আগেই সবাইকে ঘোষনা দিয়েছিলাম, বিসিএস দিবো না। মনে মনে বলেছি, “আঙুর ফল টক”, মুখে বলেছি, “ছ্যা, বিসিএস আবার দেয়ার মত একটা ব্যাপার?” যা হোক, দোস্ত সিফাত যখন ঝাড়ি দিয়ে বললো যে ফর্ম তুলে আনতেছে কারণ সবাই একসাথে বসে মজা হবে, তখন একটু মাথা চুলকিয়ে রাজী হলাম। যা হোক, ফর্ম তুলেই খেলো বিশাল ছ্যাঁকা! একেকজনের সাথে গ্যাপ ২০ করে করে। সে কি? ৩০ তম তে না শুনলাম সবাই এক সিরিয়ালে পড়েছে? এরেই কয় কপাল! ব্লগার ত্রিনিত্রি গবেষনায় দেখেছে যে, সে যে পরীক্ষা দেয় না, সেটা সেইরকম সহজ হয়, সবাই না পড়েই ধামাধাম পাশ করে বসে থাকে। এবার ঠিক করলাম, নিজে না পড়ি, মানুষকেও এত সহজে পার পাইতে দিবো না; আমি দিতে বসলেই প্রশ্ন কঠিন হবে একেবারে নিশ্চিত। হেহেহে। কিন্তু ওই ফর্ম জমা দিবে কে? দোস্ত অচিন দেশের পাখী নিজ দায়িত্বে আমার ফর্ম আমার কাছ থেকে নিয়ে বিশাল মারামারি করে একেবারে বর্ডারলাইনে জমা দিয়ে আসলো, সাথে নিজের জীবনী শক্তিও কিছু সরকারী কর্ম কমিশনকে দান করে আসলো। এত কিছুর পড়ে পরীক্ষা না দেয়াটা কেমন দেখায়?
পরীক্ষা দিব, ভাবজ আছে না? ভাবজ প্রকাশ করতে গেলে বগলে বই লাগে। এত টাকা দিয়ে বই কিনবে কে? খেয়ে কাজ নাই। আমি যে ধাই ধাই করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এতে আমার যেসব দোস্ত সিরিয়াসলি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছে, তাদের গায়ে আগুন ধরলো। দোস্ত আসিফ নীলক্ষেত যাওয়ার পরে নতুন বিশ্ব কিনাইলো। আচ্ছা থাক, ঘরের শোভা বর্ধন করুক ওইটা। মানুষ বুঝুক, মেডিকেলে পড়েছি বলে কি আমার জেনারেল নলেজ ডাক্তারদের মত?? মোটেই না। মোটা বই ধরতে কষ্ট, তাই শেলফে তুলে রাখলাম।
ক্ষণে ক্ষনে আসিফ ফোন করে খবর নিচ্ছে,
“পড়তাসস??? ধইরা এক্কেরে বুড়িগঙ্গায় ফালায় দিমু ফাইজলামী করলে”।
জটিল সমস্যা। বুড়িগঙ্গায় জীবনে গেছি দুইবার। খাবারের ঘ্রাণে যেমন অর্ধভোজন হয়, ওই পানির গন্ধেই আমি অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলাম। আর তো বুড়িগঙ্গায় যাওয়ার সখ নাই। তখন আমার জীবন বাঁচাতে এলো কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বিসিএস বিশেষ সংখ্যা। বই তো বের হইলো, কিনে দিবে কে? আবার অচীন দেশের পাখী! বই কিনে এনে দিয়ে গেলো, একটা আমার জন্য, একটা তাহার জামাই এর জন্য। মনে আশা, জামাই সব পড়ে ফেললে, তারো বিসিএস হওয়া ঠেকায় কে?? বই খানি দেখে পছন্দই হইলো, ২০ টাকা দাম। যদি নাও বা পড়ি, বিবেকের কাছে ঠেকবো না।
ভাবজ শুরু। ৭ দিন আগে বই ব্যাগে নিয়ে হাসপাতালে গমন। সাথে লাল রঙের কলম, দাগাদাগি ছাড়া ভাব জমে না। রুগী না থাকলে ডক্টরস রুমে বসে সেইরকম হাউ মাউ। আমি বরাবরই চেঁচিয়ে ছাড়া পড়তে পারিনা, হোক না সে বিসিএস। আমার কল্যাণে আমি সহ রুগীরাও জেনে গেলো বাংলা ভাষায় খাঁটি বাংলা উপসর্গ ২১ টি এবং সমাচার দর্পনই বাংলার প্রথম পত্রিকা। ২ দিন চেঁচিয়েই টায়ার্ড। সুতরাং বই ঘুরতে লাগলো অ্যাপ্রনের পকেট থেকে ব্যাগে, আর ব্যাগ থেকে টেবিলে। আমার অবস্থা দেখে ত্রাণকর্তা হিসিবে সিফাত এগিয়ে এলো। ২৪ ঘন্টায় প্রিলি পাশ নামে একটা বই ধরায় দিয়ে গেলো।
“নে, যা অবস্থা দেখতেছি তোর, কিছু তো পড়তে হবে। আগের দিন পড়িস”।
বই উল্টিয়ে দেখি, একেবারে গুনে গুনে ২৪ ঘন্টাও যদি পড়ি, কোনভাবেই শেষ হবার না। সুতরাং পড়ার চেষ্টা বৃথা তাই। বই নতুন বিশ্বের পাশে যত্ম করে রেখে দিলুম। সিট প্ল্যান যেদিন দিলো, সেদিন টের পেলুম, সাড়ে সর্বনাশ! আমার অ্যাডমিট কার্ড কই? জমাও দেইনি, রোলও জানি না, তা এখনো অচিন দেশের পাখীর কাছেই পড়ে আছে। সিট দেখে সবার মাথা চক্কর দিলো, সদর ঘাট। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। সদর ঘাট শুনেই কেমন যেন কলা কলা মনে হতে থাকলো, কারন জাফর ইকবাল লিখেছিলেন,
সফদার আলি মিয়া
সদরঘাটে গেঞ্জি কিনে চাইর পয়সা দিয়া।
যাব কি যাব না এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলো। দোস্ত পারভীনের বাড়ি ভোলা। সে নিয়মিত সদর ঘাটে যায়। সে বললো, “ দোস্ত, ঘোড়ার অত্যাচারে নড়তে পারবি না, এক্কেরে সকালে যাইস”। আসিফ আরেক ঘাট উপরে, পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে ফোন দিয়ে বলে, “যা সিট দেখে আয়, নাইলে চিনবি না”। আমি ভাবলাম, খাইয়া তো কাজ নাই। যদি সিট খুঁজে না পেয়ে পরীক্ষা না দিতে পারি, তাও ওইদিন সকালেই যাবো। হাসপাতাল থেকে ভাবজ সহযোগে ছুটি নিলাম ২ দিনের। বিসিএস বলে কথা, স্যাররা আশির্বাদের সহিত ছুটি দিলেন।
এইবার পড়া শুরু। হাউ মাউ করে ওই ২০ টাকার বই ছিবড়া বানিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিলাম। পড়তে নিয়ে টের পেলাম, ২০ টাকার বই নামেই ২০ টাকার, ইনফো না হলেও আছে হাজার খানিক! কিছুক্ষন পড়ার পড়েই মাথা গরম হয়ে যায়।
আসিফ ক্রমাগত গাইড করে চললো, “আরে লাভ ক্ষতি কর! একটা মাস্ট! আহা, ঝামেলা না করে বিজ্ঞানটা রিডিং দিয়া ফেল তো। এমনিতেই পারবি”।
তা পেপারে দেখলাম ২৯তম বিসিএসে যিনি প্রথম হয়েছেন, উনি বলেছেন, “আগের রাতে মাথা ঠান্ডা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে”। তাড়াতাড়ি সিফাত কে ফোন দিলাম,
“দোস্ত, পইড়া কাজ নাই। দেখ, ঘুমাইতে কইসে”।
সিফাত কইলো, “ঝামেলা করিস না। উনি ১২ দিন আগে পেপারে বলসে নতুন কিছু আর না পড়তে। অখন তুই মজা নেস?”
অন্য সব তো হলো, কাল রাতে অংক নিয়ে বসেই তো ১০ হাত পানির নীচে। মেডিকেলে পড়তে পড়তে যোগ বিয়োগ ও ভুলার দশা। ছোট বোনের দারস্থ হলাম, এমনকি গড় করাও ভুলে গেছি, এই অবস্থা। ছোট বোন যতটা সম্ভব ভাব নিলো। মনে হলো কানটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দেই! দিলে হয়ত কিছু বলবে না এই জন্য সহ্য করলাম।
এর মাঝে মাঝে ফেসবুকিং না করলে তো খাওয়া হজম হয় না। গিয়ে দেখি বিসিএস স্ট্যাটাসে ভর্তি। দোস্তদের স্ট্যাটাস থেকে জানলাম, ২৩শে এপ্রিল world nose pricking day, ১৯শে নভেম্বর world toilet day আর ৩রা নভেম্বর বিশ্ব কৃমি নির্মূল দিবস। সকালে উঠে দেখি, পরিবেশ দিবস কবে তা ভুলছি, এমনকি নারী দিবস মনে করতে বিস্তর বেগ পেতে হলো, কিন্তু এই তিনটা আগাছা আর মাথা থেকে যাচ্ছে না। দুইটা অ্যালার্ম ক্লক আর মোবাইল ফোন সম্মিলিত ভাবে কাজ করে সকালে আমাকে ডেকে তুললো।
দাঁত ব্রাশ করতে করতে দেখি আমি আবার a2+b2 এর সূত্র ভুলে গেছি। আচ্ছা জ্বালা! বইটা নিয়েই রওনা দিলাম। গাড়িতেই আমি পড়ে উদ্ধার করবো সব কিছু। একা সদরঘাট গিয়ে হারানোয় কাজ নেই ভেবে অচিন দেশের পাখীর বাসায় হাজির হলাম। দেখি আমার দোস্ত কি কি জামা বানাবে, তার কাপড় একটা ব্যাগে ভরে রেডি। এদিকে পরীক্ষার খবর নাই। ভাইয়া ফোন করে তার বন্ধুরে ঘুম থেকে উঠাচ্ছে এই বলে, “চল চল, দেখি আশে পাশের মানুষ কি করে”! তারপরেও বন্ধু ওঠে না। ৩০ মিনিট ঝামেলা করার পর চোখ ডলতে ডলতে বন্ধু এলো। সবাই মিলে উৎসব করতে করতে গেলাম সদর ঘাট। অ্যাডমিট কার্ডে লেখা অবশ্যই ৩০ মিনিট পূর্বে ঢুকিতে হইবে, গেট তো খুললোই সাড়ে নয়টায়!!!!
যাচ্ছেতাই অবস্থা, কারেন্ট নাই। কিছু মশা ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত ভীত শিকার দেখে আনন্দে আত্মহারা, কারে রেখে কারে কামড়াবে। তবে আমাকে কামড়ায় নাই! এসে কয়েকবার ভন ভন করে উৎসাহ দিয়ে গেছে গোল্লা ভরাট করার জন্য। সিটের ঠিক নাই, যেখানে রোল লেখা, তার ২ রুম পরে সিট। তবে ২০ গ্যাপে কোন লাভই হয় নাই। রোল পাশা পাশি হবার কারনে আজীবন আমি সিফাতের সামনে পরীক্ষা দিয়েছি, এবার এক্কেবারে পাশে। আনন্দে দাঁত সব বের করে বসে আছি। তখন পরীক্ষক চিৎকার দিলেন,
“শোনেন সবাই! আজদাবিয়া!”
মানে কি? গরমে কারো এনার্জিও নাই যে জিজ্ঞেস করবে মানে টা কি? পরীক্ষক নিজেই বলে চললেন, "এটা একটা আরবী শব্দ। মানে আমিও জানি না। এটা হচ্ছে আপনাদের কোড। আমাদের উপর বিশেষ নির্দেশ আছে যেন প্রতিটা পরীক্ষার্থী এই শব্দটি শোনেন”।
অচীন দেশের পাখী ঠিক আমার কোণা কোণি পিছনে। সে ক্লান্ত স্বরে বললো, তাড়াতাড়ি বুঝা কাহিনী কি।
আমি বললাম, “যদি পুলিশ আল কায়দা বা জঙ্গী হিসেবে ধরে তখন এই কোড প্রমাণ করবে তুই বিসিএস পরীক্ষার্থী, খবরদর ভুলিস না”।
পরীক্ষা শুরু হলো। আমার পিছনে সিট পড়েছে এক আংকেলের। বিসিএস দিতে দিতেই কিনা কে জানে, তার মাথার চুলের বড়ই অভাব, অল্প যে কয় গাছি আছে তা পুরোপুরি সাদা। তো পরীক্ষক এসে সবার মনের কথাটি জোরে সোরে বলে বসলেন,
“আপনার কি আর পরীক্ষা দেয়ার বয়স আছে?”
আংকেল মহা বিরক্ত। “আরো কয়েক বছর আছে”।
পরীক্ষক বেজার মুখে উত্তর দিলেন,
“মনে তো হচ্ছে না”।
পরীক্ষা কেমন হলো সে আর না বললাম। তবে ওই ২০ টাকার বই কিন্তু সেইরকম! অনেকগুলা একেবারে সলিড কমন। টাকা পুরাপুরি উসুল! অংক নিয়েই গোলমালে পড়লাম। ৫ খান অংক নিজ মাথা থেকে, বাকী অঙ্ক যে কয়টা দাগাইছি সবই অচীন দেশের পাখী আর সিফাতের দান। অচীন দেশের পাখী অবশ্য একটু ঝামেলায় পড়েছে। তার পাশের মহিলা আর তার সেট ছিলো এক। সেই মহিলা প্রশ্ন পাওয়া মাত্র ঝড়ের বেগে গোল্লা ভরাট করা শুরু করলো। সে ভাবলো, “ওরে খাইছে রে, কি কনফিডেন্স! নতুন বিশ্বের সহকারী রাইটার মনে হয়”। এই ভেবে বাংলা অংশ সেও ঝড়ের গতিতে দাগিয়ে চললো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মহিলা যা দাগিয়েছে তার দুই একটি বাদে সবই ভুল।
এই ছিলো আমার প্রথম বিসিএস পরীক্ষার অভিজ্ঞতা। আপনাদের কি অবস্থা?
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১১ বিকাল ৪:৩৬