টিভি রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, শুনলাম "বন্ধুরা আমাকে SMS-এর মাধ্যমে ভোট দাও, যতখুশি তত" বা এধরনেরই কিছু একটা। খটকা লাগলো, যতখুশি তত? ভোট শব্দটার অর্থ মনে করার চেষ্টা করেছিলাম সেদিন, একজন ব্যক্তি যতখুশি তত ভোট কিভাবে দেয়? বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের মত সবাই জালভোটে অভ্যস্থ হয়ে যাচ্ছে নাকি? যাহোক বাচ্চাদের অনুষ্ঠান; উদ্যোক্ত হয়তো নির্বোধ টাইপের কেউ হবে ভেবে চিন্তা বাদ দিয়েছি। পরে বুঝলাম- ভুল ভেবেছি, উদ্যোক্তা এখানে নির্বোধ না। তিনি তার বানিজ্য বুঝেন এবং একই সাথে জানেন এই দেশে সাদাসিধা মানুষের সংখ্যা কত যারা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে SMS এর পর SMS দিতে থাকবে। বলা বাহুল্য SMS বানিজ্যে তাদের রমরমা অবস্থা। যুগে যুগে সহজ-সরলদের ভাঙিয়ে ধান্ধাবাজরা খেয়ে যাবে, অবাক হওয়ার কিছু নাই।
যারা কমপক্ষে একবছর ধরে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন তারা অবশ্যই অনলাইনে মিলিওন ডলার কামানোর বিশাল সুযোগটা একবার হলেও পেয়েছেন এবং উত্তেজিত হয়েছেন। তাদের দোষ দেব না, ১৯৯৮ সালে আমি প্রথম এরকম মিলিওনিয়ার হওয়ার সুযোগ পাই। জনৈকা দক্ষিন আফ্রিকানবাসীর পুরো ফ্যামিলি মরার আর জায়গা পায়নি, বাংলাদেশে এসে তাদের বিমান ক্রাশ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে তাদের কোটি কোটি টাকা আমাকে তুলে দিতে হবে সেটা, তাহলেই নাকি অর্ধেক আমার। বিরাট উত্তেজনার বিষয়! সাথে সাথে মেইলটা ফরোয়ার্ড করলাম আমেরিকায় পড়ালেখা করতে যাওয়া ভাই-বোনদের কাছে। তারা আমাকে নিয়ে হাসতে হাসতে বিষম খেলো। হবু মিলিওনিয়ার বলে ক্ষেপাতে শুরু করলো। SSC পরিক্ষা সামনে ছিলো তাই কিছুদিনের জন্য ইন্টারনেট মোডেম আম্মুর ড্রয়ারে তালাবদ্ধ হলো, আমারো আর মিলিওনিয়ার হওয়া হলো না। পরিক্ষার পর মেইলবক্সে প্রায় একইরকম গোটাদশেক মিলিওনিয়ার হওয়ার অফার। Yahoo-তে সার্চ দিলাম(তখন পর্যন্ত গুগল আসেনি) প্রথমবারের মত জানলাম- Scam এবং Spam এর সংজ্ঞা। এরপর আর কখনো ভুল হয়নি।
এরপর অনেক সময় পার হয়েছে। ২০০৭ এর কথা, Seven Natural Wonders of the World নামের একটা সাইট নিয়ে কিছুদিন খুব হৈচৈ হলো। পৃথিবীর ওয়ান্ডারই নাকি বদলে দিচ্ছে তারা, পিরামিডের সিন কাটা! সার্চ করে জানলাম ঘটনা- ইন্টারনেটে ভোট করে ওয়ান্ডার বদলে দেয়া, ছেলেমানুষি বৈকি! গার্ডিয়ানের রিপোর্ট দেখলাম - "The Seven Wonders should be chosen by a cultural institution, not the average man on the street.."। তাইতো, রাস্তা-ঘাট থেকে যেকেউ একটা সাইট বানিয়ে ভোট নিয়ে ওয়ান্ডার বানিয়ে দিলেই হলো নাকি! অবৈধভাবে UNESCO-র নাম ব্যবহার করছে দেখে UNESCO সাফ জানিয়ে দিলো- এটা ব্যক্তিউদ্যোগে করা প্রতিযোগীতা, এর সাথে ইউনেস্কোর কোন সম্পর্ক নাই। New 7 Wonders of Nature Campaign is a scam () শিরোনামের একটা আর্টিকেলে প্রমাণ সহ বলা হলো- New7Wonders campaign is a scam that the media should pay attention to. একই রকম গোটা দশেক রিপোর্ট পড়লাম, সবকটাতেই পরিষ্কার প্রমাণ আছে। UNESCO-র বরাত দিয়ে নিউজও আছে, অনলাইনে সার্চ করলেই পাওয়া যাবে।
তবে অনলাইনে সার্চ করলে যেমন অনেক তথ্য-যুক্তি-প্রমাণ পাওয়া যাবে যা প্রমাণ করে এটা নিছক একটা ধান্ধাবাজী ছাড়া আর কিছু না তেমনি অনলাইনেই পাওয়া যাবে এদের স্বপক্ষে শত শত ওয়েবব্লগ, লিঙ্ক। SMS আর ভোটিং বানিজ্য করে এরা ততদিনে মিলিওন মিলিওন ডলার কামিয়ে ফেলেছে। সেই টাকার ঠিক কতটা অংশ এরা মেসি, কাকা, বাংলাদেশের মন্ত্রী, আমলা, মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবিদের কিনতে ব্যবহার করেছে জানি না তবে এরা এই কাজে সফল। সুতরাং এদের পক্ষে বিপক্ষে অনলাইন লিঙ্ক প্রদান বন্ধ করে চলুন কিছু তথ্য জানি ও মস্তিস্কটা ব্যবহার করি-
১) শুধুমাত্র ইন্টারনেটে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করা কোন কিছুকে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ধরা হয় না, কোনদিন হওয়ার সম্ভবনাও নাই। ইন্টারনেটে ভোটাভুটিতে ফাঁকি দেয়া সহজ এবং আরো অনেক কারণে এটা গ্রহণযোগ্য না।
২) new7wonders.com সাইটটির ভিজিটর আমাদের সামহোয়্যারইন ব্লগ থেকেও কম। এদের আলেক্সা রেংক ৬ হাজারের উপরে, সামহোয়্যারইন ব্লগের আলেক্সা রেংক ৩০০০ এর ভেতরে। বিশ্বের অন্যতম কম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একটি দেশের ব্লগ সাইটের চাইতে যাদের ভিজিটর কম তাদের সাইটে আমার সুন্দরবন আর কক্সবাজারের ছবি ঝোলানোর জন্য কোটি কোটি টাকার SMS অপচয়, আফসোস! তারচাইতে সামহোয়্যারইন ব্লগে সুন্দরবন আর কক্সবাজারের ছবি পোস্ট করুন, আরো বেশি মানুষ জানবে।
৩) আলেক্সার ট্রাফিক পরিসংখ্যান দেখুন- http://www.alexa.com/siteinfo/new7wonders.com .. New7wonders.com’s Regional Traffic Ranks-এ কোন দেশ থেকে সবচাইতে বেশি ভিজিটর এরা পেয়েছে তার পরিসংখ্যান আছে, সেই তালিকায় প্রথম ২০ জনের ভেতরেও পৃথিবীর সবচাইতে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দেশের নাম নাই।
৪) এদের সাইটে কয়েক বছর টানা বাংলাদেশের দু'টো স্থান প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলো। আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৫% ও যদি এসব ধান্ধাবাজিতে বিশ্বাস করতো তাহলে একসপ্তাহও লাগতো না শুধু আমেরিকা বা অষ্ট্রেলিয়ার সবগুলো স্থানের এই লিস্ট দখল করতে।
৫) আন্তর্জাতিক মানের কোন প্রতিষ্ঠান এই ন্যাচারাল ওয়ান্ডারকে স্বীকৃতি দেয়নি। গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল ভাব নিয়ে এরকম ৭ ওয়ান্ডার্স আপনি আমি যেকেউই ঘোষণা দিতে পারি, তাতে পৃথিবীর কিছু যায় আসে না।
যাই হোক, এরকম অনেক যুক্তি প্রমাণ আছে। সবচাইতে বড় কথা এটা একটা ব্যক্তিমালিকানায় নেয়া উদ্যোগ যার কোন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নাই। এরকম একটা বিষয় নিয়ে ভাবলেও সময় নষ্ট, SMS করে পকেটের টাকা নষ্টের তো কোন কারণই নাই। শুধু কিছু ধান্ধাবাজ মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবি টাকার জন্য এদের পক্ষ হয়ে আমাদের সহজসরল জনতাকে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে দেখে খারাপ লাগে। নষ্টদের দখলে চলে যাওয়া এই বাংলাদেশের মিডিয়া আর বুদ্ধিজীবিদের ধান্ধাবাজীতে আজকাল আর অবাক হইনা, তবে সত্যিই খুব আহত হয়েছি মুনির হাসান স্যারের মন্তব্যে। তাঁর মত একজন বুদ্ধিমান লোকের কাছে এটা একদমই আশা করিনি, বিশেষত যখন সবাই তাঁকে আইটিবিশেষজ্ঞ হিসেবে জানে-
আশা করি শীঘ্রই তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারবেন এবং মন্তব্যের জন্য লজ্জ্বিত হবেন।
ভাল থাকুন সবাই, সবসময়।
--
কিছু রিলেটেড লিঙ্ক-
-
- প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক প্রতারনা
- ফেসবুক নোট ও মন্তব্য
- ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মন্তব্য
- N7W is a SCAM and Lebanon Should Pull Itself Out IMMEDIATELY