গভীর রাতে দুটো মটোর সাইকেল এসে থামলো সন্ধ্যাজোলের বিশু বিশ্বাসের বাড়ির সদর দরজায়।
কোঠাঘরে শুয়েছিল বিশু। মটোর সাইকেলের শব্দ এবং আলো তার তন্দ্রা ছুটিয়ে দিলো।
জানালায় নিকষ-কালো অন্ধকার। কাত-হয়ে সেদিকে দৃষ্টিপাত করল বিশু। দেখলো, মটোর সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ানো একজন আরোহী চাপাস্বরে সঙ্গীদের কি-যেন বললো! তারপর জুতোর খটমট শব্দ তুলে দাঁড়ালো সদর-দরজার ধাপি-সিঁড়িতে।
লোকটাকে আর দেখতে পাচ্ছে না বিশু। শুনছে তার হাতে-ধরা দরজার শেকল বাজছে, ঝন-ঝিন-ঝিন!
ধাতব সেই শব্দের উত্তরে নিচের ঘর থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো--কে-এ-এ?
নিচের ঘরে শুয়ে থাকে সুচেতা ও মোম। যাদের কাছ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছে বিশু।
সুচেতার কর্কশ জিজ্ঞাসার জবাবে শেকল বাজানো লোকটা বললো--মাসীমা আমি সুমন, বোলপুর হাসপাতাল থেকে আসছি।
অনড় শরীরটিকে বিছানা থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলো বিশু। পারলো না। অন্ধকার রাতটিই যেন বিশাল কালো পাথর হয়ে চেপে ধরেছে তার শরীর। বলতে গেল--এত রাতে হাসপাতাল থেকে কেন?
তা-ও পারলো না। বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা কাশির দমক প্রবল বেগে বেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, শুনশান নিশুতি-রাত খান-খান করতে থাকলো।
শব্দ-সমুদ্রে উতালপাথাল বিশু যন্ত্রণার ঢেউয়ে কুঁকড়ে থেকে নিচের ঘরের দরজা খোলার শব্দ শুনলো। বেশ কিছুক্ষণ পরে মটোর-সাইকেল স্টার্ট করার শব্দে, অশ্রু গড়িয়ে পড়া চোখের দৃষ্টি জানালায় গলিয়ে দিলো বিশু। দেখলো, একটা মটোর সাইকেলের পেছনে পাশ-ফিরে বসা মোম।
যান্ত্রিক-গতির স্পর্ধায় এগিয়ে গেল ওরা। একসময় চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
তিতি-বিরক্ত বিশু যেন এতক্ষণ কন্ঠনালীতে মৃত্যুদূতের বজ্র-নিস্পেষণ টের পাচ্ছিলো, সে-কি শুধু মোমকে আড়াল করতে?
মোম চলে গেল, কাশি থেমে গেল। অবাক-কান্ড! মনে-মনে কষ্টের হাসি হাসে বিশু।
জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন তার সাথে ষড়যন্ত্রে মেতেছে।
কাশি থামলে নিজের রোগ-দীর্ণ শরীরটা ভারী মনে হয় না বিশুর। যন্ত্রণার ঘুণপোকারা লুকিয়ে পড়েছে। তবু ঘুম আসছে না। লাঠিতে ভর দিয়ে সিঁড়ির একধাপ
-দুধাপ গুণে নামতে ইচ্ছে করছে নিচে।
কার কাছে যাবে সে? সুচেতা নামের ওই কর্কশকন্ঠী মহিলা, যে একটু আগে সোমত্থ- মেয়েকে অচেনা পুরুষদের কাছে পাঠিয়ে দিলো তার কাছে? ছিঃ! তারচেয়ে মরণ ভাল।
বিশু নিশ্চিত, সুচেতা এতক্ষণ ঘরে খিল এঁটে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। যে মানুষটির গলায় সে একদিন হৃষ্টচিত্তে মালা দিয়েছিল তার বেদম কাশির আওয়াজ কি কানেযায়নি তার? সাতপাকে বাঁধা সেই মানুষটি বত্রিশ-বাঁধনের মায়া কাটালো কিনা, খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না? নাকি সে-ও শাদা-শাড়ির আকাঙ্খায় মনের চুড়ি ভাঙছে নিত্যদিন?
সারারাত এ-পাশ ও-পাশ করে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল বিশুর। জানালায় আছড়ে পড়া রোদ সেই ঘুমটুকু তাড়িয়ে দিলো।
লাঠি ঠকঠকিয়ে বিশু হেঁটে গেল গ্রামের শেষে মাঠের দিকে।
প্রাতঃকৃত্য সেরে বিশু এসে দাঁড়িয়েছে লালদিঘিরর পাড়ে। বিশাল দিঘি। তার জলে পানের পিক-রঙা শেওলা ভাসে। একপাড়ের ঘাটে মেয়েরা বাসন মাজে, অন্য পাড়ে দাঁত মাজে ছেলেরা। মানুষের আলোড়নে দুধের সরের মতো জমাট শেওলা সরে যায় দূরে।
বেশ কয়েকটা নিমডাল ভেঙে এল একজন কিশোর। বিশু তার দিকে হাত বাড়িয়ে
বললো--একটা দাঁতন দে বাবা।
--আপনাদের তো ব্রাশ করা দরকার জেঠু।
পাশ থেকে বলে উঠল একজন। তার কথায় অন্য দুজন হাসলো। কিন্তু যে ছেলেটি নিমডাল ভেঙে এনেছে,
সে একটা টুকরো এগিয়ে দিলো বিশুর হাতে। উজ্জ্বল চোখের মিস্টি- মুখ। তাকে চেনার চেষ্টা করল বিশু।
পারলো না। বললো--বেঁচে থাকো বাবা, ভগবান তোমার সহায় হোন।
দাঁত মাজতে-মাজতে বিশু ভাবলো--ডেঁপো ছেলেটা তাকে ব্রাশের কথা বললো কেন? ওরা কি জেনে গেছে
বিশুদের আর্থিক-সংগতি এখন ব্রাশ করার অবস্থায় পৌঁছে গেছে?
ঘাটে-থালা-বাসন মাজতে-মাজতে যে ছেলেমেয়ে-গুলি ফিসফিস করছে, তারা কি
মোমকে নিয়ে আলোচনা করছে? সকলের গল্পতে কি আলোচিত হচ্ছে মাঝরাতে
মোমের মটোর-সাইকেলে যাওয়া?
নিজের বাড়ির উঠোনে পা রেখে বিশুর মনে হলো, এটা কি তার নিজের বাড়ি? তাই যদি হয় তবে এখানে
তার সঙ্গে যারা বাস করে তারা তার কে? তাদের সঙ্গে
গ্রহান্তরের দূরত্ব কেন তার? তবে কি বিশু এখন থেকেই শ্মশানভূমির দাউ-দাউ অনুভব রপ্ত করছে তার পার্থিব শরীরে?
বারান্দায় চৌকি-তে বসে পায়ের উপরে পা ঠুকছে বিশু। কেটলি আর কাপ তার সামনে নামিয়ে রাখলো
সুচেতা। দাঁতে-দাঁত চোপে বিশু বললো--খাবো না।
সুচেতা বরাবর কম কথা বলে। বিশুর ক্ষোভ তার মনে গেঁথেছে কিনা বোঝা গেল না। নিস্পৃহ-স্বরে
সে বললো--কোথাও খেয়েছো নাকি?
--তোমরা যা শুরু করেছো, তার চেয়ে উপোষ থাকা ভাল। মেয়েটাকে পর-পুরুষের সাথে পাঠালে?
উত্তর না দিয়ে সুচেতা মুড়িভাজা উনুনের কাছে গেল। ছোট্ট গামলায় সদ্য-ভাজা গরম-মুড়ি তুলে,
তাতে সর্ষের তেল মাখাতে-মাখাতে বিশুর সামনে
এলো। রাখলো। আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে-মুছতে
বললো--একটা মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি, মোম গেলে সে বাঁচবে তাই পাঠালাম।
সহজ কথা-গুলি হাতুড়ির মত ঘা মারে বিশু বুকে। দাঁত কিড়মিড় বাড়ে। তোতলা-উচ্চারণে সে বললো
--তোমার মেয়ে কি ডাক্তার, ক-জনের জীবন বাঁচিয়েছে সে?
মুড়িভাজা উনুনের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে সুচেতা বললো--আমার মোম ডাক্তারের চেয়ে কম নয়,
অনেক, অ-নে-ক মেয়ের জীবন বাঁচিয়েছে সে!
হাত-পা কাঁপছে বিশুর। ভাবছে এরচেয়ে ওরা যদি তার গলার নলী কেটে দিতো, তা বুঝি এতো
যন্ত্রণার হতো না। মুখের আহার ফেলে লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ালো বিশু।
শিব-মন্দিরে গিয়ে খুব কাঁদলো বিশু। চৈত্র-সংক্রান্তিতে এখানে গাজনের মেলা হয়। তখন খুব ধুমধাম হয়। ভিড় জমে। বছরের অন্য-সময়ে সব ফাঁকা। শুনশান। বিশুর অশ্রুপাতে বুক-ওথলানো ব্যথার শব্দরাজি, নিরিবিলি মন্দিরের চার-দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে, ফিরে আসতে থাকলো তার কানে।
অতীতের মদ্যপায়ী বিশু যদি জানতো তার জন্যে এমন একটি দিন অপেক্ষা করে আছে, তবে সে মদ
ছাড়তো না। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্থ হতো না। জমি-জায়গা সব ফুরিয়ে গেছিলো বলে
তো সে মদ ছাড়েনি। নেশার হাতছানিতে মানুষ চুরি পর্যন্ত করে। বিশুও হয়তো করতো। কিন্তু করেনি।
তা শুধু মোমের কথা ভেবে।
একদিন বিশু দেখেছিল প্রভাতদা হাঁউমাউ করে কাঁদছে। মাতালের কান্ড ভেবে নিজের গেলাসে
মন দিয়েছে বিশু। কিছুক্ষণ পরে তার খেয়াল হলো অমন তো করে না প্রভাতদা কোনদিন।
চুপচাপ আসে। দু-তিন পাত্র খায়। দু-একটা কথা বলে। তারপর মিষ্টি চিবোতে-চিবোতে বাড়ি ফেরে।
প্রভাতের পাশে দাঁড়ায় বিশু।বললো--কি ব্যাপার
প্রভাতদা, আপনার আবার কিসের দুঃখ? আপনার
তো গোলা-ভরা ধান, গোয়াল-ভরা গরু, পুকুর-ভরা মাছ। দুই ছেলে চাকরী করে, মেয়ের বিয়েও শুনছি ঠিক হয়ে গেছে।
--সব ভেঙে গেছে বিশু, সব শেষ।
বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়লেন প্রভাত। কাঁদতে
-কাঁদতেই বললেন--আশীর্বাদ করা সমন্ধ ওরা ভেঙে দিলে। মেয়ের বাবা মাতাল, তাই বিয়ে হবে
না। কতদিন মদ খেয়েছি, তোমরা আমাকে মাতলামি করতে দেখেছো কোনদিন?
উপস্থিত ভিড়ে আওয়াজ উঠলো--না, না।
--তবু ওরা তাই বলছে। বাড়ির সকলে আমাকেই দুষছে। এখন আমি কি করবো?
ফের বুক-ভাঙা শব্দের অশ্রুপাতে কেঁপে-কেঁপে উঠলো প্রভাতের শরীর।
চুপিসাড়ে বেরিয়ে এসেছিল বিশু। তার মাতালমন বলছিল, মোম বড়ো হচ্ছে। বাবা মদ খায় তাই
প্রভাতদার প্রতিমার মতো সুন্দরী মেয়ের আশীর্বাদ করা সমন্ধ ভেঙে গেল। বিশু না শোধরালে মোমের
কি বিয়ে হবে?
শিবের থানে প্রতিজ্ঞা করে মদ ছেড়েছে বিশু। সুচেতা ও মোমের বিড়ি-বেঁধে সংসার চালানোর
প্রয়াসে শামিল করেছে নিজেকে।
প্রথম-প্রথম মদের আসরের জুড়িদাররা ডাকতো।এখন ডাকার কেউ নেই। প্রভাতদার আত্মহত্যার
খবর শুনে প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় পড়ে আছে রমেন। মহাদেবের ছেলে কলকাতায় চাকরী করে, সে
নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল তাকে। এখন নাকি বৃদ্ধাশ্রম হয়েছে মহাদেবের ঠিকানা। চোখের
সামনে শ্মশানে ও গোরস্থানে চলে গেল নিত্য ও বদু।
তিনজন মানুষের কায়িক শ্রমে সংসারের ভাঙা-চাকা কোন রকমে গড়াতো। তার-ই মাঝে বি-এ পাশ করলো মোম। তিনবার এস-এস-সি পরীক্ষায় বসলো। পারলো না। এখন সে রোজ সকালে বোলপুর যায়, টিউশনি পড়াতে। ফেরে সন্ধ্যায়। তাতে খারাপ কিছু দ্যাখেনি বিশু। তার মনের ভাংচুর শুরু হয়েছে গত তিনমাস।
একের পর এক টিভি, ফ্রিজ, শৌখিন-দ্রব্যাদি ঢুকছে মোমের ঘরে। বিশুর মনের খটকা ক্রমে আশঙ্কার রুপ নেয়। টিউশনিতে তো এত পয়সা নেই। তবে কি মোম আলাদীনের আশ্চর্য-প্রদীপ
পেয়েছে, নাকি ভুল পথে চলেছে সে?
মোমের ঘরের চাকচিক্য যত বাড়ে, ততই ছড়িয়ে পড়ছে বিশুর মনের মরচে শরীরময়। দীর্ঘদিনের অসংযম যে শরীরকে কাবু করতে পারেনি, তা এখন রোগ-বালাইয়ের বাস্তুভিটে।
মোম কতদিন বলেছে--চল বাবা, তোমাকে ডাক্তার দেখিয়ে আনি।
--না,না, ডাক্তারের কোন দরকার নাই। নেশা ছাড়লে এমনই হয় শুনেছি। ক-দিন পরে আপনা- আপনি-ই সেরে যাবে।
মোম আর সুচেতার জীবন থেকে ক্রমাগত নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে বিশু। একদিনও জিজ্ঞেস করেনি,এত পয়সা মোম পাচ্ছে কোথায়?
ঘৃণার এক ঘুণপোকা বিশুর সমস্থ উপলদ্ধিকে জর্জরিত করে হরদিন। তার মন বলছে- মোম
গলছে। সে আগের মত তরতাজা হয়ে বাড়ি ফেরে না। বিষঢালা সাপের মতো তার এখনকার ফেরা।
হাতে-ধরা ফলের প্যাকেট নেতিয়ে পড়ে। রক্তশূন্য মুখ, দু-চোখে অবসন্ন ছায়া।
তখন মোমকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুচেতা। গরম দুধ এবং ফলের রস খাওয়ানোর জন্যে
ঝুলোঝুলি করে। মোম আপত্তি করে--আমাকে একটু ঘুমোতে দাও মা, রেস্টের বড় প্রয়োজন এখন।
শিব-মন্দির থেকে বেরিয়ে বিশুর মনে হলো,প্রতিবাদের শক্তি শরীরে জমেছে তার। মাথার ঠিক ওপরে
সূর্য। বিশুর মগজের মতো তাপ ছড়াচ্ছে। পাপের প্রতিবাদ করার এই তো সময়। পায়ের নিচে ছায়া।
পৃথিবীর মায়া কেটে গেছে। প্রতিবিধান না হোক প্রতিবাদে হয়তো পাওয়া যাবে ঈশ্বরের ক্ষমা।
বাড়ি ফিরে বিশু দেখল মোম বাড়ি ফিরেছে।
বিশু দেখল, চৌকি উপরে বসে আছে নিস্তেজ মোম।
তার মুখের সামনে ফলের রসের গ্লাশ ধরেছে সুচেতা।ছুটে গিয়ে তাতে ধাক্কা মারলো বিশু।
সকাল থেকে গুম মেরে থাকা বিশু যে এমন আচরণ করতে পারে ভাবতে পারেনি সুচেতা। তার হাতের বাঁধন ছিটকে গ্লাস ছিটকে পড়লো শান-বাঁধানো মেঝেয়। ঝনঝন শব্দ তুলে ছত্রখান টুকরো-কাঁচে রুপান্তরিত হলো তা। হতচকিত সুচেতা উত্তেজিত স্বরে বললো--ফেল্লে কেন?
--বেশ করেছি, এটা আমার বাড়ি। নষ্টামী করতে হলে বোলপুরে গিয়ে সাইনবোর্ড ঝোলাও।
--মুখ সামলে কথা বলবে।
বিয়ের পর সম্ভবত এই প্রথম প্রতিবাদে সোচ্চার হলো সুচেতা।
--তবে-রে !
বলে সুচেতাকে ধরতে গেল বিশু। পারলো না। টলমল করে উঠলো তার দূর্বল শরীর। পড়ে গেল ছত্রখান কাঁচের টুকরোর উপর। অক্ষম আক্রোশে উঠতে গিয়ে ফের গড়িয়ে পড়লো কাঁচকুচির উপরে।
হতভম্ব মোম তার দূর্বল-কন্ঠে একবার মা একবার বাবাকে থামতে বলে ক্রমাগত চেষ্টা করছিল অশান্ত পরিবেশটিকে শান্ত করতে। বিশুর দ্বিতীয় পাতনে সে আর্তনাদ করে উঠলো।
বিরক্ত সুচেতাও আশা করেনি বিশুর এমন দশার।
সে মোমকে সাহায্য করতে গেল বিশুর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠা শরীরটা তুলে ধরতে। ক্ষত-বিক্ষত বিশু তার শরীর লক্ষ করে হাত-পা ছোঁড়ার চেষ্টা করতে-করতে গোঁ-গোঁ করতে শুরু করলো। চোখ উল্টে গেল তার।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে মৃত্যুদূতকে ধিক্কার দিচ্ছে বিশু।
আপনারও কি আমার মতো কব্জীর জোর কমে গেছে? আমি তো যেতেই চেয়েছিলাম। তারাপীঠ মহাশ্মশানের চিতায় আগুনের ফুলকি হয়ে যেতাম। দ্বরকা নদীর স্রোতে ভেসে যেত আমার অস্থি-কলস। আপনি পারলেন না। এখন দেখুন, আমার আধ-মরা মানুষের মত শুয়ে থাকা। রক্ত চলছে, স্যালাইন চলছে। কেন আপনি তার ভেতরে
বুদবুদ হয়ে ঢুকে পড়ছেন না? থামিয়ে দিচ্ছেন না আমার জীবনের ধুকপুকানি?
আমার প্রাণ কি পাষাণের চেয়ে ভারি?
বিশুর পাথর-চোখে অশ্রু জমে, গড়িয়ে পড়ে। রুমাল দিয়ে তা মোছে মোম। তার কাজল চোখ সজল হয়। ডাক্তার-নার্স এবং একদল তরুণ-তরুণী তাকে অভয় দেয়--ভয় নেই মোম, আমরা আছি। আরো রক্ত লাগে তো দেব। তোমার রক্তে কতজনের জীবন বেঁচেছে!
জ্ঞাণ ফেরার পর থেকে বিভিন্নজনের কন্ঠে নানা-ভাবে কথা গুলো শুনছে বিশু। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নাগরদোলায় উঠছে-নামছে সে।
বিকেলে রাউন্ডে এলেন ডাক্তার শরীফ। এলাকায় সৎ ও গরীব-দরদী রুপে যার খ্যাতি আছে। বিশু তাঁকে চুপিসাড়ে বললো--আমার মেয়ে কি খারাপ কাজ করে ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার শরীফ বয়স্ক মানুষ। গম্ভীর-প্রকৃতির। বিশুর জিজ্ঞাসায় মুচকি হাসলেন তিনি। বললেন--রক্ত বিক্রি করা আইনের চোখে খারাপ বৈকি। তবে মোমের কথা আলাদা। জানেন আমাদের বোলপুর সাব-ডিভিশনে মোম-ই একমাত্র এ-নেগেটিভ গ্রুপের ডোনার। কত প্রসূতির জীবন যে ওর আশ্চর্য
প্রদীপের ছোঁয়ায় বেঁচেছে তার হিসেব নেই।
ওষুধের পলিথিন ক্যারি-ব্যাগ হাতে মোমকে আসতে দেখে থেমে গেলেন শরীফ। চলে গেলেন অন্যদিকে।
মাথা নিচু করে টেবিলের উপরে ওষুধ রাখছিল মোম। বিশু তার কাঁপা হাতখানি রাখলো তার মাথায়।
অবাক বিশু দেখল পাষাণ-প্রতিমার মত তার মেয়ের চোখ জলে ভরে গেছে।
সে আরো অবাক হলো, যখন সে দেখলো, এতদিন আড়ালে থাকা সুচেতা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখেমুখে খেলা করছে খুশির রোদ।