somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"গেরিলা"- মুক্তিযুদ্ধের কিছু মূহুর্ত.....

১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ রাত ৩:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথমেই বলে নেই, আমি আগে কখনো কোন সিনেমা দেখে তার রিভিউ লিখিনি। ভালো লাগলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সবাইকে সিনেমা দেখতে বলেছি, না ভালো লাগলে স্ট্যাটাসেই ধুয়ে দিয়েছি।:|:| তাই রিভিউ ভেবে পড়ে আমাকে পরে বকা দিয়েন না প্লিজ। :((:((:((

আজকে সিনেমা দেখার কোন প্লান ছিল না। পয়লা বৈশাখে এই প্রথমবারের মত সারাদিন ঘরে বসে ছিলাম। যদিও রবীন্দ্র সরোবরের একেবারে কাছেই থাকায় দিনভর ঘরে বসেই গান শুনেছি, কিন্তু রমনাতে তো আর যাওয়া হয়নি।/:)/:) আমরা ক’জন অভাগা যারা বেরোতে পারিনি, বা বের হয়ে জামে বসেই বর্ষ বরণ করেছি তারা আজ বের হয়েছি আড্ডাবাজী করতে। এমনিতেই আজকাল কেউ কাউকে কাউয়া বা গরু খোঁজা খুঁজলেও পাইনা। সিনেমা দেখার প্রস্তাব কেউ ভুলেও করেনি। কারন নতুন সিনেমা আজকাল আগের দিন টিকেট না কাটলে সিনেপ্লেক্সে দেখার আশা না করাই ভালো। আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মুভি যত সম্ভব এরিয়ে চলি, কারন এই ভয়াবহতা বার বার দেখার মত মানসিক শক্তি আমার নেই। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছি জীবনে মাত্র ৩ বার। প্রতিবারই অশ্রুসজল চোখে বেরিয়েছি। আর তারউপর শখ করে দেখতে গিয়েছিলাম মেহেরজান। সেই ১৫০টাকার শোক আজও ভুলিনি। সাথে বিনামূল্যে খারাপ মেজাজ তো মেহেরজান সবাইকে ঢেলে দিয়েছে।X(X( ঠিক করেছিলাম কেউ রিকমেন্ড না করা পর্যন্ত আর কোন মুক্তিযুদ্ধের উপর সিনেমা নয়।

কিন্তু কপালে থাকলে কে ঠেকায়? সন্ধ্যা সাতটায় যখন ধানমন্ডিতে, তখন হঠাৎ একখান ফ্রি টিকেট মিললো। বান্ধবীর জামাইএর কি কাজ পড়েছে, টিকেট নষ্ট হবে সেই দুঃখ সে মেনে নিতে পারছে না। ফ্রি দিলে তো শুনেছি বাঙালি আলকাতরাও নাকি খেতে পারে, আর এতো আস্ত একটা টিকিট!;);) দিলাম দৌড়। যখন আমি ঢুকলাম ততক্ষনে সিনেমার ৭/৮ মিনিট পেরিয়ে গেছে। গিয়ে দেখলাম বিলকিসের (জয়া আহসান) শ্বাশুড়ী তাকে ইচ্ছেমত বকাবকি করছে। পাশে বান্ধবীকে গুঁতা দিলাম, কাহিনী কি? শুনলাম ২৫শে মার্চের রাত থেকে বিলকিসের স্বামীকে (ফেরদৌস) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিলকিস স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে এখন নিজেই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জড়িয়ে গেছে। এরপর বিরতির আগপর্যন্ত আর কোন কথা বলার আর উপায় হয় নি।

বিলকিস সিনেমার মূল চরিত্র। জয়া আহসানকে আমার মনে হয়েছে চরিত্রটির সাথে একেবারে মিশে গিয়ে অভিনয় করেছেন। বিলকিস পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকে কাজ করে। তবে তার প্রধান কাজ হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা এবং সবার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। পাকিস্তান আমলের শিল্পী আলতাফ মাহমুদের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। ধরা পড়ার মুহুর্তেও পাকিস্তানী অফিসারের দিকে তার যে দৃষ্টি ছিল, তাকেই মনে হয় সত্যিকারের অগ্নিদৃষ্টি বলে। বেশ কয়েকটা অ্যাকশন চালায় তারা তবে একজন সহমুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ে যাওয়ায় আর শেষরক্ষা হয় না। সে নির্যাতনের মুখে সবার নাম বলে দিলে প্রায় প্রত্যেকেই ধরা পড়ে তবে জয়া আলতাফের স্ত্রীর কারনে পালাতে পারে। যদিও তার কারনে বলি হয় তার আশ্রয়দাতা পুরান ঢাকার মুরুব্বী এটিএম শামসুজ্জামান। সিনেমার শুরুতে যে ভাষা ব্যবহার করে তিনি রাজাকারদের তাড়িয়ে দেন, তা এমনিতে স্ল্যাং কিন্তু তাও মনে হয় নিমক হারাম গুলোর জন্য কম। আর একজনের কথা বলতেই হবে, দ্বৈত পাকিস্তানী অফিসারের ভূমিকার অভিনেতা। তার নাম জানি না, তবে সকলের তীব্র ঘৃণা আদায়ে সফল।

সিনেমার বিভিন্ন দৃশ্যে অনেক দেয়াল লিখন এবং ব্যানার দেখিয়েছে। যার মাঝে একটা হচ্ছে খানিকটা এরকম,
“পাকিস্তান কে একত্র করুন, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিন”- গোলাম আজম
জামায়াতে ইসলামীর এজাতীয় একটি দেয়াল লিখন রক্ত লাল কালিতে সাদা কালিতে লেখা। দেখে মনে হয়, হায় বাংলাদেশ! যারা তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন অপমানিত করেছে তাদেরকেই তার মাটিতে সগর্বে হাঁটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে তারই কিছু বখে যাওয়া সন্তান। মা মাত্রই সর্বংসহা।

বাংলা সিনেমার অন্যতম প্রধান অভিযোগ সময় অনুপযোগী পোশাক পুরো সিনেমাতে একেবারেই অনুপস্থিত। জয়া আহসানের মেকআপ একেবারেই সাধারন। অন্যান্য সিনেমার মত গ্রামে এবার কেউই সিল্কের শাড়ি বা হাল আমলের সালোয়ার কামিজ পরিহিতা ছিলনা।

কিছু বাস্তবসম্মত কিন্তু ভয়াবহ দৃশ্য আছে সিনেমাতে যেটা সহ্য করতে মানসিক শক্তি দরকার। এখানে সেখানে পড়ে থাকা ক্ষত বিক্ষত লাশ, কুকুরের মুখ থেকে নিজের ভাইএর লাশ ছিনিয়ে আনা- এরকম। নদীতে নৌকায় যখন জয়া তার গ্রামের বাড়ী রংপুরের জলেস্বরী যেতে থাকে, তখন লাশ দেখে সে বমি করতে শুরু করলেও নির্বিকার চিত্তে তার পাশে বসে যবের ছাতু খেতে থাকে এক ৭/৮ বছর বয়সী বাচ্চা।

সিনেমা দেখার সময় অনেক দৃশ্য দেখেই মনে হয়েছে, গ্যালারীতে যে পাকিস্তানের পতাকা আঁকিয়ে, হাতে পতাকা নিয়ে উল্লাসরত অবস্থায় ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়েছে, তারা কি কেউ হলে আছে? টিএসসির সামনে ফেরিয়ালার কাছ থেকে যারা পাগলের মত পাকিস্তানের পতাকা কিনে গায়ে জড়িয়েছিল, তাদের একজনো কি আছে? নাকি তারাও এখন বাকি দর্শকের সাথে মুক্তিবাহিনীর অ্যাকশনের সময় তালি দিচ্ছে আর বলছে, “জয় বাংলা”। বড় ইচ্ছা করে, প্রতোক স্কুল-কলেজের ছাত্র ছাত্রী দের জন্য জীবনে একবার হলেও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যাওয়া বাধ্যতামূলক করা। যদি এতে এক্সট্রা মার্ক দিলে তারা যায়, তবে তাই যেন করা হয়।

সিনেমায় পাকিস্তানী অফিসার মুক্তিসেনা কে টর্চার করার সময় একটা সত্যি উক্তি দিয়েছেন, “উসকো পুছতে রাহো। ইয়ে গাদ্দারকা দেশ হ্যায়। কোই না কোই তো বাতাহি দেগা খোকন কমান্ডার কাহা হ্যায়” – ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকো। এটা বিশ্বাসঘাতকের দেশ। কেউ না কেউ তো বলেই দেবে খোকন কমান্ডারকে কোথায় পাওয়া যাবে। [উর্দু ভুল হতে পারে, মনে হয় হিন্দী লিখে ফেলেছি।] সিনেমার প্রায় প্রতিটি দৃশ্য বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে পাকিস্তানীরা আমাদের ক্ষতি যা না করেছে, ঘৃণ্য রাজাকাররা করেছে তার ১০০ গুন।

সরকারী অনুদান আর ইমপ্রেস টেলিফিল্মের সহযোগীতায় পরিচালক নাসির উদ্দিন ইউসুফের কাজ নিয়ে কিছু বলার নেই। চমৎকার সিনেমাটোগ্রাফি। জয়া যখন পুরনো কল্পনায় বিভোর থাকে তখনকার সামান্য দৃশ্যও তার কল্যানে অসাধারন হয়ে ধরা পড়েছে। আর যুদ্ধের প্রতিটি দৃশ্য যেন তার অনুভবের ফসল।

সব মিলিয়ে সিনেমাটি সবার অবশ্য অবশ্য অবশ্যই দেখা উচিত।

একটা গল্প দিয়ে শেষ করি-
প্রথম আলোতে পড়েছিলাম বেশ আগে যে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের নাসির উদ্দিন ইউসুফ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাক সেনারা গাড়ী থামিয়ে সবাইকে আলাদা করতে থাকে। তখন এক অপরিচিত বৃদ্ধ “এতো আমার ছেলে, এতো আমার ছেলে” বলে চেঁচালে তাকে যেতে দেয়া হয়। এরকম কাহিনী মনে হয় সবার পরিবারেই আছে। আমার বাবা ১৯৭১ এ মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে সে বাসে করে গ্রামের বাড়ীতে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাকসেনারা বাস থামায় এবং সবাইকে কারণ ছাড়াই লাইনে দাঁড় করায়। আব্বুর পাশের লোকটিকেও গুলি করা হয়। কিন্তু অপরিচিত একজন লোক হঠাৎ, “আরে এতো খুব ভালো ছাত্র। সারাদিন পড়াশোনা করে। এতো এখনো ক্লাস করবে, পাকিস্তান স্বাভাবিক আছে দেখানোর জন্য”- ইত্যাদি বলে চিল্লাচিল্লি করতে থাকলে কি কারনে আব্বুকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনা আমি জেনেছি আমার বয়স ২০ হবার পরে। আমি যখন অবাক হয়ে আব্বুকে বলেছি, “তুমি যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে, এসব গল্প আমাদের কখনো বলনি কেন?” তার উত্তর, “এসব বলার মত কিছু না”।

আসলেই এসব বলার মত কিছু না।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ সকাল ৮:২১
৫৮টি মন্তব্য ৫৮টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×