সালে তেঁতুলিয়া এলাকায় দেখা গেছে। তার পূর্ব থেকেই মথুরা, বনমোরগ প্রভৃতির সংখ্যা খুবই কমে গেছে। হাড়গিলা, মদনটাকে এবং মানিকজোড় দু’দশক আগে গ্রামেগঞ্জে দেখা যেত। এখন এ তিনটি প্রজাতি বেশ বিরল। হাঁসের মধ্যে বাসিন্দা বাদিহাঁস এবং বোঁচা হাঁস বা কোম্বডাক গেল দশকগুলোতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একসময় বাদি হাঁসের বিস্তৃতি ছিল সব চিরসবুজ বনে। এখন কয়েক জোড়া বেঁচে আছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পাবলাখালি ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায়। বাদি হাঁস অন্যসব জায়গা থেকে হারিয়ে গেছে। বোঁচা হাঁস সিলেট মোমেনশাহীর হাওড়ে এবং রাজশাহীর চর ও বিলে ছিল। এখন কদাচিৎ সিলেটের হাওড়ে দেখা যায়। কয়েক বছর আগে ঠাকুরগাঁ মহকুমায় বাচ্চাসহ একজোড়া সারস দেখা গেছে। ডাহর পাখি বা বেঙ্গল ফ্লোরিকান কয়েকযুগ আগে শনের বনসমৃদ্ধ এলাকায় বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে ছিল, এখন আর দেখা যায় না। মাস্কড ফিনফুট, হরিয়াল, কোড়া, ধনেশ পাখি, বৃহদাকার কাঠ ঠোকরা, কথাবলা ময়না পাখি এবং নীল কুটিরের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে।
সরীসৃপ:
সরীসৃপের মধ্যে ঘড়িয়াল, বাইশাল বা ঘট কুমীর যদিও সব নদ-নদীতে বিচরণ করত, কিন্তু বর্তমানে লোনা পানি অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। খুবই সামান্য সংখ্যায় লোনা পানির কুমির, কুঙ্গ, ভদ্রা, সেলা, ভোলা এবং পশুর নদীতে বাস করছে। তিন প্রজাতির গুইসাপ এদেশে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় রামগদি (Varanus salvator) নামের গুইসাপ দেশের মাঝামাঝি এলাকা থেকে সব দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলায় দেখা যায়। কালো গুই, সোনা গুই এবং রাম গদির সংখ্যাও বেশ কমেছে। অজগর, ময়ালসাপ, দারাজ, দুধরাপ, গোখরা, রাজ গোখরা বা শংখচুর এবং চন্দ্রবোরা সাপ ও শাকিনীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। দুমুখা সাপও আজকাল দেখা যায় না। এক সময়ে এদেশে সম্ভবত সাপের সংখ্যা জনসংখ্যার অধিক ছিল, কিন্তু আজকাল সাপের সংখ্যঅ যেভাবে কমছে, হয়ত শিঘ্রই কোনো কোনো প্রজাতি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কাছিম বর্গীয় প্রাণীর মধ্যে সুন্দরবনের নদীতে পাওয়া যায় বড় কাইট্টা (কমন বাটাগুড়), চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি কচ্ছপ এবং হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ।গেছো ব্যাঙ এবং কোলা ব্যাঙের সংখ্যা দেশ থেকে অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
আগামী পর্বেঃ বাংলাদেশে মানব বসতি, বাংলাদেশে প্রারম্ভিক জনবসতি
আদি বাংলার ইতিহাস (প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দ) পর্ব ৪৩