একজন মায়ের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন কি?
পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রতিদিন প্রচারিত আপডেট খুব একটা বিচলিত করেনা আমাকে। হ্যাঁ শুধু পত্রিকাই নয়, ব্লগ জগত, অনলাইন নিউজ আপনি যেখানেই যাবেন সেখানে দেখবেন রুমানা মনজুরকে। প্রায় অন্ধ রুমানা মনজুরের আরো প্রায় বিভৎস ছবি দেখে প্রায়ই আমাকে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়। তিনি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক। কানাডাতে পিএইচি রত। মনে প্রশ্ন জাগে যিনি দেশের সেরা ছাত্রদের শিক্ষা দেন তার কেন এমন হলো? কেন এই বিভৎসতা? কেন এই নারকীয় নির্যাতন? এমন ঘটনার দ্রুত ও দৃষ্ঠান্তমূলক শাস্তি আমার মতো সচেতন সব মহলেরই দাবী। এব্যাপারে পত্র পত্রিকা বেশ সরব অবস্থান নিয়েছে তাই আমি সেদিকে আলোকপাত করবোনা। তবে সামুতে মানবী নামের একজনের একটা পোস্ট লটকানো ছিলো। যার কমেন্টসগুলো পোস্টের চাইতে গুরুত্বপূর্ন বলে মনে করছি। আপনারা পড়ে দেখতে পারেন।
নির্যাতন ও পুরুষতন্ত্র
কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে রুমানা মনজুর নির্যাতনের ঘটনাকে সমাজে নারীর অসহায় প্রান্তিক অবস্থান হিসেবে চিত্রায়িত এবং সমাজের সকল পরুষকে দোষারোপের চেস্টা করছেন। যা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। ইংরেজীতে বলবো 'রিডিকিউলাস। কেনো পুরুষতন্ত্র আসছে? কেনো পুরুষতন্ত্রকে দোষারোপ করা হচ্ছে। যখন আপনি কোন অপরাধকে পুরুষতান্ত্রিক ব্যাপার ও পুরুষ শাসিত সমাজের রূপ বলে সংজ্ঞায়িত করবেন তখন সাথে সাথেই নারীতন্ত্র ব্যাপারটা চলে আসে। আর এটি নারী -পুরুষকে একটা বিপরীত ও সংঘাতপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যায়। আজকের সমাজকে পুরুষ শাসিত সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করে নারী নির্যাতন হচ্ছে বলে যদি মনে করা হয় তাহলে কালের প্রবাহে সমাজ যদি কখনো নারী তান্ত্রিক হয় তাহলে কি পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারেনা? আমরা সাধারন মানুষ নিশ্চয় এমন সমাজ চাই না। তাই রুমানা মনজুরের ঘটনাকে আমি পুরুষ শাসিত সমাজের সরূপ হিসেবে মনে করিনা।
তবে কি মনে করছি
আসুন একটু দেখে নেই অপরাধ কি? সহজভাবে বললে অপরাধ হচ্ছে, a deviant behavior that violates prevailing NORMS, CULTURAL standards prescribing how human ought to behave NORMALLY. এবং অপরাধী হচ্ছে সে যে এই deviant behavior গুলো করে। রুমানার স্বামী রুমানার সাথে যেরূপ আচরন করেছে তা হচ্ছে deviant behavior। তাকে আমি স্রেফ একজন অপরাধী মনে করছি। এটা পুরুষ বা নারীর ব্যাপার নয় এটা অপরাধ, অপরাধী, আদালত ও আইনের ব্যাপার। আমরা এটাকে কোন ভাবেই নারী পুরুষ ইত্যাদি ভাবে বিভাজিত করতে পারিনা। কারন সমাজটা নারীরও না, পুরুষেরও না। সমাজটা সবার। সমাজটা আমাদের। আদালত তার অপরাধের মাত্রা নিরুপন করে তাকে সঠিক শাস্তি দিবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন নির্যাতিতা রুমানা ও সচেতন মহল সরকার এবং আদালতকে অনুরোধ করেন আসামীর উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তখন মনে প্রশ্ন জাগে, কেনো?
কেনো এই বিচার দাবী?
একজন হত্যা প্রচেস্টাকারী নরপিশাচের উপযুক্ত বিচার দাবী করা হচ্ছে কেনো? প্রসঙ্গত এখানে চলে আসে সরকার ব্যবস্থা, আইন শৃংখলা পরিস্থিতি, পাওয়ার গেইম, বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা- আনাস্থা ইত্যাদি বিষয়গুলো। ভিকটিমকে কেনো মিডিয়ার কাছে রিকোয়েস্ট করতে হয়, প্লিজ আপনারা আমাকে সাহায্য করুন যাতে নরপিশাচটার উপযুক্ত শাস্তি হয়। তাহলে কি মানুষ রূপী হায়েনা সাইদের উপযুক্ত বিচার না হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে? আমি বলি হ্যাঁ, রয়েছে। আমরা সেই দেশে বসবাস করি যে দেশে সাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত হত্যাকারীকে আমাদের সম্মানিত রাস্ট্রপতি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং ক্ষমা পাওয়ার কিছু দিনের ভেতরেই সেই চক্র আরেকটি হ্ত্যা করেছে। বিচার বিভাগকে দলীয় আর নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়গুলো এবং বিভিন্ন ছলায় বিচারকদের (এমনকি সাবেক একজন প্রধান বিচারতিও জড়িত) যেভাবে উৎকোচ গ্রহনের বিষয়গুলো সমকালীন কাগজে ছাপা হচ্ছে তাও আমাদের ন্যায় বিচার পাওয়ার বিষয়ে সন্দিহান করছে। আর পুলিশের দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নাইবা বললাম। আজকের নিউজপেপার দেখলে অনেকেই অবাক হবেন সরকারের সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রীর স্ত্রী আসমা কিবরিয়া তার স্বামী হত্যার চার্জশীটের ব্যপারে অনস্থা প্রকাশ করেছেন। বরং তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেছেন আসমা কিবরিয়া কে? তাই একজন নির্যাতিতা যিনি কিনা মানুষ গড়ার কারিগরও তার ন্যায় বিচারের জন্য এমন আর্তনাদ ও ফরিয়াদ উচিত নয় বৈকি? এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে আমাদের সমাজে যারা নিরীহ এবং পাওয়ার এক্সারসাইজ করার সুযোগ নেই তারা আদালতের উপরও আস্থা রাখতে পারছেন না। কোন সভ্য সমাজে ন্যায় বিচারের জন্য দাবী করতে হয়না। আর এমন অবস্থা চলতে থাকলে এমন নারকীয় ঘটনা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে নিশ্চিত করেই বলা যায়।
কেনো রুমানাকে সংবাদ সম্মেলন করে বিচার চাইতে হবে। আইনের শাসনে এমন নজির নেই। নরপশু সাইদের উপযুক্ত, দ্রুত ও দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা রাস্ট্রের কর্তব্য।
এসব অপরাধ দিন দিন বাড়ছেই
আসলে এমনতর অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলছে। আমি পরিসংখ্যান দিতে চাইনা, কারন তালিকটা অনেক বড়। একটা বিষয় আলোকপাত করবো সেটা হচ্ছে, আমাদের দেশে কোন নারীর উপর যেকোন ধরনের আক্রমন হলে ই এটাকে ট্যাগিং করার চেস্টা চলে। সমাজের কিছু সুবিধাবাদী শ্রেনীর লোক আছে যারা এটাকে আধুনিক ব্যাবসায় বিপননের সকল রকমের তরিকা ব্যবহার করে এটাকে পুঁজি কারার চেস্টা করেন। এমন সংবেদনশীল ঘটনাগুলোকে পুরুষতন্ত্র, মোল্লাতন্ত্র, জিহাদী, ফতোয়া, রাজাকার, জামায়াত-শিবির, বিএনপি, সংখ্যালঘু, আওয়ামীলীগ ইত্যাদি ট্যাগ ব্যবহার করে ব্রান্ডিং করেন। যা অনাকাংখিত। এতে করে বিষয়গুলো সমাজে একটা শ্রেণীর মানুষের প্রতি আরেকটা শ্রেনীর মানুষের মুখোমুখি অবস্থান তৈরির যথেষ্ট প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। রুমানার ঘটনাও এর বাইরে নয়। পত্র-পত্রিকা, ব্লগে এটাকে পুরুষ শাসিত সমাজের একটা নোংরা বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আর আমরা সাধারন পাঠকরা এতে করে বিভ্রান্ত হচ্ছি। মূল সমস্যাকে প্রাধান্য না দিয়ে এসব ট্যাগিং কে বিশেষ গুরুত্ব দিই। এমন সংবেদনশীল নিউজ ও মন্তব্য প্রতিবেদনগুলো পড়ে নিশ্চয় আমাদের দেশের নারীসমাজের আবেগী মনকে নাড়া দিচ্ছে এবং তারাও হয়তো ভাবেন সমাজটা আসলেই পুরুষের এজন্যই তারা মেয়েদের নির্যাতন করে। তবে কি আমার ছেলে, আমার স্বামীও এর বাইরে নন। আজ হয়তো তারা ভালো, কালতো ভালো নাও থাকতে পারে, কারন তারা পুরুষ এবং সমাজ পুরুষ শাসিত। তাই আমি বলতে চাই এই ট্যাগিং বানিজ্য সমাজের জন্য কোন মঙ্গলের বিষয় নয়। নারী-পুরুষকে পরস্পরের বিপরীত অবস্থানে আনা বা মুখোমুখী দাঁড় করানো উচিত হবেনা। আমাদের বুঝতে হবে সমাজটা নারীর একার না, সমাজটা পুরুষের একার না, সমাজটা নারী-পুরুষ সকলের। আমাদের সকলের সমান অধিকার এ সমাজে। নজরুল বলেছেন,
''সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোন ভেদাভেদ নাই
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যান কর
অর্ধেক তার করিয়েছে নারী, অর্ধেক তার নর।''
নৈতিকতা ও আইনের শাসন
উপরেল্লিখিত দুটি বিষয় আলোচনা করা অপ্রাসংগিক নয় বলে মনে করছি।
আমাদের রাস্ট্র আছে, আছে সরকার, আছে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহীনি, আছে বিচার ব্যবস্থা, আছে সংবিধান। আমাদের সবই আছে। তবু কেনো আমরা লিমন কিংবা রুমানাদের নিরাপত্তা দিতে পারছিনা? কেনো রুমানা সাত দিন ধরে হাসপাতালে থাকার পরও তার পরিবার আদালত বা পুলিশের কাছে গেলোনা? কেনো আমরা সাইদের মতো হাজারো পশুকে নিবৃত্ত করতে পারছিনা? কারন আমাদের সব থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রয়োগে দূর্বল। দেশে আইনের শাসন নেই। মানুষের মধ্যে নৈতিকতা নেই। সরকার রাজনৈতিক হরতাল, বিরোধী দল দমন বা জামায়াত-শিবির পীড়নে যতটা যত্নশীল ও দৃঢ় ততটা যত্নশীল নয় সাধারন মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে। আজ রুমানাকে হত্যাচেস্টা, সনজিতার আত্মহত্যা, প্রতিনিয়ত ইভটিজিং এর ঘটনা, হরতালের পূর্ব রাতে গাড়িতে আগুন ধরানো, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্নীতি এমনকি অধুনা ঘটে যাওয়া ২৮শে অক্টোবরে লগি বৈঠা দিয়ে রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ হত্যা কোনটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং একই সূত্রে গাঁথা। কারনে সমাজে আইনের শাসন নেই। বিচার ও শাস্তির ভয় নেই।
একটা অনুরোধ
পরিশেষে আমি সবার কাছে অনুরোধ করবো। আজ যারা রুমানার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত। তারা এ বিষয়টাকে নারী পুরুষ ডিসক্রিমিনেশান বা পুরুষ শাসিত সমাজ বলে ট্যাগায়িত না করে এটাকে সামাজিক সমস্যা মনে করে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন। কারন সমাজ যদি কখনো নারীতান্ত্রিক হয়েও যায় তখন যে অপরাধ ঘটবেনা এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেনা। আজ আমাদের ক্ষয়িষ্ণু সমাজে নৈতিকতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠ করা খুব জরুরী। এমন একটা সমাজ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন যেখানে কোন নারী প্রয়োজনে গভীর রাতেও টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ভ্রমন করতে পারে নির্ভয়ে। সেই স্বপ্নীল সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য, নৈতিকতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। সমাজে যেদিন মনুষত্ব আসবে সেদিনই কেবল রুমানারা নিরাপদে থাকবে। রাজপথে কোন হত্যাযজ্ঞ হবেনা।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১১ বিকাল ৪:৪৮