লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে অধৈর্যভাবে বোতাম টিপেই যাচ্ছে তূর্য। চুল গুলি একটু টানাটানি করতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। কাল সন্ধ্যায় সেলুনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার ফল হিসেবে এখন তার চুল মোটামোটি আর্মি ছাট। চুলই খুঁজে পাচ্ছে না ধরার জন্য। কবিদের চুল হবে সিল্কি, একটু আগোছালো। আর্মি ছাট চুলের কবি আজ পর্যন্ত কেউ দেখেছে কিনা সে জানে না। তূর্য মনে প্রাণে একজন কবি। জীবনানন্দ দাশের পর হুমায়ূন আহমেদ জন্ম দিয়েছিলো কবি আতাহারের। এরপরেই তূর্য। এতদিনে তার পৃথিবী ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলার কথা কবিতা দিয়ে। সমস্যা হচ্ছে প্রেরণার অভাব। জীবনানন্দ দু-দন্ড শান্তি পেয়েছিলেন বনলতার কাছে, সবচেয়ে সুন্দর পদ আতাহারের হাতের মুঠোয় এসেছিলো নীতুর প্রভাবে, কিন্তু তার কে আছে? শুধু মাত্র একটা কবিতা দরকার তার, একটা। চমৎকার কিছু শব্দ মালা সবসময়েই ঘুরপাক খাচ্ছে তার আশে পাশে, কেবল প্রেরণার অভাবে কলমের ডগায় আসছে না।
টুং টাং। লিফটের দরজা খুলে গেলো। ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলো তূর্য। ৮তলার কোমড় ছাড়ানো চুলের তরুনী মেয়েটি। ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটবাড়ীর নিয়ম অনুযায়ী তাদের মাঝে মাঝে বাসায় ঢুকতে বা বেরুতে দেখা হয়, কিন্তু কখনো কথা হয়নি। একলা এই মেয়ের সাথে যাওয়া কি উচিত হবে? লিফটের দরজা প্রায় বন্ধ হয়ে যখন যাচ্ছে, মেয়েটি অবাক চোখে তাকালো। তূর্য বোতাম চেপে ভিতরে ঢুকে গেলো। লিফটের এক তরুনীকে নিয়েই আতাহার লিখেছিলো “বাসর” নামক অসাধারণ কবিতাটি। কে জানে, হয়ত এই মেয়েই তার প্রেরণা! লিফটটা ধীর গতিতে নামছে। মেয়েটি স্মার্ট ভাব দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সহজাত বাঙালি ললনার জড়তা কাটাতে পারছে না। তূর্য চোখ বন্ধ করে কবিতার লাইন খুঁজতে লাগলো।
সত্যি কথা
বলতে কি দাদা!
মেয়েটির মনের মধ্যে
তেঁতুল আর আদা।
ধ্যাত, এটা কি হলো? অণুকাব্য লিখতে লিখতে তার টাইটেল অণু পরমাণু তূর্য হয়ে যাচ্ছে। এই লাইন অতি সত্বর ছাড়তে হবে। তূর্য দুই হাতে কপাল চেপে ধরলো।
আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে
খুঁজি নাকো;
উহু, আবার জীবনানন্দ। এই লোক অধিকাংশ লাইন লিখে ফেলেছেন, ঘুরে ফিরে তার কাছেই হাত পাততে হয় বারবার।
“এক্সকিউজ মি, আপনি কি অসুস্থ?”
অসম্ভব সরু ক্যানক্যানে একটা কন্ঠে চটকা ভাঙলো তূর্যর। অসম্ভব, তার প্রেরণার কন্ঠ এরকম ঢঙি চড়া স্বর হবে না। লম্বা চুলের মেয়েটিকে তার এখন মনে হচ্ছে শাকচুন্নি পেত্মী। টুং শব্দে লিফট খুলে গেলো। উত্তর না দিয়ে তূর্য বের হয়ে গেলো। শাকচুন্নির পিছনে নষ্ট করার সময় তার নেই।
“এই মামা, যাবেন?” “এই যে মামা, এদিকে, ভার্সিটি যাবো, যাবেন?”
কেউ যাবে না। শাকচুন্নি এসে ক্যানক্যানা গলায় ডাকার সাথে সাথে দুইটা রিক্সা চলে এলো। শাকচুন্নিও ঢাকা ভার্সিটিতেই পড়ে। তবে তার ব্যবহারে অপমানিত মেয়েটি মোটেই তার দিকে ফিরে তাকালো না। তূর্যর মেজাজ খারাপ হতে লাগলো। দেশে নিয়ম থাকা উচিত, কবিরা রিক্সা সিএনজি যাই চাবে, তাদের সাথে সাথে দিতে হবে। শেষ পর্যন্ত বুড়ো এক চাচা তাকে নিতে রাজী হলো। তীব্র রোদ, বুড়ো মানুষটা কালো একটা সানগ্লাস পড়ে আছে। হঠাৎ দেখে মনে হয় অন্ধ। আচ্ছা, উইঁপোকারা কি অন্ধ হয়? হুমায়ূন আহমেদের আরেকটা সৃষ্টি কবি রু আদে লিখতে চেয়েছিলেন। তূর্য তো চাইলেই তাকে সাহায্য করতে পারে লিখতে। বাক্যের পর বাক্য সাজাতে শুরু করলো সে-
শহরের
বিষাদ তবু
বৃক্ষের কাছে জমা।
ছিল অন্ধকার- ক্রমাগত নিঃশব্দের
পাখিদের কাছে জমা।
অন্ধ উইপোকা দেখেনা আকাশদিন
আর মেঘেদের নীল ক্ষমা।
“ভাতিজা নামবা কই?”
হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলে তূর্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে; তার বেশীর ভাগ কবিতা এভাবেই হারিয়ে যায়।
“শহীদ মিনারের অপোজিটে চলেন চাচা। গণিত বিভাগ”।
গণিত নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই তার। কবিতা লেখার ছদ্মনাম সে নিয়েছে অগাণিতিক। শুধুমাত্র বাবার অত্যাচারে সে এখানে। নতুবা তূর্যর ইচ্ছা ছিলো বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়ার।
গেট দিয়ে ঢুকতেই ঊর্মির সাথে দেখা। নামের সাথে মানানসই ভাবে তার ঢেউ খেলানো চুল। তূর্য বরাবরের মতই মুগ্ধ হয়। আজকেও কি সুন্দর যে লাগছে। অবশ্য ঊর্মি তাকে মোটেই পাত্তা দেয় না; কথাই বলে না। সে শুধু ভালো ছাত্রদের সাথে মেশে। খাতা-কলম ছাড়া রঙচটা জিন্স পড়ে যে ছেলে ক্লাসে দেরী করে আসে, তার দিকে ঊর্মি ফিরেও তাকায় না। তূর্য ফিসফিস করে বলে,
তোমার-আমার মাঝে কোন
গল্প নাই
গল্পগুলো থেকে গেলো
কল্পনাই!
“অ্যাই তূর্য! গত দুইদিন আসিসনি কেন?”
“এমনি”।
“তোর সমস্যাটা কোথায়, আমাকে একটু বলবি?” বিরক্তি নিয়ে বলে আশীষ। “এবার পরীক্ষা কি দিবি, না তাও দিবি না?”
তূর্য হাসে।
“পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল…”
“একদম চুপ” ধমকে ওঠে আশীষ। “তুই এবার এসব ঢং বন্ধ করবি। কবিতা দিয়ে জীবন চলে না, আর এইসব দুই তিন লাইনের কবিতা আমাকে শোনাবি না খবরদার”।
“আরে বাবা, রাগ করছিস কেন? ইচ্ছে না করলে কেমনে ক্লাসে আসবো বল!”
কবজি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে আশীষ। “চল ক্লাসে। ক্লাস শেষে গত ক্লাসের নোটস তুই আমার কাছ থেকে বুঝে তারপরে যাবি”।
তূর্য আশীষের পাশে হাঁটতে থাকে। কি চমৎকার ভাগ্য নিয়েই না সে জন্মেছে, আশীষ তার মত ছন্নছাড়ার এত ভালো বন্ধু কি ভাবে হয়?
আশে পাশে কত পরিচিত মুখ, কারো দিকে তূর্যর তাকাতে ইচ্ছে হয় না। মাঝে মাঝে এরকম কেন হয়? সাড়ে ১২টার ক্লাসটা নেন মীরা ম্যাডাম। লাল টকটকে বব চুল। তূর্যর রঙ করা চুল অসহ্য লাগে; কিন্তু তারপরো ম্যামের থেকে মুগ্ধ দৃষ্টি ফেরাতে পারে না। লাল চুলেও ম্যাম অনন্যা। কি ধারালো কথা বার্তা, তার মত অন্যমনস্ক ছাত্রও সমীকরণ বুঝে ফেলে। মাঝে মাঝে মনে হয়, ইউক্লিড না জন্মালে কি এমন ক্ষতি হতো পৃথিবীর? সে তো আর জীবনানন্দ নয়।
“অ্যাই আশীষ” চিৎকার দিয়ে কেউ ডাকে। “নোটস টা এনেছিস আজকে?”
“ওহ, হ্যাঁ”। আশীষ তূর্যর দিকে তাকায়। “অ্যাই, তুই ক্লাসে যা। আজ কিন্তু তিনতলায় ক্লাস হবে, ৩১০ নং রুম। আমি রুশোকে নোটস টা দিয়ে আসছি”।
“হুমম”।
আশীষ সন্দেহের দৃষ্টি দেয়, “সোজা ক্লাস কিন্তু”।
“আরে বাবা, আমি কি বাচ্চা? যা তো”। চোখ পাকায় তূর্য।
সিঁড়ির মুখে দেখা হয় শ্রাবন্তীর সাথে। শ্রাবন্তীর মুখে হাসি ফুটে উঠে, চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে। তূর্যও সৌজন্য হাসি দেয়। নামটা তার ভীষন পছন্দ, শ্রাবন্তী। এত চমৎকার নামের মেয়ে দেখতে এরকম কেন? ঘাড় পর্যন্ত ছোট চুল, পোষাক আশাকের কোন ঠিক নেই। ক্লাস শেষে সবসময় হাতে হয় ফুচকা নয় ঝালমুড়ি। তূর্যর সুন্দর মেয়ে ছাড়া দেখতে ভালো লাগে না, কবিরা সৌন্দর্যের পূজারী। শ্রাবন্তী তাকে দেখলেই সরল একটা হাসি দেয়। প্রথম দিনই তূর্য কয়েকটা লাইন তাকে উৎসর্গ করেছিলো, ২ বছরেও আর কোন নতুন লাইন শ্রাবন্তী তাকে উপহার দেয়নি।
আমায় দেখলে
দাও মুচকি হাসি!
আমার তাতে
উঠে যায় কাশি!
তূর্যর হঠাৎ সবকিছু অসহ্য লাগতে থাকে। শেষ কবিতা সে কবে লিখেছে? দুই মাস? না, ৩ মাস আগে। দীর্ঘ তিন মাস সে কিছু লিখতে পারছে না, কেউ কি বুঝতে পারছে তার অশান্তিটা? সবাই কি করে এত স্বাভাবিক থাকে? সিঁড়ি বেয়ে অবসন্ন ভাবে উঠতে থাকে তূর্য। পুরনো লেখা কয়েকটা লাইন আবৃতি করে মনে মনে,
চিঠিটি ডাকবাক্সে ফেলবার আগে
কাগজের নিউরোনে রাখো
মেঘময় সহজ চুম্বন।
এটা কি স্ট্যাটিস্টকস বিভাগে চলে এসেছে নাকি সে? মানে চার তলায়। ক্লাসটা যেন কোন ফ্লোরে? তূর্য সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। দোতালায় একটা ক্লাসে ঢুকতেই থতমত খায়। কোন চেনা মুখ নেই। ওহ, ভুল করে জুনিয়র দের ক্লাসে চলে এসেছে। রুম নাম্বারটা কত বলেছিলো আশীষ? তূর্য আবার উপরে উঠে ব্যস্তভাবে রুম খুঁজতে থাকে। ক্লাস মিস দিয়ে আশীষকে চটাতে চায় না। তিনতলার সিঁড়ির রেলিং এ হাত দিয়ে থমকে যায় তূর্য। তার কিছু একটা লিখতে হবে, এখনি। কাগজ কলম কিছুই নেই, কেন নেই? এক কোণায় একটা ইটের টুকরা পড়ে আছে। তূর্য মেঝেতেই বসে পড়ে, আসে পাশে কৌতুহলী চোখ তার উপর নিবদ্ধ হয়। তূর্য তন্ময় ভাবে লিখতে থাকে মেঝেতে…
পিচ্ছিল হয়ে থাকা কাদা মাঁড়িয়ে মাঁড়িয়ে
অবশেষে কাঠের সিঁড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল।
বরাবর উপরের দিকে বেয়ে বেয়ে
তিন তলার সমান উঠলাম।
এটা ‘আপনি’ কক্ষ।
অথচ এখানে থাকবার কথা ছিল
‘তুমি’ কিংবা ‘তুই’ কক্ষ।
হয়তো ‘তুমি’ কক্ষটিকে নিচে ফেলে এসেছি
অথবা ‘তুই’ কক্ষটি উপরের দিকে।
কিংবা ‘তুই’ কক্ষটিই নিচের দিকে,
অথবা ‘তুমি’ কক্ষটি খুঁজে পেতে হলে;
বাইতে হবে আরও অনেক ধাপ।
এমনটা ভাবতে ভাবতেই ভাবনাহীন হয়ে পড়ে প্রথাগত প্রেমিক পুরুষ।
না, শেষ হয়নি। আরো কিছু বলবে সে, আজকে পৃথিবীর সব রঙ, ছবি, ছন্দ আর অন্ত্যমিলের রহস্যের চাবিকাঠি তার হাতের মুঠোয়। চোখ বন্ধ করে সে ভাবতে থাকে। হঠাৎ গায়ে কাপড়ের ঘষা লাগে। চোখ খুলে দেখে তার কবিতার মাঝে কেউ ছড়িয়ে দিয়ে গেছে কিছু কদম ফুলের রেণু। তূর্য লিখে ফেলে,
নির্ধারিত কক্ষটি খুঁজে পাবার কিংবা বৃষ্টি নামার আগেই।
ঘাড় ঘোরায় তূর্য। ব্যস্ত ভাবে নিজের চেয়ে তিন সাইজ বড় ব্যাগ নিয়ে কে দৌড়ে পালাচ্ছে? শ্রাবন্তী না? তূর্য ফিসফিস করে বলে,
সমস্ত মুগ্ধতা চোখে নিয়ে,
গাঙচিলের ডানার মত দুহাত তুলে বসে থাকি;
তুমি আসবেই।
-----------------------------------------
আমি "কবি" উপন্যাস আর আতাহার- দুইজনেরই বিশাল ফ্যান। একারনেই এই খাপছাড়া লেখা। নিজের কোন লেখাই নেই, সবই ধার করা। প্রতিটি অনুকাব্য আর কবিতা ব্লগার গাব্রিয়েল সুমনের রচনা। আমাকে গল্পে তার কবিতা গুলো ব্যবহার করতে দেয়ার জন্য তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভ কামনা রইলো তার অনাগত কবিতাগুলোর জন্য।
-----------------------------------------