রাজকান্দির আতংক - প্রথম পর্ব
অনীক শব্দ করে পড়তে থাকে।
২৭শে এপ্রিল, ভোর ৫:২০
উফফ, পড়তে পড়তে মাথা ধরে গেলো। তবে আশার কথা, আর মাত্র দুইটা পরীক্ষা। এরপরেই প্রফ শেষ। প্রফ টা পাশ করতে পারলেই ডাক্তার! ভাবতেই অন্যরকম লাগে। ডাক্তার হবার পরো কি আমাদের বন্ধুত্ব এমনই থাকবে? না সময়ের সাথে আমরা সবাই হারিয়ে যাব? ব্যস্ত হয়ে যাব নিজ নিজ কাজে? নাহ, অন্তত শাহরিয়ার, তন্বী, রাহাত-এরা আমার মতই থাকবে।
“ধূর, কি সব রোজনামচা লিখেছে এই ছেলে!” বিরক্ত হয় সুজন।
“তো তুই কি আশা করেছিলি? প্রেমের গল্প?” অনীক মুখ ভ্যাংচায়।
“হলে মন্দ কি হতো? এসব পড়াশোনা নিয়ে ভ্যাজর ভ্যাজরের চাইতে তো ছ্যাঁকার গল্প ভালো”।
“আচ্ছা, আজকের আকাশে মেঘ কি অনেক বেশী নাকি রে?” অন্যমনস্কভাবে বলে উঠে সিয়াম। “আকাশ এত অন্ধকার কেন? কাল রাতে ট্রেনে আসতে আসতেও না দেখলাম প্রায় পূর্নিমা?”
তাই তো! টনক নড়ে বাকি দুইজনের। কাল তো ভীষন রকম জোছনা ছিলো আকাশে। সিয়াম পারলে ট্রেনেই কবিতা লিখা শুরু করে, অনেক কষ্টে ওকে আটকানো গেছে। আজ এরকম মেঘে ঢাকা কেন আকাশ? কতটা মেঘ জমলে পরে এরকম জোছনা ঢাকা পড়ে?
অনীক চিন্তিত মুখে বলে, “লক্ষণ তো ভালো না রে। মনে হয় ঝড়-বৃষ্টি হবে”।
“সর্বনাশ। যেই না তাম্বু খাটাইছি, এ তো উড়েই যাবে। সিলেটের ঝড় মানে তো ঝড়ের বাপ”। ফ্যাকাশে মুখে বললো সুজন।
আগুন প্রায় নিভু নিভু। আরো কিছু শুকনো পাতা তাতে গুঁজে দেয় সিয়াম।
“ওহি হোগা যো মাঞ্জুরে খোদা হোগা”।
“ভুল হিন্দি বলে মেজাজ খারাপ করবি না খবরদার! বাংলা না পারলে ইংলিশ বল”। ঝাড়ি দিয়ে অনীক আবার জোরে জোরে পড়তে শুরু করে।
৭ই মে, ২০১১ রাত ১২:৩০
অবশেষে পরীক্ষা শেষ হলো। সব ক্লান্তি শেষ। আজ বিকেলেই আড্ডা হচ্ছিল, এখন আমরা করবোটা কি। কোথাও বেড়াতে যাওয়া দরকার। নবীন বলছিল সেন্ট মার্টিনের কথা। সেন্ট মার্টিন তো গতবারই গেলাম। তবে শুনে এখন আবার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ১৭ তারিখ তো ভরা পূর্নিমা। পূর্নিমার সেন্টমার্টিন-ভাবতেই আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সোনিয়ার আবার ইচ্ছা রাঙামাটি। কি করা যায় ভাবছি।
১৩ই মে ২০১১ রাত ৯:০০
ইউরেকা!! পেয়ে গেছি। এর নামই তো জীবন! আজ শাহরিয়ার হলে এসেছিলো। এসে কাজের কথা বললো। এসব সোনিয়া তন্বীদের নিয়ে আসলেই হবে না। এদের সাথে নিলে হয় সেন্ট মার্টিন বা রাঙামাটিতেই যেতে হবে। ধ্যাড়ধ্যাড়ে পানসে লাইফ আর পড়াশোনা নিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি। অজানার উদ্দেশ্যে যেতে চাই। শাহরিয়ারের মামা শ্রীমঙ্গল চা বাগানের ম্যানেজার। চা বাগানেই থেকে আসবো দিন কয়েক। কালই বেড়িয়ে পড়বো।
“মামা সঠিক ডিসিশন নিসে!” হাসতে হাসতে বললো অনীক। “মেয়ে মানেই ঝামেলা”।
উত্তরে সুজন কিছু একটা বলতে যাবে, হঠাৎ চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক বন্ধ হয়ে গেলো। পুরো বনাঞ্চল একেবারে নিশ্চুপ, শুধু পানির কলকল শব্দ। তিনজন একসাথে সোজা হয়ে বসলো। প্রায় সাথে সাথেই দূরে কোন বন্য প্রাণীর জোরালো ডাক ভেসে এলো। তিন বন্ধু চমকে উঠলো। বুঝতে পারলো না ডাকটি কোন দিক থেকে এলো। ক্ষণকাল পরেই আবার সেই হুংকার। তীব্র রাগে যেন গজরাচ্ছে। আতংকে সুজন আগুন বাড়াতে গিয়ে বেশী পাতা ঠুসে দেয়ায় আগুন নিভে যায় যায় অবস্থা। সিয়াম দ্রুত ফুঁ দিয়ে কোন ক্রমে আগুনটাকে টিকিয়ে রাখে।
সুজন তোতলাতে থাকে, “ওটা……ওটা কি-ক্কিসের ডাক রে?”
“মনে হয় শেয়াল”। সিয়াম শুকনো গলায় বলে; কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে, শেয়াল এভাবে ডাকে না।
এবারে অনীক বলে ওঠে, “আমি যদি খুব বেশী ভুল করে না থাকি, তবে এটা নেকড়ে বা হায়েনার ডাক”।
“কি?”- একসাথে সিয়াম আর সুজন লাফিয়ে উঠে।
“এই অঞ্চলে কোন নেকড়ে বা হায়েনা নেই। আর হায়েনা বা নেকড়ে কি দেশে আছে নাকি?” অবাক কন্ঠে সিয়াম বলে।
“সে তো আমিও জানি”। অনীক মাথা নাড়ে। “কিন্তু এটা ওই জাতীয় কোন প্রানীরই ডাক। আমি ন্যাশনাল জিওগ্রাফি নিয়মিত দেখি। আমি নিশ্চিত”।
আবার ডেকে উঠে প্রাণীটা। এবার মনে হয় আরেকটু কাছে।
“গাছে উঠবো নাকি রে?”- সুজন প্রায় কেঁদে ফেলে।
“না, আমাদের আগুন টিকিয়ে রাখতে হবে। বন্য প্রাণী আগুন ভয় পায়”। বিপদে পড়লেই সিয়ামের মাথা ঠান্ডা। একারনেই সিয়ামের উপর এত ভরসা অনীক আর সুজনের। যত পাতা আর শুকনো কাঠ কুড়িয়েছিলো, সব এনে কাছে রাখে তিনজনে মিলে। গুমোট আবহাওয়ার সাথে চারিদিকের নিস্তব্ধতা যেন গলা টিপে ধরছে। ঘড়ি দেখলো অনীক। মাত্র সোয়া ১০টা বাজে। এখনো পুরো রাত পড়ে আছে। চিন্তা করেই অনীকের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। যদি এখান থেকে সুস্থ বেরুতে পারে, আর জীবনে কোনদিন রাতে দুই/তিনজন মিলে জঙ্গলে থাকবে না।
আবার ঝিঁঝিঁ পোকার স্বস্তিদায়ক ডাক শুরু হলো। মেঘও একটু যেন কাটলো। মেঘের কিনারা দিয়ে একটু একটু জোছনার আলো আসছে। সবাই শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এখন পরিস্থিতি এত ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। অনীক পন্ডিতি শুরু করলো,
“শোন, এত ঘাবড়াসনে। আজ ভরা পূর্নিমা! তাও জুন মাসের। জানিস জুনের পূর্নিমা কে নর্থ আমেরিকাতে কি বলে? হানিমুন বলে”।
“হানিমুন কেন? সবাই কি মধুচন্দ্রিমায় যেত নাকি এই দিনে?” অবাক প্রশ্ন সুজনের।
“আরে না রে গাধা। ওদের দেশে এই সময়ে প্রচুর মধু উৎপন্ন হত। তাই এই মাসের পূর্নিমাকে বলে হানিমুন। তবে হানিমুন শব্দ নাকি এইখানে থেকেই এসেছে। প্রচলিত নিয়মে, গ্রীষ্মকালে যাদের বিয়ে হত, সেই সব নবদম্পতিকে বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে মধু খেতে হত। অবশ্য অনেকের মতে এর উৎপত্তি প্রাচীন ব্যাবিলনে……”
“ওরে আল্লাহ রে! থাম থাম! আর আমাদের হানিমুন শব্দের উৎপত্তি শুনে কাজ নেই”- অনীককে একসাথে থামিয়ে দেয় সিয়াম আর সুজন। একবার যদি অনীক জ্ঞান দিয়ে শুরু করে, আর রক্ষা নেই।
অনীক ভেংচি দিলো। “তা শুনবি কেন? ভালো জিনিসে তো তোদের অরুচি”।
অনীককে অগ্রাহ্য করে সিয়াম বললো, “কিন্তু আজই যে পূর্নিমা তুই সিওর হলি কি করে?”
“কারণ এই অজানা ডাক্তার ভাই তার ডায়েরীতে লিখেছেন ১৭ই মে ছিল পূর্নিমা। আজ ১৫ই জুন। চাঁদের এই পরিবর্তনকে ব্যখ্যা করা হয় লুনার সাইকেল দিয়ে। যদিও চাঁদ একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে আসে ২৭.৩ দিনে, বা ধর ২৭ দিনে; লুনার সাইকেল কিন্তু সাড়ে ২৯ দিনের বা ২৯ দিনের। এই বাড়তি সময়টা চাঁদ নেয় কারণ পৃথিবী এর মাঝে সূর্যের চারিদিকে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন মাইল প্রদক্ষিণ করে ফেলে। তো সেই অনু্যায়ী আজ ১৫ই জুনই তো ফুল মুন, বা পূর্ণচন্দ্র দিবস; নাকি?”
“বাহ বাহ, স্যার! আপনার তো ভবিষ্যত অন্ধকার। অচিরেই আপনি শিক্ষক পদে আসীন হতে যাচ্ছেন!” সুজনের গলা শোনা যায়।
“জ্বী, ধন্যবাদ”। অনীক ব্যাঙ্গ করে। “এবার তাহলে আমরা ডায়েরীতে ফিরে যাই?”
১৪ই মে ২০১১, রাত ৮:০০
কি অপূর্ব পরিবেশ। আমার তো মনে গান আসছে, “এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো”। ভাগ্য এইটা ডায়েরী, শাহরিয়ার শুনলে এতক্ষনে টিজের জ্বালায় ভেসে যেতাম। তবে শাহরিয়ারকেও ভাবুকই দেখতে পাচ্ছি। ডায়েরী লিখছি মামার বাংলোর বারান্দায়।টেবিলের উপরে আমার রূপা দিয়ে মোড়া ছুরিটা রাখা। ছুরি দেখে মামা ভীষন অবাক। শুধু আগার তীক্ষ্ণ ভাগ রূপা দিয়ে বানানো। মধ্যভাগ স্বাভাবিক ছুরির মত; আর বাটে চমৎকার রূপার কারুকাজ। এই ছুরি আমি সবসময় বেড়াতে গেলে নিয়ে যাই। মামাকে বললাম, এই ছুরি আমাদের বংশে কবে থেকে আছে তা কেউ জানে না, তবে বংশের বড় ছেলেকে এটা দেয়া হয়। আমাকেও আমার বড় ছেলেকে দিতে হবে। শাহরিয়ারের প্রশ্ন, “যদি তোর ছেলে না হয়?” এটা অবশ্য আমি ভাবিনি। তবে কি মেয়েকে দিয়ে যাব? ইশ, কি আবোল তাবোল ভাবছি। কবে বিয়ে করবো কোন ঠিক আছে? যাক, চা বাগানের ম্যানেজারদের এত বিশাল বাংলো দেয়; দেখে তো আমি অবাক। শুনলাম ডাক্তারদেরো নাকি এইরকম বড় বাসা দেয়। পাশ করে চা বাগানের ডাক্তারের পদের জন্য অ্যাপ্লাই করবো নাকি? শহরের ভীড় আর কোলাহল থেকে দূরে, প্রকৃতির মাঝে কিছুদিন কাটিয়ে গেলে মন্দ হয় না। আর এখানকার মানুষগুলো ভীষন ভালো। সহজ সরল জীবন। এদের জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে। শাহরিয়ারের গলা শুনতে পাচ্ছি, রাতের খাবারে নাকি স্পেশাল বনমোরগ আছে। ডায়েরী পরে লেখা যাবে।
১৬ই মে ২০১১ রাত ১০:০০ টা
কাল ডায়রী লেখার একদম সময় পাইনি। দুইটা দিন যেন উড়ে গেলো। হাকালুকি হাওর ঘুরলাম, মাধবপুরের শান্ত লেক দেখলাম, মামার গাড়ি চেপে চা বাগানের আনাচে গানাচে গেলাম। ৭ রঙা চা খেলাম। চা দেখে তো আমি অবাক। সত্যি সত্যি সাত রঙ! পেপারে তবে ঠিকই লিখেছিলো। চা খেয়ে বিশেষ মজা পেলাম না, তবে বিস্ময়কর চা; মানতেই হবে। কাছেই নাকি বাইক্যা বিল আছে। শীতকালে পাখির অপূর্ব মেলা বসে। শীতকালে আসতেই হবে। মামা একলা মানুষ; এখনো বিয়ে করেন নি। আমরা আসাতে যে কি খুশীটাই হয়েছেন, বলার নয়। আবার আসলে নিশ্চই মাইন্ড করবেন না। সারাদিন ঘুরে খুবই ক্লান্ত। চোখের পাতা যেন লেগে আসছে। এর মাঝে বাবুর্চির হাতের যে রান্না, দুই দিনেই মনে হয় ৪ কেজি ওজন বেড়ে গেছে। এখন আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাল সকালে যাবো চম্পারাই টি স্টেটে। মামার নাকি কি কাজ আছে, সাথে আমরাও ঘুরে আসবো।
“বাহ, এদের তো ভালো এনার্জি রে, এই ডাক্তার গুলির। এইভাবে এখনো মানুষ ডায়রী লিখে, জানতাম না”। - সুজন বলে উঠে।
“তোর মত আইলসা ভাদাইম্যা পোলা ছাড়া সবাই পারে এসব করতে। তুই তো আছিস শুধু মেয়েদের পিছে ঘুরাঘুরিতে”- ভেংচি কাটে অনীক।
“তবে রে” বলে সুজন অনীক কে ধরতে যেতেই সিয়াম বাঁধা দেয়।
“দোস্ত, এখন না” – বলেই ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলে। বাতাস এসে অনেক মেঘ সরিয়ে নিয়ে গেছে। আগুনের তেজ অনেক কম হলেও আশে পাশে সবই পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। চাঁদের প্রায় অর্ধেকটাই এখন মেঘের বাইরে; জোছনার আলোতে সব কিছু কেমন যেন ভয়াবহ দেখাচ্ছে। অনীক আর সুজন চুপ হয়ে যায়, প্রশ্নাতুর চোখে তাকিয়ে থাকে। হ্যাঁ, একটা হালকা শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘন পাতার উপরে যেন কেউ পা টিপে টিপে হাঁটছে। সুজনের দাঁতে দাঁতে বাড়ি খেতে থাকে। এই শান্ত পরিবেশে শব্দটা বড় কানে বাজে। অনীক সুজনের মুখ চেপে ধরে। অবশ্যই কেউ হাঁটছে; ঘন অরন্যের দিকে তাকিয়ে কিছু ঠাওর করতে পারলো না সিয়াম। আস্তে করে বন থেকে কেটে আনা ডালটা হাতে নেয় সে। সে জানে না, কোন প্রাণী না মানুষ; তবে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করার ছেলে সিয়াম না। আবার সেই অসহ্যকর নীরবতা। ঝিঁঝিঁ পোকা গুলি কেন ডাকা বন্ধ করে দেয়? এদের সমস্যা কি? শব্দ যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। কেউ বার বার এই প্রান্ত থেকে ঐ প্রান্ত হেঁটে যাচ্ছে, আবার ঘুরে আসছে। সিয়াম লাঠি বাগিয়ে দাঁড়ায়। চেঁচিয়ে বলে, “কে? কে হাঁটে?”
কোন উত্তর নেই। অনীক এক হাতে সুজনকে সামলাতে সামলাতে আরেক হাতে আগুন উসকে দেয়। ঠিক সেই সময়ে মেঘ এসে আবার চাঁদকে ঢেকে দেয়। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ফেরত আসে; আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না। এবার সিয়ামও ভড়কে যায়। অশুভ কিছু একটা আছে এই জায়গায়। গ্রামবাসী এমনি এমনি ভয় পায় নি। কোন বন্য প্রাণী আছে; যাকে সবাই দানো বলে।সিয়াম ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
“রাতে ঘুমানো যাবে না। তোরা ছুরি দুইটা কাছাকাছি রাখ। আমি দাটা নিচ্ছি”।
সুজন ফোঁপানো শুরু করে। অনীক রাম ধমক দিলো,
“গাধামী করিস না তো। এখন ভয় পাওয়ার সময় না, বাজে সবে রাত সাড়ে ১১টা। সারা রাতই পড়ে আছে এখনো”।
“আগুন নিভতে দেয়া যাবে না। যতক্ষন আগুন আছে, এই প্রাণী কাছে আসবে না”। সিয়াম গম্ভীর গলায় বলে।
সুজন আয়াতাল কুরসি পড়ে সবাইকে ফুঁ দিয়ে দেয়। তিন জন সতর্ক ভাবে চুপ করে বসে থাকে। ঝরনার দিক থেকে কিছু আসার সম্ভাবনা নেই। বাকি রইলো জঙ্গলের তিন দিক। তিন জনে এমন ভাবে এবার বসে যেন সব দিকেই নজর রাখতে পারে। কিছু কাহাতক আর চুপ করে বসে থাকা যায়? ডায়রী হাতে নিলো অনীক।
১৭ই মে ২০১১, বিকেল ৩:৩০
এখন আমি বসে আছি তৈলংকামী গ্রামে। চমৎকার একটি গ্রাম। পাহাড়ের এপাশে ওপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঁশ-শণে তৈরী মাত্র ১০-১২টি ঘর নিয়ে আদিবাসী দের গ্রাম। চম্পারাই টি স্টেটে মামা কাজ করতে করতে বললেন আমাদের ঘুরে আসতে। শাহরিয়ারকে নিয়ে আর পারিনা, এত ছটফটে। কি করে যে এই ছেলে ডাক্তারি করবে, ভেবে মাঝে মাঝে টেনশন লাগে। হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কলাবন পাড়া। এখানে এসে ছেলের মাথায় অ্যাডভেঞ্চারের কি যে ভূত চাপলো, তার পরিণামে এখন আমি এই গ্রামে বসে আছি। কলাবন পাড়ার এক শ্রমিকের কাছ থেকে শুনেছে যে এখানে নাকি চমৎকার একটা ঝিড়ি পথ আর ঝরনা আছে। টলটলে কাকচক্ষু জল নাকি তার। শ্রমিকের ছেলের নাম কাল্টু। কাল্টুর গাইডেই এতদূর এসেছি। গ্রামের মানুষ খুবই ভালো। সাদরে অ্যাপায়ন করলো আমাদের। খেয়ে এখন বাঁশের চাটাই এর উপরে শুয়ে ডায়েরী লিখছি। শাহরিয়ার গেছে লোক জোগাড় করতে, যে আমাদের ঝরনা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। কেন জানি না, কেউই যেতে ইচ্ছুক না। আমারো যে খুব ইচ্ছে তা নয়, মামাকে না জানিয়ে…
এরপরের পৃষ্ঠা ছেঁড়া। অনীক কৌতূহলী হয়।
“কে ছিঁড়লো এই দুই তিন পৃষ্ঠা? দেখেই বুঝা যাচ্ছে কেউ টেনে ছিঁড়েছে”।
আগুন দপ দপ করে উঠলো। নেকড়ের মত প্রাণীটি ডেকে উঠলো। ডাকটা এমন যে একেবারে বুকের মাঝখানে গিয়ে কাঁপিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় কাতর কোন প্রাণীর ডাক। সিয়াম দাটা শক্ত করে চেপে ধরে। মেঘ পুরোপুরি সরে গেছে। তীব্র জোছনা চারিদিকে দিনের আলোর মত স্পস্ট করে দিচ্ছে। সিয়াম মনে মনে প্রার্থণা করে, মেঘ যেন আর চাঁদকে না ঢাকে। আগুন যদি নিভেও যায়, দেখতে আর সমস্যা হবার কথা না। সুজন থর থর করে কাঁপছে। এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ শুরু করলো, “এমন চাঁদের আলো, মরি যদি সেও ভালো……”
“চুপ” অনীক ধমকে ওঠে। “একটা বাজে কথা না, আর যেই মরুক, আমরা আজ মরব না”।
“দোস্ত, আ-আমার বাথরুম ধরেছে”। সুজন তোতলাতে তোতলাতে বলে।
এই পরিস্থিতিতেও না হেসে পারে না অনীক। সুজনের ছোট বেলার সমস্যা। ভয় পেলেই তার বাথরুমে যেতে হয়। পরীক্ষার সময় অনীকের সুজনের জন্য সবসময় পরীক্ষা হলে যেতে দেরী হতো। শেষ মূহুর্তে সুজন বাথরুমে যাবেই।
“সামনের ঝোপের ধারে যা”
“দোস্ত, তোরা প্লিজ এইখানেই থাক। কোথাও যাইস না”।
“আরে যা, আমরা তোর পিঠের দিকে তাকিয়ে আছি”। অনীক আশ্বস্ত করে তাকে।
অনীক ডায়েরী হাতে নিতেই সিয়াম বলে, “রাখ তো ওটা”।
“না, এর শেষ পড়ে ছাড়বো”।
কয়েক পাতা উল্টিয়ে লেখা পাওয়া যায়। এতে তারিখ নেই। মুক্তার মত হাতের লিখাও নেই। লেখা পড়াই দুঃসাধ্য। কেউ কাঁপতে কাঁপতে লিখেছে লেখা গুলো। লাইন গুলি এঁকে বেঁকে গেছে। হরফের সাথে হরফ মিশে করেছে লেখাকে দুর্বোধ্য। অনীক কষ্ট করে পড়তে থাকে।
আমি জানি না আমি কি এই দুনিয়াতে আছি কিনা। শরীফ নেই; শরীফ মরে গেছে। আমার বন্ধু, যে আমার জন্য প্রাণ দিয়েছে, আমি তাকে ফেলে ঝরনায় চলে এসেছি। আমি আমার বন্ধুর মৃত্যুর জন্য দায়ী। এটা কি দুঃস্বপ্ন? তবে আমার লিখে যেতেই হবে। আমি যদি মারা যাই; কেউ এই ডায়রী পেলে যেন জানে কি করে আমরা মারা গেলাম। শরীফ আসতে চায়নি, আমিই মামাকে না জানিয়ে জোর করে ওকে টেনে এনেছি। হায় আল্লাহ, এ আমি কি করলাম।ঝিড়ি পথের ডান দিক দিয়ে যে রাস্তাটি যায়, ওখানে এক দূর্গ আছে। সন্ধায় আমরা যখন ওখানে যাই, ওটা ছিলো না। পুরো সময় কেউ আমাদের লক্ষ্য করেছে। শরীফ অনেকবার ফিরে যেতে চেয়েছে, আমি কান দেইনি। রাত্রে পূর্নিমার চাঁদ যখন মাথার উপরে, তখন দূর্গটি ভেসে উঠলো। উফফ, কি ভয়ংকর সেই দূর্গ।
একেক পৃষ্ঠায় কয়েকটি করে শব্দ লেখা। রক্ত মাখা সেই লেখা পড়া প্রায় দুঃসাধ্য। লেখকের যে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল তা নিশ্চিত। সিয়াম প্রায় ছিনিয়ে নেয় ডায়রী অনীকের হাত থেকে।
আমার মাথা খারাপ হয়ে গেলো পূর্নিমার আলোয়, আমি শরীফকে টেনে নিয়ে গেলাম তার মাঝে। একটা মানুষ অন্ধকারে বসে আছে। কি ভয়ানক দৃষ্টি; আমাদের দিকে তাকালো। শরীফ তাকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কে?” তখনই দেখলাম… হে আল্লাহ আমাকে শক্তি দাও আমাকে লিখতেই হবে। মানুষটি চাঁদের আলোয় এলো। আসামাত্র তার মাঝে কি যেন ঘটে গেলো। মুখ নীচু করে জান্তব আক্রোশে চিৎকার করতে লাগলো। পিঠ বেঁকে গেলো। হাত থেকে নখ বের হয়ে চারপাশে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে ফেললো। আমরা চিৎকার করে উঠলাম। এই একবিংশ শতাব্দীতে কি ওয়ারউলফ থাকা সম্ভব? এই তবে গ্রামবাসীর দানো! হায়, আমি কি মূর্খ! আমি তাদের বিশ্বাস করিনি। তখনই সে আমাদের দিকে তাকালো। হলুদ চোখে কি তীব্র জিঘাংসা। আমরা দৌড় দিলাম। কিছু বুঝার আগেই সে শরীফের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নখের আঘাতে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেললো শরীফকে। মরার আগ মূহুর্তে শরীফ আমার দিকে তাকিয়েছিলো। হায়, আমার বন্ধু!
সিয়াম আর অনীক ঢোক গিলতে থাকে; এ তবে শাহরিয়ার। শাহরিয়ার কোথায় তাহলে এখন? সেও কি মারা গেছে? এক ঝটকায় অনীক তাকায় সুজনের দিকে। সুজন এখনো প্রাকৃতিক কর্ম সারতে ব্যস্ত।
পরের পৃষ্ঠা গুলি রক্তে রঞ্জিত; ছিন্ন বিচ্ছিন্ন।
আমি দৌড়াতে থাকি। অন্ধের মত। নেকড়ে মানব আমাকে তাড়া করে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে আমাকে ধরে ফেলে। সে লাফ দেয়, তবে আমি সরে যাওয়ায় আমার পা কামড়ে ধরে। যন্ত্রণায় আমার বোধ লুপ্ত হয়। হাতে পাই সেই ছুরিটি যেটা শরীফ আমাকে রাখতে দিয়েছিলো। মনে পড়ে নেকড়ে মানব কে মারতে হলে রূপার বুলেট লাগে। রূপার ছুরিতে কি হবে? অন্ধের মত আমি হৃদপিন্ড বরাবর আঘাত হানতে থাকি। তীব্র আক্রোশে সে আমাকে মারতে চায়, কিন্তু পড়ে যায়। আমি তার পিঠের উপর উঠে আঘাত হানতেই থাকি বিরামহীন ভাবে। আমার নীচেই নেকড়েটি একটা মানুষে রূপান্তরিত হয়। এর পরে আমি কোনক্রমে ঝরনার কাছে আসি। এই ডায়রী পাই। চাঁদের আলোয় আমার কেমন যেন লাগছে। কি ভীষন ব্যথা আমার প্রতিটি অঙ্গে। তীব্র ঘৃণা বোধ হচ্ছে। আর পারছি না। আমার পা… আমার বুক…
ডায়েরী শেষ।
অনীক আর সিয়াম দুইজন তাকিয়ে থাকে একজন আরেকজনের দিকে। এও কি সম্ভব? শাহরিয়ার কোথায় তারা এখন জানে। মায়া নেকড়ের কারণেই কি এই অঞ্চলে অন্য কোন প্রাণী নেই? ঝিঁঝিঁ পোকা ডাক থামিয়ে দেয় যখন মেঘ সরে চাঁদ উন্মুক্ত হয়? আজ না পূর্ণচন্দ্র দিবস? কিন্তু এসব তো সবই মিথ; বানানো। ধপ শব্দে চমকে যায় তারা। আগুনের শেষ বিন্দু প্রাণপণ যুদ্ধ করে যেন হার মানে; নিভে যায়। সুজন…… সুজন কোথায়?
অনীক আর সিয়াম ঘাড় ঘোরায়। সুজন নেই। কিছুক্ষন আগেও সুজন এই সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল; এখন নেই।অনীক অস্ফুট শব্দ করে। সিয়াম থর থর করে কাঁপছে। হাত ধরা ধরি করে তারা ঝরনার দিকে পিছাতে থাকে। যে কোন দিক থেকে জন্তুটা আসতে থাকে। তাদের কাছে রূপার তৈরী কিছুই নেই।
পিছনে মৃদু গড়গড় শব্দ শোনা যায়। হঠাৎ কানের কাছে যেন বাজ পড়ে; ভীষন শব্দে নেকড়ে ডেকে ওঠে। তাকাবে না তাকাবে না করেও সিয়াম আর অনীক একই সাথে পিছনে ঘোরে। বোটকা গন্ধ নাকে বাড়ি দেয়। হলুদ বীভৎস নিষ্ঠুর এক জোড়া চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নেকড়ে শরীর নিচু করে; লাফ দেয়ার পূর্ব মূহুর্তে মাংসাসী প্রাণীরা যেমন করে থাকে। দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশে তখন ভীষন রকম জ্যোৎস্না; বাতাসে তীব্র হাহাকার।
দূরে তৈলংকামী গ্রামের এক আদিবাসী মা নেকড়ের ডাক শুনে প্রাণপণে তার তিনমাসের শিশুটিকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১১ রাত ২:০৮