লক্ষী সোনা, কেমন আছো তুমি? আমিও কি বোকা, এ কেমন প্রশ্ন করছি আমি? মাকে ছেড়ে কেউ কি কখনও ভাল থাকে? তারপরও মনে তীব্র আশা তুমি ভাল আছ। কারণ তোমাকে তো আবার ফিরে আসতে হবে তোমার এই পঁচা মা টার কাছে। তোমাকে ছাড়া যে তোমার এই মা টার কিচ্ছু ভাল লাগেনা। শত ব্যাস্ততার মাঝেও যখনই তোমার কথা মনে পরে তখনি সব কিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হয়। ভালই তো ছিল তার জগৎ কচি কাঁচার দের নিয়ে। তুমি এসে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত তার জগৎটা রাঙ্গিয়ে দিয়ে আবার কোথায় হারিয়ে গেলে? এ কেমন অভিমান তোমার?
কোটি মানুষের এই যান্ত্রিক শহরটাতে যখন প্রথম এলাম তোমার বাবার সাথে তখন দু চোখে তোমাকে নিয়েই অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেইসাথে এটাও বুঝেছিলাম যে তোমার জন্য অনুকূল পরিবেশ এনে দিতে পারার ক্ষমতা অর্জন করে তবেই তোমাকে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসা উচিত হবে আমাদের। আর তাই তো তোমার জন্য সুন্দর একটি পরিবেশ গড়ে দেবার জন্য আমার আর তোমার বাবার সংগ্রাম শুরু হল।সকাল থেকে সন্ধ্যা দুজন দুদিকে ব্যস্ত। সারাদিন পরিশ্রমের পর অফিস থেকে তোমার বাবা যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে খুব মায়া লাগে ওকে দেখে। পরেরদিন ভোর হতে না হতেই আবার ছুটি দুজনেই দুই প্রান্তে। এ যেন যান্ত্রিক শহরের দুই যন্ত্রমানবের সংসার। এই যান্ত্রিকতার মাঝে প্রাণের পরশ পাই শুধু ঐ সময়টাতে যে সময় আমি স্কুলে বাচ্চাগুলোর সাথে কাটাই। ওদের নিস্পাপ মুখ, ওদের ভালবাসা,ওদের আধোআধো বুলি, ওদের সরলতা, ওদের দুস্টুমি এসবকিছুই আমাকে তোমার অভাববোধটাকে যেন আরও তীব্রভাবে জানিয়ে দেয়। আর কেনইবা তা হবেনা বল , এই যে যে বাচ্চাগুলো তিনঘন্টা ছায়ার মত আমার কাছে কাছে থাকে, আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা সেই বাচ্চাগুলোই যখন ছুটির পর তাদের মামনিকে দেখে এক দৌড়ে ছুটে যায় তখন তাদের মুখে যে স্বর্গীয় দ্যূতিটি ছড়িয়ে পড়ে সেই আলোয় কতটাই না ম্লান হয়ে যাই এই আমি, তাদের অতি সাধারন একজন মিস।
আর পারলামনা। সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে আনার। ভাবলাম, খুব অর্থ না থাক ভালবাসার তো কমতি নেই আমাদের তাই দিয়েই না হয় পূর্ণ করব তোমার সকল অপূর্ণতা। কিন্তু তোমার এই হতভাগ্য মা তার কথা রাখতে পারেনি। তার ভালবাসায় হয়ত কোথাও কমতি থেকে গিয়েছিল তাই তো সে তোমাকে ধরে রাখতে পারেনি। তাই তো তুমি অভিমান করে চলে গেলে। আচছা তোমার কি এই মনে করে অভিমান হয়েছিল যে তোমার মা তোমার চেয়ে তার স্কুলের বাচ্চাদের বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলছে? লক্ষী সোনা, এমন মনে করোনা। কি করব বল তোমার অনভিগ্গ মা যে ভিষণ বোকা ।ও যে বুঝতেই পারেনি তোমাকে নিয়ে ওর বাচ্চাদের সাথে ছুটোছুটি করাটা একদম ঠিক নয়। যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তীব্র ব্যাথায় নীল হতে হতে বুঝতে পারলাম আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ আজ পেয়েও হারালাম। এতদিনের তিল তিল করে গড়া স্বপ্নের আজ মৃত্যু হতে চলেছে।পরম করুণাময়ের কাছে অনেক কাঁদলাম, প্রার্থণা করলাম,ক্ষমা চাইলাম তোমার কাছে বারবার কিন্তু তুমি ফিরলেনা কিছুতেই। একরাশ অভিমান নিয়ে তোমার এই হতভাগ্য মা কে পিছনে ফেলে রেখে তুমি হারিয়ে গেলে কোন অজানা এক জগতে।
জানি আমি তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি, এক ব্যর্থ মা আমি, তাই তুমি অভিমান করে চলে গেছ । কিন্তু সোনা, তোমার বাবার কথা ভেবে তুমি আর একবার ফিরে আসো আমাদের কাছে। ওর তো কোন দোষ নেই। তুমি আসলে বুঝতে পারবে পৃথিবীর শ্রেস্ঠ বাবারা কেমন হয়। তুমি আসলে আমি তোমার জন্য সব ছেড়ে দিব, জানি কস্ট হবে তারপরও দরকার হলে তোমার জন্য আমি স্কুল ছেড়ে দিব, নয়মাস বিছানায় থাকব, কোথাও বের হবনা তবুও তুমি আমার কাছে এসো। এসো কোনও রাজপুত্তুর বা রাজকন্যার বেশে। তখন কোন একদিন স্কুল ছুটির পর আমি দাঁড়িয়ে থাকব গেটের বাইরে আর তুমি আমাকে দেখে এক স্বর্গীয় দ্যূতি ছড়িয়ে এক গাল হেসে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার কোলে। আমি তো দিন গুনে চলেছি সেই দিনটির জন্যই।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৩:১১