
ছোটবেলায় আমার একটা মজার খেলা ছিলো। ভাত নিয়ে আসলেই আমি গম্ভীর গলায় বলতাম, “গল্প বলো, নাইলে খাবো না”।


যাযাবর হওয়ার কারণে আমার অনেক গুলো স্কুল, আর অনেক গুলো কাকের সাথে পরিচয়। দিনাজপুরের কাকেরা অতি ভালো ছিলো, ভাত দিলে ভাত খেয়ে চলে যেতো; হাউ কাউ করতো না। রাজশাহীতে যখন ছিলাম, বাসার কাছে ছিলো একটা বিশাল বট গাছ। তাতে না হলেও হাজার খানিক কাক থাকতো। সকালে কা কা রবে সবাই তিতিবিরক্ত। কিন্তু কাকের সংখ্যা যে এত, টের পেলাম এক বিকেলে। বিকেলে হাউ কাউ শুনে বারান্দায় গিয়ে দেখি পুরা আকাশ কাকের জন্য কালো হয়ে গেছে, আর সবাই পাগলের মত কা কা করেই যাচ্ছে। পরে আব্বু বললো, যে কোন কাক মারা গেলে নাকি সব কাক এভাবে জুটে ঝামেলা করে। পাক্কা কয়েক ঘন্টা ছিলো সেই অবস্থা। সিলেটের কাকেরাও মাই ডিয়ার টাইপই। এত জায়গার এত কাক দেখে, পর্যালোচনা করে দেখলাম, ঢাকার কাকদের মত পাজি কাক পুরা বাংলাদেশে নাই। এরা কাউকে ভয় পায় না, বরং নিজেরাই একেকজন গ্যাংলিডার!

কাউয়া ভালো না বাসলেও তাদের সাথে আমার কোন রকম দুশমনি ছিলো না। উলটে তারা আমাকে বিশেষ সুবিধা দিতো। কি রকম সুবিধা? তারা কখনো আমাকে তাদের টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করেনি। কিন্তু আমার পাশে যে থাকে, তারা এই সুবিধা পায়না। না হলেও ২০ বার এমন হয়েছে যে কাউয়া এসে আমার বন্ধুর শার্ট বা জামা অথবা আরো ভয়ংকর ভাবে চুলের সাড়ে দেড়টা বাজিয়েছে, কিন্তু আমি বিপদমুক্ত।


হোস্টেলের সামনে অনেকগুলো ডাব গাছ, আর সবই কাউয়ার দখলে। সকাল-বিকাল তো অবশ্যই, মাঝে মাঝে মাঝরাত্রে কা কা করে সবার মাথা ধরায়। পাজি কাক গুলি কিছু কিনলেই প্যাকেট ছোঁ মারার ধান্দায় থাকতো। প্রতিদিন ফুচকা না খেলে আমার আবার ঘুম ধরতো না, তাই আমার পিছেই লাগতো বেশী।



প্যাথোলজী ল্যাব থেকে প্রাক্টিকাল খাতা নিয়ে ফিরছি, হলের গেট দিয়ে ঢোকা মাত্র দেখি দুইটা কাক আমার দিকে তীর বেগে ছুটে আসছে। এক চিৎকার দিয়ে খাতা দিয়ে মুখ ঢেকে এক দিকে ডাইভ দিলাম। বদমাইস কাউয়া খাতার উপরে ডানার ঝাপটা দিয়ে চলে গেলো। কি অসম্ভব কথা! আমি তো হতভম্ব।




কিছুদিন পরে আবার একই ঘটনা। এক বন্ধুর সাথে বাইরে খাইতে যাবো, তা সেখানে আবার তার মহা হ্যান্ডসাম আরেক বন্ধু থাকবে। আমি আবার হিলে একেবারেই স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করিনা। মাঞ্জা মারার জন্য বাধ্য হয়ে পড়েছি, অতি সাবধানে হাঁটছি, আবার অ্যাকসিডেন্ট না ঘটিয়ে ফেলি।



বেশীদিন অপেক্ষা করতে হলো না, আবার ঘটনা ঘটলো। নাজনীন কে আমি দুই প্লেট ফুচকা ধরতে দিয়ে গিয়েছি রুমে ব্যাগ রাখতে। দোতালার সিঁড়ি ঘরের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আমি দেখলাম, ৩টা কাক নাজনীনের উপরে ঝাঁপ খেয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। উদ্দেশ্য একেবারে পরিস্কার, ভয় পেয়ে হাত থেকে প্লেট পড়লেই তারা প্লেট নিয়ে চম্পট দেবে। কিন্তু নাজনীন তো আর আমি না, সে হচ্ছে আমাদের হলের হ্যান্ড রেসলে দুই নাম্বার চ্যাম্পিয়ান। “বদমাইস কাক, তোরা জানিস আমি কে?” “দুইটার মাথা ধরে একেবারে দেয়ালের সাথে ঠুকে ঘিলু বার করে দেবো”- এই জাতীয় বাক্যবাণ দিতে দিতে সে অসীম সাহসিকতার সাথে কাউয়া তিনটার মোকাবিলা করতে লাগলো।



মাঝে কিছুদিন কাকেরা নিশ্চুপ। আমি চিন্তিত; এ অবশ্যই ঝড়ের পূর্বে শান্ত আকাশ। কিছুদিন পরেই কাহিনী ঘটলো। নাজনীন সন্ধ্যা বেলায় গোসল করে যাচ্ছিলো টিভি রুমে টিভি দেখতে, হল থেকে বেরুবা মাত্র পাজি কাউয়া তার মাথায় ইয়ে করে দিলো। রাগে নাজনীন তাড়া করলো, কিন্তু কাউয়ারে কে কবে আজ পর্যন্ত দৌড়ে ধরতে পেরেছে?


বৃটিশ কাউন্সিলের সামনের ডাস্টবিনে সবসময় এক গুষ্টি কাক বসে থাকে। এদের দেখলেই মানে মানে আমি রিক্সার হুড তুলি। কোন ভরসা আছে? একবার যাচ্ছি এক বন্ধুর সাথে, ওখানে এসেই তো আমি তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিলাম। সে খ্যা খ্যা করে হাসতে লাগলো। হাসি মুখেই ছিলো, কাউয়া সুন্দরমত তার কপালে ইয়ে করে দিলো।



এবারে একটি উপকথাঃ
কাক নিয়ে বেশীরভাগ গল্পে সে হচ্ছে ভিলেন। কিন্তু কানাডার উপকথায় কিন্তু কাককে ত্রাণকর্তা হিসেবে ধরা হয়। গল্পটা অনুবাদ করে দিলাম।
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। কানাডার উত্তরের শেষ মাথার আর্কটিক অঞ্চলের বাসিন্দা ইনুইটরা তখনো জানতো না দিন কাকে বলে। সারা বছরই থাকতো সেখানে রাত। সেই অঞ্চলে বাস করতো এক বুড়ো কাক। তার মুখেই প্রথম ইনুইটরা জানতে পারে যে পৃথিবীর অন্য পাশে আলো আছে। স্কুল ছুটি হলেই বাচ্চারা কাকের কাছে আবদার করতো দিনের আলোর গল্প বলার জন্য। একসময় সবাই এসে কাককে অনুনয় করে বলে তাদের জন্য দিনের আলো এনে দিতে। বুড়ো কাক মাথা নাড়ে, “আমার পক্ষে কি আর সম্ভব অত দূরে গিয়ে আলো আনা? ডানায় তো অত শক্তি নেই”। শেষ পর্যন্ত বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে কাক রাজি হলো।
দিনের আলো আনার জন্য যাত্রা শুরু করে সে। কত সময় ধরে যে সে উত্তরের কালো আকাশ আর তারার মাঝ দিয়ে উড়ে যায়, তার হিসাব কে রাখে? একসময় কাক যখন বিরক্ত হয়ে ভাবছে যে সে ফিরে যাবে, তখন সে দেখলো দিগন্তরেখায় আলোকরশ্মি দেখা যাচ্ছে। কাক নতুন উদ্যমে উড়ে চললো। হঠাৎ দিনের আলো তার সব সৌন্দর্য আর মহিমা নিয়ে উদ্ভাসিত হলো। কত রঙ আর রূপের যে খেলা চারিদিকে। মাথার উপর নীল আকাশ, তার মাঝে ধূসর মেঘ। চারিদিকে সবুজ গাছ। দেখে দেখে কাকের আশ মেটে না। দীর্ঘ যাত্রার পর বিশ্রাম নিতে সে এক গাছের ডালে বসলো। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো, সে এক ছোট্ট সাজানো গ্রামে এসেছে।
হঠাৎ কাক দেখতে পেলো একটি সুন্দরী মেয়ে নদী থেকে জল নিয়ে বাড়ী ফিরছে। কাক জাদুবলে নিজেকে ধূলার ছোট্ট কণায় রূপান্তরিত করে মেয়েটির ফারের কোটের সাথে আটকে রইলো। মেয়েটি ছিলো গ্রামপ্রধানের মেয়ে। বাড়ীতে ঢুকার পরে কাক দেখতে পেলো, গ্রামপ্রধানের ঘরের এক কোণে একটা বাক্স অদ্ভুত সুন্দর আলোয় আলোকিত। কাক তো সাথে সাথে বুঝতে পারলো যে এইটাই দিনের আলোর রহস্য। গ্রামপ্রধানের ঘরে ছোট একটা ছেলে খেলা করছিলো। কাক উড়ে গিয়ে ছেলেটার কানে বসলো।
ধূলা কানে যাওয়ায় ছেলেটা কান ঘষতে লাগলো। কিছুতেই বের না করতে পেরে কান্না জুড়ে দিলো। গ্রামপ্রধান ব্যস্ত হয়ে বললো, “কি হয়েছে সোনা? কি চাও তুমি”। কাক ছেলেটার কানে ফিসফিস করে বললো, “আমি ঐ আলোর বল দিয়ে খেলতে চাই”। ছোট ছেলেটা কাকের কথাই তার দাদাকে বললো। কান্না থামানোর জন্য তার দাদা তাড়াতাড়ি বাক্স খুললো। সেখানে দুইটা বল রাখা ছিলো। একটা বলের সাথে সূতা বেঁধে ছেলেটাকে দিলো। ছেলে খুশী হয়ে খেলা শুরু করলো। কাক আবার কানে যন্ত্রনা দেয়া শুরু করলে ছেলে আবার কাঁদতে লাগলো। গ্রামপ্রধান তড়িঘড়ি করে বললো, “আবার কি হয়েছে সোনামনি?” কাক ফিসফিস করে বললো, “আমি বাহিরে যেয়ে খেলবো”। চিন্তিত মুখে গ্রামপ্রধান আর তার মেয়ে বাচ্চাকে বাহিরে নিয়ে এলো। আকাশের নিচে আসামাত্র কাক নিজস্ব রূপে ফিরে গেলো আর ছোঁ মেরে বলটা নিয়ে উড়াল দিলো। লাঠি সোটা নিয়ে গ্রামবাসী দৌড়ে আসতে আসতে কাক চলে গেলো তাদের নাগালের বাইরে।
দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে নিজ অঞ্চলে এসেই কাক ঠিক অঞ্চলের মাঝখানে বলটাকে ফেলে দিলো। বলটা মাটিতে পড়ে ফেটে যেতেই চারিদিক আলোয় ভরে গেলো। আনাচে কানাচে যত ছায়া ছিলো, সব ভয়ে দূরে পালালো। অন্ধকার পাহাড়ের গায়ে রঙের ছোঁয়া লাগলো। বরফের ওপর আলোকরশ্মি পড়ায় এত ঝিকমিক করতে লাগলো যে ইনুইটরা বাধ্য হলো চোখ ঢাকতে। আনন্দে লোকে পাগল হয়ে গেলো। চারিদিকে শুরু হলো উৎসব আর কাকের স্তুতি। কিন্তু কাক বললো, “দিনের আলো কিন্তু সারাজীবন থাকবে না। আমি কেবল একটা বল আনতে পেরেছি। একারনে বছরের ৬ মাস থাকবে দিন। আর বাকি ৬ মাস বলটা শক্তি সঞ্চয় করবে পরবর্তী আলোর জন্য”। তা সেজন্য লোকে মন খারাপ করলো না। ৬ মাস থাকবে দিন, এই বা কম কি?
পরবর্তী কালে মুখে মুখে কাকের এই বীরত্বের গল্প সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো। আর কাককে তারা কি সম্মান আর ভালোবাসাটাই না দিতো, তা না বললেও চলে। তখন থেকেই কানাডার ঐ অঞ্চলে ৬মাস দিন, আর বাকি ৬ মাস রাত।
সূত্রঃ ইন্টারনেট।