
বাঙালি মাত্রই ভোজনরসিক। আমরা খেতে আর খাওয়াতে- দুটোতেই সমান তালে পারদর্শী।






সরকারী হাসপাতালে কাজ করার জন্য আছে শুনতে মজার কিন্তু আসলে করুন অভিজ্ঞতা। আমার ইন্টার্ন জীবন শুরু হয়েছিল সার্জারী ওয়ার্ডের মাধ্যমে। তো প্রথম দুই সপ্তাহ তো খালি এদিক যাই ওদিক যাই আর রোগী আসলেই আশেপাশে সিনিয়র কে আছে খুঁজতে থাকি। কয়েক মাস যাবার পরেই দেখলাম আবিস্কার করলাম, যে রোগীদের কাছে প্রধান সমস্যা আসলে একটাই, সেটা হচ্ছে খেতে পারছে না। ইভিনিং বা নাইট ডিউটিতে সবসময় একজন ডাক্তার থাকে, আর বেশীর ভাগ সময়েই তা হচ্ছে ইন্টার্ন। তো এক ইভিনিং এ আমি বসে আছি, এমন সময় রোগীর মা এল। রোগীর মাত্র তার আগের দিন বড় ধরনের সার্জারী হয়েছে তার লার্জ গাটে। সোজা বাংলায় আলসার হয়ে একেবারে পেট ফুটো হয়ে গিয়েছিল। এধরনের বড় অপারেশনে সাধারনত ৩ দিনের আগে মুখে কিছু দেয়া হয়না। মহিলা এসেই প্রথম কথা,
“কি চিকিৎসা দেন আপনারা? এদিকে রোগী না খেয়ে মরে যায় আর আপনারা খাইতে দেন না?”
আমি তাকে একেবারে বাংলায় ভালো করে বুঝিয়ে বললাম যে মুখে কিছু খেতে দেয়া যাবে না, কিন্তু রোগী মরবে না, কারন আমরা স্যালাইন চালাচ্ছি। মহিলা খানিকক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করে চলে গেল। ১০ মিনিট ও যায় নি, আবার। “ছেলেটারে প্রান জুস দেই? আহারে পোলা আমার ১ দিন ধরে না খাইয়া আছে। কালকে অপারেশনের আগে থেকে সে না খাওয়া”।
আমি অনেক কষ্টে মেজাজ ঠান্ডা করে বললাম, “মা, কাল যখন রোগীকে নিয়ে আসছিলেন, সে তো ব্যাথায় বসেও থাকতে পারছিল না, খাবে কি করে? আসার ৩ ঘন্টার মাঝেই তো ওটিতে নিলাম”। বলে আবার ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম যে পানিও যেন না দেয়।
৫ মিনিট পরে আবার ফাইল নিয়ে হাজির। “পানি না হয় না খাইল, রোগী কলা খাইতে চায়, চটকায়ে কি দিমু?”
এবার আমি হতাশ!







এরকম ঘটনা প্রতি আমাদের প্রতি ৪/৫ জনে একজনের সাথে আছেই।




সার্জারীতে আমি এমন রোগীও দেখেছি, যার পেটে এত বড় টিউমার যে শ্বাস নিলে ব্যথা পায়, কিন্তু হাসপাতালে আসেনি। যেই ২/৩ দিন খাবার অরুচী, অমনি দৌড়ে এসেছে, এবং এসে ধরা পড়েছে ক্যান্সার বেশ ছড়িয়ে পড়েছে।
এর পর যখন পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে গেলাম, কাহিনী আরো করুন! রীতিমত আতংক জনক। কারন বাংলাদেশের বেশীরভাগ মা অশিক্ষিত। এদেরকে বলেও বুঝানো যায় না যে কি বাচ্চাদের জন্য ভালো। পেডি তে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম নেপোলিয়ন কি সত্য কথাই না বলেছেন! “তোমরা আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি দিব”। কারন বাচ্চা শ্বাস নিতে না পেরে নীল হয়ে যাচ্ছে, ডাক্তার যে সামনের রুমেই আছে তাকে জানানোর খবর নাই। সে দিদিদের সাথে চ্যাও ম্যাও করতেসে যে বাচ্চার স্যালাইন ঠিকমত যাচ্ছে না।
যাই হোক, পেডি ওয়ার্ডে এক অ্যাডমিশনের দিন বসে আছি। এক ৩/৪ বছরের পিচ্চিকে তার মা নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছে, বাচ্চা কি না কি খেয়ে ফেলছে। আপু বাচ্চাকে জিজ্ঞস করলো, “বাবা, কি খাইসো?”
পিচ্চির স্মার্ট উত্তর, “আন্টি, তেলাপোকা মারার ওষুধ খাইসি”।

আমি পাশে চেয়ার থেকে উলটে পড়তে পড়তে ঠিক হলাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কি খাইসো?”

সে এবার ব্যখ্যা করে বুঝালো আমাদের, “ওই যে, চক আছে না চক, তেলাপোকা হেঁটে গেলে মরে যায়? ওইটা”।

এত সহজ স্বাভাবিক উত্তর, গাধার মত বললাম, “কেন?”
সে উত্তর না দিয়ে এমনভাবে তাকালো যে এই বেকুবটা এসব কি জিগায়!


সৌভাগ্যবশত খুবই অল্প পরিমানে খেয়েছিল বলে তাকে কিছু আর করতে হয়নি।
এমনিতে যদিও বহির্বিভাগে একেবারে ৬০ ভাগ মা এসে বলে যে বাচ্চা কিছু খাচ্ছে না, যদিও আল্লাহর রহমতে বাচ্চাকে দেখে বুঝা যায় না।
এর পরের সমস্যা যদিও বা ডাক্তার তাদের খেতে বলে, তাহলে তারা কি খাবে? সাধারনত অপারেশনের পরে খাবার শুরু করার সময় আমরা প্রথমে তরল, তারপরে স্বাভাবিক খাবারে যাই। তরল খাবারের মাঝে বাজারের জুসটা মানা করা হয় (যদিও কেউ শোনেনা, সবার কাছে তরল মানেই জুস, প্রাণ নাইলে ফ্রুটো!) কারন প্রচুর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা করে। রোগীর লোককে ম্যাডাম বলে গেছে ডিম দিয়ে স্যুপ করে দিতে।
আমাকে এসে তার অ্যাটেন্ডেন্ট বলছে, “আপু, স্যুপ কি কাঁচা ডিম দিয়ে বানাবো?”


প্রথমত আমার মাথায়ই আসলো না, কাঁচা ডিম দিয়ে আবার কিসের স্যুপ হয়। বললাম, “কেন? কাঁচা দিয়ে দিবেন কেন?আপনি কি স্যুপে কাঁচা ডিম খান?”

সে বললো, “না”।
আমি বললাম, “আপনি খেতে পারেন না, তাহলে রোগী কি করে খাবে?”

উত্তর এল, “কিন্তু সে তো অসুস্থ!”

এবার আমার তাকায় থাকা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না।

মেডিসিন ওয়ার্ডে একবার এই স্বাভাবিক খাবার নিয়ে বড় ঝামেলায় পড়েছিলাম। রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, আগের রাতে প্রায় যায় যায় অবস্থা। লিভারের অবস্থা খুবই খারাপ। আমরা খুবই টেনশনে ছিলাম রাত পুরোটা টেকে কিনা। আল্লাহর রহমতে পরেরদিন বিকাল নাগাদ সে মোটামুটি ঠিক হল। রোগীকে মুখে কিছু দেয়া হয়নি আগের দিন। পরের দিন সে খেতে চাইলে আমি বললাম, একদম স্বাভাবিক খাবার নরম করে অল্প করে খান, বেশী দরকার নাই, সাথে স্যালাইন চলুক।
হঠাৎ সিএ ভাইয়া এসে বলল, “এই, তুমি তোমার রোগীরে কি খাইতে বলসো?”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “খুব খেতে চাচ্ছিল, একটু নরম ভাত খেতে বলসি”।

ভাইয়া বললো, যাও তো দেখে আসো।

আমি ওয়ার্ডে ঢুকে টাশকি খেয়ে পরলাম।



আল্লাহ মেহেরবান, রোগী বেঁচে গিয়েছিল সেই যাত্রা।
অবশ্য রোগীদের আর কি দোষ, তারাও তো বাঙালি! দার্জিলিং এ প্রথমবার যখন গেলাম, খুবই জ্বালায় পড়েছিলাম। এরা তো কিছুই খায় না। সারাদিন পাহাড় বেয়ে উঠা নামা করেও কি করে এরা এত কম খেয়ে পারে কে জানে। প্রথমত, খাবার দোকান খুবই কম। একেবারে ১৪/১৫ ঘন্টা জার্নি করে তখন আমাদের সবার অবস্থা তো শেষ। এক দোকানে দেখলাম রাইস আছে, তো আমরা ৭/৮ জন ঢুকে অর্ডার দিলাম। ও মা, খাবারের খোঁজ নাই। প্রায় ১ ঘন্টা পরে যখন আমরা খিদেয় প্রায় পড়ে যাচ্ছি, তখন খাবার আসলো। প্লেটের দিয়ে তাকিয়ে আবার মুখ অন্ধকার। খুবই অল্প ভাত, পিচকু একটা মাছ, সব্জী আর ডাল এত কম যে খুঁজে পাওয়া মুস্কিল। আমি ভাবলাম আমারই তো আবার নিতে হবে, ভাইয়া আর পিচ্চিদের কথা বাদই দিলাম। ভাইয়ারা যখন আরেক প্লেট করে সাথে সাথে অর্ডার দিল, ওরা হাঁ করে তাকায় বললো, “আপনাদের আরো লাগবে?” তাদের মাথাতেই নেই যে এত কেউ কি করে খাবে। তারপর মাথা নেড়ে বললো, আর হবে না। এটুকুই কষ্টে যোগাড় করেছে।



দ্বিতীয়বার যখন ৩৭ জন বান্দর মিলে গেলাম দার্জ়িলিং, আমি আগে থেকেই সবার কান ঝালাপালা করতেসি, “ওই তোরা কিন্তু কোন খাবার পাবি না, বিস্কট কিন! কেক কিন”। কেউ কথা শুনলো না, ওদের দেখে আমিও কিনলাম না, এবং আবার ঘোরাফিরার মাঝে একই অবস্থা!!! নেড়া বেলতলায় আসলে অনেকবার যায়।


ভূটানে আরো খারাপ অবস্থা। হোটেলটা থিম্পুর বেশ নামী হোটেল। ভূটানে খাবার, পানি, বিদ্যুত এসবের অনেক সঙ্কট, তাই যাওয়ার পর পরই আমাদের বলে দিল যে পানি পরি্মিত ব্যবহার করতে, আর তাপমাত্রা ৬/৭ ডিগ্রী হওয়ার পরেও লবীতে কোন হিটার চালায় না। যাই হোক, বাংলাদেশ থেকে পারো, তারপর থিম্পু, বেশ লম্বা জার্নি ছিল। রাতে ডিনার নাকি হোটেলে বুফে। গিয়ে দেখলাম, রুটি আর আলু না কি জানি সব্জী, ডাল আর সালাদ। এর মাঝে রুটির পরিমান এত কম যে হয়ত জনপ্রতি ২/৩টার বেশী হবে না। আমরা গিয়েছি প্রায় ৩০ জন। বলাই বাহুল্য সবার কম পড়লো, এবং ওদের অবাক দৃষ্টি দেখে খুবই লজ্জা পেলাম। কি করে মানুষ এত খায়, ওদের ধারনা নাই।
তারপরো খাই-খাই অনেক ভালো লাগে।








বেঙ্গালুরু তে চাটের দোকানে।

মালয়েশিয়াতে কি জানি টম য়াম মিল।

ইহা তার বড় পছন্দের, নান্দুস।

কোন দেশ ভুলে গেছি, কানাডা মনে হয়।

আবার নান্দুস, এবার বেঙ্গালুরুর।

ঢাকার পিজা হাট।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুলাই, ২০১১ রাত ৯:৩৭