ধর্মীয় রাজনীতি কাকে বলে শেষ পর্যন্ত বোঝা হয়েই উঠলো না। যা দেখলাম সবই রাজনীতিতে ধর্মের জঘন্য ব্যবহার। অন্ততপক্ষে যে রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়া যায় বা দখল করা যায় তাতে ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রয়োগ সম্পূর্ণ অসম্ভব। সেখানে ধর্মকে আর দশটা রাজনীতিতে ব্যবহার্য উপাদানের পর্যায়ে নেমে আসতে হয়। রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ায়, অর্জনে বা দখলে যা যা ব্যবহৃত হয় তার চারভাগের তিনভাগই নানারকম ধোঁকাবাজী। নানান ধাঁধাঁয় জনতার চোখ ধাঁধিয়ে মর্তের মাল নিজস্ব পাতালে পাঠানো। এই জঘন্য অনৈতিক কূটচালের মধ্যে যখন জনসমাজে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের নৈতিক বিশ্বাসকে ব্যবহৃত হতে দেখি তখন তাঁকে ধর্মের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা আরো বেশী করে নিরিহ বিশ্বাসী মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে মনে হয়। এই মনে হওয়ার তালিকায় আমি একা নই এই সুসংবাদে আত্মতৃপ্ত অনুভব কৃশ হয়ে আসে প্রতিদিন আরো বেশী করে ধর্মকে রাজনৈতিক কূটচালে ব্যবহৃত হবার দু:সংবাদ থেকে।
উপনিবেশবিরোধী কৃষক আন্দোলনে ধর্মীয় শ্লোগান এসেছে। কিন্তু সেই শ্লোগানে আন্দোলনের ইস্যু কৃষক আন্দোলন থেকে ধর্মীয় আন্দোলনে বদলে যায় নি। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহও শেষ বিচারে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম হিসেবেই ইতিহাসে দেখা হয়। এদের কোনটারই "রাষ্ট্রক্ষমতা" দখলের উদ্দেশ্য সামনে ছিল না। আজকের পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠাণে যাকে প্রাতিষ্ঠাণিক রাজনীতি বলে, অন্তত ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে সংগঠিত যে সমস্ত প্রতিরোধে কোন একটি সুনির্দিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের শ্লোগান ব্যবহৃত হয়েছে, তার আওতাভুক্ত নয়। বেশীরভাগ আন্দোলন ছিল কার্যত: ধর্মনিরপেক্ষ,(এখানে ধর্মনিরপেক্ষতা অভিধানের অর্থে ব্যবহৃত, প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতার আখর হিসেবে নয়)।
প্রাতিষ্ঠাণিক রাজনীতিতে ধর্মীয় লেভেল সাঁটার কাজটি করেছেন প্রতিষ্ঠাণের কর্ণধারগণ। আরো খোলাখুলি বলতে গেলে ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ। এগুলোর মধ্যে খানিক নরম, আধা নরম, আধা চরম পুরো চরম সবগুলি হচ্ছে উনিশ শতকে উদ্ভুত খৃষ্টীয় ফান্ডামেন্টালিজমের নানামাত্রার পরীক্ষামূলক বাঁটোয়ারা। ক্ষুদ্র-অপরিপক্কবুদ্ধিতে যা বুঝি পুঁজিবাদ বিকশিত হতে মুনাফা হালাল করতে শুরুতে ধর্মবিরোধীতা করেছে, পরে শ্রমিক আন্দোলন ফুঁসে ওঠায় আর শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব অবিশ্বাসীদের হাতে যাওয়ায় তারা পরিকল্পিতভাবে রাজনীতিতে ধর্মকে ফিরিয়ে এনেছে। এতে মোট বিরোধের শক্তিতে একাধিক পকেট সৃষ্টি সহজ হয়, মুনাফার পথও পরিস্কার হয়। এই ছিল মোটামুটি ১৮৬০ দশক থেকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ৪৫ বছরের কথা। ১৯৯০ নাগাদ অবিশ্বাসীদের গড়া বিপরীত প্রতিষ্ঠাণ টিকে থাকতে পারলো না। পুঁজিবাদ নতুন সঙ্কটে পড়লো। এতকার ধরে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে তৈরী করা লাঠিয়ালদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এদের কাউকে কাউকে কোথাও কোথাও কাজে লাগতে পারে (পাকিস্তান,বাংলাদেশ) কিন্তু এর অনেকগুলিই ইতিমধ্যে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠেছে, তাদেরকে কি প্রক্রিয়ায় ম্যানেজ করতে হবে সেই পরিকল্পনায় নানা রকম নিরীক্ষা চলতে লাগলো। নিরীক্ষকরা নিজেরা খৃষ্টান পরিবারের লোক হওয়ায় তাঁরা ডিফল্ট খৃষ্টীয় সাম্প্রদায়িকতা ধারণ করেন। তাঁদের এই মনোভাব কিছু কিছু এলাকায়, বিশেষত আরব বিশ্বে, যেখানে জ্বালানীতেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করতে সাহবেরা গায়ের জোরে ইহুদীরাষ্ট্র বসিয়েছেন, সেখানকার রাজনীতিতে বিপরীতের শক্তি হিসেবে ইসলামী ধর্মবিশ্বাসকে সামনে নিয়ে আসে। যদিও মনোযোগ দিয়ে ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে আরব জাতীয়তাবাদ দীর্ঘ সংগ্রাম করে এসেছে সেটা পুরোদস্তুর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি ছিল। ধর্মের তকমা আঁটা সৌদী আরবই বরং আরব বিশ্বে বরাবর ইহুদী খৃষ্টানদের তল্পীবাহক হিসেবে কাজ করে এসেছে। অবিশ্বাসী আর উদারপন্থী(দর্শনের অর্থে)দের নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ রাজনীতির মারপ্যাচে আর বিশেষত ১৯৯০তে ভেঙে পড়া বিপরীত শিবিরের পতনে দূর্বল হয়ে আসে। সেই জায়গা হামাস-হিজবুল্লাহদের মতো "চরমপন্থী"দের হাতে চলে আসে। তবু আমি তাদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামীই বলবো। কারণ তারা লড়াই করছেন সাম্রাজ্যবাদের সাথে ধর্মের সাথে নয়। আর হামাস-হিজবুল্লাহর সমর্থকগোষ্ঠীতে বহু আরব খৃষ্টানও রয়েছেন।
এই ইতিহাস মোটামুটি সর্বজন বিদিত। সমস্যা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঠ্যাকাতে আফগানিস্থানে যেই মুজাহিদ বাহিনি তৈরী হয়েছিল পাকিস্তানের পেশোয়ার এলাকায় আঙ্কলস্যামের বসানো মাদ্রাসার তালিব অর্থাৎ ছাত্রদের নিয়ে, তাঁদেরকে কেন্দ্র করে আলকায়দা নামক গোপন সন্ত্রাসবাদী সংগঠণের কার্যকলাপ নিয়ে। তারা ঠিক কোথায় আছেন, কি করছেন এই বিষয়গুলি জনগণের কাছে আগাগোড়া অস্পষ্ট। সেই সাথে অস্পষ্ট তারা কারা সেই প্রশ্নও। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে আসলে কারা হামলা করেছিল সেটা কিন্তু পরিস্কারভাবে বিশ্ববাসী এখনো জানে না। বিশ্ববাসী আরো জানেনা আলকায়েদা আসলে কারা চালাচ্ছে। তাঁদের মেনিফেস্টো কি? বিশ্বের রাজনীতি সচেতন যে জনগণ একবার চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রাতিষ্ঠাণিক রাজনীতির স্বাদ পেয়ে গেছেন তারা কি করে আলজাজিরা টিভির অস্পষ্ট ফুটেজের আরো অস্পষ্ট বক্তব্যকে রাজনৈতিক ঘোষনাপত্র হিসেবে দেখতে পারেন?
বরং এর উল্টোদিক থেকে যদি আমরা এই পরিস্থিতিতে কে কতটা লাভবান হচ্ছেন তার হিসেব করি তাতে কিন্তু বোমাবাজরা চেতনে হোক অচেতনে হোক পুরনো মনিবের ওয়াফাদার হিসেবেই চিহ্নিত হন। লন্ডনের পাতাল রেলে বোমা মারলে সাম্রাজ্যবাদের যৌনকেশে নূনতম বিভঙ্গও ঘটে না অথচ মুসলমানদের একতরফা সন্ত্রাসী জাতি বলে দেখানো যায়। তাতে অনেকরকম লাভ। সাদাচামড়ার সাম্প্রদায়িক খৃষ্টানদের ভোট পাওয়া যায়, যাদেরকে নতুন করে গড়া জরুরি হয়ে উঠেছে প্রতিচ্যে নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়া শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে আর সুবিধা মতো জিওপলিটিক্যালী গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলিতে মৌলবাদের উত্থান দেখিয়ে সেটা ঠেকাতে বোমা মেরে দখল করার যুক্তি সাজাতে। হিজবুল্লাহদের উপর এই কারণেই বোমা পড়ে, সাহেবদের কাছে বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জামাই আদর এই কারণেই বাড়ে।
পুঁজিবাদ বিশ্ববাজার সৃষ্টি করেছে, বিশ্বরাজনীতিও সৃষ্টি হয়েছে তার সাথে। গত পৌনে দুশ বছরে সেই রাজনীতির জঘন্য মারপ্যাচে আমরা ধর্মকে একতরফা ধর্ষিত হতে দেখেছি। ধর্মের ভাবমূর্তী নীতিদর্শনের পরিবর্তে সন্ত্রাসের ইন্ধনদাতার জায়গায় এসে দাড়িয়েছে। নীতিদর্শন নিয়ে প্রচুর বির্তকের অবকাশ থাকলেও বলা যায় পৃথিবীতে এখনো তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় নি। একে বাঁচাতে হলে প্রথম কর্তব্য ধর্মমতগুলিকে প্রতিষ্ঠাণের কবলমুক্ত করা। ব্যক্তিজীবনে নৈতিকতার অনুশীলনে প্রয়োগই ধর্মের পবীত্রতা রক্ষা করতে পারে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠনিক রাজনীতিতে গেলেই সেটা নোংরা রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকবে।