আমরা সবাই জানি যে, চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে, আবার পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে, সূর্য আবার ...(আপাতত আর গভীরে যাচ্ছি না). যে কোনো কিছু আমাদের চোখে দেখতে হলে সেই জিনিস থেকে আলো এসে আমাদের চোখে পড়তে হবে। চাঁদের কোনো আলো নাই। সূর্যের আলো চাঁদের উপরে এসে পড়ে, আর সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসলে আমরা চাঁদকে দেখতে পাই।
আমরা মোটামুটি এইটা ও জানি যে, সূর্যগ্রহণ হচ্ছে চাঁদের কারণে সূর্যকে কিছু সময়ের জন্য দেখতে না পাওয়া (পুরোপুরি বা আংশিক). আর চন্দ্রগ্রহণ হচ্ছে পৃথিবীর কারণে কিছু সময়ের জন্য চাঁদকে দেখতে না পাওয়া। সূর্যগ্রহণ ঘটে তখন, যখন দিনের বেলা চাঁদ, পৃথিবী এবং সূর্যের মাঝখানে এমনভাবে এসে পরে যে সূর্য ঢেকে যেয়ে পৃথিবীর উপরে চাঁদের ছায়া পড়ে অন্ধকার হয়ে যায়, অর্থাৎ চাঁদের কারণে সূর্যের আলো দেখা যাবে না।
আর চন্দ্রগ্রহণ তখন ঘটে, যখন রাতের বেলা পৃথিবী, সূর্য ও চাঁদের মাঝে এমনভাবে এসে পরে যে সূর্যের আলো আর চাঁদের উপরে এসে পরে না, তাই চাঁদ সূর্যের আলো না পেয়ে কোনো আলো প্রতিফলিত করতে পারে না, আর চাঁদকে ও তখন কিছু সময়ের জন্য আমরা দেখতে পাই না।
এখন কথা হচ্ছে, চাঁদ প্রতিমাসে একবার পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসে। তাই সেই হিসেবে প্রতি মাসে একবার আমাদের সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ দেখার কথা। কিন্তু সেটা আমরা দেখি না।
কেন?
এই কেনো উত্তর দেয়ার আগে চলুন আর ১ দিন পরে যে সূর্যগ্রহণ হতে যাচ্ছে সেটার সম্পর্কে কিছু জেনে নেই।
২৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, সৌদি আরব এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু অঞ্চলে আগুনের বলয় (ring of fire) এর মতো করে সূর্যগ্রহণ (annular eclipse) দেখা যাবে। এই ring of fire নিয়ে একটু পরে আরো বিস্তারিত বলছি।
নিচের animated ছবিটা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখেন তাহলে একটা লাল বিন্দু দেখতে পাবেন (বাম থেকে ডান দিকে সরে যাচ্ছে). এই বিন্দুটা পূর্ন annular সূর্যগ্রহণ এর পথটা দেখাচ্ছে। অর্থাৎ এই বিন্দু বরাবর পৃথিবীর যেসব জায়গা আছে সেসব স্থান থেকে ২৬ তারিখের পূর্ন annular সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। আর যে বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার ছায়াটা লাল বিন্দুর চারপাশ জুড়ে আছে, সেটা হচ্ছে সূর্যগ্রহণ এর পূর্ণ বিস্তার। মানে হচ্ছে, এই ছায়ার ভেতরে যেকোনো জায়গা থেকে সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র লাল বিন্দু বরাবর পূর্ণ ring of fire গ্রহণ (১০০%) দেখা যাবে, আর ছায়ার বাকি স্থানগুলো থেকে partial, মানে আংশিক গ্রহণ দেখা যাবে (১% থেকে ৯৯%).
নিচের ভিডিওটিতে উপরেরটির মতো একই ধরণের আরেকটি animation দেখা যাবে। তবে এইটাতে পৃথিবীকে গোলাকার এর পরিবর্তে কেটে চ্যাপ্টা করে চারকোনা ম্যাপ করে দেখানো হয়েছে।
এখন আসি ring of fire এর কথায়। চার ধরণের সূর্যগ্রহণ সাধারণত আমরা দেখতে পাই: পূর্ণ সূর্যগ্রহণ, annular (রিং এর মতো) সূর্যগ্রহণ, আংশিক সূর্যগ্রহণ, হাইব্রিড সূর্যগ্রহণ। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ মানে চাঁদ সূর্যের আলোকে সম্পূর্ণ রূপে block করে দেয়। কিন্তু চাঁদ সূর্যের তুলনায় প্রায় ৪০০ গুন ছোট। তাহলে চাঁদ কিভাবে সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিতে পারে? পৃথিবীর থেকে চাঁদের, আর পৃথিবী থেকে সূর্যের, এই দুইটা দূরত্ব একটু ভেবে দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা আমাদের সাধারণ জীবনযাত্রাই কিন্তু দেখতে পাই, কোনো বস্তু আমাদের চোখের যত নিকটে আসে ততই তাকে অনেক দূরের অন্য কোনো জিনিসের চেয়ে বড় মনে হবে। যেমন মনে করেন, আপনার মোবাইল ফোনটাকে চোখের সামনে ধরে আপনি অনায়াসে আপনার থেকে ৪০০/৫০০ মিটার দূরের একটা ৪০ তোলা বিল্ডিং কে আড়াল করে দিতে পারবেন। অথবা, অন্যভাবে যদি বলি, মোবাইলটা চোখের পাশে ধরে, মোবাইল আর বিল্ডিংটা একসাথে দেখলে দুইটার size ই সমান মনে হবে।
ঠিক এই ধরণের একটা ব্যাপার এই ঘটে সূর্য র চাঁদের ক্ষেত্রে। চাঁদ যদিও সূর্যের চেয়ে ৪০০ গুন্ ছোট, কিন্তু চাঁদ আবার পৃথিবী হতে সূর্যের চেয়ে ৪০০ গুন্ কাছে! যেকারণে, পৃথিবী থেকে চাঁদ এবং সূর্য দুটোকেই আমাদের কাছে মোটামুটি সমান আকৃতির মনে হয়। আর একারণেই চাঁদ যখন পৃথিবী এবং সূর্যের মাঝখানে সঠিক অ্যাঙ্গেল এ আসে, তখন মনে হয় যে চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিয়েছে। এইরকম যখন হয়, সেটাকে আমরা পূর্ণগ্রহন বলি। কিন্তু চাঁদ যেহেতু অনেক ছোট, তাই চাঁদের ছায়াও অনেক ছোট। আর একারণেই, পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদ যদিও পুরো সূর্যকেই ঢেকে দিতে সক্ষম, কিন্তু পুরো পৃথিবীতে চাঁদের সেই ছায়া পরা সম্ভব না। আর একারণেই পৃথিবীর সব জায়গা থেকে সূর্যগ্রহণ একসাথে দেখা যায় না, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হলে ও না। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ এর সময় অনেকটা নিচের ছবির মতো দেখতে পাওয়া যায়:
আংশিক গ্রহণটা তাহলে আশা করি বুঝতে পারছেন, সূর্যের একটা অংশ যখন ঢাকা পরে চাঁদের আড়ালে সেটা আংশিক গ্রহণ তৈরি করে।
আর annular eclipse এর এই বলয় তৈরি হওয়ার কারণ হচ্ছে পৃথিবী থেকে চাঁদ এর দূরত্ব। আমরা সবাই জানি যে চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরে। অর্থাৎ চাঁদ সবসময় পৃথিবী থেকে সমান দূরত্বে রেখে ঘুরে না। আর চাঁদ এখন তার কক্ষপথের এমন এক জায়গায় আছে যেটা পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে। যে কারণে, পৃথিবী থেকে চাঁদকে এখন সূর্যর চেয়ে ৩% ছোট দেখা যাচ্ছে। এর ফলে চাঁদ যখন সূর্যের একদম উপরে এসে গ্রহণ তৈরি করবে, তখন পুরো সূর্যটা ঢাকা পড়বে না, ৯৭% ঢাকা পড়বে। আর এই বাকি ৩% ঢাকা না পড়ার কারণেই সূর্যগ্রহণের সময় চারপাশে আমরা সেই আগুনের বলয়টা দেখতে পাবো।
নিচের ছবিটা ২০১১ র জানুয়ারীতে এইরকম এই একটা annular eclipse এর সময় তোলা।
২৬ তারিখ যারা উপরের ছবির লাল বিন্দুর নিচে থাকবেন, তারা এইরকম একটা দৃশ্য দেখার আশা রাখতে পারেন। যদিও এতো সুন্দর খালি চোখে মনে হবে না, কারণ এই ছবিটি space থেকে NASA র তোলা।
একদম উপরের ছবিটা দেখে আপনারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন যে এইবার বাংলাদেশের কোনো জায়গা থেকেই পূর্ণ রিং অফ ফায়ার সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে না। কিন্তু কোন অঞ্চলে সর্বোচ্চ কতোটুকু দেখা যাবে এবং কখন দেখা যাবে সেটা জানার জন্য এই ওয়েবসাইটে যেতে পারেন: Click This Link
বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর নাম লিখে search করলে কখন গ্রহণ শুরু হবে, কখন সর্বোচ্চ গ্রহণে পৌঁছবে, আর কখন শেষ হবে, সব বিস্তারিত দেখতে পাবেন। চাইলে ওই স্থানের গ্রহণের animated ভিউর ভিডিও টা ও দেখে নিতে পারেন। এমনকি গ্রহণ শুরু হওয়ার পরে এই সাইট থেকে সেটার লাইভ ভিউ ও দেখতে পাবেন। [তবে সাইটটি ল্যাপটপ বা ডেস্কটপ থেকে দেখলে ভালো করে বুঝতে সুবিধা হবে। মোবাইল থেকে একটু ঝামেলা মনে হতে পারে]
উদাহরণস্বরূপ আমি নিচে ঢাকার information গুলোর ছবিটা দিলাম:
আর এই লিংকে গেলে আপনারা ঢাকা থেকে যে গ্রহণটা দেখা যাবে সেটার animation টা দেখে নিতে পারবেন: Click This Link
যাইহোক, এখন 'কেন আমরা প্রতি মাসে একবার করে সূর্যগ্রহণ আর চন্দ্রগ্রহণ দেখি না?' সেই উত্তর দেয়ার পালা। কিন্তু উত্তরটা পরের পর্বের জন্য রেখে দিচ্ছি। কারণ, এই আর্টিকেল লেখা শুরু করার পরে মনে হচ্ছিল অনেক সহজে বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারবো। এখন মনে হচ্ছে আরও একটু সময় নিয়ে লিখলে ভালো হবে
তবে দুটো বিষয় জানিয়ে রাখি, পরের পর্বের হাইলাইট হিসেবে:
১. চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে যে উপবৃত্তাকার পথে ঘুরছে, সেই পথ প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। প্রতিবছর চাঁদের কক্ষপথ ৩.৮ cm করে বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে দূরে যেতে যেতে একদিন হয়তো ভারসাম্য নষ্ট হয়ে এই মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে, আমরা মুসলমিরা যেটাকে 'কিয়ামত' বলে থাকি। তবে, যদি আমরা ideal situation চিন্তা করি, যে ভারসাম্য নষ্ট হবে না, তাহলে আনুমানিক ৬০০ মিলিয়ন বছর পরে চাঁদ এর কক্ষপথ এতো বড় হয়ে যাবে যে পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদ আর সূর্যকে ঢাকতে পারবে না. অর্থাৎ ওই সময় থেকে আর কখনো সূর্যগ্রহণ হবে না।
২. পৃথিবী সূর্যের চারপাশে যে উপবৃত্তকার পথে ঘুরছে, এই উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ সবসময় সমান নয়। আর যেহেতু পৃথিবী উপবৃত্তকার পথে ঘুরে, তাই আমাদের মনে হতেই পারে যে প্রতি ১ বছর পরপর পৃথিবী একই পথে আবার ফায়ার আসে। কিন্তু মহাশূন্যের সাপেক্ষে চিন্তা করে যদি বলি তাহলে পৃথিবী কখনোই তার ঘূর্ণন পথের পার হয়ে যাওয়া কোনো স্থানে আর ফেরত আসে না। কারণ, পৃথিবীর এই উপবৃত্তাকার ঘূর্ণন তা শুধুই উপবৃত্তকার না, এটা একই সাথে spairal ঘূর্ণন!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১২