অভিশপ্ত আয়না (প্রথম পর্ব)
পরের দিন সারাটা ক্ষণ সুপ্তি ভার্সিটিতে অস্থির হয়ে থাকে। কখন সে বাড়ি যাবে, কখন রাত হবে। তার অস্থিরতা দেখে চৈতী বললো, “কি রে প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো? এত ছট ফট কেন?” সুপ্তি না শোনার ভান করলো। ইভান দেখতে যেন রুশ দেশের রূপকথার ইভানের মত। সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ঘরের আয়নায় কোন এক রাজপুত্র এসে দেখা দেবে?
রাত ১২টা বাজতে সুপ্তি তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ রাতে সে ঘুমাবে না। রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ঘরে ধীর গতিতে শীতল হাওয়া বইতে থাকে, সাথে সেই গন্ধ। এত সুন্দর দেখতে ইভান, কিন্তু এই পচা গন্ধ কেন আসে তবে? সুপ্তি তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে যায়। ইভানের মুখে স্মিত হাসি। ইভান ভীষন রকম ফ্যাকাসে।
“কেমন আছ সুপ্তি?”
“ভালো। তুমি?”
ইভানের মুখ বিষন্ন হয়ে যায়। “আয়নার মাঝে আর কেমন থাকবো?”
“তুমি আয়নায় কেন? কি হয়েছে?”
ইভান বিষন্ন কন্ঠে জবাব দেয়, “আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু এক সকালে উঠে দেখতে পাই আমি আমার ঘরের আয়নার মাঝে বন্দি হয়ে গেছি। তারপর থেকে এখানেই আছি। কতবার কতজন কে ডাকার চেষ্টা করেছি, কেউ শোনেনি। ১০০ বছর পর আজ তুমি শুনলে”।
১০০ বছর! সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
“তোমার তাহলে বয়স কত?”
ইভান হাসে।“৩০০ বছর আগে তো ২৩ ছিল, এখন তোমাদের হিসেবে নিশ্চই ৩২৩, কিন্তু আমার হিসেবে ২৩”।
“১০০ বছর পর আমি ডাক শুনলাম, আগে কে শুনেছিল?” সুপ্তি নিজের কন্ঠের আবেগ লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হয়।
ইভান উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে।
“সুপ্তি, আমার অনেক কষ্ট, অনেক কষ্ট”।
সুপ্তির বুকে আবেগের বান ডাকে। তার ইচ্ছে হতে থাকে গ্রীক দেবতার মত দেখতে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়।
“তুমি কি আমার হাতে হাত রাখবে সুপ্তি?”- করুণ ভাবে ইভান জিজ্ঞেস করে।
সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দেয়। আয়নায় সে ইভানের হাতের উপর হাত রাখে। বরফের মত ঠান্ডা। হাত যেন বেশীক্ষন রাখা যায় না। সে সরিয়ে নিয়ে চায়, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে সে হাত সরাতে পারছে না। ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। তার চোখে এখন জান্তব উল্লাস। ভীষন লোভে চোখ ঝক ঝক করছে। সুপ্তি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে। সাথে সাথে ইভান আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ছবি মিলিয়ে যায়।
সুপ্তি তারপরো পরের রাতের জন্য অপেক্ষা করে। আবার ইভান আসে, হাতে হাত রেখে তারা গল্প করে। ইভান চলে যায়। ইভান দিনে দিনে আরো সুন্দর হয়।ফ্যাকাশে গালে গোলাপী ছোপ লাগে। মাত্র ৩ দিনেই সুপ্তির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। কিছুতেই সে কোন শক্তি পায় না। চোখের কোণে কালি। তার মা ব্যস্ত হয়।
“কি হয়েছে রে সুপ্তি? তুই দেখতে এমন হচ্ছিস কেন? রাতে ঘুমাস না?”
সুপ্তি দুর্বল কন্ঠে প্রতিবাদ করে। “কই মা, ঠিকই তো আছি”।
পরের দিন ক্লাসে দ্বিতীয় পিরিয়ডেই সুপ্তি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি তার বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে। খবর পেয়ে তার আম্মু আব্বু আর সুকন্যা দৌড়ে আসে। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে অবাক হয়ে যায়। কোন রক্তপাতের ইতিহাস নেই, কিন্তু কি ভীষন রকম রক্তশূন্যতা। রক্তের রিপোর্টে দেখা যায় হিমোগ্লোবিনের লেভেল কমে ৪গ্রাম/ডিএল এ এসেছে। যেখানে তার থাকার কথা নিদেন পক্ষে ১৩। ডাক্তার বলে এখনি রক্ত দিতে হবে। আম্মুর সাথে রক্তের গ্রুপে তার মিল আছে। বন্ধুরা দৌড়ে আরো দুই ব্যাগ জোগাড় করলো। সুপ্তির আম্মু ক্রমাগত কাঁদতে থাকে, কি অসুখ ডাক্তার তখন কিছুই বলতে পারছে না। এরকম হলে নাকি ক্যান্সারের সম্ভাবনা দেখা যায়। আম্মুর অফিসের কলিগের ফুফাতো ভাইএর ছেলের তো তাই হলো। রাত বাড়ার সাথে সাথেই সুপ্তি অস্থির হয়ে যায় বাসায় যাবার জন্য। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, রক্ত না দিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে না। আম্মু আব্বুও কোন রিস্ক নেবেন না। কিন্তু ইভানের যে আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। সারাটা রাত সুপ্তির অস্থিরতার সাথে কাটে। পরের দিন সে কান্নাকাটি করে হাসপাতালে থেকে সন্ধায় বাসায় ফিরে আসে। সে কথা দেয় যে রক্ত নিতে সে কালই আবার আসবে। রাতে আম্মু সাথেই থাকতে চায়, কিন্তু সুপ্তি মানা করে। রাত ২টা বাজতেই সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কিন্তু ইভান কই?
সুপ্তি ইভান কে অনেক ডাকে। অনেকবার করে ক্ষমা চায়, বার বার করে তার অসুস্থতার কথা বলে। কিন্তু ইভান তো আসে না। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়ে।রাত সাড়ে তিনটার দিকে তীব্র অস্বস্তির সাথে তার ঘুম ভাঙ্গে। ঘরে বিকট গন্ধ। এত ঠান্ডা যে সুপ্তি কেঁপে কেঁপে উঠে। গন্ধে সুপ্তির বমি চলে আসতে থাকে। অনেক কষ্টে নাকে হাত চাপা দিয়ে সুপ্তি আয়নার সামনে আসে। ভিতরে আবছা একটা ছায়া। সুপ্তি ডাকে, “ইভান?”
ছায়ামূর্তি ঘুরে তাকায়। সুপ্তি আতংকে স্তব্ধ হয়ে যায়। এ কে? কি ভীষন চেহারার এক বুড়ী। সাদা শনের মত চুল, চোখ দুটো ধক ধক করে যেন জ্বলছে, কি তীব্র জিঘাংসা তার মাঝে। চামড়া শত শত বছরের পুরনো চামড়ার মত ঝুলে পড়েছে। লাল জিহবা মাঝে মাঝে সাপের মত লকলক করছে। খলখল করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো বুড়ী। সুপ্তির বোধবুদ্ধি সব লোপ পায়। তার পা কে যেন পাঁচ মণ পাথর দিয়ে আটকে রেখেছে; কন্ঠস্বর হয়েছে রুদ্ধ। সে শুধু ভীত শশকের মত চেয়ে রইলো।
আবার হেসে উঠলো বুড়ী। অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে বললো্, “হাত বাড়া সামনে”।
সুপ্তি তীব্র আতংকে মাথা নাড়লো। বুড়ী চিৎকার দিলো, “হাত বাড়া বলছি”।
সুপ্তির ডান হাত তার আয়ত্তের বাইরে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করেও তার হাতকে আটকাতে পারলো না, হাত আয়না স্পর্শ করলো।
ভীষণ অট্টহাসিতে ঘর ভরে গেলো। এমন জান্তব ভয়ংকর গা শিউরানো হাসির যে পৃথিবীতে অস্তিত্ত আছে সুপ্তি তাই জানে না। এর জন্ম এ পৃথিবীতে না, অন্য কোথাও। অন্য কোন জগতে। পচা মাংসের তীব্র গন্ধ সইতে না পেরে সুপ্তি বমি করে ফেললো ঘরের মাঝেই।
বুড়ি খল খল করে হাসতে হাসতে বললো,
“ইভান কে পেয়েছিস তুই? তোর প্রাণের ইভান? আমিই তোর ইভান। ১০০ বছর পর আজ আমি মুক্তি পেয়েছি। আমি, আজিনাহা! আহ, কি আনন্দ!”
সুপ্তির মাথা কাজ করে না। সে মেঝেতে বসে থর থর করে কাঁপতে থাকে।
“আজ থেকে আমি তোর মাঝেই থাকবো। তুই রাতে যখনই ঘুমাবি, আমি তোর মাঝ থেকে জেগে উঠবো। ১০০ বছর আমি কোন রক্তের স্বাদ পাইনি। আজ আমার রক্ত চাই, অনেক অনেক রক্ত”।
সুপ্তি জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে অনুভব করতে পারে, একটা শীতল ছায়া তার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে।
সকালে জ্ঞান ফিরে সে দেখতে পায়, আম্মু তাকে নিয়ে আবার হাসপাতালে চলে এসেছে। তবে সে অনেক সুস্থ বোধ করছে। ডাক্তাররা রিপোর্ট দেখে অবাক। মাত্র ৩ ব্যাগ রক্ত পেয়ে হিমোগ্লোবিন লেভেল বেড়ে ১৬তে ওঠা এক কথায় অসম্ভব। বাংলাদেশের রিপোর্টের অবস্থা দেখে ডাক্তাররা ভীষন রাগারাগি করতে লাগলেন। এই রিপোর্ট অবশ্যই ভুল। কিন্তু চোখও তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগের দিন যে মেয়ের চোখ একেবারে কাগজের মত সাদা ছিল, তার তো এখন একদম স্বাভাবিক চোখ। রিপোর্ট দিয়ে আব্বু আম্মুর মাথা ব্যথা নেই, তাদের মেয়ে সুস্থ, তাতেই তারা খুশী। কিন্তু সুপ্তির মাথা এখনো কাজ করছে না। তার সাথে এসব কি হচ্ছে? বাসায় ফিরে সুপ্তি আয়নার দিকে তাকায়। এ যেন একদম স্বাভাবিক আয়না। তার মাঝে কি বুড়ীটা ঢুকে পড়েছে? কই? তার তো একদম স্বাভাবিক লাগছে, যেন কিছুই হয়নি। আর ইভান? ইভানকে কি বুড়ী আয়নায় বন্দি করে রেখেছে? ইভান ছাড়া সে বাঁচবে না।
রাত বাড়ার সাথে সাথে সুপ্তি অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। কি যেন তার মাঝে জেগে উঠতে চাইছে। ভীষন ঘুমে তার দুই চোখ জড়িয়ে আসছে। রাত ১২টা বাজতেই সুপ্তি গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সারাটা রাত সুপ্তি ভয়ংকর ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখে। সে যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে বিশ্রী মাংস পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। সে রক্তের স্বাদ পেতে থাকে। সে রক্তে যেন মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। কি বিশ্রী ভাবেই না সে হাসছে। চিৎকার দিচ্ছে, জান্তব উল্লাসে সে যেন ফেটে পড়ছে।
খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙ্গে। সারা শরীরে কালসিটে পড়ে গেছে, ভীষন ব্যথা। নিজের দিকে তাকিয়ে তার চোখ বিষ্ফোরিত হয়। টি শার্ট রক্তে মাখা মাখি। বাথরুমে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে সে, মুখ হাত সবই রক্তে মাখা মাখি। এবং সে জানে অবশ্যই এই রক্ত মানুষের রক্ত। কাঁদতে কাঁদতে সে গোসল করতে থাকে। সে এখন পিশাচীনী। এক ভয়ংকর পিশাচ তার মাঝে ঢুকে পড়েছে। সে যখনই ঘুমাবে, পিশাচ জেগে উঠবে। এখন সে কি করবে?
আম্মু দরজা ধাক্কাতে থাকে, “এই সুপ্তি, তোর রুমে নিশ্চই ইঁদুর মরেছে রে, এত বাজে গন্ধ কেন? আজই রুম ফিনাইল দিয়ে পরিস্কার করাবো বুয়াকে দিয়ে। আগে চল বাইরে যাই”।
সুপ্তি বলে উঠে, “আমি কোথাও যাবো না আম্মু”।
আম্মু ধমকে উঠে, “কথা বাড়াবি না। কত কষ্টে তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিলাম, আর বলিস বাইরে যাবি না?”
সুপ্তি রেডি হয়ে ডাইনিং এ আসতেই শুনলো বুয়া আম্মুর সাথে কথা বলছে উত্তেজিত ভাবে। কয়েক গলি পাশেই তার বস্তি। সেখানে নাকি আজকে একটা অদ্ভুত লাশ পাওয়া গেছে। কেউ লাশের গলায় কামড় দিয়ে ধমনী ছিড়ে সব রক্ত শুষে নিয়েছে। পুলিশ কোন কিনারাই করতে পারছে না। সুপ্তি ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। এটা অবশ্যই ডাইনী আজিনাহার কাজ। আম্মু তার অবস্থা দেখে বুয়াকে ধমকায়, “যাও তোমার কাজ করো। আমার মেয়েকে ভয় দেখিও না”।
আম্মুর সাথে সুপ্তি বেরোয়। আজ থেকে সে আর ঘুমাবে না। রাতে যত কষ্টই হোক সে ঘুমাবে না। ডাইনীটাকে সে জেগে উঠতে দেবে না।
সে জিজ্ঞেস করে, “আম্মু কোথায় যাচ্ছি?”
আম্মু লাজুক ভাবে বললো, “চায়ের সেটটা খুবই পছন্দ হয়েছে বুঝলি। দেখি ওই বাড়ির চৌকিদার যদি এখনো সেটা বিক্রি না করে থাকে, তবে নিয়েই আসি”।
আবার সেই অভিশপ্ত বাড়ি; যেখান থেকে আয়না এসেছে। সুপ্তি আতঙ্কে বলে, “না না আম্মু, ঐ বাড়িতে যাবো না”।
আম্মু অনুনয় করে, “লক্ষী মা, তুই বাইরে থাকিস, আমি যাব আর নিয়ে আসবো”।
বাড়িটি আগের মতই আছে, ১৫ দিকে কোন পরিবর্তনই হয় নি; তবে সাবেকী আমলের বৈঠক খানার আসবাবপত্র অনেক কমেছে। ভালোই বিক্রি হয়েছে মনে হয়। তাদের দেখেই চৌকিদার বলে উঠলো,
“আমি জানতাম, আপনারা আসবেন। তাই চায়ের সেট তুলে রেখেছি”।
চৌকিদার তীব্র দৃষ্টিতে সুপ্তির দিকে তাকালো। সুপ্তির মনে হলো, উনি সব দেখতে পাচ্ছেন। সব কিছু জেনে যাচ্ছেন। ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সে ওই অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে। আম্মু চায়ের সেট দামাদামি করে কিনে ফেললেন। সুপ্তি বেরিয়ে যাবে, তখন বুড়ো মানুষটি তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি তোমার একটা জিনিস ফেলে গেছো। আমি জানতাম তুমি তা নিতে আসবে”।
সুপ্তি অবাক হয়ে দেখলো, তার হাতে সেই ডায়েরী।
“এটা…… এটা আমার নয়”। ঢোক গিললো সে।
মানুষটি কোন কথা না বলে ডায়েরী বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আম্মু বাইরে থেকে তাড়া দিচ্ছেন। সুপ্তি দেখলো বুড়ো মানুষটির চোখে সহৃদয়তার ছোঁয়া। সুপ্তি হাত বাড়িয়ে ডায়রীটি নিলো। মানুষটি বললো,
“ভালো থেকো। আমারো তোমার মত একটি মেয়ে আছে”।
সুপ্তি বাসায় ফিরেই ডায়েরী খুললো। ১০০ বছরের পুরনো ডায়েরী, কিন্তু সে তুলনায় অবস্থা যথেষ্ট ভালো। কেউ সংরক্ষন করেছে যেন। পাতা গুলি হলদেটে, কিছু কিছু জায়গায় কালি ছড়িয়ে গেছে; কিন্তু বেশ কিছু লাইন পড়া যায়। ডায়েরী বেশ কিছু পাতা মাঝ থেকে নাই হয়ে গিয়েছে। ডায়েরীর প্রথম পাতায় লেখা, “আমার জীবন নামা”। নীচে লেখিকার নাম দেয়া; মালবিকা রায়। ১০০ বছর আগে এই মেয়েটিও হাসতো, খেলতো, ডায়েরী লিখতো, আজ সে কোথায়? প্রথম দিকে শুধু ঘর কন্নার গল্প। আজ তার বান্ধবী এসেছে, কাল বাবা ঘোড়া্র গাড়িতে চড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছে। পড়তে পড়তে টের পেলো, সে বাবা-মায়ের অতি আদরের এক কিশোরী কন্যার লেখা পড়ছে। ডায়েরীর মাঝা মাঝি একটি পৃষ্ঠা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। একটি লাইন অতি কষ্টে পড়া যায়,
“আজ বাবা আমাকে চমৎকার একটি আয়না দিয়াছেন। শ্মশান ঘাটের বিখ্যাত তান্ত্রিক বাবাকে উহা দিয়াছেন”।
সুপ্তির গা শিউরে উঠলো। এর পরের পাতা গুলি সবই অল্পবিস্তর পানিতে ভেজা; কালি ছড়িয়েছে। এর পর পাতায় পাতায় যা পড়া গেলো সবই আয়নার গল্প। একটা লাইন পড়ে চমকে উঠলো সুপ্তি,
‘আয়নায় আমার জন্য বাবা রাজপুত্র পাঠাইয়াছেন’।
থর থর করে ভেতর টা কেঁপে উঠলো সুপ্তির। মালবিকাও তার মত রাজপুত্র দেখেছিল। তবে তার রাজপুত্রের নাম কুমার বীরেন্দ্র; ইভান নয়। সুপ্তি বুঝলো, ইভান যথেষ্ট আধুনিক নাম। যুগে যুগে ডাইনী রাজপুত্রের নাম বদলায়। ইভান নামে কেউ নেই, ইভান একটা মায়া। সুপ্তি ফুঁপিয়ে উঠলো। ইভানের বেশ ধরে ডাইনী তার রক্ত নিয়ে হয়েছে শক্তিশালী। সে প্রতারিত; যেমনটি হয়েছিল বেচারী মালবিকা। সুপ্তি কান্না সামলাতে সামলাতে পড়ে চললো। এর পর শুধুই ভালোবাসার গল্প; শুধুই রাজপুত্রের গল্প। সুপ্তির দুই গাল বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো।
বেশ কয়টি পৃষ্ঠা ঝরে গেছে। এর পরের পাতায় দুই তিনটা লাইন কোনক্রমে পড়া যায়। তাতে লেখা,
“আমার রাজপুত্রকে ডাইনী ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। ডাইনী আমার মাঝে বসবাস করিতেছে। হায় ভগবান, আমি কি করব?”
পরের পৃষ্ঠাগুলো মর্মান্তিক। ডাইনী রুপী মালবিকা নিজের বাবাসহ আরো অনেককে হত্যা করে রক্ত খেয়েছে, পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়েছে এক অজানা আতঙ্ক। তীব্র অনুশোচনায় মালবিকা পাগল প্রায়। সে ঘুমায় না, ঘুমাতে চায় না। কিন্তু তারপরো ঘুমিয়ে পড়ে।
সুপ্তি থর থর করে কাঁপতে থাকে। যদি আজিনাহা আজ রাতে তার আম্মু আব্বুকে মারে? অথবা সুকন্যাকে? না, তার প্রিয় মানুষদের ক্ষতি সে হতে দেবে না। দরকার হলে সে আজ এখনি আত্মহত্যা করবে। ডায়েরী পড়তে পড়তে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়েছে। সুপ্তি কাঁপতে কাঁপতে পড়ে চললো।
হঠাৎ আম্মু এসে বাধা দিলো।
“এত গল্প বই পড়তে হবে না। শিরিনের ননদের আজ বিয়ে, ভুলে গেছিস? যা রেডি হ”।
সুপ্তি কাতর কন্ঠে বললো, “আম্মু প্লিজ, আজ আমি আর কোথাও যাবো না। প্লিজ আম্মু”।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মু একটু ভয় পেলেন। “কি হয়েছে রে মা?”
“কিচ্ছু হয় নি আম্মু। আমার মাথা ধরেছে”।
আম্মুর ভয় কাটলো না। “আমিও যাবো না, আবার যদি তুই অজ্ঞান হয়ে যাস?”
“না না আম্মু, আমি শুধু ক্লান্ত। আর মোবাইল তো অনই আছে। তোমরা যাও”।
সবাইকে বিদায় দিয়ে সুপ্তি আবার ডায়েরী পড়তে লাগলো। কিছু পাতা বাদ দিয়ে হঠাৎ দেখলো জান্নাত আশার আলো দেখছে। সে পড়তে লাগলো,
“অদ্য আমি উপায় পাইয়াছি, কি করিয়া ডাইনী আজনাহা কে আবার আয়নায় ফেরত পাঠাইবো। তাহাকে ধ্বংস করা অসম্ভব; অতো শক্তি আমার ফকিরের নাই। কিন্তু ফকির বাবা উপায় দিয়াছেন। মধ্য রাত্রিতে যখন আজিনাহা আমাকে ঘুমের দেশে ঠেলিয়া দিবার জন্য সকল মায়াজাল বিস্তার করিবে, আমাকে তাহা প্রতিহত করিতে হইবে। আয়নাটির সম্মুখে অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করিতে হইবে। ডাইনী আমাকে যত প্রকার কষ্টই প্রদান করুক না কেন, আমাকে তাহা সহ্য করিতে হইবে।আমাকে বার বার বলিতে হইবে,
আজিনাহা তুই তোর রাজ্যে ফিরিয়া যা
রক্তপিপাসু তুই নিপাত যা
হত্যাকারী, তুই তোর অন্ধকার দুনিয়াতে ফিরিয়া যা।
অতঃপর আ্জিনাহা অগ্নিশিখার উত্তাপ সহ্য করিতে না পারিয়া যখন কথা বলিবে, তখন ছুরি দিয়া আমার হাতের ধমনী কাটিয়া রক্ত অগ্নিশিখাকে দান করিতে হইবে। এতে আমার জীবন সংশয় হইবে, আমি মারাও যাইতে পারি; কিন্তু আর নিরপরাধ লোকদিগকে আমি জীবন দিতে দিব না। আমি কুমার বীরেন্দ্রকে হারাইয়াছি, নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাবাকে হত্যা করিয়াছি; আমার মা পাগল হইয়াছেন- জীবন থেকে আমার পাওয়ার আর কিছুই নাই”।
সুপ্তি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে এগারোটা বাজে। আত্মীয়ের বিয়ে, তাই সবাই বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরতে রাত সাড়ে ১২টা/১টা বাজাবে। ১২টা বাজতে আর বাকি ৩০ মিনিট। সে নিজের জীবন দেবে, কিন্তু তার প্রিয় মানুষগুলোর কোন ক্ষতি হতে দেবে না। সুপ্তি রান্নাঘরে গিয়ে যত কাগজের প্যাকেট পেলো সব নিয়ে তার রুমে জড়ো করলো। ছোট একটা নড়বড়ে কাঠের টুল ছিল, তাও নিয়ে এলো। ছুরিটা রাখলো তার ডান পাশে। কেরোসিন ঢেলে সে আগুন জ্বালিয়ে দিলো আয়নার সামনে। ধোঁয়ায় সুপ্তি কাশতে লাগলো। তাড়াতাড়ি করতে হবে। আগুন যদি বেশী বেড়ে যায়, তবে বিল্ডিং এ ধরে যেতে পারে। সতর্কতার সাথে সে আগুনে ভাঙ্গা টুলের পা আর কাগজ দিতে লাগলো। ধোঁয়া চারিদিক গ্রাস করে ফেললো। এর মাঝে সুপ্তির ভীষন ঘুম পেতে লাগলো। সুপ্তি টের পেলো আজিনাহা বেরিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু করেছে। সুপ্তি জোরে জোরে বলতে লাগলো,
আজিনাহা তুই তোর রাজ্যে ফিরে যা
রক্তপিপাসু তুই নিপাত যা
হত্যাকারী তুই তোর অন্ধকার দুনিয়াতে ফিরে যা।
সুপ্তি টানা বলে যেতে লাগলো। ধোঁয়া তার ফুসফুসে ঢুকে যাচ্ছে, কাশির দমক সামলে সে বলে যেতে লাগলো। ঘুমে তার দুই চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণ চেষ্টাতেও খুলে রাখা যাচ্ছে না। সুপ্তির মনে হতে থাকলো, আ্জিনাহা জাহান্নামে যাক, আমি একটু ঘুমাই। তখনই তার বাবা-মার চেহারা ভেসে উঠলো তার সামনে। সুপ্তির বুকে নতুন করে বল এলো যেন। সুপ্তি আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো,
আজিনাহা তুই তোর রাজ্যে ফিরে যা।
উফফ, কি ব্যথা! কেউ যেন ধারালো ছুরি সুপ্তির আঙ্গুলের ফাঁকে চালাচ্ছে। তীব্র ব্যথায় সুপ্তি কাঁদতে লাগলো। কিন্তু মন্ত্র পড়া থামালো না। বরফ শীতল চাই কেউ সুপ্তির নাকে ঠেশে ধরেছে, এক বিন্দু বাতাসের জন্য ফুসফুস আকুলি বিকুলি করছে; সুপ্তি মনে প্রাণে চাচ্ছে সে এখনি মারা যাক। কিন্তু আজনাহা তাকে মরতেও দেবে না। সুপ্তি হাঁস ফাঁস করতে করতে বলতে লাগলো, তুই নিপাত যা। কতক্ষন সে কষ্ট সহ্য করছে সে জানে না, তার এখন কোন বোধও নেই। সে শুধু ভাঙ্গা রেকর্ডের মত একই কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ তীব্র বোটকা গন্ধে চারিদিক ভরে গেলো। শীতল ভেজা ভেজা স্পর্শ আগুনের উত্তাপ থাকা সত্বেও টের পাওয়া যাচ্ছে। সুপ্তি আরো জোরে জোরে বলতে লাগলো। আজনাহার তীব্র বিদ্রুপাত্মক খল খল হাসির শব্দ শোনা গেলো। সুপ্তির ভয়ে গায়ে কাঁটা দিলো। সে নিজেকে সাহস দিলো, আজিনাহা তোমাকে মারবে না, তুমি ওর আবাস। ভাবতেই ঘেন্নায় তার বমি এলো।
আজিনাহার অশ্রাব্য গালাগালি শোনা গেলো।
“তুই কি চাস? তোর কি ধারণা এসব করলেই আমি চলে যাব? আমি আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী! এসবে আমার কিছুই হবে না”। খল খল হাসি বয়ে গেলো চারিদিকে।
সুপ্তি কোন কথা না বলে ছুরি হাতে নিলো।
আজনাহার বিশ্রী কন্ঠ শোনা গেলো,
“তুই যে হাতের ধমনী কাটলে মরে যাবি, তা কি তুই জানিস? তুই মরে গেলে তোর বাবা মার কি হবে? তোর মাও যে আত্মহত্যা করবে তা জানিস?”
সুপ্তি কেঁপে উঠলো। আজিনাহা সন্তষ্টির হাসি হাসলো মনে মনে।
ডাইনী বলে চললো, “তোর বন্ধুরা পরীক্ষা শেষে সেন্ট মার্টিন যাবে, আর তুই যাবি কবরের তলায়। তোকে কেউ মনে রাখবে না”।
সুপ্তি ফুঁপিয়ে উঠলো।
“ছুরি নামিয়ে রাখ বদমাইস মেয়ে। নিজের কথা ভাব। তুই মরলে তুই আর ইভানকে দেখতে পাবি ভেবেছিস? আমি জানি ইভান কোথায় আছে। ইভানকে চাস না তুই?”
সুপ্তি চোখ বুজ়ে রইলো। তারপরে সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “না না না, ইভান কে চাই না। ও একটা মায়া। তুই জাহান্নামে যা”।
বলেই ছুরি দিয়ে বাম হাতের রেডিয়াল আর্টারি কেটে ফেললো। রক্ত ধারা আগুনে পড়তে লাগলো। আগুন যেন রক্ত পেয়ে পাগল হয়ে গেলো।
আজিনাহা ভয়ংকর ভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলো, “না না না”। সাথে অশ্রাব্য সব গালাগালি।
শেষ শক্তি দিয়ে সুপ্তি তার হাত আগুনের উপরে ধরে রাখলো; এর পর আস্তে আস্তে ঢলে পড়লো। এখন সে ঘুমাবে, শান্তির ঘুম ঘুমাবে। দরজায় কে এখন ঘন্টা বাজাচ্ছে? তারা কি জানে না সুপ্তি অনেক ক্লান্ত?
পরিশিষ্ট:
অভিশপ্ত আয়নাটাকে সুপ্তি ভাঙ্গার অনেক চেষ্টা করেও না পেরে সেটিকে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়েছে। ডায়েরীটি যে খুব যত্ম করে বুড়ো মানুষটিকে ফেরত দিয়ে এসেছে। বুড়ো তাকে চা খাইয়েছে, এবং যাবার সময় বলেছে, “আমি জানতাম, তুমি ভালো থাকবে”।
সুপ্তির রূপকথার রাজকুমার এখনো আসে নি। তবে সুপ্তি জানে যে সুমন তাকে নিয়ে লুকিয়ে কবিতা লেখে। প্রায়ই সে সুমনের ডায়রীর মাঝে লুকিয়ে গোলাপ, কৃষ্ণচূড়া এমনকি বাঁদরলাঠি ফুলের পাপড়িও রেখে আসে। সুমন এখনো ধরতে পারেনি কাজটা কে করে।
৬ মাস পরের ঘটনাঃ
কামরাঙ্গি চরের বিন্তি প্রতিদিনের মত আজ সকালেও দাঁতন করতে করতে নদীর পাড়ে এসেছে। দূরে কিছু একটা চক চক করছে। আলো পড়লেই ঝিকিয়ে উঠছে। আয়না নাকি? বিন্তি আগ্রহ ভরে এগিয়ে যেতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২১