
দীর্ঘ ৯ মাস পর সিলেট আসবো। স্বাভাবিক নিয়মে আমার উত্তেজনায় ৩ দিন ঘুম হবার কথা ছিলো না, কিন্তু অতিরিক্ত ব্যস্ত থাকার জন্য প্রতি রাতেই মরা কাঠের মত ঘুম। জার্নি ব্যাপারটা আমার খুবই পছন্দের। এ ব্যাপারে আমি সর্বভুক, অর্থাৎ প্লেন, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, নৌকা এমনকি ভ্যানেও আমার অরুচি নেই। দেড়-দুই বছর আগেও আমি চশমা পড়তাম, কিন্তু চরম বখাটে ছিলাম। মানে, রাত ২টার সময় ঘুম ভেঙ্গে যদি মনে হত সিলেট যাবো, সকাল ৭টার সময় উঠে ক্লাস টলাস বাংক করে সোজা সিলেট। একবার তো বাসের সামনে লাফ দিয়ে পড়ে দুই হাত তুলে সোহাগ কে থামিয়েছিলাম, আমাকে না নিয়েই চলে যাচ্ছিলো কিনা। এখন আমি চশমা পড়িনা, তবে অতিশয় ভদ্র। ১০ দিন আগে টিকিট কাটাই, গম্ভীর মুখে ডেট চেক করি, বাসায় ফোন দিয়ে জানাই। সেজন্য মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ। সড়ক দুর্ঘটনা সিকিমাত্র কনট্রোল করতে না পারায় বাধ্য হয়ে আমি ভদ্র মানুষ হয়ে গেছি।

ঢাকা-সিলেট বাস জার্নির মত রোমান্টিক জার্নি বাংলাদেশে আর দুইটা আছে কিনা সন্দেহ। উহু, ঢাকা-কক্সবাজার জার্নিও এত রোমান্টিক নয়। হ্যাঁ সেটা ঠিক, প্রতিবছর সকালে ঘুম ঘুম চোখে যখন দূর থেকে সমুদ্র দেখি কক্সে ঢোকার আগ মুহূর্তে, প্রত্যেকবার মনে কাঁপন লাগে- কিন্তু সে তো ক্ষণিকের জন্য। সিলেট যাবার প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করি। সিলেটের আকাশের সাথে আর কোন আকাশের তুলনা হ্য়না। সাধারনত আমি বেছে নিতাম বিকেল ৩টার বাস। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা-সাতটায় আমি থাকতাম সিলেটের কাছাকাছি। অসাধারন সেই আকাশ। কানে থাকতো অর্ণব অথবা নিকল ব্যাকের গান, চোখের সামনে লাল বেগুনী রঙের মাঝে অপূর্ব মেঘমালা- আহা। অদ্ভুত বিষন্ন হয়ে থাকতো মন, এরকম বিষন্নতা পাওয়া যায় কালে ভদ্রে। এবারে টিকিট কাটা হলো সকাল সাড়ে নয়টার; সব কৃতিত্ব স্বরাস্ট্র মন্ত্রীর। নিজের বাবাই দুই দুইবার ডাকাতির সম্মুখীন হবার কারনে সন্ধ্যা রাতে জার্নি করা আমার জন্য নিষেধ হয়ে গেছে।

জার্নিতে আমি সবসময়ই ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে উঠি। এমপিথ্রি প্লেয়ারে রোমান্টিক এবং হাউকাউ প্লে লিস্ট, ব্যাগে দুইটা বই (একটা রম্য,



“মা, এখন তোমরা কোথায়?”
“আব্বু আমরা রাস্তায়”।

আব্বু তাড়াতাড়ি ছোট বোনকে চাইলো। সে নিশ্চিত জানে যে আমি রাস্তা ঘাট কিচ্ছু চিনিনা, তার উপর বাসে উঠে প্রথম ২ ঘন্টা ঘুমাই, তারপরেও যে কেন প্রথমে আমাকেই ফোন দেয় আমি বুঝি না।
বাস ভর্তি বাচ্চা কাচ্চা-সব ঈদ করতে যাচ্ছে। ক্যাচর ম্যাচর, বাধ্য হয়ে ওদের দিকেই মনোনিবেশ করলাম। টুং টুং করে এসএমএসের আওয়াজ আসলো বেশ কয়েকটা। ছোট ভাই শাহরিয়ার ড্যানি আমার মত ডাইরেক্ট কথা বার্তায় বার্তায় বিশ্বাসী, সুতরাং তার এসএমএস, “আপু, গিয়েই ফেবুতে আপডেট দিবেন যে সুস্থ আছেন”। বন্ধু বোকা ছেলে নরম স্বভাবের, সে ঘুরিয়ে লিখলো, “বোঁজো! পৌঁছাইলা?” সকাল ১০ রওনা দিয়ে মানুষ ১২টায় কেমনে সিলেট পৌঁছায়? সুতরাং আমিও ডাইরেক্ট আন্সার দিলাম, “নো টেনশন, ত্রিনিত্রি ইজ স্টিল অ্যালাইভ”।

সারা দেশের মাঝে ব্যতিক্রম হয়ে আছে সিলেটের রাস্তা, কারন রাস্তা এখনো চমৎকার কাছে; এমনকি জামও ছিলো না। তবে সমস্যা হচ্ছে ছাগল আর গরু।



ভৈরব পার হয়ে কিন্তু আকাশে তখনো সূর্য। মন একটু খারাপ হলো, এমন কখনো হয়নি যে সিলেটের আকাশ আমাকে বৃষ্টি দিয়ে স্বাগত জানায়নি। এমনকি কড়া শীতের রাতেও মেঘের দল একটু হলেও বৃষ্টি নামায়, সবাই জানে যে আমি সিলেটের বৃষ্টি চরম ভালোবাসি। মন খারাপ ভাব কাটলো হবিগঞ্জ পার হয়ে। কথা নাই বার্তা নাই হুড়মুড় করে বৃষ্টি চলে এলো, আকাশ সাথে সাথে পালটে গেলো। হঠাৎ করে চমকে উঠলাম, সামনে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা?? না, মেঘগুলো এমনভাবে নিজেদের সাজিয়েছে যে মনে হচ্ছে ধোঁয়াশার আড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া উঁকি দিচ্ছে। অর্ণবের “হারিয়ে গিয়েছি” গানটা শুনতে শুনতে আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি, বাকিরা সবাই ঘুমায়।
হোটেলগুলোর মাঝে উজানভাটি আমার পছন্দের, কিন্তু গ্রীনলাইন থামে রাজমণিতে। নেমে বেজার মুখে হাঁটাহাঁটি করলাম, বাচ্চাগুলো মহা আনন্দে আইসক্রিম খাচ্ছে- দেখেই রাগ লাগলো।


সন্ধ্যায় নীরব ফোন দিলো, “আপু, আমি আর রাজা দুইজনেই রেডি”। আমি ভয় পেলাম, দুইজনের প্লান কি?



এবারে আরেক চিন্তায় পড়লাম। সেকালের মানুষ আমি; ডিজুস জেনারেশন তো আর না যে ফেবুতে একবার ছবি দেখেই চিনে ফেলবো। মাথা চুলকিয়ে বললাম,
“আচ্ছা ভাই নীরব, তোমার কি দাঁড়ি আছে?



নীরব খিক খিক করে হাসতে লাগলো, “না নাই”।
“দুই ঘন্টার মাঝে তো দাঁড়ির ব্যবস্থা হবে না, হবে?”

“আরে ধুরো আপু, আমি চিনবো। আপনার কাউরে চিনতে হবে না”।
উনুন বা চুলাকে সিলেটি ভাষায় বলে উন্দাল; রান্নাঘরও বোঝায়। রেস্টুরেন্টটা আমার অনেক প্রিয়। নীরব জানে আমি ফুডোগ্রাফির ইনঅ্যাকটিভ অ্যাডমিন এবং অন্ধ ভক্ত, একারনে সে বেছে বেছে রাত ২টা অথবা বিকেল ৪টার মত ওড টাইমে বিভিন্ন রকম খাবারের ছবিতে আমারে ট্যাগ করে। সেটা না পারলে স্ট্যাটাস দেয়, “গেলাম উন্দালে, খাইলাম মনের সুখে”। রো্যা রেখে এসব দেখে আমার মেজাজ সপ্তমে উঠে। উন্দালের সামনে দুইজনের থাকার কথা, গিয়ে সিকিউরিটি ছাড়া কাউকে পেলাম না। গেলাম ভেতরে খুঁজতে। দেখি দোতালার কোণায় দুইজন বসে আছে, যাদের ব্লগার কম রাগী মারদাঙ্গা বেশী মনে হয়।



আসল অচেনা রাজ্যের রাজাকে দেখে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো; অত্যন্ত বাচ্চা বাচ্চা ভালো মানুষ চেহারা। কোন সম্ভাবনা নেই মাইর টাইর খাওয়ার। সিলেটের স্কুল কলেজ জেনে খুবই পুলকিত হয়েছিলাম, কিন্তু আমার স্কুল না জেনে একটু মন খারাপ হলো। নীরব এসেই বললো, “অর্ডার দেন। সব খাইয়া ফালামু। রোযা না রেখেও আমাকে রো্যা থাকতে হয়, জীবন শেষ”।


“আপু, নতুন কি লিখছেন?”
মনে মনে বললাম, ইয়া নাফসি। মুখে বললাম, “ইয়ে মানে কোন টপিক পাই নাই এখনো”।


“মানে আপনার নতুন পোস্টের শিরোনাম এখনো ঠিক হয় নাই, নাকি?”
কি জ্বালা, এ ছেলে তো সাংবাদিকতায় পড়ে না বলেই জানতাম!
এবারে আমিও গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলাম, “আসলে আমি তো আর সিরিয়াস রাইটার না, যখন যেটা মনে আসে সেটাই লিখি”।


নীরবের আরো কিছু প্রশ্ন ছিলো হয়ত, কিন্তু তখনই রাজা পিছনের স্টার ওয়ান চ্যানেলে কি এক ট্যালেন্ট শো দেখে হেসে ফেলায় কথা বার্তার মোড় ঘুরে ট্যালেন্ট শোতে চলে গেলো। রাজাকে অনেক ধন্যবাদ।


এই কথা সেই কথা, ওহ, ফাঁকে খাওয়া দাওয়া চলে আসলো। এই খাবো সেই খাবো, পারলে চেয়ার টেবিল খাবো বলে অনেক আস্ফালন করার পর নীরব অতি কষ্টে একটা পরোটা খেয়ে বললো, “হ্যাঁ, অনেক খাইছি!” রাজামশাই প্রজাদের সামনে খাওয়া ঠিক হবে কিনা সেটা ডিসাইড করতে না পেরে সামান্য রাইতা আর কোকেই সন্তষ্ট ছিলেন। আমি চিন্তা করলাম, ভাগ্যিস আমি ইফতার করে আসছি বলে খেতে পারলাম না। নাইলে সবজীটা যেরকম ছিলো, আমি অবশ্যই কড়াইটা শেষ করে ফেলতাম। এরপর গিয়ে নীরব কাউ কাউ করতো, “ত্রিনিত্রি আপুর জ্বালায় আমি একটা বেগুনের টুকরাও পাইনাই”।




শাহজালাল ভার্সিটিতে শেষ গিয়েছি প্রায় দুইবছর হতে চললো। কথক পলাশ ভাইএর এক কিলো পোস্টটা পড়ে আবার ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। নীরব অবশ্য হাঁটার দাওয়াত দিয়ে রেখেছে, টাইম মিলাতে পারবো কিনা সেটাই ভাবছি। তবে এক কিলোতে যাই আর না যাই, এবার আমার এম সি কলেজে অবশ্যই যাবো। পুকুর ঘাটটাও আছে, লাইব্রেরীটাও নিশ্চই আছে; শুধু আমার আড্ডা দেয়ার সঙ্গী সাথীরাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। হায়, সিলেটের সেই দিন গুলি!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১:৫৬