এই ভোরেও হোটেলের মেইনগেইট খোলা। রহস্যটা উম্মোচিত হলো একটু পরেই যখন আমি ডাল লেইকের পাশে পাশে দৌড়ুতে লাগলাম। শ'য়ে শ'য়ে কাশ্মিরী - বয়সের ভেদাভেদ ছাড়াই সবাই হাঁটছে, দৌঁড়াচ্ছে ডাল-লেইকের পাশ ধরে। কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর ঠান্ডা মোটামুটি সহনীয় হয়ে এলো। ডাল লেইকের ঘাটগুলো নাম্বারি করা। এই ভোরে সেইসব ঘাট স্বাস্থ্য -উদ্ধারকারী কাশ্মিরীদের দখলে। উল্লেখ যোগ্য যেটা দেখলাম তা হলো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিন্দুমাত্রও শিথিল নয় অফুষ্ঠ এই ভোরেও।
স্বচ্ছতোয়া ডাল লেইকের অভ্যন্তরে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ, ছোট-ছোট রুপোলি মাছ খেলছে সেই গুল্মলতা ঘিরে ঘিরে । হঠাৎ দেখলাম তুলতুলে ছোট ছোট বালিহাঁসের কয়েকটি ছানা জলকেলিরত ।জুম লেন্স সাথে ছিল না, তাই মোটামুটি কাছে গিয়ে ছবি তুলবার জন্যে যেই ক্যামেরা তাক করেছি, সাথে সাথে তাদের দীর্ঘ ডুব সাতাঁর শুরু হয়ে গেল, এইখানে ডুব দেয় তো দুরে ওখানে গিয়ে ওঠে। শেষে ব্যর্থ হয়ে হোটেল রুমে ফিরে সবাইকে জাগিয়ে দিলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে দলবেঁধে মোড়ের ছোট্ট নাস্তার দোকানটিতে ছোলাবাটুয়া ও গরম গরম পুরি সহকারে ব্র্যাকফাস্ট সারলাম। রুম ফিরে আধঘন্টার মধ্যে সবাই তৈরী হয়ে নিলাম গুলমার্গ যাওয়ার জন্যে---ইতিমধ্যে আমাদের ড্রাইভার রিয়াজভাই আমাদের জন্যে বরাদ্দ টয়োটা-ইনোভা নিয়ে হাজির। শুরু হলো গুলমার্গ যাত্রা.....
যেহেতু কলকাতা থেকে কেনা প্রিপেইড সিম কা্শ্মিরে অচল, তাই রিয়াজভাই আমাকে উনার থেকে একটি সিমকার্ড ধার দিয়েছিলো গতকাল সন্ধ্যায়। রাতেই ইন্টারনেট একটিভ করে রেখেছিলাম। গাড়িতে বসেই অত্যাধুনিক জিপিএস সুবিধা চালু করে দিলাম।রিয়াজভাইকে ডানে-বামে ড্রাইভিং ডিরেকশন দিতেই সে অবাক বিস্ময়ে আমাকে জিঙ্ঘেস করলো আমি আগে কাশ্মির এসেছি কিনা। আমি তাকে আমার এন্ডয়েড ফোনে গুললের ডিরেকশন দেখালাম।বললাম দিন অনেক পাল্টে গেছে...এখন জায়গা না চিনলেও জিপিএস চিনিয়ে দেবে। নো চিন্তা-ডু ফুর্তি....।
গুলমার্গ
কাশ্মিরে ভ্রমনার্থীদের জন্যে বড়ই উদ্রেকের বিষয় হচ্ছে পথে পথে টোল পরিশোধের এর ঝামেলা, যা গাড়ীর আরোহীকেই বহন করতে হয়। কোথাও একশ, কোথাও পঞ্চাশ কোথাওবা বিশ রুপি না দিলে রাস্তার উপর পড়ে থাকা বাঁশের ব্যারিকেড উঠবে না। এররকম প্রায় তিনটি ব্যারিকেড পেরিয়ে আমাদের ইনোভা পৌঁছালো গুলমার্গ জিপ স্ট্যান্ডে। গাড়ি পার্কিয়েরও ১০০ রুপি। গাড়ি থেকে নামতেই একঝাঁক ঘোড়াওয়ালা ঘিরে ধরলো, গুলমার্গ ঘুরিয়ে দেখাবে আর যেহেতু গেন্ডোলা (রোপওয়ে-কার) বন্ধ তাই বরফের কাছে নিয়ে যাবে। আসার আগেই এই ঘোড়াওয়ালেদের প্রতারণার ঘটনা পড়েছিলাম তাই ওদের কথায় কান দিলাম না। দু'জন কাশ্মিরী পুলিশ এগিয়ে আসতেই জিঙ্ঘেস করলাম সত্যি সত্যি গেন্ডোলা বন্ধ কিনা। ওরাও জানালো রিপেয়ারিং এর জন্যে ফেইজ ওয়ান ও ফেইজ টু অভিমুখি গেন্ডোলাই বন্ধ। ভগ্নচিত্তে আমরা হাটঁতে লাগলাম, পিছনে পিছনে হাঁটছে ঘোরাওয়ালারা। পরিস্থিতিটা অনেকটা এই রকম, আমরা ঘোড়া নিবো না আর ওরা আমাদের ঘোড়ায় চড়িয়েই ছাড়বে। আমরা চুপচাপ হাঁটছি আর ওরা পেছন থেকে নানারকম মন্তব্য করছে---"কতটুকু পায়ে হেঁটে যেতে পারবে দেখা যাবে, কিছুই দেখতে পারবে না---ইত্যাদি। কিছুক্ষনপর একজন ঘোড়াওয়ালা একজন পুলিশকে নিয়ে আসলো আমাদেরকে বোঝাতে যে হেঁটে হেঁটে গুলমার্গ দেখা যায় না। পুলিশটিও আমাদের ইনিয়ে-বিনিয়ে বোঝাতে লাগলো যে গুলমার্গ-দর্শনে ঘোড়ার গুরুত্ব। অবশেষে আমি ও নোমান দরদাম করতে লাগলাম, শুরুতে একটি ঘোড়া ৮০০ রুপি বললেও আমরা বললাম ১০০ রুপি। শেষে অনেক বাগ-বিতন্ডের পর প্রতি ঘোড়া ২০০ রুপিতে রফা হলো শুধুমাত্র নারী ও শিশুদের জন্যে। আমি ও নোমান পায়ে হেঁটেই রওনা হলাম ওদের পিছুপিছু। প্রথমে গেলাম চিলড্রেন পার্কে। গলফ-কোর্টের মতোই সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ, চারপাশে পাইন ট্রি-এর নন্দিত শোভা, মধ্যখানে কৃত্রিম পাথুরে লেইক। মাঠের মাঝে মাঝে বসবার জন্যে কারুকার্য শোভিত মেটাল বেঞ্চ । বন্ধের দিন হওয়াতে মোটামুটি অনেক কাশ্মিরী পিকনিক পার্টি সেখানে ভিড় করেছে পরিবার-পরিজনসহ। সবার সাথেই দুপুরের খাবার-দাবার আর গ্যাস-স্টোভ ও পুরো গ্যাস-সিলেন্ডার (জীবনে এই প্রথম এমন ব্যবস্থা দেখলাম), পরে অবশ্য এর যথাযথ কারণটা অনুধাবন করলাম। এখানে এখন গড় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৭ ডিগ্রি (দিনের বেলায়), তাই ঘর থেকে বানিয়ে আনা খাবার-দাবার ঠান্ডায় জমে যাওয়ায় খুব স্বাভাবিক। তাই গ্যাস-স্টোভ ও সিলিন্ডারই একমাত্র গরম খাবারের নিশ্চয়তা দিতে পারে শীতল এই আবহাওয়ায়। আমাদের পক্ষে তো বাংলাদেশ থেকে গ্যাসের চুলা বা সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বিস্কিট ও ঠান্ডা পানি সহযোগে আমাদের মিনি লাঞ্চ সারলাম, পার্কে বসে।কিছুক্ষন পর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর জন্যে রওনা হলাম গেন্ডোলা স্টেশনের দিকে। চড়তে না পারি অন্তত: স্টেশন আর কারগুলো দেখে আসি। গুলমার্গে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্প ঘুরে রোপওয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে পার্শ্ববতী দেশ পাকিস্থান-বর্ডার সংলগ্ন পর্বতচুড়ায় অকস্কাৎ কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা গেলো। জলবতী মেঘ, করাৎ-করাৎ শব্দে বাজ পড়ছে থেকে থেকে। আমার উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলাম। কারন এই ঠান্ডার মধ্যে যদি বৃষ্টিতে ভিজে যাই তাহলে আমাদের শিশুদের তো বটেই এমনকি আমরা বুড়োখোকাখুকিরাও নিউমোনিয়া হওয়া ঠেকাতে পারবো না, যেহেতু আমাদের সাথে বাড়তি কোন পোশাক নাই। তাই ঘোড়াওয়ালাদের বললাম তাড়াতাড়ি কোন আড়ালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। তারা আমাদের আশ্বস্থ করলো এই বলে যে বৃষ্টি ঠিক ওই পর্বতমালার উপরই ঝরবে, খোলা এই উপত্যকায় পড়বার সম্ভাবনা খুব কম। ঘোড়াওয়ালাদের ভবিষ্যতবানী সত্যি হলো জোরালো এক পশলা বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি ধোঁয়াশা পর্বতগুলোকে মিনিট পাঁচেক ভিজিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। শুকনো অবস্থাতেই আমরা গেন্ডোলা স্টেশনে পৌঁছলাম।
গুলমার্গে পর্বত চূড়ায় কালো মেঘের ঘনঘটা
স্টেশনে পৌঁছুতেই দেখলাম বিশাল লম্বা লাইন। ওরেবাবা সবাই কি আমাদের মতো দুধের-স্বাদ ঘোলে মেটাতে এসেছে নাকি। স্টেশনের সিকিউরিটি গার্ডদের জিঙ্ঘেস করতেই আসল সত্য বেড়িয়ে এলো। ফার্স্ট-ফেইজে গেন্ডোলা ঠিকই চলছে, শুধুমাত্র মেন্টেনেন্স-এর জন্যে সেকেন্ড-ফেইজই বন্ধ। প্রথমেই ধরলাম ঘোড়াওয়ালাদের আমাদের মিথ্যা তত্ত্ব দিয়ে প্রতারনা করার জন্যে। আমাদের অভিযোগ তাদের কানে গেল কিনা ঠিক বোঝা গেল না , কারন তখন তারা উদাস ভঙিতে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কি আর করা, নোমানকে পাঠালাম তাড়াতাড়ি টিকেট কিনতে। টিকেট কেটে প্রায় ঘন্টা-দেড়েক লাইনে দাঁড়ানোর পর আমাদের পালা এলো গেন্ডোলা চড়ে ফাস্ট-ফেইজ তথা খিলানমার্গের পর্বত চুড়ায় পৌঁছানোর জন্যে। একেবারে খাড়া পর্বতের ঢালে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে রোপওয়ের টাওয়ার । ধীরে ধীরে রোপওয়ে উঠছে আমাদেরকে নিয়ে আর আমরা জীবনে প্রথমবার গেন্ডোলা চড়ার উত্তেজনায় রিতিমত লাফাতে লাগলাম একটি মাত্র তারের উপর ভাসমান এই যন্ত্রের পেটের মধ্যে বসে। সাথে সাথে সটসট করে এর ছবি ও, ওর ছবি এ তোলা হচ্ছে---ডিজিটাল ক্যামেরার আদতই তো আলাদা ! মোটামুটি বিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম খিলানমার্গে। গেন্ডোলা স্টেশন থেকে বেরুতেই প্রচন্ড ঠান্ডায় অন্তরাত্মা কেপেঁ উঠলো। এই ভরদুপুরে এখানকার তাপমাত্রা এখন মাত্র পাচঁ থেকে ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতে না জানি কি অবস্থা দাড়াঁয় !!
আমাদের লাইট লাঞ্চ অনেক আগেই হজম, খিদেয় সবার পেটে ছুঁচো ডন মারছে। তাই যেমন হোক, কারো জন্যে নুডুলস, কারো জন্যে ফ্রাইড রাইসের অর্ডার দিলাম অস্থায়ী একটি হোটেলে। প্রচন্ড ঠান্ডা তাই একেবারে চুঅে থেকেই সরবরাহ হচ্ছে আমাদের আইটেম গুলো। খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে খিলান মার্গের নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে দেখতে সমান তালে চললো ছবি তোলা। এর মাঝেই পরিচিত হলাম কিছু কাশ্মিরী যুবকের সাথে। কাশ্মিরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারনা পেলাম তাদের কাছ থেকে। চিরশীতের রাজ্যখ্যাত খোদ কাশ্মিরেই নাকি এমন জায়গা আছে যেখানের গড় তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস !! কত অজানারে......
খিলানমার্গ থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ নেমে আসা পাহাড়ী সন্ধ্যা আমাদের পেয়ে বসলো। অন্ধকারের সাথে সাথে ঠান্ডাও নামছে সমান তালে। রিয়াজ ভাইকে বললাম তাড়াতাড়ি গাড়ী নিয়ে আসতে।আপেলের ভরা মরশুম এখন। গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে পাশ্ববর্তী আপেলবাগান থেকে প্রায় পচিঁশ-কেজি ওজনের একপেটি আপেল কিনলাম মাত্র ২০০ রুপি দিয়ে। রাত প্রায় আটটার দিকে শ্রীনগর শহরে পৌঁছে প্রথমেই রেস্টুরেন্ট-করিমসে কাশ্মিরী বিরানী নামে অখাদ্য খেলাম। কেউ যেন ভুলেও এই রেস্টুরেন্টে না ঢুকে। ইতিমধ্যে সেইদিনের জন্যে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছি। তাই হাল্কা পায়ে হেটেঁই হোটেলে ফিরলাম। ফিরেই সবাই সোজা বিছানায়।আগামীকাল আমাদের গন্তব্য সোনমার্গ । চলবে
সোনমার্গ
বেতাব সিনেমা খ্যাত বিখ্যাত বেতাব ভ্যালি
সোনমার্গ থেকে ফেরার পথে চিলড্রেন পার্কের সামনে
যুসমার্গে একজন কাশ্মিরী ঘোড়াওয়ালা
অপূর্ব কাশ্মির
সোনমার্গের কাছাকাছি
আরুভ্যালির পথে
পহেলগাঁ থেকে জম্মু ফেরার পথে
সোনমার্গ থেকে শ্রীনগর ফেরার পথে
কাশ্মিরের আরেকটি নদী
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৪৯