পর্ব-২
৩১ শে মে, ১৯৮১।
ট্রেনের রাত্রির যাত্রা আমার এক্কেবারে পিচ্চি থাকতেই ভীষন পছন্দ। ট্রেনের দুলনিতে খুব গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি। এখনো যেখানে ঢাকায় থাকতে রোজ ঘুমুতে ঘুমের অষুধের প্রয়োজন হয়-কিন্তু তূর্ণা নিশিথা চলা শুরু করার পাঁচ মিনিটে ঘুমিয়ে পড়ি, সেখানে সে রাতে ঠায় বসে রাত পার করে দিলাম। স্টেশনে নেমে কোন বাহন না পেয়ে হেঁটে শাসনগাছা পর্যন্ত এসে একটা রিকসা ঠিক করতে পারলাম। পাহাড়ের ঢালে, আমার মেসের কাছে যখন রিকসা থেকে নামলাম, তখন ঘড়িতে (সেল ফোনের যুগ শুরু হবার পর ও বস্তু আর ব্যাবহার করা হয় না) সকাল চারটা বিশ। দ্রুত ইউনিফর্মে তৈরি হয়ে ইঊনিটে (সেনাদলের সেনানিবাসের অবস্থান) গেলাম। পুরো ইঊনিট খা খা করছে। শুধু সহ অধিনায়কের অফিসে বাতি জ্বলছে। সহ অধিনায়কের কাছে যেতেই উনি বল্লেন; " তোমার আসার খবর বিকেলের দিকে ব্রিগেড সদর থেকে পেয়েছি, সাথে তোমার সংযুক্তির আদেশ। তোমাকে ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের অস্থায়ী জি এস ও-৩ {অপারেশন সংক্রান্ত নিয়োগ যা তখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সবখানের পদাতিক ব্রিগেডে suspended animation (পোস্ট ছিল নিয়োগ ছিল না)এ ছিল} নিয়োগ দেয়া হয়েছে আজ পূর্বাহ্ন থেকে। ব্রিগেড ট্যাক্টিক্যাল হেড কোয়ার্টার এখন ফেনী শহরে, বি ডি আর সদর দপ্তরে। সকাল সাতটার মধ্যে তুমি ব্রিগেড মেজরের সামনে উপস্থিত থাকবে।
একটা পিক আপে আমার সমস্ত সম্পত্তি ( ২ জোড়া ইঊনিফর্ম, ২ টি ট্রাউজার, ২টি শার্ট, ২ টি সর্টস, ২ টি টি-শার্ট, ১ জোড়া চপ্পল আর আমার প্রাণ প্রিয় ছোট্ট একটি কেসেট প্লেয়ার সাথে অনেক কেসেট) নিয়ে আমি আমার গাড়ি চালক আর ওয়্যারলেস অপারেটরকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
বি ডি আর সদর দপ্তরে ব্রিগেড মেজর (বি এম)আমকে অপারেশনাল ব্রিফিং দিলেন। যার সার কথা ছিল সেনা সদর থেকে ৩৩ পদাতিক ডিভিশনকে দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছে চিটাগাং এর ২৪ পদাতিক ডিভিশনকে আত্ম সমর্পন করানো। ৩৩ পদাতিক ডিভিশন সে দ্বায়িত্ব দিয়েছে ৪৪পদাতিক ব্রিগেডকে। ভোর পাঁচটায় ৬ ইস্ট বেংগল (অধিনায়ক মুক্তি যোদ্ধা লেঃ কর্ণেল শাহ মোহাম্মদ ফজলে হোসেন, ৩০ শে সেপ্টেম্বর '৮৩ তে শারিরিকভাবে সম্পূর্ণভাবে অনুপযুক্ত অবস্থায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়)এর এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন হায়দার ৭০ জন সৈনিক ও ২ জন জে সি ও (নায়েব সুবেদার/সুবেদার/সুবেদার মেজর) নিয়ে শুভপুর সেতু পার হয়ে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। শুভপুর সেতুর এপারে আমার সেনাদল আর ওপাড়ে ৬ ইস্ট বেংগল- একে অপরের দিকে অস্ত্র তাক করে আছে আগের দিন থেকে। আমার কাজ হবে আত্মসমর্পনের পুর্নাংগ ব্যাবস্থা, তদারক ও নিশ্চিত করা। আমি উত্তরে বললাম যে ২৪ পদাতিক ডিভিশন কুমিল্লা, যশোর ও রংপুরের সম্মিলিত ডিভিশনের সমান। ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের মতো অসম্পূর্ণ একটা ব্রিগেড কিভাবে সে ডিভিশনকে সারেন্ডার করাবে? উনি পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন "এত বিশ্লেষনী ক্ষমতা থাকতে আমি কেন বুদ্ধিজীবী না হয়ে সেনা বাহিনীতে আমার পশ্চাদদেশ ঘষতে এলাম (to rub your ass)?
আমার অস্থায়ী অফিসে স্থিতু হয়ে বসতে না বসতেই ক্যাপ্টেন হায়দার (আমার ছয় মাসের জেষ্ঠ)ঢুকলেনঃ একটা মাইক্রো রিকিউজিশন করো (৪৪ পদাতিক ব্রিগেডকে ততক্ষণে সে ক্ষমতা পেয়ে গেছে) আমি ওপার থেকে মেজর দোস্ত মোহাম্মদ শিকদারকে {৬ ই বেংগলের সহ অধিনায়ক, repatriated (পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত )} ঊঠিয়ে নিয়ে আসি, সাথে ব্যাটালিয়ানের গুরুত্বপূর্ণদের। তাহ'লে আপনা আপনিই ডিফেন্স খালি করে সবাই চলে আসবে এপাড়ে। একটা ২২ সিটার মাইক্রো আনা হ'ল তাতে ট্যাংক ভর্তি করে পেট্রল ভরে ক্যাপ্টেন হায়দার চলে গেলেন। আমার রানার (বেসামরিক পিওনের সমার্থক বলা যেতে পারে) তিন ব্যান্ডের একটা ট্রাঞ্জিস্টার (রেডিও) নিয়ে আমার অফিসে ঢুকল। বি বি সি থেকে বলছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভারতীয় সেনারা অনুপ্রবেশ করছে। তাদের সংখ্যা বিশাল (with great strength) । আমি বি এম কে জানালাম। উনি তখনকার জনপ্রিয় ফিলিপস ২০ ব্যান্ডের একটা রেডিও কোত্থেকে যেন জোগাড় করলেন। আমর আবার শুনলাম।
ভয়াবহ পরিস্থিতি। পার্বত্য চট্টগ্রামের কোন সেনা দলের সাথে আমাদের কারো যোগাযোগ নেই যে আমরা খবরটি যাচাই করবো। গুজব বলেও ঊড়িয়ে দিতে পারছিনা- বি বি সি বলে কথা! অনুমান করছি যে রাষ্ট্রপতির ঘোষনা শুনে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধরত সবাই কুমিল্লার পথে। এদিকে ডিভ সদর ও সেনাসদর থেকে ক্রমাগত চাপ আসছে সঠিক তথ্য জানানোর জন্যে।
ব্রিগেড অপারেশন রুম (অপস রুম)। চার দেয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাঁদ পর্যন্ত নানা মাপের ম্যাপ-চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের। ইন্টেলিজেন্স হাবিলদার তার সহকারী নিয়ে চিটাগাং ডিভের deployment (সেনা মোতায়েন) আঁকতে ব্যাস্ত।, যদিও সে deployment ততক্ষণে কাগুজে, আসলে কে কোথায় কেউই জানেনা। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান (পরে মেজর জেনারেল, তুরস্কে রাষ্ট্রদুত থাকা অবস্থায় প্রয়াত, দেলদুয়ারের Theif of Bagdad নন), বি এম, বি ডি আর ব্যাটালিয়ান কমান্ডার মেজর বিখাঊজ, ত্থুক্কু মেজর দাউদ (তখন বি ডি আর ব্যাটালিয়ান গুলো কমান্ড করতো মেজররা) আর আমি। সবাই মিলে উপায় বের করার চেষ্টা করছি। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমি ছাড়া আর যারাই তখন অপস রুমে -সবাই প্রত্যাগত, এমনকি ব্রিগেড কমান্ডারের রানার পর্যন্ত!
হঠাৎ বি এম বলে উঠলো ' স্যার! বি ডি আরের ওয়্যারলেস নেট ওঅর্ক তো খুবই শক্তিশালী, আমরা ওদের সেট দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি না কেন? তাছাড়া হিলে তো ওদেরও deployment আছে। শুরু হয়ে গেল কাজ। বি ডি আরের ছিল তখন ফিক্সড ব্যান্ড সেট- CD- 100. চারটি ব্যান্ডে কথা বলা যেত। ঝকঝকে নতুন ছোট্ট ব্রিফ কেসের মত দেখতে এ সেটগুলোর রেঞ্জ ছিল বিশাল। এক ঘন্টার মধ্যেই বের করা গেল যে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঘটেনি। আমরা সেটা ডিভ ও সেনা সদরকে জানিয়ে দিলাম।
আমার অফিসে আসতে না আসতেই ক্যাপ্টেন হায়দার হাজির। সাথে মেজর দোস্ত মোহাম্মদ শিকদার, ৬ ই বেংগলের কম্পনি অধিনায়ক মেজর ইসমত(প্রত্যাগত) ও ক্যাপ্টেন ইলিয়াস {জাতিয় রক্ষী বাহিনী (JRB)}. এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুধু মাত্র মেজর দোস্ত কে। তিনি এপারে আসতে চাচ্ছিলেন না। ক্যাপ্টেন হায়দার তাকে জোর করে বন্দুকের মুখে নিয়ে এসেছেন। মেজর দোস্ত মোহাম্মদকে ছোট্ট একটা ঘরে বন্ধ করে পাহারার ব্যাবস্থা করলাম। ততক্ষণে ৬ ই বেংগলের সবাই ফেনী নদীর প্রতিরক্ষা ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আধঘন্টার মধ্যে আরেকটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ান এসে হাজির। তাদের থাকার জায়গা দেখিয়ে ফিরতে না ফিরতেই বিএমের অফিসে ডাক পড়লো। বিএম ও কমান্ডার দাঁড়িয়ে। বি এম আমাকে অতি নিরিহ গলায় বললেন " যে দুটো ব্যাটালিয়ান এসেছে আদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলা বারুদ নিয়ে নাও (disarm them)". আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। প্রথমতঃ তারা সবাই স্বেচ্ছায় এসেছে, দ্বিতীয়তঃ একজন সৈনিকের কাছে অস্ত্র সমর্পন আর একজন মেয়ের সম্ভ্রমহানী সমার্থক, তৃতীয়তঃ এই অসম্ভব প্রায় কাজটি জেষ্ঠ কারো করার কথা! ব্রিগেড কমান্ডার বলে উঠলেন " দেখ, আমাদের কিছু করার নেই, আদেশ সেনাসদর থেকে ডিভ হয়ে আমার কাছে এসেছে (Look young man, the order has come from the AHQ through Div, I'm undone)."
কিছু বলে কোন লাভ হবেনা বুঝে আমি হাঁটা দিলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম কিভাবে এ অসাধ্য সাধন করা যায়। ওদের ছাঊনি পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌছুতে একটা বুদ্ধি বের হ'ল। আমি দুই ব্যাটালিয়ানের দুই সুবেদার মেজরকে (সৈনিকদের সবচেয়ে ঊঁচু পদবীর)ডাকলাম। বললাম যে চিটাগাং থেকে যারা আসছে তাদেরকে জিয়া হত্যাকারী হিসেবেই সাধারন মানুষেরা মনে করছে (কথাটা অসত্য ছিল না)। জেনারেল জিয়ার যে পরিমান জনপ্রিয়তা, যে কোন সময়, সাধারন মানুষ তাদের ওপর চড়াও হতে পারে। হাতে আস্ত্র থাকলে অযথা রক্তপাত হবে। তাই তারা দুজন যেন ব্যাপারটা বুঝিয়ে সবাইকে বলে এবং একজায়গায় অস্ত্র জমা করে।
আমি যেভাবে আমার বি এমের দিকে তাকিয়ে ছিলাম ঠিক সেই দৃষ্টিতে ওরা দু'জন তাকালো আমার দিকে। আমার তখন যা বয়স, তাদের দুজনেরই সেনাবাহিনীর চাকুরী তার চেয়ে বেশী। আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম যে আধ ঘন্টা পর আমি আমার লোকজন নিয়ে আসবো ।
২৫ মিনিটের মাথায় তারা দুজন ফিরে এসে জানালো অস্ত্র ও গোলা বারুদ আমি নিয়ে যেতে পারি।
ক্যাপ্টেন হায়দারের একক সিদ্ধান্তের ফলে ৬ ই বেংগল শুভপুরের প্রতিরক্ষা ত্যাগ করায় চিটাগাং এর সৈন্যদের কুমিল্লার দিকে আসতে আর কোন বাঁধা থাকলো না। শুরু হ'ল বানের পানির মত ২৪ পদাতিক ডিভের ও চট্টগ্রাম এরিয়ার সৈনিক ও অফিসারদের আসা।
তাদের স্থান সংকুলানের জায়গা খোঁজার জন্যে আমি বের হ'লাম, সাথে ক্যাপ্টেন হায়দার। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন হায়দার বললেন " এই আমার স্টেনটা দেখেছ?" জীপ থামিয়ে আমরা দুজনই AK 47 এর চায়নিজ ভার্সানটি (SMG) খুঁজতে লাগলাম। কোথাও নেই!
আমাদের তখনকার জিওসি (General Officer Commanding; Division Commander) মেজরে জেনারেল আব্দুস সামাদ (প্রত্যাগত) হঠাৎ উদয় হলেন। খোঁজায় ব্যাস্ত থাকায় আমরা আগ থাকতে দেখিনি।
সটান দঁড়িয়ে স্যালুট দিলাম।" কি খুঁজছ তোমরা?" সেনা বাহিনীতে অস্ত্রের একটা ক্ষুদ্র অংশ হারানোই কবিরা গুনাহ, আস্ত একটা অস্ত্র হারানোর কথা কেঊ কল্পনাও করতে পারেনা। কিছুক্ষন ইতস্তত করে ক্যাপ্টেন হায়দার বলে উঠলেন " স্যার, আমি আমার স্টেন হারিয়েছি"
"স্টেন হারিয়েছে তো কি হয়েছে বাবা?" জেনারেলের উত্তর। অত সহজে পার পেয়ে আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম দু'জন।আসলে ক্যাপ্টেন হায়দার সেনাবাহিনীর জন্যে কি বিরাট একটা কাজ করে ফেলেছিলেন তা তিনি তখনো বুঝে উঠতে পারেন নি। আর পরেও(আজ পর্যন্ত) তাঁর সেই অবদানের মৌখিক স্বীকৃতিও কেউই দেয়নি। আর শ্বেত প্ত্রের সে মিথ্যাচারের কথা আর নাই বললাম। সারা জীবনে যত মিথ্যে শুনেছি সব এক করলেও শ্বেত পত্রের একটি পাতার মিথ্যে গুলোর সমান হবেনা।
বিকেলের একটু আগে ডেরায় ফিরলাম। আরেক আপদ। চিটাগাং এর সৈন্যরা যে সংখ্যক অস্ত্র জমা দিয়েছে সেগুলোর একটা ব্যাবস্থা করতে পারলেও রাইফেল, SMG (Sub Machine Gun, sten), LMG (Light Machine Gun), MG (Machine Gun) এর গুলি গোনা আর সম্ভব হচ্ছিল না। জনা পঞ্চাশ সৈনিক কয়েক ঘন্টা টানা গুনেও শেষ করতে পারছিল না। শেষে আমি একটা বুদ্ধি বের করলাম। বাজার থেকে দাড়ি পাল্লা ও পাঁচ কে জির বাটখারা কিনে এনে পাঁচ কেজি গুলি মাপলাম তারপর সে গুলি গুনালাম। তারপর পাঁচ কেজি হিসেবে মেপে মেপে গুলি গণনা শেষ করালাম।
রুমে যেতে যেতে দেখি ব্রিগেডের ডিকিঊ ( DAA&QMG: Deputy Assistant Adjutant & Quarter Master General) মেজর এমদাদ হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। লোকের রাতের (সন্ধ্যার) খাবার জোগাড় তখন হয় নি। কুমিল্লার সাপ্লায়ারেরা অপারগতা প্রকাশ করেছে। বুঝতে পারলাম ১ ব্রিগেড মাইনাসের খাবার প্রায় দুই ডিভিশন সৈন্যের সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হবে। সমস্যার সমাধান অচিরেই হয়ে গেল। চিটাগাং থেকে SSD (Station Supply Depot) সেদিনের পুরো তাজা রসদ নিয়ে শুভপুর পার হয়েছে। অনেক সৈন্যই সেদিন আধখান করে ইলিশ মাছ খেল।
সন্ধারগে আগেই সবাইকে রাতের খাবার খাইয়ে দেয়া হয়েছে। আমি আমার রুমে বসে ভাবছি বুট জোড়া বদলে নেবো কিনা, এমন সময় RP (Regimental Police) এসে জানালো চিটাগাং থেকে কিছু অফিসার এসেছেন, আমার সাথে দেখা করতে চান। আমি আবাক হলাম। চিটাগাং এর সব অফিসারই তো তাদের নিজ নিজ সৈন্য দলের সাথে এসেছে , আসছে। রুম থেকে বের হয়ে দেখি-আমার প্রাণ প্রিয় বন্ধু, কোর্সমেট লে. রফিক, আরেক বন্ধু মেজবাহ উদ্দিন সেরনিয়াবাত, সেকেন্ড লে. মোসলেহ ঊদ্দিন আহমেদ, আরো ক'জন। যশোরে একসাথে কমিশন পেয়ে পাশাপাশি ইঊনিটে, একই ব্রিগেডে যোগ দিয়েছিলাম আমি আর রফিক। তার সাথে যশোরের অভিজ্ঞতা লিখতে আমার হাজার দেড়েক পৃষ্ঠার প্রয়োজন, একজন আরেকজনের জন্যে দুপুরের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করা, ক্যাপ্টেন বেলালের (পরে ব্রিগেডিয়ার ও অবসরপ্রাপ্ত) বাসার খিড়কি দুয়ার দিয়ে ঢুকে তার স্ত্রীর সমস্ত রান্না চুরি করে এনে সাবার করা, সব সময় একই কাপড় পরে সারা যশোর চষে বেড়ানো- দড়াটানার মোড়, সিদ্দিক বেকারি, কারবালা, ঘোপ সেন্ট্রাল রোড, বন্দুক আলার বাড়ি, চুড়োমোন কাঠি, শার্শা, বারোবাজার, গাজী কালুর মাজার, চৌগাছায় স্বাধীনতা যুদ্ধের নিদর্শন দেখতে যাওয়া, শনিবার রাতে রিকশাওয়ালাকে সিটে বসিয়ে দুজনে পালা করে রিকশা চালানো, সারারাত প্রচন্ড গরমে (১১০ ডিগ্রি ফারেন হাইট) বাসস্থানের সামনের রাস্তায় শুয়ে শুয়ে পুরো volume এ গান শোনা-ABBA, Beatles, Bee gees.......... হঠাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত শীতল স্রোত বয়ে গেল। এদের কথাই কি বিচারপতি সাত্তার বলছিলেন "।.।।...।।...।একদল দূষ্কৃতকারী...... "? আমি পাথরের মত দাড়িঁয়ে থাকলাম।
'''দোস্ত, কিছু খাবার দে, দু'দিন ধরে না খাওয়া"। সম্বিত ফিরে পেয়ে আমি কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদারকে তলব করলাম। ব্রিগেড ট্যাক হেড কোয়ার্টারে আমি একা অফিসার। আমার সেনাদলের অফিসার্স মেস তখন ফেনী নদীর আশেপাশে। ব্রিগেড অফিসার'স মেস কোথায় জানিনা। আমি সৈনিকদের সাথেই খাই। কোয়ার্টার মাস্টারকে ওদের খাবারের যোগার করতে বলতেই সে যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বল্লো " স্যার, আমাদের খাওয়া দাওয়া তো শেষ , যা কিছু ছিল ফেলে দিয়েছি"। আমি ওর সাথে খাবার ফেলার জায়গটাতে গেলাম। একটা গর্তে কিছু ভাত, ডাল, সব্জি আর মাছ। আমি খাবার গুলো তুলে ধুয়ে নিয়ে আসতে বললাম। এক হাতে একটা বাল্টি আরেক হাতে ক'টা প্লেট নিয়ে কোয়ার্টার মাস্টার আসতে না আসতেই সবাই বালতির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
আমার ১৯৭৪ এর কথা মনে পরে গেল।
মোটা লম্বা বালাম খাতায় সবার নাম চড়ালাম। তারিখ ও সময় দিলাম। সাক্ষর নিলাম। আমি সাক্ষর করলাম। আবার তারিখ ও সময় দিলাম। আত্মসমর্পনের অফিসিয়াল রেজিষ্টার ওটা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ওরা সাধারন ক্ষমার সময় সীমার প্রায় ১২ঘন্টা আগে সারেন্ডার করেছে।
অন্যদেরকে আরেকটা রুমে জায়গা করে দিয়ে রফিককে আমার রুমে নিয়ে আসলাম। আমার একপ্রস্থ কাপর পরে আমার পাশেই সে শুলো। ক্যাসেটটা ছেড়ে দিয়ে গল্প করতে লাগলাম।
রাত বারোটা। আমার ঘরে টোকা পড়লো। আসতে পারি? মোসলেহ ঢুকলো। স্যার দু রাত ঘুমুতে না পেরেও ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ ক্রলেই দেখতে পাচ্ছি সে বিভৎস দৃশ্য। আমি জেনারেল জিয়া হত্যার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী।
ক্যাসেটে বেজে চলছেঃ
No more carefree laughter
Silence ever after
Walking through an empty house, tears in my eyes
Here is where the story ends, this is goodbye
Knowing me, knowing you
There is nothing we can do
Knowing me, knowing you
We just have to face it, this time we're through
Breaking up is never easy, I know but I have to go
Knowing me, knowing you
It's the best I can.।.।.।.।.।.।
-চলবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৭