১.
প্যাথোলজী ল্যাবে মাইক্রোস্কোপ আর স্লাইড নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে জিনান ঘড়ির দিকে তাকালো। আড়াইটায় ক্লাস শেষ হবার কথা, পৌনে তিনটা বেজে গেছে। আজকেও ক্যান্টিনে কিছু পাওয়া যাবে না। অথচ স্যাররা কোনদিনো ব্যাপারটা বুঝবে না। শেষ মূহুর্তে নতুন কিছু স্লাইড ধরিয়ে দেবেই, যার মাথা মুন্ডু কিছুই বোঝা যায় না। মেডিকেলে পড়তে পড়তে নাকি মানুষের স্বাভাবিক বোধ অনেক লোপ পায়, কে জানে আর ১০ বছর পর জিনানের কি অবস্থা হবে। আজকে নীলক্ষেত যেতেই হবে, মাইক্রোবায়লজীর একটি বই কিনতে। বিকেলে আবার তিথির রুমে আম উৎসব হবার কথা। আর এখন বাজে পৌনে তিনটা, এখনো স্যারের ক্লাস শেষ করার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাগে জিনানের স্লাইডগুলি মটমট করে ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছে। পাশে অনিমেষ মনোযোগ সহকারে স্লাইড গুলি যেন গিলে খাচ্ছে। জিনান তাকাতেই এক গাল হেসে বললো, “আইটেমগুলি কিন্তু এবারের কার্ডে ছোট ছোট। আমরা চাইলে এক সাথে তিন/চারটা করে দিতে পারি”। মাইক্রোস্কোপটা তুলে অনিমেষের মাথায় একটা বাড়ি দেয়ার দুর্দান্ত ইচ্ছা জিনান অনেক কষ্টে চাপা দিলো। আর বেশীক্ষন থাকলে কি হতো বলা যায় না, কিন্তু স্যার দয়া করে তিনটার সময় ক্লাস শেষ করে দিলো।
খাতা বই নিয়ে দৌড় দিলো জিনান। হোস্টেলের গেটে এসে মিলির সাথে দেখা। একই সাথে এক প্লেট ফুচকা আর আরেক প্লেট চটপটি খাচ্ছে। কোন মানে হয়?
“ওই, একসাথে দুই প্লেট খাচ্ছিস কেন? দিন দিন যে মোটা হচ্ছিস, কোন খেয়াল আছে?”
“তা তুই না খেয়ে কি এমন শুকনা হাড়জিরেজিরে হয়েছিস শুনি?” মিলি ভেংচি দিলো।
“নীলক্ষেত যাবি?”
“নীলক্ষেতের আমভর্তা কিনে দিলে যাবো”। খিক খিক করে হাসি দিলো মিলি।
উফফ, কেন যে একটা বয়ফ্রেন্ড নেই! জিনান সখেদে ভাবলো। সোনালীর আনন্দ দেখো কেউ! পরীক্ষার আগের রাতে একটা ফোন দিলেই হয়, রুশো দৌড়ে আসবে সব নোট ফটোকপি করে নিয়ে। ক্যান্টিন যথারীতি বন্ধ। দোকান থেকে একটা লিচি জুস কিনে স্যারকে বকা দিতে দিতে মিলির সাথে নীলক্ষেত রওনা দিলো জিনান।
২.
বিকেল ৫টায় তিথির রুমে উপস্থিত হবার কথা। ৬টার সময় গিয়ে জিনান পেলো মাত্র ৪ জনকে।
“কি রে? আম উৎসব তো মাঠে মারা গেলো। এত কম কেন মানুষ?”
“আর বলিস না, কাল যে শুক্রবার সেতো মনেই ছিল না। সব পাবলিক বাসায় গেছে”। রাগ করে পারভীন উত্তর দিলো।
“আর যাদের ঢাকায় বাসা নেই তারা মামা-খালার বাসায় গেছে”।– কামরুন যোগ করলো।
“চমৎকার! তাহলে শুধু আমরা ৫ জনই কি বলিস? টেনশন লেনে কা নেই! এমন মজা করবো যে সবাই রাতে কান্না কাটি করবে! এখনি আম ভর্তার প্রতি স্টেপের ফডু খিচে ফেসবুকে আপ্লোডাইতেছি, খাড়া”।
“তোর লগে না মিলি ছিল? সে কই গেলো?”- তিথি জিজ্ঞেস করলো।
“সে গেছে ডেটিং মারতে, শর্মা হাউজে। উহার বয়ফ্রেন্ড নাকি উহাকে দেখে নাই প্রায় ৩৬ ঘন্টা হইয়াছিলো, আর অপেক্ষা করিতে পারে নাই”। ভেংচি দিয়ে জিনান জানালো।
মুখে যাই বলুক, আম উৎসব মোটেই জমলো না। একটু পর সাচী বিদায় নিলো, তার নাকি মাথা ব্যথা। আসল কথা হচ্ছে প্রতিদিন পড়াশোনা না করলেই তার মাথা ব্যথা হয়। কিন্তু সবার সামনে বললে এখন টিজ খাবার ব্যাপক সম্ভাবনা, তাই এই কথা। এবারে পারভীন সিনেমা দেখার প্রস্তাব দিলো। সবাই ব্যাপক উৎসাহে রাজী। প্রায়ই পারভীনের রুমে সিনেমার আসর বসে। কিন্তু কি মুভি? পারভীন জানালো, গ্রাজের দুইখান পার্ট টাটকা পড়ে আছে, সে কিসের জন্য? গ্রাজের কথায় জিনান একটু থমকালো, সে মোটেই ভূতের মুভি দেখতে পারে না। একবার দেখলে সাতদিনের জন্য তার অবস্থা শেষ। প্রতিটা দৃশ্যে চিৎকার দিয়ে পরিবেশ আরো ভয়াবহ করা তার জন্মগত স্বভাব। একারনেই তার বন্ধুরা তাকে ছাড়া ভূতের মুভি দেখতেই চায় না, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তাদের নাকি ভালো লাগে না। কিন্তু আজকে পরিস্থিতি ভিন্ন। জিনান হলের যে ফ্লোরে থাকে সেখানে সে, কুলসুম আর তৃষা ছাড়া বাকি সব জুনিয়র। ফার্স্ট প্রফ শেষ, তাই পুরো ফ্লোর ফাঁকা। তার নীচের ফ্লোরের ৮০ ভাগ আপু প্রায় ২০ দিন ধরেই নেই, কারণ তাদের ফাইনাল প্রফ শেষ। এখন কি মুভি দেখা ঠিক হবে?
পারভীন তার মনের কথা বুঝেই যেন বললো, “ওহ হো! ভুলেই গেছি! আমাদের জিনান তো আমার ভূতের মুভি দেখলে ১০ দিন একা ঘুমাতে পারে না। আচ্ছা আচ্ছা, চল কোন কার্টুন দেখি”। সাথে সবার সম্মিলিত খিক খিক হাসি। অপমান গিলে জিনান বললো, “তোদের মাথা! দেখলে গ্রাজই দেখবো, চল”। প্রথম পর্ব দেখেই জিনানের অবস্থা খারাপ। কিন্তু মুভির নেশাও সেইরকম, দ্বিতীয় পর্ব না দেখে তো উঠা যায় না। মুভি শেষ হতে হতে রাত ২টা। কামরুন বললো, “ওই তোর ফ্লোরে তো কেউই নাই রে, তৃষা আর কুলসুম ও গেছে বাড়ি, তুই আমার রুমে থাক আজকে রাতে”।
“আরে নাহ, রাতে সিমস না খেললে আমার ভালো লাগে না, আবার ল্যাপটপ তোর রুমে আনা আনি, রুমেই যাই। মুভি দেখে ভয় পাওয়ার দিন শেষ”। টি শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে জিনান উত্তর দিলো। তাকে চাপাচাপি করে রুমে না রাখার জন্য পরবর্তীতে জিনান কামরুনকে যে কতবার দোষারোপ করেছে তার হিসেব নেই।
৩.
গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজতে ভাঁজতে জিনান উপরে উঠে এলো। পুরো ফ্লোর কেমন যেন নিস্তব্ধ। সিঁড়িতে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো সে। আবার দোতালায় ফিরে যাবে কিনা – ডিসিশন নিতে পারছে না। “দুত্তোরি, নিকুচি করেছি ভয়ের”- বলে উঠে গেলো। করিডোরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পুরোটাতে যতগুলি লাইট ছিল, সব জ্বালিয়ে দিলো। ফ্লোরের কমলি বিড়াল আরাম করে ঘুমাচ্ছিল, লাইট জ্বালিয়ে ধাপধুপ শব্দ হওয়ায় বিরক্ত হয়ে নীচে চলে গেলো। রুমে ঢুকে জিনান ভাবলো আজ বরং লাইট জ্বালিয়েই ঘুমাই। ল্যাপটপে জোরে প্রিয় নিকেল ব্যাকসের গান ছেড়ে শুয়ে পড়লো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না, ঘুম ভাঙলো শোঁ শোঁ আওয়াজে। ঘুম ভেঙে প্রথমে জিনান কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না। প্রথম কথা, রুম অন্ধকার কেন? সে নিশ্চিত জানে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছে। বেশী ভাবাভাবির অবকা নেই, খোলা জানালা দিয়ে পাগলের মত বাতাস ঢুকছে। জিনান বড় বড় করে ঢোক গিলতে লাগলো। একটু পর অন্ধকার টা সয়ে এলে করিডোর থেকে আসা আবছা আলোয় সে দেখলো, রুমের কোন অবস্থা নাই। টেবিল থেকে খাতা বই উড়ে, প্রাকটিক্যাল খাতার খোলা পেজ দিয়ে রুম ভরা। বাইরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। লাফিয়ে উঠে জিনান সুইচ জ্বালাতে গেলো। সুইচ তো জ্বালানোই আছে, তার মানে লাইট গেছে। আতংকে জিনানের মনে হলো, আবছা আলো মাখা এই আঁধার এখনি তার গলা চেপে ধরবে। জোর করে সে নিজেকে স্বান্তনা দিলো, “এটা ঝড়, প্রায়ই হয়। মাথা ঠান্ডা করো, কিচ্ছু হয়নি। তোমার রুমে আরো লাইট আছে”। দ্বিতীয় টিউবটি জ্বলতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বাতাসের শব্দে কান ঝালাপালা। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে জিনান দেখলো, হলের সামনের গাছ গুলি আজকে যেন পাগল হয়ে গেছে। উন্মত্ত ভাবে শুধু এদিক সেদিক পাতা দোলাচ্ছে, কেউ কেউ অবসন্ন ভাবে অস্থির বাতাসের কাছে আত্মসমর্পণ করছে যেন। নারিকেল গাছের পাতা গুলিকে মনে হচ্ছে অসহ্য জোরে শুধু না না বলে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। কল্পনার ডাল পালা আকাশ ছোঁয়ার আগেই জিনান সশব্দে জানালা বন্ধ করলো। বাতাসের শব্দ কমলো কই তাতে? করিডোরে যেন অশরীরি আত্মা অসহ্য রাগে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর ঝন ঝন করে শব্দ হচ্ছে, কেউ যেন ইচ্ছে মত করিডোরে রাখা জিনিস গুলি লাথি মেরে সরিয়ে রাগ কমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ক্ষনে ক্ষনে জিনান চমকে উঠতে লাগলো। তার শুভ বুদ্ধি তাকে জানাচ্ছে, করিডোরের শেষ প্রান্ত পুরোটা খোলা হওয়ায় সব বাতাস পাগলের মত ঢুকে এই কান্ড ঘটাচ্ছে। কিন্তু কাঁপুনি থামছে কই?
ঠিক সেই সময় শুরু হলো তীক্ষ্ণ কিন্তু টানা একঘেয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। জিনানের মুখ দিয়ে চিৎকার বেড়িয়ে এলো। শব্দটি ঠিক গ্রাজ মুভিতে আত্মা আসার আগে যেমন হয়, তেমন। শব্দ থামছেই না। আতংকে জিনান থর থর করে কাঁপছে। কোনমতে বিছানার পাশে রাখা পানি খেতে শুরু করলো সে, উদ্দেশ্য অ্যাড্রেনালিন রাশের জন্য যে আতংক সে অনুভব করছে তা থামানো। এটা ২০১১ সাল, এবং সে পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ন দেশে এমন একটি বিল্ডিং এ সে আছে, যেখানে না হলেও ৫০/৬০ জন মানুষ আছে।সুতরাং কোন আত্মা এখানে আসবে না। ভাবতে ভাবতেই ঝন ঝন করে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ, সাথে কান্নার শব্দ। কে যেন ইনিয়ে বিনিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে কাঁদছে। জিনানের হাত থেকে পানির বোতল পড়ে গেলো। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা এর মত ঠিক তখন গেলো কারেন্ট। জিনান আর পারলো না, একমনে প্রার্থনা শুরু করলো যাতে সে এখন অজ্ঞান হয়ে যায়। তার হলে কখনোই কারেন্ট যায় না, গত ৬ মাসে একবারো গেছে কিনা সন্দেহ। আজ রাতে কেন অন্ধকার হয়ে গেলো? কান্নার শব্দ বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজটি থামছে, আবার শুরু হচ্ছে।তার মনে হলো এখন অবশ্যি তাকে এই ফ্লোর ছেড়ে যেতে হবে।কিন্তু তার বুকে আর এক বিন্দু সাহস নেই যা দিয়ে দরজার ছিটকিনিটা খোলা যায়। জিনান অন্ধকারে মোবাইলের জন্য হাতড়ানো শুরু করলো। পাওয়া মাত্র কামরুনকে ফোন দেয়া শুরু করলো। বেজেই চললো, ওপাশে কেউ ধরছে না। পারভীনের মোবাইল বন্ধ থাকে জেনেও ফোন দিলো।এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও মহিলা অবিচল ভাবে বললো, “দুঃখিত, এই মূহুর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না”। মোবাইল ছুড়ে ফেলে দিলো ফুঁপিয়ে উঠল জিনান। সাথে সাথে কারেন্ট চলে এলো। আলো আসায় জিনানের মাথা অনেকাংশে ঠান্ডা হলো। কান্নার শব্দ অবশ্যই বিড়ালের। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে কোন গ্রাজের আত্মা আসছে না, সেটি অবশ্যই বাথরুমের দরজা। তীব্র বাতাসে এদিক সেদিক যাচ্ছে। এখানে আর কিছুক্ষন থাকলে সে মারা যাবে, তাকে অবশ্যই দোতালায় তার বন্ধু দের কাছে যেতে হবে।
বেশ কয়েকবার আয়াতুল কুরসি পড়ে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেললো জিনান। বাতাসের তান্ডব একবিন্দু মনে হচ্ছে কমেনি, তীব্র বাতাসে পড়ে যাবার মত অবস্থা। কে যেন এসে আবার করিডোরের বাতি গুলি নিভিয়েছে, মাত্র দুইটি আলো কেমন গা ছম ছমে এক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কোন দিকে না তাকিয়ে কাঁপা হাতে দরজায় তালা লাগালো জিনান। পিছন ফিরতেই বরফের মত জমে গেলো। সবুজ একজোড়া চোখ। সেকেন্ডের জন্য জিনানের মনে হলো, তাকে এখনি কেউ চেপে ধরবে। চাবিটা হাত থেকে পড়ে শব্দ হতেই “ম্যাও” শব্দে সবুজ চোখ সিঁড়ির দিকে চলে গেলো। কমলি বিড়াল! চেপে রাখা নিঃশ্বাস টা বের করে নিজেকে গালি দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো সে। সিঁড়ি ঘরে গিয়ে দেখলো আবছা অন্ধকারে একটা মানুষের অবয়ব সিঁড়ির উপরে বসে আছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে, মানুষটি হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে বসে আছে, আর মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে।
“কে? কে ওখানে?” – নিজের গলার ফ্যাঁসফ্যাঁস আওয়াজে নিজেই চমকালো সে।
কোন উত্তর নেই।
“কে?” – চেঁচিয়ে উঠলো এবার সে।
ধীরে ধীরে মুখ তুললো অবয়ব।
“ওহ! সাচী!উফফফ, তুই? তুই, দোস্ত? দোস্ত আমি অনেক ভয় পাইছি রে! আমার ফ্লোরে আমি ছাড়া কেউ নাই। কি ভয়ংকর ঝড়, দেখ তুই। বিড়াল কেমন করে কাঁদছে দেখ। আমি কামরুনের রুমে যাচ্ছি”। -এক নাগাড়ে কথাগুলো বললো জিনান থামলো।
সাচী শুধু চেয়ে রইলো। বিদ্যুত চমকানোর আলোয় জিনান দেখলো সাচীর গালে চোখের জল গড়িয়ে পড়ার দাগ।
“দোস্ত তোর কি হইছে? তোর রুম না নীচ তলায়? এত উপরে আসছিস কি জন্য এই ঝড়ে? কান্দিস কেন? রাফি ঠিক আছে?”
সাচীর ছোট ভাই অনেকদিন ধরে হজকিন্স লিম্ফোমার সাথে যুদ্ধ করে চলেছে, জানে জিনান। এই রাতে তার এই ব্যবহারের আর কোন কারন তার মাথায় এলো না।
সাচী কোন কথা না বলে উঠে ছাদের দিকে যেতে লাগলো। জিনান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
“এই? সাচী? কই যাস?”। সাচী উঠতেই থাকলো। জিনান এবারে নিশ্চিত, বাসা থেকে কোন খারাপ খবর এসেছে, সাচীর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। বিকট শব্দে বাজ পড়লো। জিনান চমকে গেলো। নাহ, সাচীকে একা ছাড়া যাবে না। জিনান দৌড় দিলো, সাচী ততক্ষনে ছাদে পৌঁছে গেছে। জিনানের কেমন যেন বোধ হতে থাকলো। কোথাও কোন একটা সমস্যা আছে, সাচী এই ঝড়ের মাঝে ছাদে কেন যাচ্ছে? আর ছাদের দরজা বিকেল ৪টায় প্রতিদিন তালা দেয়া হয়, আজকে খোলা কেন? নাকি সাচীর কাছে চাবি ছিল? যেটা মূলত অসম্ভব।
বাতাসের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। এখন শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ভিজতে ভিজতে জিনান দেখলো সাচী রেলিং এর উপরে উঠে বসেছে। জিনানের এবার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। ছুটে গিয়ে সাচীর হাত ধরলো। উদ্দেশ্য টেনে হলেও সাচীকে রুমে নিয়ে যাবে। হাত ধরা মাত্র জিনানের মনে হলো, সে একটা বরফের চাই ধরেছে। শক খাওয়ার মত করে ছিটকে সরে যেতেই সাচী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “ আমি আর নেইরে জিনান, আমি আর নেই। আমি খুব বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। অনেক বড় একটা ভুল। আমার আম্মুকে এখন আমি কি বলবো? সে যে নতুন একটা অ্যাপ্রনে এখনি আমার নামের আগে ডাঃ লিখে সেলাই করেছে, এখন আমি কি করবো?”
জিনান বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকলো।
সাচী বলে চললো, “আমি সুমনকে অনেক ভালোবাসতাম, কিন্তু তার জন্য আমি এত বড় ভুল কেমন করে করলাম?” হঠাৎ সাচী জিনানের দিকে হাত বাড়ালো, “তুই ও চল না দোস্ত, আমার অনেক ভয় করছে। আমি একা একা কি করে থাকবো এখন? দোস্ত তোর পায়ে পড়ি, আমার সাথে চল”।
জিনানের মনে হলো তার গলায় শক্ত কি যেন চেপে বসেছে, প্রানপণ চেষ্টাতেও সে “না” শব্দটি মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না, শুধু শব্দহীন ঠোঁট দুটো নড়ছে। সাচী রেলিং থেকে নেমে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
পরিশিষ্টঃ
৩ বছর পরের কথা। মেডিসিন ফিমেল ওয়ার্ডে জিনান ব্যস্ত ভাবে অ্যাডমিশন ডিউটি করছে। ইন্টার্নদের কোন শান্তি নেই। সারাক্ষন দৌড়ের উপর। বারান্দায় মাত্র এক রুগীর এক্সরে হাতে নিয়েছে, ওয়ার্ড থেকে কান্নাকাটির শব্দ ভেসে এলো। দৌড়ে ওয়ার্ডে ঢুকে দেখলো, ট্রলিতে করে ২০/২১ বছর বয়সী এক মেয়ে এসেছে। তার পাশে এক মহিলা চিৎকার করে কাঁদছে। ঝাড়ি দিয়ে লোকের ভীড় কমিয়ে মেয়ের হাত ধরলো জিনান। পালস অত্যন্ত দুর্বল। মেয়েটির মা কাঁদতে কাঁদতে জানালো, মেয়ে বিষ খেয়েছে। মুখের দিকে তাকিয়ে জিনান যেন সাচীকেই দেখতে পায়। ৩ বছর আগে সাচীর আম্মুর অবিশ্বাসে ভরা চোখ দেখতে পায়। না, দুর্বল মূহুর্তের ভুলের মাসুল আর কোন সাচীকে সে পেতে দেবে না। দ্রুত হাতে সে ট্রিটমেন্ট লেখার কাগজে ঔষধের নাম লিখতে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মে, ২০১১ রাত ৮:৩৩