ষড়ঋপু সিরিজের দ্বিতীয় কাহিনী ”ক্রোধ”
রাত্রি নেমেছে শহরের উপর, কিন্তু তিমির কেবল আকাশে নয়—সে বসেছে মানুষের শিরায়, দৃষ্টিতে, শ্বাসে। পুরনো শহরের এক প্রান্তে, যেখানে ইট ভেঙে পড়ে আর বাতির আলো টিমটিম করে কাঁপে, সেখানে থাকে একটি ছায়া। ছায়ার নাম—ইহান।
ইহান খুব সাধারণ এক ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, মৃদুভাষী, শান্ত স্বভাবের, মাথা নিচু করে চলে। যারাই তাকে চিনেছে, বলেছে—"ভদ্র ছেলে। সময়ের আগে বড় হয়ে গেছে।" কেউ জানে না, এই ছেলেটার ভেতরে একটা আগুন জন্মেছে। আগুন, যা নিঃশব্দে পুড়িয়ে খায় তার শরীর, মন, আত্মা।
শুরুটা হয়েছিল ছোটবেলায়, বাবার রাগের ঘায়ে। মুখের ওপর হাত, দেয়ালে ঠেলা, আর রক্তে রাঙা ফ্লোর। মা কিছু বলত না, কাঁদত। ইহান শিখে গিয়েছিল, চুপ থাকা কীভাবে একটা বেঁচে থাকার কৌশল হতে পারে। কিন্তু চুপচাপ জমে থাকা ক্রোধও একসময় নিজের ভাষা খুঁজে নেয়।
সে ভাষা ছিল নীরব প্রতিশোধের।
শহরের এই পাশে প্রায়ই কিছু মানুষ হারিয়ে যায়। কেউ খেয়াল করে না। ইহান করে। সে রাতের পর রাত সেই গলিতে হাঁটে, যেখানে বাতি নেই, শব্দ নেই, কিন্তু ছায়ারা ফিসফিস করে। ছায়ারা তাকে ডাকে, বোঝায়—এরা সেই যারা অন্যের রক্তে বাঁচে, অন্যের কান্নায় হাসে।
এক রাতে, সে দেখল এক লোক তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছে। মেয়েটি কান্না করছিল। ইহান কিছু বলল না। চেয়ে চেয়ে দেখল। এরপর যখন লোকটা চলে গেল, সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল—"তোমার ঠিকানা কোথায়?" মেয়েটি তাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।
তারপর সে লোকটাকে অনুসরণ করল। রাত গভীর হতেই, সেই পুরনো ভাঙা ফ্যাক্টরির কাছে পৌঁছে তাকে থামাল। কিছুই বলল না। হাতে একটা কুড়াল ছিল। ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে, সে লোকটার চোখে তাকিয়ে দাঁড়াল। এবং সেই রাতেই, শহরের ছায়াগুলো ইহানকে গ্রহণ করল।
এরপর থেকে ক্রোধ আর ইহান এক হয়ে গেল। দিনে সে শান্ত, নিরীহ ছাত্র। রাতে, ছায়া।
সে কাউকে খুন করত না শুধু শাস্তি দেবার জন্য। সে খুঁজে বেড়াত—যারা বঞ্চিত, নিপীড়িত, যারা বলার সাহস পায় না, তাদের কষ্টের উৎসকে। তারপর তাদের মুখোশ খুলে, অন্ধকারে ডুবিয়ে দিত। তার প্রতিশোধ ছিল প্রতীকী, কিন্তু নির্মম।
সে শহরের গভীর থেকে একটা রেকর্ড রাখত—যার যার নাম অন্ধকারে লেখা, তাদের হালখাতা। মেট্রোস্টেশনের কাছে থাকা নোংরা হোটেল থেকে শুরু করে, বনানীর কাঁচঘেরা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট—সবখানেই তার ছায়া পৌঁছাতো। একবার সে একজন প্রভাবশালী কর্পোরেট বসের কাহিনি জানল, যিনি নারী কর্মীদের মানসিকভাবে ভেঙে দিতেন, তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করতেন।
ইহান ওই লোকের বাসার আশেপাশে সপ্তাহ কাটাল। জানালা দিয়ে তার অভ্যস্ত ভঙ্গি, আধা-নগ্ন দম্ভের ভাষা, রাতের নির্জন মুহূর্ত—সব পর্যবেক্ষণ করল। তারপর এক রাতে, ঘুমন্ত অবস্থায় লোকটার কক্ষে ছায়ার মতো ঢুকে পড়ল। তার ঘুমের মধ্যেই লোকটা অনুভব করল হিমশীতল একটা হাত তার গলায়। ইহান তার কানে ফিসফিস করে বলল—"তোমার প্রতিটা চিৎকার আমি শুনেছি। এখন শুনবে আমার নীরবতা।"
সকালের পত্রিকায় খবর এল—"অজানা কারণে মৃত্যু, কোনো চিহ্ন নেই।"
কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল তার নিজের মধ্যের ছায়া।
একদিন, ক্লাসে একজন নতুন ছাত্র এল—তামিম। বুদ্ধিমান, জনপ্রিয়, উচ্চস্বরে কথা বলা অভ্যাস। প্রথম দিনেই সে বলল, "ইহান, তুই তো খুব চুপচাপ। ভীতু নাকি?"
ইহান হাসল না। সে কিছুই বলল না। কিন্তু তামিম তার পিছু ছাড়ল না। একদিন ইহান জানল, তামিমই সেই ছেলে, যে হোস্টেলে এক নবীন ছাত্রকে মানসিকভাবে ভেঙে দিয়েছিল। সেই ছেলেটি এখন আর কথা বলে না।
ইহানের চোখে সেই মুহূর্তে একটা আগুন জ্বলে উঠল। সে জানে এই আগুন নিভবে না, যতক্ষণ না অন্যায় মিটে যায়। সে তামিমের পেছনে ছায়ার মতো লাগল। তার চলাফেরা, কথাবার্তা, মিথ্যা বন্ধুত্বের মুখোশ—সবকিছু পর্যবেক্ষণ করল।
রাতের এক গভীর সময়, হোস্টেলের বাইরে পুরনো বটগাছের নিচে একটা পুরনো কূপের ধারে দেখা গেল দুই ছায়া। এক ছায়া দাঁড়িয়ে, এক ছায়া হাঁটু গেড়ে কাঁপছে। তামিম চিৎকার করে বলছিল, "আমাকে মেরে ফেলবি? আমি তো কিছু করিনি!"
ইহান তার দিকে তাকাল। চোখে জল, কিন্তু ঠোঁটে রক্তমাখা নির্লিপ্ততা। "তুমি কিছু করোনি, বলছো? তোমার প্রতিটা শব্দ একেকটা ছুরি ছিল। আমি শুধু তোমার আত্মাকে আয়নায় দেখাচ্ছি।"
পরদিন সকালের খবর—তামিম নিখোঁজ।
কেউ জানে না কীভাবে, কোথায়। শুধু ফ্যাক্টরির দেয়ালে লেখা ছিল—"ক্রোধ যখন ন্যায়ের মুখোশ পরে, তখন নরকেই স্বর্গ মনে হয়।"
ইহান ফিরে এল ক্লাসে। চুপচাপ। মৃদুভাষী। কেউ কিছু টের পেল না। কিন্তু তার চোখে তখন ছায়ার আভা। তার হাঁটার ভঙ্গিতে ছিল ধ্বংসের এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা।
এই শহর জানে না, তার ছায়ায় একজন পাহারাদার বাস করে। যার নাম—ইহান। যার হৃদয়ে ঘুমিয়ে আছে প্রাচীন এক রিপু—ক্রোধ, যা ন্যায়ের নামে জেগে ওঠে, এবং অন্যায়কে গ্রাস করে নীরব, নিঃশব্দে।
শেষ নয়। কারণ ক্রোধ তো কখনো মরে না। সে কেবল অন্য এক ছায়া খুঁজে নেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৬:১৭