আয়নাটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপ্তি। চমৎকার ডিম্বাকৃতির আয়না, চারপাশে লাল আর কালোর অদ্ভূত নকশা করা বর্ডার। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে আয়নার উপরে বসানো দুইটি ময়ূর। ময়ূর দুটির লেজ আয়নার দুই পাশে ঝুলে রয়েছে। চোখ গুলিতে কি পাথর বসানো কে জানে, লাল রঙ এর চোখগুলো আলো না পড়লেও যেন ঝিকমিক করছে। প্রথম দৃষ্টিতেই আয়নাটির প্রেমে পড়ে গেলো সে। এরপর পুরো ঘরে এক চক্কর দিয়ে আবার সেই আয়নার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। মনের কল্পনায় দেখছে, আয়নাটিকে তার রুমের ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়ালে কি চমৎকারই না দেখাচ্ছে। আয়নার দাম যে তার নাগালের বাইরে হবে, সে নিয়ে সুপ্তির মনে কোন সন্দেহ নেই। তার স্কলারশিপের টাকা বেশীর ভাগই সে মনের আনন্দে উড়িয়েছে। সেটা নিয়ে এখন তার অনেক মন খারাপ হলো।
সে এসেছে তার মায়ের সাথে পুরান ঢাকার গলির মাঝে তস্য গলির তিনতলা এক বাড়ীতে। বাড়ীটি এত পুরনো যে যে কোন সময়ে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়বে। সেই কোন আমলের জমিদার বাড়ি, বয়স প্রায় ৩০০ বছর।অনেক বছর বাড়িটি বন্ধ থাকার পর কে বা কারা যেন পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে অ্যান্টিক পুরনো আসবাবপত্র বিক্রি হবে। তার মার সখ অ্যান্টিক শো পিসের, একারনেই শুক্রবারের সকালে আরাম ছেড়ে তারা এখন এই পুরনো বাড়ীর বৈঠক খানায় দাঁড়ানো। সুপ্তি পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, তৃতীয় বর্ষে। শুক্রবারে তাকে বেলা ১২টার আগে বিছানা থেকে তোলা কষ্টসাধ্য নয়, একেবার দুঃসাধ্য কাজ। আজকে সেই কাজটি তার আম্মু, নাসরিন বেগম ওরফে নাসু, করতে সক্ষম হয়ে আব্বুর কাছ থেকে বাজীর ৩০০০ টাকা আদায় করেছে। সেই টাকা নিয়েই নাসরিন ঢু মারতে এসেছে এই পোড়ো বাড়িতে। তার আম্মুর ইতোমধ্যে একটা পানের বাটা আর একটি ফুলদানি খুবই পছন্দ হয়েছে। এখন সে দরদাম করতে ব্যস্ত সাদা চুলের বুড়োর সাথে। সেই এই বাড়িটি দেখাশোনা করে। বাড়িটির বর্তমান মালিক জন্মের পর থেকেই আমেরিকা। একবারো দেশে আসেনি। এখন সে চায় সব কিছু বিক্রি করে দেশের সাথে সম্পর্ক একেবারেই মিটিয়ে দিতে।
এক ফাঁকে সুপ্তি বাড়ি নীচতলা পুরোটাই ঘুরে এসেছে। সবকিছুইর ঝুরঝুরে দশা। দোতলার একটি ঘর কোনমতে আস্ত আছে, যেটিতে বুড়ো চৌকিদার থাকে। তিনতলায় কেউ ওঠে না প্রায় নাকি ১০০ বছর হয়ে গেছে। নীচ তলার রুমগুলি এখনো কিছুটা আস্ত আছে বটে, কিন্তু ভ্যাপসা গন্ধ আর প্রচন্ড ধূলা। এক কালের রঙিন কাঁচ গুলো অবহেলা আর পরিচ্ছন্নতার অভাবে ধূলি ধূসরিত। ঘুরতে ঘুরতে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে পড়ে সুপ্তি। বিশাল কাঠের দরজা, এককালে হয়ত চমৎকার কাঠের কাজ করা ছিল; এখন তার উপরে কয়েক পরত ধূলার আস্তরন। সুপ্তি টানাটানি করতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেলো। রুমটি বেশী বড় নয়, মাঝারি আকৃতির। ভিতরে ঢুকে সুপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে বিশাল বিশাল সব আলমারি, আর তাতে না হলেও হাজার দশেক বই হবে। এ বাড়ির লাইব্রেরী বোধ হয়। মাকড়সার জাল সরিয়ে সরিয়ে ঢুকতে হয়, অবস্থা এতই করুণ। ঝটপট শব্দ হচ্ছে, তার মানে ইঁদুরের সাম্রাজ্য।সাথে চামচিকাও অবশ্যই আছে। ঘরের কোনে একটা লাঠি পেয়ে সেটা নিয়েই সুপ্তি এগুতে থাকে জাল সরিয়ে।একটা আলমারি টানাটানি করে খুলতে ব্যর্থ হয়। সব মনে হয় তালা দেয়া। ঘরের এক কোনে একটা টেবিল আর ইজি চেয়ার। চেয়ারের কোন দশা নেই, কি করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তা এক বিস্ময়। টেবিলের উপরে এখনো কিছু বই ইতঃস্তত পড়ে আছে। শত বছর আগে এই টেবিলে বসেই কেউ লিখতো, বই গুলি পড়তো – ভাবতেই সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সবকিছুর উপর শত বছরের ধূলা। সুপ্তি ভাবলো তার মা এই রুমে এলেই সর্বনাশ। মার প্রবল ডাস্ট এলার্জি। বাসার সব ধূলা ঝাড়াঝাড়ি সুপ্তি আর তার বাবাকেই করতে হয়। সুপ্তি টেবিলের রাখা বইগুলোর উপর থেকে হাত দিয়েই ধূলা সরাতে থাকে। কালো মলাটের একটি মোটা বই, প্রথম পাতা খুলতেই ঝুর ঝুর করে সব খসে পড়লো। পাতা নেই বললেই চলে, যা আছে সব ইঁদুর আর পিঁপড়া মিলে ভোগে লাগিয়েছে। কিসের বই বোঝার কোন উপায় নেই। বইটির পাশে ছোট একটি ডায়েরী। সুপ্তি অবাক হয়ে দেখলো সবকিছুর ধূলার সাম্রাজ্যে ঢাকা হলেও ডায়েরীটি যথেষ্টই পরিস্কার। কেউ যেন নিয়মিত এর ধূলা ঝাড়ে। পাশেই কালির দোয়াত, তার মাঝে পাখির পালকের কলম। ধূলায় রঙ অস্পস্ট। সুপ্তি ডায়েরীটি তুলে নিল।
“এখানে কি চাই?” – গম্ভীর রাগী গলায় কেউ একজন প্রশ্ন করলো।
সুপ্তি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে ডায়েরী ফেলে দিলো। আতংকে তার গলা রুদ্ধ হয়ে গেলো, কোনমতে পিছনে ফিরে দেখলো বুড়ো চৌকিদার কোন ফাঁকে চলে এসেছে। এত তন্ময় হয়ে সুপ্তি সব দেখছিলো যে সে বুঝতেই পারেনি অন্য কেউ ঘরে প্রবেশ করেছে। তোতলাতে তোতলাতে সে জবাব দিলো,
“এই তো, এমনি। এমনি আমি সব ঘুরে দেখছিলাম”।
বুড়ো চৌকিদারের চোখ রাগে ধক ধক করে জ্বলছে।
চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“কখনো এমন কোথাও যেতে হয় না যেখানে তুমি অবাঞ্চিত। এমন কোন কিছু স্পর্শ করতে হয় না যা তোমার নয়। তোমার কৌতুহল তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই”।
সুপ্তির কাঁপুনি বেড়ে গেলো। আজকাল সে অনেক সাইকো থ্রীলারের ছবি দেখে তার বন্ধু চৈতীর পাল্লায় পড়ে। এই লোকটিও সাইকো নয় তো?
“আমি…… আমি দুঃখিত। বুঝতে পারিনি”। কাঁপা কন্ঠে কথা গুলো বলেই লোকটির পাশ দিয়ে দৌড় দিলো সুপ্তি। দরজা দিয়ে বের হতে হতে সে শুনতে পেলো লোকটি কারন ছাড়াই হাসছে।
বাইরে বৈঠক খানায় এসে দেখলো তার মা চার পাঁচটি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। যেতেই সুপ্তি ধমক খেলো।
“অ্যাই পাজি মেয়ে, কোথায় ছিলি তুই? জানিস আমি কতক্ষন ধরে খুঁজছি। বাসায় যেতে হবে না? রান্না কি ভূতে করে দিয়ে যাবে?”
সুপ্তি কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। রাস্তায় লোকজনের মাঝে না গেলে তার কাঁপুনি কমবে না। অদ্ভূত কিছু একটা আছে এই বাড়ীতে। এক মূহুর্ত সে এখানে থাকবে না।
বুড়ো চৌকিদার ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সুপ্তির মা তার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভাবে বললেন,
“মেয়েটা আমার বড় পাগলী হয়েছে। তাহলে আজ আসি?”
“জ্বী জ্বী। তবে কি আমি চায়ের সেটটি আপনার জন্য রাখবো? একেবারে খাঁটি পুরনো জিনিস কিন্তু, ১৫০ বছরের কম বয়স না”।
সুপ্তির মা দুঃখের সাথে মাথা নাড়লেন, “যে দাম বলছেন, তাতে কোন ভাবেই সম্ভব না”।
“আরেকটু না হয় কমালাম, আপনি এত জিনিস নিলেন”।
সুপ্তির মা কিছুক্ষন ভেবে বললেন, “আপনি দিন ১৫ যদি রাখতে পারেন তবে ভালো হয়, এর পর আমি এসে নিয়ে যাবো”।
“ভালো খদ্দের না পেলে রাখবো। আপনি খবর নিয়েন”।
প্রথম দুই তিন দিন সুপ্তির রাতে একা ঘুমুতে একটু ভয় ভয় করছিলো; কিন্তু তার ছোট বোন হচ্ছে পাজির পা ঝাড়া। কি ভেবে যে আব্বু তার নাম সুকন্যা রেখেছে সে আল্লাহ মালুম। একবার যদি শোনে যে সুপ্তির রাতে ঘুমুতে ভয় করছে, ফোন করে করে সবার কাছে খবর পৌঁছে দেবে। তাই সে যে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাচ্ছে, তা কাউকে জানতে দিলো না। দিন তিনেক পরেই সব আগের মত। অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার ধাক্কায় সুপ্তির জীবন আবার আগের ধারায়ই চলতে লাগলো।
২৪শে এপ্রিল সুপ্তির জন্মদিন। ২৩শে এপ্রিল রাতে সে খুবই আনন্দ নিয়ে জেগে থাকে। প্রতিবারই জন্মদিনে রাত ১২টা এক মিনিটে সে বেশ কিছু উপহার পায়। তার মাঝে কিছু উপহার গৎবাঁধা। তার ভালো মানুষ বাবা একটা খামে শুভ জন্মদিন লিখে কিছু টাকা দেবে, যেটাতে সে বন্ধুদের খাওয়ায়। তার পাজি বোন একটা কার্ডে হ্যাপী বার্থডে লিখেই খালাস। ছোট খালা উপহার আগেই পাঠিয়ে রাখে। প্রতি বছরই সে একটা করে জামা পায়। পাশের বাসার নীনা আন্টির কেক পুরো বিল্ডিং এ হিট। নীনা আন্টি একটা কেক বানিয়ে আনে। গত বছর নীনা আন্টির ৪ বছরের ছেলে কৌশিক একটা ললিপপ দিয়েছিল। যেটা দেয়ার আগে আবার সে খানিকক্ষন খেয়েছে। এবছর কি করবে কে জানে! তবে তার আম্মুর দেয়া উপহার সবসময়ই ব্যতিক্রম। কোনবারের সাথে কোন বারের টা মিল থাকে না। এই তো দুই বছর আগে সে পেয়েছিলো রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট, গত বছর আম্মু তার জন্য কিনে এনেছিল মুক্তার চমৎকার একটা সেট। পার্টিতে সে প্রায়ই সেটা পড়ে। এবছর কি পাবে তা নিয়ে সে খুবই উত্তেজিত। শুয়ে শুয়ে সে ঘুমের ভান করতে লাগলো। ১২টা ১ বাজার সাথে সাথে সবাই হ্যাপী বার্থডে টু সুপ্তি বলতে বলতে রুমে ঢুকে পড়লো। সুপ্তি ভান করলো যে সে একেবারে আকাশ থেকে পড়েছে। ডাইনিং রুমের টেবিলের উপরে নীনা আন্টির কেক রাখা। চারপাশে মোমবাতি সাজানো।মোবাইলে টানা ভাইব্রেশন হচ্ছে, মেসেজ আসার জন্য। আনন্দে সুপ্তির চোখে জল এলো। কেক কাটা পর্ব শেষ করেই সবাই ঘুমানোর জন্য দে ছুট। আম্মু এসে সুপ্তির কপালে চুমু দিয়ে তার উপহারটি বিছানায় রেখে গেলো। সবাই চলে গেলে পরে গভীর রাতে সুপ্তি তার উপহারগুলো খুলতে বসলো। তার বোনের কার্ডটির মাঝে এবার বান্দরের ছবি। দাঁত বের করে বান্দরটি হ্যাপী বার্থডে জানাচ্ছে।সুখের বিষয় এবার কৌশিক কোন উপহার ছাড়াই এসেছে। ছোট খালার জামাটিও মন্দ না। আব্বুর দেয়া টাকা গুলি ব্যাগে ভরে সুপ্তি আগ্রহ ভরে আম্মুর দেয়া উপহার খুললো।
উপহার খুলে সুপ্তি খানিকক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরপর আবার নতুন করে চোখে জল আসা শুরু হলো। যে আয়নাটি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো ওই পোড়ো বাড়িতে, আয়নাটি তার আম্মু তার জন্য নিয়ে এসেছে। মা দের চোখে কি কিছুই এড়ায় না? সুপ্তি উঠে তার ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডারটি সরিয়ে আয়নাটা লাগায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সে আবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। চারপাশের বর্ডারে কি সূক্ষ্ণ কারুকাজ। কাঠের মাঝে লাল আর কালো রঙ করা। উপরের ময়ূরের লেজ দুইটি কি দিয়ে বানানো যে এত বছর পরেও এতটুকু রঙ নষ্ট হয়নি? আর চোখ গুলি কি রুবী? সুপ্তির চেহারা তার নিজের কাছে বিশেষ সুবিধার কখনোই মনে হয় না। কিন্তু এখন সে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। আয়নায় কি সুন্দরই না তাকে লাগছে। একটা লাল টিপ এনে কপালে পড়লো। রূপকথার রাজকন্যা যেন। আনন্দ দিয়ে সুপ্তি ঘুমাতে গেলো। কিন্তু ঘুম কেন যেন খুব ছাড়া ছাড়া গেলো। শেষ রাতের দিকে তার ঘুমের মাঝেই মনে হতে লাগলো কেউ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
পরের দিন বাসায় বিকেলে হৈ হৈ করতে করতে চৈতী, সুমন আর তুলি এলো। সুপ্তির আম্মু মানুষ কে খাওয়াতে পারলেই খুশী। ৬/৭ পদের নাস্তা বানিয়ে ফেললেন তখনই। আয়না দেখে সবাই থ। চৈতী তো পারলে নিয়েই যায়। কয়শ বছরের পুরনো জিনিস, কে এটা বানিয়েছে, কেই বা ব্যবহার করতো- এসব নিয়ে ব্যাপক আড্ডাবাজী।সুমন বরাবরই কল্পনার রঙ ছড়াতে ভালোবাসে। তার ধারণা, আয়নাটা অভিশপ্ত। সবার রক্ত চুষে নেয়। একারণেই ময়ূরগুলোর চোখ লাল। নতুবা কে কবে শুনেছে ময়ূরের চোখ লাল। সবার হো হো অট্টহাসিতে তার মতবাদ চাপা পড়লো। কিন্তু সুপ্তি বিশেষ খুশী হতে পারলো না। বন্ধুরা যখন ডাইনিং রুমে খেতে বসেছে, আর সে এসেছে তুলির মোবাইলটা তার ঘর থেকে নিতে; আবার তার সেই অনুভূতি ফিরে ফিরে এলো। কেউ তাকে দেখছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি দিলো সুপ্তি। নাহ, এটা তার মনের ভুলই হবে।
সবাই চলে গেলে রাতের খাওয়া সেরে সুপ্তি নিজের রুমে ফিরে এলো। ঘুমুতে যাবার আগে সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নাটা যেন তাকে আবিষ্ট করে ফেলছে। ঘড়ির আওয়াজে চমকে গেলে সে দেখলো ১টা বেজে গেছে। মানে সে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। এত সময় ধরে আয়নায় সে কি দেখছে? হঠাৎ তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জাগলো। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা বইতে সে পড়েছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ১৭শ সালের ডাইনী ব্লাডি মেরীকে ডাকলে সে আসে। অবশ্য প্রতিবার ৪৫ বার করে ডাকতে হবে অনেক দিন ধরে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, “ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী”। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো। কিছুই হলো না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসে ফেললো। কি বোকার মত সে গল্পের বই এর কথায় মেরী না কাকে ডাকাডাকি করছে। সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আবার ঘুমের মাঝে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি। কেউ অবশ্যই তাকে দেখছে।
রাত তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। সারা ঘরে কেমন যেন শীতল একটা ভাব। বৈশাখ মাসের এই বিশ্রী গরমে এরকম ঠান্ডা ভাব কি করে হলো? বৃষ্টি নাকি বাইরে? পরদা সরালো সুপ্তি। নাহ, বাইরে সব শুকনো, বাতাস পর্যন্ত নেই। গাছের পাতাগুলিও চুপ চাপ, সবাই ঘুমে বিভোর। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন বিছানার মাথার কাছ দিয়ে সরে গেলো। ঝট করে ঘাড় ঘোরালো সুপ্তি। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নামলো। নাক কুঁচকে গেলো তার। কেমন যেন একটা গন্ধ; বিশ্রী পচা গন্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো কপালে। এসব কি হচ্ছে? তার জানামতে বাসায় কোন ইঁদুর নেই, তেলাপোকা অবশ্য আছে। তেলাপোকা মরলে এরকম গন্ধ কখনো হয়না। বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো সুপ্তি। উদ্দেশ্য আয়নার পাশের সুইচবোর্ডে টিউব লাইটের সুইচ অন করবে। আয়নার কাছাকাছি গিয়ে সে কেমন যেন আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ গুন গুন করে কোন গান গাচ্ছে, না কবিতা পড়ছে। ধীর লয়ে নীচু সুরে কেউ গুন গুন করছে। একটু গোঙগাচ্ছেও যেন। আয়নার দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও সুপ্তি তাকিয়ে ফেললো।
না, আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে। ওই তো সে, ফুল আঁকা টি শার্ট পড়া। সবুজ আলোতে নিজেকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে, কিন্তু এটা তারই প্রতিবিম্ব। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালো সুইচের দিকে। আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো সুপ্তি। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; হাত দুইটা পাশে রাখা। কিন্তু সে তো বাম হাত উপরে তুলেছে সুইচ অন করার জন্য। আতংকে চিৎকার দিয়ে সে পিছনে সরে এলো। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আয়নার সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দিল, যেন সুপ্তিকে ছুঁতে চায়।দুই হাতে মুখ ঢেকে আকাশচূর্ণ করা চিৎকার করে উঠলো সুপ্তি। আতংকে থর থর করে কাঁপছে। বাইরে তার আম্মু আব্বু দরজা ধাক্কাচ্ছে। সুকন্যার গলাও যেন শোনা যাচ্ছে। সুপ্তি মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখলো আয়নায় এখনো তাকে দেখা যাচ্ছে। হাত নাড়ালে আয়নার হাতও নড়ছে। কোনমতে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই তার আম্মু ঝাঁপিয়ে পড়লো।
“কি? কি হয়েছে রে মা? সর্বনাশ, এত ঘেমে গেছিস কেন?”
“জানি না আম্মু”। বলে সুপ্তি একেবারে শুয়ে পড়লো তার মার কোলে।
১৫ মিনিট পর লেবুর সরবত খেয়ে মাথা মুছে সে মোটামোটি সুস্থির হলো। তার বাবা মার ধারনা সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এখন এই আলোকিত রুমে এত প্রিয় মানুষের মাঝে সুপ্তির নিজেরই লজ্জ্বা করতে লাগলো। তার কোন সন্দেহ নেই যে মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙার জন্য এবং বেশী সাইকো থ্রীলার দেখার ফলাফল হচ্ছে এটা। ফিচলে সুকন্যা ঘোষনা দিলো যে রাত্রে গুরু ভোজন হবার কারণে পেট গরম হওয়ায় সুপ্তি উলটা পালটা স্বপ্ন দেখছে। ইদানিং সে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভক্ত হয়েছে। কথায় কথায় টেনিদার উক্তি উদ্ধৃতি করে সবার মাথা ধরায়। সুকন্যাকে ভেংচি দিয়ে সুপ্তি আবার ঘুমুতে চলে গেলো, তবে এবার আম্মুও সাথে এলেন। আবার কি স্বপ্ন দেখে কোন ঠিক নাই।
পরের দিন দুপুরে খাবার টেবিলে রাত্রের কাহিনী নিয়ে আলোচনা হলো। আসলে ঘটনা টা কি? সুপ্তি দুঃস্বপ্ন বলে ব্যখ্যা দিয়ে এড়িয়ে গেলো। এখন আবার সুকন্যাকে টিজ করার কোন সুযোগ দেয়ার মানে হয় না। তবে সে নিজেই চিন্তিত, আসলেই কি দুঃস্বপ্ন ছিলো? সবকিছু এত বাস্তব মনে হচ্ছিল—নাহ সুপ্তি এ নিয়ে আর ভাবতে চায় না। বিকেলে তুলি আর সুমনের সাথে সুমনের গুরুর গিটার বাজানো শুনতে যাওয়ার কথা, সে সেটা নিয়েই ভাববে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হবার সাথে সাথে সুপ্তির আবার অস্বস্তি হতে থাকে। আজ রাতে কি হবে কে জানে। আজ সে দরজা না লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। ডাইনিং এর লাইট সারা রাত্রি জ্বালানো থাকে, তাতে করে তার রুমেও আলো পৌঁছায়। ওই ভৌতিক সবুজ আলোর চাইতে সাদা আলো যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। রাত গভীর হতে থাকে, কিন্তু সুপ্তির আর ঘুম আসে না। চাপা অস্বস্তিতে সে জেগে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। হঠাৎ তার আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সারা ঘরে গুন গুন একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। সুপ্তি উঠে বসে। সাথে সাথে সব চুপ। তার ভয় ভয় করতে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকে দেখলো, আড়াইটা বাজে। ঘরটা আবার কেমন যেন শীতল, যেন এসি চালানো হয়েছে। সাথে সেই গন্ধ। সুপ্তি নাক কুঁচকে বসে থাকে। আবার আম্মুকে ডাকার একটা ইচ্ছে জেগে উঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে বার কয়েক গালি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই আবার সেই গুন গুন আওয়াজ। এবার একটু জোরে। তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন একটানা মন্ত্র পাঠ করে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে। সুপ্তি লাফিয়ে নামে বিছানা থেকে। কিন্তু একটা অমোঘ আকর্ষন তাকে টেনে আয়নার দিকে নিয়ে চলে। কোন এক অজানা শক্তি তাকে বাধ্য করে আয়নার দিকে তাকাতে। না এবার আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে, ভীত মুখে তাকিয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে সুপ্তি। এবার চোখ খুলতেই সে ভয়ানক ভাবে চমকে যায়। আয়নায় এ কার মুখ? চিৎকার দেবার জন্য মুখ খোলে সে, কিন্তু আয়নার চোখটির ব্যথিত ভাব দেখে থমকে যায়। অপূর্ব এক চেহারা। তবে অনেক শুকনো। ঘন কালো চুল, বাতাসে আস্তে আস্তে দুলছে। খাড়া নাক, উন্নত ললাট, যেন এক গ্রীক দেবতা। তবে সবচেয়ে মায়াভরা তার চোখ, তার মাঝে যেন সাগরের গভীরতা। ছেলেটি ব্যথিত চোখে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াভরা বিষন্ন সেই চোখ অগ্রাহ্য করা সুপ্তির পক্ষে অসম্ভব।
সুপ্তি ভুলে যায় সে কোথায় আছে, তার কাছে মনে হয় এটাই বাস্তব। আয়নার মাঝে মানুষ দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সে চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“তুমি কে?”
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপরে বলে, “আমি ইভান”।
দৃপ্ত এবং ভরাট কিন্তু ভীষন আপন করা কন্ঠ।
“তুমি আয়নার মাঝে কেন? তুমি ই কি কাল রাতে এসেছিলে?”
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ডাকার চেষ্টা করছিলাম”।
“তুমি আয়নায় কেন? তোমার পরিচয় কি?”
আর কোন কথা না বলে আয়নার মাঝে ছবি মিলিয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে সুপ্তি অনেক করে দেখে, নাহ, আয়না আবার স্বাভাবিক একটা আয়না হয়ে গেছে। লাইট নিভিয়ে সুপ্তি অনেক বার বলে, “ইভান, ইভান, শুনতে পাচ্ছ?” আয়না নিশ্চুপ থাকে, অন্ধকারে শুধু ময়ূরের চোখগুলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে।
অভিশপ্ত আয়না (দ্বিতীয় পর্ব)