
আগেই সবাইকে ঘোষনা দিয়েছিলাম, বিসিএস দিবো না। মনে মনে বলেছি, “আঙুর ফল টক”, মুখে বলেছি, “ছ্যা, বিসিএস আবার দেয়ার মত একটা ব্যাপার?”











পরীক্ষা দিব, ভাবজ আছে না?





ক্ষণে ক্ষনে আসিফ ফোন করে খবর নিচ্ছে,
“পড়তাসস??? ধইরা এক্কেরে বুড়িগঙ্গায় ফালায় দিমু ফাইজলামী করলে”

জটিল সমস্যা। বুড়িগঙ্গায় জীবনে গেছি দুইবার। খাবারের ঘ্রাণে যেমন অর্ধভোজন হয়, ওই পানির গন্ধেই আমি অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলাম। আর তো বুড়িগঙ্গায় যাওয়ার সখ নাই





ভাবজ শুরু।


“নে, যা অবস্থা দেখতেছি তোর, কিছু তো পড়তে হবে। আগের দিন পড়িস”।
বই উল্টিয়ে দেখি, একেবারে গুনে গুনে ২৪ ঘন্টাও যদি পড়ি, কোনভাবেই শেষ হবার না। সুতরাং পড়ার চেষ্টা বৃথা তাই। বই নতুন বিশ্বের পাশে যত্ম করে রেখে দিলুম। সিট প্ল্যান যেদিন দিলো, সেদিন টের পেলুম, সাড়ে সর্বনাশ!



সফদার আলি মিয়া
সদরঘাটে গেঞ্জি কিনে চাইর পয়সা দিয়া।
যাব কি যাব না এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলো। দোস্ত পারভীনের বাড়ি ভোলা। সে নিয়মিত সদর ঘাটে যায়। সে বললো, “ দোস্ত, ঘোড়ার অত্যাচারে নড়তে পারবি না, এক্কেরে সকালে যাইস”। আসিফ আরেক ঘাট উপরে, পরীক্ষার আগের দিন বিকেলে ফোন দিয়ে বলে, “যা সিট দেখে আয়, নাইলে চিনবি না”। আমি ভাবলাম, খাইয়া তো কাজ নাই। যদি সিট খুঁজে না পেয়ে পরীক্ষা না দিতে পারি, তাও ওইদিন সকালেই যাবো। হাসপাতাল থেকে ভাবজ সহযোগে ছুটি নিলাম ২ দিনের। বিসিএস বলে কথা, স্যাররা আশির্বাদের সহিত ছুটি দিলেন।
এইবার পড়া শুরু। হাউ মাউ করে ওই ২০ টাকার বই ছিবড়া বানিয়ে ফেলার প্রস্তুতি নিলাম। পড়তে নিয়ে টের পেলাম, ২০ টাকার বই নামেই ২০ টাকার, ইনফো না হলেও আছে হাজার খানিক!

আসিফ ক্রমাগত গাইড করে চললো, “আরে লাভ ক্ষতি কর! একটা মাস্ট! আহা, ঝামেলা না করে বিজ্ঞানটা রিডিং দিয়া ফেল তো। এমনিতেই পারবি”।
তা পেপারে দেখলাম ২৯তম বিসিএসে যিনি প্রথম হয়েছেন, উনি বলেছেন, “আগের রাতে মাথা ঠান্ডা রেখে ঘুমিয়ে পড়তে”। তাড়াতাড়ি সিফাত কে ফোন দিলাম,
“দোস্ত, পইড়া কাজ নাই। দেখ, ঘুমাইতে কইসে”।


সিফাত কইলো, “ঝামেলা করিস না। উনি ১২ দিন আগে পেপারে বলসে নতুন কিছু আর না পড়তে। অখন তুই মজা নেস?”

অন্য সব তো হলো, কাল রাতে অংক নিয়ে বসেই তো ১০ হাত পানির নীচে। মেডিকেলে পড়তে পড়তে যোগ বিয়োগ ও ভুলার দশা। ছোট বোনের দারস্থ হলাম, এমনকি গড় করাও ভুলে গেছি, এই অবস্থা। ছোট বোন যতটা সম্ভব ভাব নিলো। মনে হলো কানটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দেই!

এর মাঝে মাঝে ফেসবুকিং না করলে তো খাওয়া হজম হয় না। গিয়ে দেখি বিসিএস স্ট্যাটাসে ভর্তি। দোস্তদের স্ট্যাটাস থেকে জানলাম, ২৩শে এপ্রিল world nose pricking day, ১৯শে নভেম্বর world toilet day আর ৩রা নভেম্বর বিশ্ব কৃমি নির্মূল দিবস। সকালে উঠে দেখি, পরিবেশ দিবস কবে তা ভুলছি, এমনকি নারী দিবস মনে করতে বিস্তর বেগ পেতে হলো, কিন্তু এই তিনটা আগাছা আর মাথা থেকে যাচ্ছে না।


দাঁত ব্রাশ করতে করতে দেখি আমি আবার a2+b2 এর সূত্র ভুলে গেছি। আচ্ছা জ্বালা! বইটা নিয়েই রওনা দিলাম। গাড়িতেই আমি পড়ে উদ্ধার করবো সব কিছু। একা সদরঘাট গিয়ে হারানোয় কাজ নেই ভেবে অচিন দেশের পাখীর বাসায় হাজির হলাম। দেখি আমার দোস্ত কি কি জামা বানাবে, তার কাপড় একটা ব্যাগে ভরে রেডি। এদিকে পরীক্ষার খবর নাই। ভাইয়া ফোন করে তার বন্ধুরে ঘুম থেকে উঠাচ্ছে এই বলে, “চল চল, দেখি আশে পাশের মানুষ কি করে”! তারপরেও বন্ধু ওঠে না। ৩০ মিনিট ঝামেলা করার পর চোখ ডলতে ডলতে বন্ধু এলো। সবাই মিলে উৎসব করতে করতে গেলাম সদর ঘাট। অ্যাডমিট কার্ডে লেখা অবশ্যই ৩০ মিনিট পূর্বে ঢুকিতে হইবে, গেট তো খুললোই সাড়ে নয়টায়!!!!
যাচ্ছেতাই অবস্থা, কারেন্ট নাই। কিছু মশা ইতঃস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত ভীত শিকার দেখে আনন্দে আত্মহারা, কারে রেখে কারে কামড়াবে। তবে আমাকে কামড়ায় নাই! এসে কয়েকবার ভন ভন করে উৎসাহ দিয়ে গেছে গোল্লা ভরাট করার জন্য। সিটের ঠিক নাই, যেখানে রোল লেখা, তার ২ রুম পরে সিট। তবে ২০ গ্যাপে কোন লাভই হয় নাই। রোল পাশা পাশি হবার কারনে আজীবন আমি সিফাতের সামনে পরীক্ষা দিয়েছি, এবার এক্কেবারে পাশে। আনন্দে দাঁত সব বের করে বসে আছি। তখন পরীক্ষক চিৎকার দিলেন,
“শোনেন সবাই! আজদাবিয়া!”
মানে কি? গরমে কারো এনার্জিও নাই যে জিজ্ঞেস করবে মানে টা কি? পরীক্ষক নিজেই বলে চললেন, "এটা একটা আরবী শব্দ। মানে আমিও জানি না। এটা হচ্ছে আপনাদের কোড। আমাদের উপর বিশেষ নির্দেশ আছে যেন প্রতিটা পরীক্ষার্থী এই শব্দটি শোনেন”।
অচীন দেশের পাখী ঠিক আমার কোণা কোণি পিছনে। সে ক্লান্ত স্বরে বললো, তাড়াতাড়ি বুঝা কাহিনী কি।

আমি বললাম, “যদি পুলিশ আল কায়দা বা জঙ্গী হিসেবে ধরে তখন এই কোড প্রমাণ করবে তুই বিসিএস পরীক্ষার্থী, খবরদর ভুলিস না”।

পরীক্ষা শুরু হলো। আমার পিছনে সিট পড়েছে এক আংকেলের। বিসিএস দিতে দিতেই কিনা কে জানে, তার মাথার চুলের বড়ই অভাব, অল্প যে কয় গাছি আছে তা পুরোপুরি সাদা। তো পরীক্ষক এসে সবার মনের কথাটি জোরে সোরে বলে বসলেন,
“আপনার কি আর পরীক্ষা দেয়ার বয়স আছে?”

আংকেল মহা বিরক্ত। “আরো কয়েক বছর আছে”।
পরীক্ষক বেজার মুখে উত্তর দিলেন,
“মনে তো হচ্ছে না”।

পরীক্ষা কেমন হলো সে আর না বললাম। তবে ওই ২০ টাকার বই কিন্তু সেইরকম! অনেকগুলা একেবারে সলিড কমন। টাকা পুরাপুরি উসুল! অংক নিয়েই গোলমালে পড়লাম। ৫ খান অংক নিজ মাথা থেকে, বাকী অঙ্ক যে কয়টা দাগাইছি সবই অচীন দেশের পাখী আর সিফাতের দান। অচীন দেশের পাখী অবশ্য একটু ঝামেলায় পড়েছে। তার পাশের মহিলা আর তার সেট ছিলো এক। সেই মহিলা প্রশ্ন পাওয়া মাত্র ঝড়ের বেগে গোল্লা ভরাট করা শুরু করলো। সে ভাবলো, “ওরে খাইছে রে, কি কনফিডেন্স! নতুন বিশ্বের সহকারী রাইটার মনে হয়”। এই ভেবে বাংলা অংশ সেও ঝড়ের গতিতে দাগিয়ে চললো। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মহিলা যা দাগিয়েছে তার দুই একটি বাদে সবই ভুল।
এই ছিলো আমার প্রথম বিসিএস পরীক্ষার অভিজ্ঞতা। আপনাদের কি অবস্থা?

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০১১ বিকাল ৪:৩৬