একটা মাছি অনিল বাবুর চারপাশে উড়ছে। ঋণীতা মাছিটার দিকে তাকিয়ে আছে। মাছিটা কি নির্ভয়ে বারবার ঠিক কাকুর মুখের চারপাশে ঘুরছে, যেখানে চিনির দানা গুলো লেগে আছে! ঋণীতার হাতেও চিনি, এক মুঠো চিনি। কিন্তু মাছিটা তাঁর কাছে আসছে না! কি অদ্ভুত! মাছিটা বুঝে গেছে ঐ মানুষটার হাত তুলে তাকে সরানোর ক্ষমতা নেই, তাই সে মানুষটাকে নিয়ে ইচ্ছে মতন খেলছে! ঋণীতা তাকিয়ে আছে, উড়ন্ত মাছিটার দিকে আর নিথর হয়ে পড়ে থাকা তাঁর কাকুর শরীরের দিকে! এখন এই ছোট্ট মাছিটাও তাঁর কাকুর থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাধর, অনেক অনেক বেশি!! এই বুঝি মৃত্যু! এমনি বুঝি!
আরি! মাছিটা ভো ভো শব্দ করছে! ঋণীতার কানে এসে বাজছে শব্দটা! না এটা ভো ভো শব্দ না! খুব মিষ্টি আর ভরাট স্বর! এটাতো কাকুর গলার স্বর, হুম কাকুই তো! ঐ তো! কাকু ডাকছে! ঋণ ঋণ বলে! ঐযে চেয়ারটায় বসে! হুম...
‘কাকু, তোমার ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চা।সাথে আর কি আছে বলতো? না, না, এত সময় নেই জলদি বল আমার হাতে আর কি আছে?’
‘ভাঁজহীন আজকের পেপার।’
‘বারে! তুমি জানলে কি করে?’
‘তুই যেভাবে জানলি আমার চা খেতে ইচ্ছে করছিল, ঠিক সেভাবে।’
‘হুম, হয়েছে, খুব পেরেছ। এখন জলদি ওঠ। তোমাকে কতদিন আয়েশি ভঙ্গিতে চা খেতে দেখিনা! ওঠ, উঠে বারান্দায় গিয়ে চেয়ারে বসে পেপার হাতে নিয়ে চা খাও, আমি দেখব।’
‘হাহাহা, আমার পাগলী ঋণ! চল।’
‘কি ভাবছ কাকু?’
‘কই কিছু নারে মা!’
‘কাকু, তুমি দাদা বউদির ব্যবহারে খুব কষ্ট পাও তাইনা?’
‘ ও কাকু, তুমি চিন্তা করনা, আমি ইন্টারশিপ শেষ করেই আমাদের জন্য আলাদা সংসার সাজাবো, তুমি আমি আর মা। আমরা থাকবনা এখানে। তুমি মনে কষ্ট নিওনা কাকু!’
‘আর তোর যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন?? তোর স্বামীও তো আমাদের তাড়িয়ে দিবে রে ঋণ!’
‘তাহলে আমিও ওকে তাড়িয়ে দিয়ে তোমাদের কাছে চলে আসব।তুমি আমাদের জন্য কত কি করেছ! বাবা যখন চলে গেল তারপর আমাদের কথা ভেবে আর বিয়ে করনি! আর সেই তোমাকে ছেড়ে আমার থাকতে হবে!!! এমন পতিদেবের আমার কোন দরকার নেই কাকু! ’
‘হাহাহা, পাগলী ঋণ আমার!’
‘হুম। চা টা কেমন হয়েছে বললে না যে?’
‘খুব সুন্দর, শুধু যদি একটু চিনি.....’
‘সে কথা ভুলেও মুখে আনবেনা, তোমার জন্য চিনি একদম নিষিদ্ধ!’ কপট রাগ নিয়ে বলল ঋণীতা।
‘একটা দিন খেলে আর এমন কি!’
‘না, আমি পারবনা! রোগী হয়ে একজন ভাবী ডাক্তারকে সাধছ নিয়ম ভাঙ্গার জন্য! কাপটা দাও একটু লবণ দিয়ে আনছি।’
হাত বাড়াল ঋণীতা! তাঁর হাতে এখনও চিনি লেগে আছে, সে ভাল করে দেখল, হুম চিনিই তো, কিন্তু সেতো লবণ আনতে গিয়েছিল!! মাথা তুলল ঋণীতা, কাকুর শরীরটা এখনও নিথর হয়ে পড়ে আছে, মাছিটা উড়ছে , ভন ভন ভন করে!! না না, ভন ভন করছে না! এ অন্য কিছু বলছে, এ অন্য কেউ!
মাছিটার ডাকে তীব্র ঘৃণা, হুম ঘৃণা! খুব ধারালো শব্দ, না না শব্দ না চিৎকার , হুম চিৎকার! বউদির চিৎকার! হুম, বউদি, ঐ তো বউদি, চিৎকার করছে, চিৎকার করছে, কাকুর সাথে!! কি যেন বলছে!! কাকু কাঁদছে! কাকু তো কখনো কাঁদেনা! না কক্ষনো না! কাকু সেই ছোট্টটি থেকে এত বড় করেছেন, কক্ষনো কাঁদেননি! বাবা যখন মারা গেলেন, তখনও না!! কাকু কাঁদছেন!! হুম! ঐ যে, বউদি কাকুর দিকে আঙ্গুল উচিয়ে কথা বলছেন, কাকু বসে আছেন, কুঁজো হয়ে, কাকুর চোখে জল! কাকু মাথা নিচু করে... হুম, ঐ তো!! বউদি চিৎকার করছে, বুড়ো ভাঁড়, বুড়ো ভাঁড় বলছে, বোঝা, ঝামেলা , উটকো,বাজে এই কথা গুলো ঋণীতার কানে আসছে! ঋণীতা এসব শুনতে চায়না, না,না,না! সে কান পেতে আছে, কাকুর মুখে ঋণ শুনবে বলে! কই কাকু ডাকছেননা, ডাকছেননা কাকু... কাকু কুঁকড়ে যাচ্ছেন, কাকু ছোট হয়ে মুখ লুকিয়ে আছেন!!!
ঋণীতার চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো!মাছিটা এখনও উড়ছে! কাকুর মুখে ঢুকে যেতে চাচ্ছে! নাহ, অনেক হয়েছে! ঋণীতা উঠে দাঁড়ালো। চিনি গুলো হাত থেকে ঝেড়ে ফেলল। পাশে রাখা ইলেকট্রিক ব্যাটটা হাতে নিল। এখন শুধু একবার বাটনটা চেপে ধরার কাজ! ব্যাস!! সব শেষ!!!
কাকুর পাশে এখনও খালি ইনজেকশন গুলো পড়ে আছে, আর ইনসুলিন এর খালি বোতল গুলো! কাকুর রোজ রাতে ইনসুলিন নিতে হত। সেজন্য কয়েকটা বোতল সবসময় ঘরে রাখা হত! কাকু আজ এক সাথে সব ইনসুলিন ভেতরে নিয়ে নিলেন, রোজকার ঝামেলা শেষ করে ফেললেন! ঋণীতা দৌড়ে চিনি এনে মুখে দিয়ে দিয়েছিল, শেষ চেষ্ঠা! কিন্তু হলনা! কিচ্ছু হলনা!
ঋণীতা খালি ইনজেকশন গুলোর থেকে একটা হাতে উঠিয়ে নিল। এর ভেতর এখন শুধু বাতাস আছে, ভর্তি বাতাস। ঋণীতা জানে এখন সে কি করবে! সে জানে! সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো, সে বউদির ঘরের দিকে হাঁটছে। নাহ!! আজ করিডর টা এত লম্বা লাগছে কেন! অনেক লম্বা!! ঋণীতা এর শেষ দেখার অপেক্ষায় আছে, সে জানে এর শেষেই সব কিছুর একটা পরিপূর্ণ শেষ আছে তাই!!
জানালায় দুটি চড়ুই বসে আছে। চড়ুই দুটি ঘোর লাগা চোখের অতি মায়াবী একটি মেয়েকে করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখছে, দেখছেই!!!
উৎসর্গ- ছোটচা, তোর মনে আছে সেই ছোট্ট বেলার কথা! যখন আমি স্কুলে যেতাম! মনে আছে? তুই রোজ আমায় আনতে যেতিস, একটা লাল সাইকেল নিয়ে! সেই সাইকেলে করে আমরা বাসায় ফিরতাম! আর মনে আছে, লাল আইস্ক্রিম এর কথা? দুজন মিলে খেতাম, কে আগে শেষ করতে পারবে সেই খেলাটা? তোর মনে আছে বট গাছের ডালে ঝুলে পড়ার কথা? মনে আছে তোর কাছে শিখে মাকে ভাবী বলে ডাকতাম! মনে আছে তোর? কিচ্ছু মনে নেই না? তুই সব ভুলে গেলি! শুধু কষ্ট গুলো মনে রাখলি! তুই ছিলি সবচে ছোট, কিন্তু তবু তুই সেই আহ্লাদ টুকুন নিতে পারতিস না, ইমু ছিল দাদুর আদরের, লাল সাইকেলটাও ইমুর ছিল, মাঝে মাঝে তুই নিতিস! তাই তোকে দাদুর বকা শুনতে হত! কেক কেটে ইমুর জন্মদিন হত, তোর হতনা রে! জানিস, পুরনো ছবি গুলো বের করে আমি পাগলের মত তোকে খুঁজি, কিন্তু পাইনা খুঁজে! সব খানে ইমুর ছবি, তুই কোথাও নেই রে! দাদু নাহয় তোকে ইমুর থেকে কম ভালবাসত, তো কি হয়েছে বলতো?? আমি, মা, দাদি, বাবা, ফুপিরা সবাই তোকে কত ভালবাসি না?? তুই আমাদের ভালবাসা ভুলে গেলি! এত অভিমানী কেন ছিলি তুই? জানিস, তোকে আমার ফটিকের মত লাগে! কতদিন যে সেই গল্পটা পড়ে আমি তোর জন্য কাঁদতাম! তুই জানতিস এসব?? নাহ, তুই তো ভুলে গেছিস, সব ভুলে গেছিস!
আমি অনেক বড় হয়ে গেছি জানিস? তোর থেকেও বড়। আর কিছুদিন পর চাকরি করতে পারব এত বড়! তখন আমার অনেক টাকা হবে জানিস? ছোট বেলায় এই টাকা গুলো থাকলে তোকে আমি একটা টুকটুকে লাল সাইকেল কিনে দিতাম, তারপর তুই আর আমি ঘুরতাম, দুর দুর, অনেক দুর। আর তোর জন্মদিন করতাম, বিশাল একটা কেক এনে, আর এক অ্যালবাম ভর্তি শুধু তোর আর তোর ছবি রাখতাম! কিচ্ছু করতে দিলিনা তুই! তোকে যেদিন নিয়ে গেল, সেদিন আমার চিৎকার শুনেছিলি? কতবার ডাকলাম তোকে! তুই আসলিনা! কে যেন বলল তুই ফিরে আসবি, আমি বিশ্বাস করে কান্না থামিয়ে লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে ছিলাম! কই! তুই তো আসলিনা! জানিস, তারপর অনেক দিন আমি তোর অপেক্ষায় ছিলাম! অনেক দিন! তুই আসিসনি! আর কোন দিনও আসবিনা , তাইনা? তুই এমন কেন রে?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ৮:৪১