
কোন একটা ইংরেজী গল্পে পড়েছিলাম, কথা হচ্ছে ধনুক থেকে ছোড়া তীরের মত। একবার যদি ছুটে যায়, আর ফেরানো যায় না। তীর দ্বারা সৃষ্ট দাগ যেমন বছরের পর বছর গাছ বয়ে নিয়ে বেড়ায়, কথাও বছরের পর বছর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কিন্তু বেফাঁস কথা? এরকম তো অসংখ্যবার হয়েছে যে আপনি বলতে চাইছেন এক কথা, মুখ দিয়ে বের হয়েছে আরেক কথা। আপনার কথা জানি না, আমার চারপাশে তো অহরহ দেখছি। ছোটবেলার কথাই ধরুন। ছোট বেলায় না বুঝে তো কত কথাই ঠুশ ঠাশ বলে বসি, কি নিষ্ঠুর ভাবেই না মানুষ জন পরে তার জন্য সাজা দেয়! আমার বয়স যখন দেড় কিংবা দুই হবে (আমার অবশ্যই মনে নেই), তখন নাকি টিভিতে ডানো অ্যাড দিলেই আমি ঘুম থেকে উঠেও ডানো ডানো করে গান গাইতাম।কিন্তু তার জন্য এখনো ডানো মিল্কের কৌটা দেখলে বাসার সবার খ্যাক খ্যাক করে হাসির মানেটা কি?






বেফাঁস কথা আমি এখন একটু কমই বলি। কারন নেড়া অনেকবার বেল তলায় গিয়ে তবে তার চুল গজিয়েছে। এজন্য না বুঝলে এখন কথা না বলে মুখে একটু হাসি ঝুলিয়ে বসে থাকি, যার অর্থ “হ্যাঁ সব বুঝেছি” বা “না কিছুই বুঝিনি, কিন্তু প্যাচাল ভালো লাগে না” – দুইটাই হইতে পারে।


হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো, “আপু, আপনার ইডিডি কবে?”

আপু একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। নিজের পেটের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, “আমি কি খুব বেশী মোটা?”

এবং অবশ্যই তখন আমার বন্ধু তোতলাতে শুরু করলো। ঘটনা সামাল দেয়ার জন্য তখন আমাকে কত কথাই যে বলতে হলো যার মাঝে সবচেয়ে বারুদ ভেজা কারণটি হলো, “ওয়ার্ডে আসেন না তো, তাই সবাই ভেবেছে যে গুড নিউজ”। কিন্তু আপুর সন্দেহের দৃষ্টি আর গেলো না!


আগবাড়িয়ে কথা বলার জন্য বিশ্রী অবস্থায় পড়া এই প্রথম না। পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে গিয়ে আমি পেজগি পাকিয়েছিলাম।

এক বেলার খাওয়া মিস যাওয়ার পরে রাগত ভাবে দুইজনকে ডেকে বললাম,
“বাচ্চার বাবা-মা কি বেঁচে নাই?”

মানুষটি মাথা চুলকিয়ে বললো, “জ্বী আছে তো”।
“তাইলে তাড়াতাড়ি খবর দেন। একে বাচ্চার অবস্থা ভালো না, তার উপর তাকে সঠিক ভাবে খাওয়াতে হবে। নানা-নানী দিয়ে কি হয়? কেমন বাবা-মা! একজনকে আসতে বলেন”।
মানুষটি কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সামনের বেডের বাবুর ফিচলে অ্যাটেনডেন্ট আমাকে আলো দেখালো।
“কি কন আফা, উনিই তো বাচ্চার বাবা, আর ওইযে মা”।

খানিকক্ষন আমি আক্কেলগুড়ুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থা। ফিচলে অ্যাটেনডেন্ট মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে।কিছুক্ষন পরেই যে সে সব বেডে গিয়ে গিয়ে এই মজার কাহিনী বর্ননা করবে তা সন্দেহাতীত।





এই বেফাঁস কথা বলার জন্যই বেশীর ভাগ মানুষ তার পিতৃ-মাতৃ কর্তৃক দেয়া এত ভালো ভালো নাম বাদ দিয়ে আজগুবী সব নাম দিয়ে পরিচিত হয়। আমাদের এক ক্লাসমেট এই জীবনে যা বলতে চেয়েছে কোনভাবেই বলতে পারেনি। উদ্ভট সব কথা বার্তা বলে গিট্টু পাকিয়ে এমন বেড়াছেড়া অবস্থা করে, যে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার চাইতে বুড়ীগঙ্গার নোংরা পানিতে সাঁতার কাটা সহজ।




“এই, এই ছেলে, দাঁড়াও”।
আমার বন্ধু টেরই পেলো না। পিঠে গুঁতা দেয়াতে অটোমেটিক দাঁড়িয়ে গেলো, মন তখন কোথায় কে জানে।
“বলো, What is sex?”
স্যার আসলে জানতে চেয়েছিলেন সেক্সের ডেফিনেশন, মানে ক্রোমজমের ক্যাচক্যাচানি। আমার বন্ধু ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো, “স্যার, আওয়ার বেসিক নিড”।


কয়েক সেকেন্ডের জন্য পিন পতন নিরবতা। অতঃপর স্যার সহ সকলের হো হো হাসিতে তার চমক ভাঙলো। কিন্তু ততক্ষনে কথা গুলির মত ছুটে গেছে, আর কি ফেরানো যায়? পুরো তিন মাস তাকে দেখলেই, “দোস্ত, বল তো, আমাদের বেসিক নিড টা কি?”



উলটা পালটা কথা বলে পরিস্থিতি আউট অব হ্যান্ড করার জন্য আমার এক বন্ধু আমাদের মহলে ত্রাস। একেবারে না দেখে না বুঝে, সে সত্য কথাটা ঠাশ করে মুখের উপরে বলে দিয়ে চলে যাবে। অতঃপর এই বেচারী আমাকে এবং আমার আরেক বন্ধুকে সেটা সামাল দিতে হবে। এটাই অনেকদিন ধরে চলে আসছে। কোন কথা বলার আগে তাই আমরা বলি, “দোস্ত, তুই কইস না, আগে আমি বলি, তারপরে বলিস”। তারপরেও সে শোনে না। আরেক বন্ধুর রিসেপশনে গিয়েছি। জামাইকে তেমন ভালো লাগলো না। মানে আমাদের বন্ধুর জন্য একেবারেই ভালো লাগছিলো না। তা তো আর বলা যায় না, আহা উহু করে ছবি তুললাম।
হঠাৎ আমার সত্যবাদী বন্ধু বলে বসলো,
“ধূর, কি বিয়া করতাসে দেখ!

আমি সাথে সাথে সহমত ব্যক্ত করলুম। “যা কইসোস দোস্ত”।

সামনে এক বন্ধুর বিস্ফোরিত চক্ষু দেখে পিছে ঘুরলাম। কোন ফাঁকে যে জামাইএর বন্ধুরা ঘুরতে ঘুরতে আমাদের পিছে চলে এসেছে কেউ খেয়াল ই করেনি। কি করি?



আমার বন্ধু বলে বসলো,
“অ্যাঁ, তোর বয়ফ্রেন্ড কবে থিকা?”





কখনো কি বাচ্চা কাচ্চাদের সামনে কিছু বলেছেন এই ভেবে যে, “ধূর, ও কি কিছু বুঝে? ছোট মানুষ”। কক্ষনো করবেন না!















“ওই! তুই তাহসীনরে কি বলসিস?”


আমি তো কিছুক্ষন বুঝলামই না কাহিনী কি। পরে শুনলাম, সেই পুঁচকু, যার কিনা বয়স ৭ বছর, সে ওই নাম্বারটি দিয়ে আমার আম্মাজানের হাতে দিয়ে বলেছে, “এই নাম্বারে ত্রিনিত্রিআপু ফোন করে কাকে যেন চাইছে”। সৌভাগ্যবশত আমার আম্মাজান তখনো মোবাইলের হাল হকিকত বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই, তাই সে কাগজ ফেলে দিছে। এই হচ্ছে বাচ্চা কাচ্চাদের বেশী বুঝার অবস্থা।


আবার না বুঝলেও কাহিনী আছে। আমার মামাতো বোনের বয়স তখন সাড়ে ৪ হবে। পাশের বাসার ছেলেটির বয়স ৫। চমৎকার জোড়ি। ছেলেও গোপনে আমার মামাতো বোনের উপর ফিদা।


সে এলে পড়ে গম্ভীর মুখে আমার এক দূর সম্পর্কীয় ভাই বললো,
“তা, তুমি যে আমাদের বোনকে পছন্দ করো, তাকে বিয়ে করবা না?”
ছেলেও স্মার্টলী উত্তর দিলো, “বড় হলেই করবো”।


আমার ভাই আরো গম্ভীর হয়ে বললো,
“কিন্তু তার আগেই যদি ভালো সম্বন্ধ আসে, তাহলে কিন্তু আমরা বসে থাকবো না”।


ইমন (পিচ্চি ছেলে) এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, “তাহলে কি করতে হবে?”
“তোমার আব্বুকে তোমার বলা দরকার যাতে সে আনমনার(আমার বোন) আব্বুকে কথাটা বলে”।


এখানে প্রসংগতো উল্লেখ্য, আমার মামা তখন ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট, আর ইমনের বাবা তার ঠিক নীচের পদে ছিলেন। তখন আমাদের নানুবাড়ীর ড্রইংরুমে তাদের একটা কি যে আলোচনা চলছিলো আরো ৭/৮ জন আংকেলের সাথে। ইমন শুনে সাথে সাথে রওনা দিলো।
মিটিং এর মাঝে ঢুকে তার আব্বুর শার্ট টানতে লাগলো আর ভাঙা রেকর্ডের মত বলতে লাগলো,
“আব্বু, এই আব্বু, আমি আনমনাকে বিয়ে করবো। আব্বু শোনো না, আমি আনমনাকে বিয়ে করবো, তুমি আনমনার আব্বুকে এখনি বলো”।



আংকেল লজ্জায় যত, “ঠিক আছে বাবা, বাসায় গিয়ে কথা বলবো আমরা” এসব বলে, ইমন তত ঘ্যান ঘ্যান করে। আমার মামা আর বাকি সব আংকেল হাসতে হাসতে শেষ। আমরাও যে দরজায় কান লাগিয়ে শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি, সে বলাই বাহুল্য!



সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১১ রাত ১:৪৬