বলিউড তথা হিন্দি সিনেমা কিভাবে দেশী, প্রবাসী ও অনাবাসী ভারতীয়দেরকে প্রভাবিত করেছে তা ভারতের বাইরের একজন সাধারন দর্শক কল্পনাও করতে পারবে না। বলিউড কেন্দ্রিক যে কোন আলোচনায় এই প্রভাব সর্ম্পকে খানিকটা ধারনা থাকা প্রয়োজন। তাই শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ডালটনের মোটেল ব্যবসায়ী ভবেশ শেঠের জীবনে বলিউডের প্রভাব বর্ননার মধ্য দিয়ে এ সম্পর্কে খানিকটা ধারনা দেওয়া হচ্ছে। ভবেশ একজন অনাবাসী ভারতীয়।
ভবেশের বাবা সত্তুরের দশকে ভারত থেকে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে কানাডাতে ভবেশের জন্ম হয়। পরবর্তীতে বাবার কাজের সুবাদে সে ড্রেটয়েট, হিউস্টন এবং টেনিসিতে বসবাস করেছে। মাঝে মধ্যে মা-বাবার সাথে ভারত সফর করে থাকে ভবেশ। ১৯৯৯ সালে পারিবারিকভাবে গুজরাটি মেয়ে তিজালের সাথে ভবেশের বিয়ে হয়। ভবেশের হাতে-গোনা সৌভাগ্যবান ভারতীয়দের একজন যে কিনা একই মঞ্চে একজন বলিউড সুপার স্টারের সাথে অনুষ্ঠান করেছে।
প্রবাসে বেড়ে উঠা অনাবাসী ভারতীয়রা ভারতকে চেনে বলিউড বা হিন্দি সিনেমার চোখ দিয়ে। ভবেশ মা-বাবার সাথে ভিডিও ক্যাসেটে হিন্দি সিনেমা দেখে বড় হয়েছে। নয় বছর বয়সে ভবেশের প্রিয় মানুষ ছিল অমিতাভ বচ্চন। সিনেমার পর্দায় অমিতাভ মারা গেলে ভবেশ কেঁদে-কেটে অস্থির হয়ে পড়ত। অভিনয় জিনিষটা কি তা তখন সে বুঝত না। বড় হবার সাথে সাথে ভবেশের হিন্দি সিনেমা প্রীতি আরও বেড়েছে। তার স্ত্রী তিজাল হিন্দি সিনেমার পোকা। তাদের ছেলে কিষান জ্ঞান হবার পর থেকেই হিন্দি সিনেমার নাচ-গানের ভক্ত।
২০০৪ সালে বলিউডের তারকাদের কনসার্ট টেম্পটেশন ২০০৪ এর একটি শো আটলান্টায় আয়োজিত হয়। ভবেশ জন্মদিন ও বিয়েতে পাওয়া উপহার বিক্রি করে সেই কনসার্টের টিকেট ক্রয় করে। বলিউডের কনসার্টে ফিল্ম স্টাররা জনপ্রিয় সঙ্গীতের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে নাচেন, কৌতুক করেন এবং দর্শকদের সাথে নানা ইভেন্টে অংশ নেন। সেবারের কনসার্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষন ছিল শাহরুখ খান। শাহরুখ ও অন্যান্য তারকাদের নিয়ে দুই মাস ধরে বিভিন্ন দেশের ষোলটি শহরে টেম্পটেশন ২০০৪ কনসার্টের শোগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এসব শহরের ভেন্যুগুলোতে ধারন ক্ষমতা ছিল সাত থেকে বিশ হাজার। টিকেট মূল্য ৩০০-৪০০ ডলার। কিন্তু এত দাম সত্ত্বেও বিপুল চাহিদার কারনে অনেক ভেন্যুতেই টানা দুইবার শো এর আয়োজন করা হয়। প্রায় সব দর্শকই ছিল অনাবাসী বা প্রবাসী ভারতীয়। এরা কবে কিভাবে প্রবাসী হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস লেখা নেই। যেমন হল্যান্ডের অধিকাংশ ভারতীয়দের পূর্বপুরুষরা ১৮৭৩ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে ডাচ কলোনী সুরিনাম হয়ে শ্রমিক হিসেবে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিল। কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতের সাথে সরাসরি সংযোগ না থাকলেও বলিউড তথা হিন্দি সিনেমার সাথে এদের সংযোগ নিবিড়।
চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসরিন মুন্নী কবির তার The Outer World of Shah Rukh Khan ডকুমেন্টারিতে শাহরুখ খানকে ঘিরে ভক্তদের উন্মাদনা তৈরীর কিছু দৃশ্য দেখিয়েছেন। রাত দুটোর সময়েও প্রিয় সুপার স্টারকে এক ঝলক দেখার জন্য হোটেলের বাইরে শত শত তরুন-তরুনী অপেক্ষা করে। তার সাথে একবার দেখা করার জন্য তারা পারে না এমন কোন কাজ নেই। শাহরুখের দেহরক্ষীদের তরুনী ভক্তরা যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দেয়। কনসার্টের আয়োজকদের দুই হাজার ডলার ঘুষ দিতেও এরা প্রস্তুত। বিনিময়ে মঞ্চের পেছনে একবার শাহরুখ খানের সাথে দেখা করিয়ে দিতে হবে।
২০০৪ সালের ৩রা সেপ্টেম্বরের কনসার্টে যাবার আগে ভবেশ তার স্ত্রীকে বলেছিল সে স্বপ্নে দেখেছে শাহরুখের সাথে একই মঞ্চে অনুষ্ঠান করছে। তিজাল কথাটা হেসে উড়িয়ে দেয়। কনসার্টে শাহরুখ স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে উপস্থাপনা শুরু করে। একটি পর্বে শাহরুখের দু’জন দর্শকের প্রয়োজন হয়। একটি মেয়ে আগে থেকেই নির্বাচিত ছিল। মেয়েটি একটি প্রতিযোগিতায় জেতার পুরষ্কার হিসেবে এই সুযোগ পেয়েছিল। পুরুষ নির্বাচন পর্বটি ছিল উন্মুক্ত। শাহরুখের ঘোষনার পরপরই ভবেশ নিজের সিটের উপর লাফিয়ে উঠে উত্তর ভারতীয় এক নাচের মাধ্যমে শাহরুখের দৃষ্টি আকর্ষন করতে পারে। শাহরুখ ভবেশকে মঞ্চে আহবান জানায়। শাহরুখ যখন ভবেশের হাতে মাইক্রোফোনটা তুলে দেয় তখন সে বলে, আজ থেকে সাতদিন আগে আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম শাহরুখের সাথে একই মঞ্চে অনুষ্ঠান করছি। আমার স্ত্রী পর্যন্ত আমার কথায় বিশ্বাস করেনি অথচ ঈশ্বরের শপথ আমি সত্যই স্বপ্নটা দেখেছিলাম। ভবেশের কথা শুনে শাহরুখ হাসতে হাসতে বলে, তোমার কথা শুনে আমি সত্যিই অভিভূত তবে একজন ছেলে হিসেবে তোমার স্বপ্নটা কোন নগ্ন সুন্দরী রমনীর সাথে হলেই আমি খুশী হতাম। ভবেশ শাহরুখের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।
ভবেশ প্রায় ত্রিশ মিনিট শাহরুখের সাথে মঞ্চে দেবদাস সিনেমার একটি গানের দৃশ্যায়নে অংশগ্রহন করে। এই মূহুর্তগুলো ভবেশের জীবনকে পাল্টে দেয়। বলিউড সুপারষ্টারের সাথে অনুষ্ঠান করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হয় সে। সেদিন থেকে ভবেশকে নিয়ে তার ভারতীয় বন্ধুরা, আত্মীয়রা আলাপ করলে ভবেশের এই মূহুর্তগুলোর কথা মনে করবেই।
সিনেমা পাগল দেশ বলতে যা বোঝায়, ভারত ঠিক তেমনি একটি দেশ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশী সিনেমা তৈরী হয় ভারতেই। সংখ্যায় যা বছরে গড়ে ৮০০ এর বেশী। এর ভেতর গড়ে ২০০টির বেশী সিনেমা তৈরী হয় মুম্বাইতে। বোম্বের নতুন নাম মুম্বাই। এক একটি সিনেমা তৈরীতে এখানে সময় লাগে বিশ দিন থেকে এক বছরের উপর।
ভারতে প্রতিদিন কত মানুষ সিনেমা হলে সিনেমা দেখে তা হিসেব করলে অনুমান করা যায় ভারতীয় অর্থনীতিতে সিনেমা ইন্ড্রাষ্ট্রির প্রভাব কেমন। প্রতিদিন গড়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষ ভারতের প্রায় সাড়ে বারো হাজারের অধিক সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যায়। হলগুলোতে টিকেটের অভাব এক স্বাভাবিক ব্যাপার। টিকেটের এ অভাবকে কাজে লাগিয়ে প্রায় প্রতিটি সিনেমা হলে গড়ে উঠেছে কালো বাজারী চক্র। তারা টিকেটের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দাম বাড়িয়ে ব্ল্যাক মার্কেটে টিকেট বিক্রি করে থাকে। সিনেমা হলগুলোতেও আছে বৈচিত্র্য। দিল্লী, মুম্বাইয়ের মত শহরে গড়ে উঠেছে সর্বাধুনিক মাল্টিপ্লেক্স সিনেমা হল। আবার গ্রামের সিনেমা হলগুলো গড়ে উঠেছে তাঁবুর ভেতর, যেখানে মেঝেতে শুয়ে-বসে দর্শকরা সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু যেখানেই দেখুন না কেন সবখানেই আপনি সেই চিরচেনা মশলা মেশানো হিন্দি সিনেমার রেসিপিটা উপভোগ করবেনই। আবেগ, নাচ, গান, ফাইটিং, হাসি-কান্নার এমন মিশ্রন হিন্দি সিনেমা ছাড়া অন্য সিনেমাতে সেভাবে পাওয়া যায় না।
দর্শকদের অনুভূতিও সব জায়গায় কম-বেশী একই রকম। সব জায়গাতেই নায়ক বা নায়িকার আগমনের প্রথম দৃশ্যে দর্শকরা মুখ দিয়ে নানা শব্দ করতে থাকে। সংলাপ পছন্দ হলে হাততালির জোয়ার বয়ে যায়। গানের সাথে ঠোঁট মেলানো চলে সমানতালে। কোথাও কোথাও দর্শকরা গানের সাথে নাচতে শুরু করে। যাত্রা পালার মত পর্দার দিকে ছুঁেড় মারে খুচরো পয়সা। রঙ্গিন হিন্দি সিনেমার থেকেও রঙ্গিন সিনেমা পাগল ভারতীয় দর্শকরা।
ভারতে সেই সিনেমাকেই সফল ধরা হয় যেখানে দর্শক পকেটের পয়সা খরচ করে একই সিনেমা বারবার দেখে থাকে। কিছু কিছু ব্লক ব্লাষ্টার সিনেমা টানা পাঁচ বা দশ বছর পর্যন্ত কোন কোন সিনেমা হলে এক নাগাড়ে চলেছে। ভারতে সিনেমা মনোরঞ্জন। জীবনধর্মী নিরীক্ষা নয়।
এ জন্যই হয়ত হিন্দি সিনেমাতে সবকিছুই সম্ভব। মার-দাঙ্গা হিন্দি সিনেমাতেও পুলিশের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো নায়ক-নায়িকা গান গাইতে গাইতে মূহুর্তেই ভারত থেকে চলে যায় সুইস পর্বতমালার বরফের মাঝে। নায়ক বিন্দুমাত্র আহত বা ক্লান্তি ছাড়া একাই দশজনকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ছাড়ে। নায়িকারা মিনি স্কার্ট সহ নানা উত্তেজক পোষাক পরে পার্টি করে বেড়ায়। অথচ সিনেমার শেষ পর্যন্ত তার কুমারীত্ব বিসর্জন দেওয়ার মত মহাপাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলে। ঘর বাড়িতে আয়া-বুয়ার সংখ্যা দেখা না গেলেও সব সময় তা অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সাজানো থাকে। বিনোদনধর্মী হিন্দি সিনেমা বড় বেশী রঙ্গিন।
গানগুলোকে ধরা হয় হিন্দি সিনেমার মূল প্রাণশক্তি। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় সাহিত্য ও সভ্যতার সাথে গীতি কথা, গান মিশে আছে। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের হিন্দি ছবিতে কখনও কখনও চল্লিশটার বেশী গান থাকত। ১৯৩২ সালে নির্মিত ইন্দ্রসভা সিনেমায় গানের সংখ্যা ছিল একাত্তর। তবে পঞ্চাশের দশক হতে গানের পরিমান সিনেমা প্রতি দশটার নিচে নেমে আসে। এখন এ সংখ্যা গড়ে ছয় এর নিচে। হিন্দি সিনেমার গানগুলো বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিয়ের অনুষ্ঠান, পার্টি, নাইটক্লাব, পূজা-অর্চনায় ব্যাপকভাবে এ গানগুলো ব্যবহার করা হয়। ভারতীয়রা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আনন্দের অংশ হিসেবে গানের অন্তর বা অক্ষর মিলিয়ে প্রতিযোগিতা করে থাকে।
হিন্দি সিনেমার কাহিনী খুব একটা জটিল হয় না। হিন্দি সিনেমায় সত্য আর সুন্দরের জয়গান করা হয়। প্রথমদিকের ভারতীয় সিনেমা ছিল মূলত পৌরণিক কাহিনী নির্ভর। ভারতের প্রথম পূর্নাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাতা ধুন্ডীরাজ গোবিন্দ ফালকে (দাদাসাহেব ফালকে) ১৯১৩ সালে নির্মাণ করেন রাজা হরিশচন্দ্র। দাদাসাহেব ফালকে এক পুরোহিতের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন।
হিন্দি সিনেমার নায়করা সাধারনত ফর্সা ও হালকা-পাতলা দেহের অধিকারী হয়। সিনেমায় তারা রামের ন্যায় সর্বদা ন্যায়ের রক্ষক থাকে। নায়কের সব কিছুই ভাল। বিপরীতে খল অভিনেতা দেখতে মোটাসোটা, কৃষ্ণ বর্ণের এবং তার সবকিছুই মন্দ। সিনেমাতে পারিবারিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। নায়িকারা থাকে চরিত্রবান ও রূপবতী। হিন্দি সিনেমাতে জীবনের বাস্তবতাগুলোকে উপস্থাপন করা হয় না বললেই চলে। বরং জীবন কেমন হওয়া উচিত তার একটা আনন্দময় সংস্করন উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। বলিউড এর বিনোদন সিনেমাগুলো ভারতীয়দের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছে। হিন্দি সিনেমায় দেখানো সাজ-সজ্জা ও উৎসবের আদলে সিলিকন ভ্যালির সফটওয়্যার প্রকৌশলী থেকে শুরু করে বিহারের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামবাসীরাও বিয়ে, পূজা সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজন করে। অনেক দেশের মূল সিনেমা হলগুলোয় হিন্দি সিনেমা দেখানো হয় না। সে সব দেশে স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হিন্দি সিনেমা পৌঁছে গেছে মানুষের শোবার ঘরে। দেশে দেশে গড়ে উঠেছে হিন্দি সিনেমাপ্রেমীদের সংগঠন।
যেমন দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রতি সপ্তাহে একদল কোরিয়ান দর্শক, যারা নিজেদের বলিউড লাভারস ক্লাব পরিচয় দিয়ে থাকে তারা একত্রিত হয়ে হিন্দি সিনেমা উপভোগ করে। ভাষা না জানায় সিনেমাতে কোরিয়ান ভাষার সাবটাইটেল ব্যবহার করে তারা। ভারতীয়দের অনুকরনে সিনেমা দেখার অংশ হিসেবে তারাও নায়িকা দেখে শিষ দেয়, গানের সাথে নাচে, ভিলেনকে গাল-মন্দ করে। এ ক্লাবটি হিন্দি নাচ শেখার জন্য ক্লাশেরও আয়োজন করে।
নাইজেরিয়া বিশেষ করে উত্তর নাইজেরিয়াতে ১৯৫০ এর দশক হতে লেবানীজদের মাধ্যমে হিন্দি সিনেমার প্রবেশ ঘটে। আজ সেখানের যানবাহন, প্রাইভেট ট্যাক্সিতে বলিউডের নায়ক-নায়িকার পোস্টার চোখে পড়াটা সাধারন ব্যাপার। মুদী দোকানেও বলিউড সুপার স্টারদের পোস্টারের ছড়াছড়ি। নাইজেরিয়ার স্থানীয় বহু গায়ক ও গীতিকার হিন্দি সিনেমার গান ও সুর নকল করে ইসলামী ভক্তিমূলক গান রচনা করে। ত্রিশ বছর ধরে উত্তর নাইজেরিয়ার সংস্কৃতি পরিচালিত হচ্ছে হিন্দি সিনেমার ফ্যাশন আর বলিউড আইকনদের অনুকরনে।
১৯৬৫ এর দ্বিতীয় পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে হিন্দি সিনেমার আমদানী ও প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তা পাকিস্তানী দর্শকদের হিন্দি সিনেমা প্রীতি কমায়নি। ভারতে যেদিন কোন হিন্দি সিনেমা মুক্তি পায় সেই একই দিনে পাকিস্তানেও পাইরেটেড ডিভিডিতে সেই সিনেমাটি পাওয়া যায়। র্উদু ও ইংরেজী ভাষার পাকিস্তানী পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত হিন্দি সিনেমার সমালোচনা করা হয়। করাচী ও লাহোরের বড় বড় বিজ্ঞাপনগুলোতে শাহরুখ খানের ছবি ব্যবহার করা হয়। শাহরুখের বাপ-দাদার পেশোয়ারের বাড়িটি পর্যটকদের অন্যতম আর্কষন কেন্দ্র। চলচ্চিত্র নির্মাতা মহেশ ভাট একবার কৌতুকের ছলে বলেছিলেন, পাকিস্তানের ভারত আক্রমন না করার একটা বড় কারণ হল শাহরুখ খান।
মুম্বাইয়ের হিন্দি সিনেমা ইন্ড্রাষ্টির নাম হলিউডের আদলে বলিউড কিভাবে হল? নিউইর্য়ক টাইমস পত্রিকার ভাষাবিদ উইলিয়াম সেফায়ার দেখিয়েছেন, ১৯৭৬ সালে ক্রাইম থ্রিলার লেখক এইচ আর এফ কিটিং প্রথম হিন্দি সিনেমা ইন্ড্রাষ্ট্রিকে বলিউড নামে অভিহিত করেন। বলিউড হলিউডের উন্নয়নশীল দেশের সংস্করন। এক সময় হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কলা-কুশলীরা মূল ধারার মিডিয়ায় বলিউড নাম ব্যবহারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। কিন্তু এ নামের ব্যবহার ঠেকানো যায়নি। ২০০১ সালে অক্সফোর্ড ইংরেজী ডিকশনারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বলিউড নামটিকে অন্তভূর্ক্ত করা হয়। ইয়োগা আর তাজমহলের মত বলিউডও এখন ভারতের আরেক পরিচয়।
ভারত একটি বৈচিত্র্যপূর্ন দেশ। আয়তনের দিক দিয়ে এটি বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ দেশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত বিশ্বে দ্বিতীয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ২৩ টি স্বীকৃত ভাষা আছে ভারতে। বহু ধর্মের জন্ম যেমন এখানে হয়েছে তেমনি বিপুল সংখ্যক ভারতীয়রা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। ভারতের অসাম্প্রদায়িকতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর শিক্ষার সাথে পাশাপাশি অবস্থান করছে উগ্রবাদিতা, দারিদ্র্যতা, পশ্চাৎপদতা এবং নিরক্ষরতা। মুম্বাইয়ে আছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বস্তি এলাকা যেখান থেকে মাত্র দশ মিনিটের গাড়ি দূরত্বেই আছে অভিজাত ব্র্যান্ডের বিভিন্ন দোকান। এসব ভারতের বাস্তবতা। শশী থর তার লেখা ফ্রম মিডনাইট টু দি মিলেনিয়াম বইতে প্রশ্ন করেছিলেন, এত বৈচিত্র্যকে এক করেছে কে?
এ প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তরের একটা উত্তর, বলিউড। হিন্দি সিনেমা সেই আঠা যা বিশ্বের প্রায় ১১০ টি দেশে ছড়িয়ে পড়া বহু ভাগে বিভক্ত ভারতবাসীকে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র আর বয়সকে ছাপিয়ে একটি ভারতীয় পরিচয়ে এক করে রাখতে পারে। অন্য দেশে বসবাস করা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের ভারতীয়রা হিন্দি সিনেমা দেখলে ভারতের সাথে তাদের নাড়ির টান অনুভব করে। এদের অনেকেই এখন আর মূল ভাষাটা জানে না। সাব টাইটেল দিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখে থাকে। নিউইর্য়ক আর লন্ডনের নাইট ক্লাবগুলোতে এখন ভারতীয় ডিজেরা হিন্দি সিনেমার গানের রিমিক্স পরিবেশন করে। বলিউডের সিনেমার প্রতি আকর্ষন থাকা মানেই জাত গেল গেল এ রব এখন আর উঠে না। ভারতের মত হিন্দি সিনেমাও এখন সগর্বে বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে।
হিন্দি সিনেমার এই জাগরনের সাথে শাহরুখ খানের সুপার স্টার হয়ে উঠার নিবিড় যোগ সূত্র রয়েছে। বলিউড জাগরনে আধুনিক হিন্দি সিনেমার অবতার হিসেবে শাহরুখের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ভারতের রাস্তায় দেব-দেবীর পোষ্টারের পাশাপাশি তার পোষ্টারও বিক্রি হয়। তার নামে মন্দির হয়েছে। তার সাথে কোন অনুষ্ঠানে কেউ নাচ বা গান করার সুযোগ পেলে মানুষটির পরিচয়ই বদলে যায়। ভারতীয় এবং অ-ভারতীয় হিন্দি সিনেমার ফ্যানদের কাছে শাহরুখ খানের আবেদন টম ক্রুজ ও ব্র্যাড পিটের মিলিত আবেদনের থেকেও বেশী। সম্প্রতি শাহরুখের দূর্গে ফাটল ধরলেও যে শক্তিতে আর তেজে দীর্ঘদিন ধরে সে বলিউডে রাজত্ব করে চলেছে তা নিকট অতীতে বা আসছে সময়ে আর কেউ পারবে বলে অন্তত চলচ্চিত্র বোদ্ধারা বিশ্বাস করে না। মুম্বাইয়ের পানের রসে লাল হওয়া স্টুডিওর দেয়ালগুলোতে হেলান দিয়ে গল্প করা মানুষদের কাছে দিল্লীর মধ্যবিত্ত এক মুসলমান পরিবারের এতিম সন্তানের শূন্য থেকে বলিউডের বাদশা হবার কাহিনী এখন এক কিংবদন্তী। শাহরুখের ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো সংগ্রহ করার জন্য ভক্তদের মাঝে কাড়াকাড়ি চলে। মুম্বাইয়ে শাহরুখের বাংলো বাড়িটি পর্যটকদের এক জনপ্রিয় আকর্ষন। রবিবার বিকেলে অনেকেই শাহরুখের বাড়ির বাইরে ভিড় করে তাকে এক নজর দেখার আশায়। কখনও কখনও বাড়িতে থাকলে শাহরুখ বারান্দায় এসে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়। ভক্তরা এতেই মহাখুশি।
শাহরুখের জীবন কেবলই একজন সাধারন মানুষের সাফল্যের কাহিনী নয়। হিন্দু প্রধান দেশে শাহরুখ একজন মুসলমান সুপার স্টার। শাহরুখের জীবনে স্বাধীনতা উত্তর ভারতের নানা ভাঙ্গন আর সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায়। ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সাথেও শাহরুখের উত্থান প্রাসঙ্গিক। নব্বই দশকের শুরুতে ভারতীয় অর্থনীতি প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়। ১৯৯১ সালে বিশ্বব্যাংকের লোন পরিশোধে ব্যর্থ হয় ভারত। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে শুরু করলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অর্থনৈতিক খাতে বড় বড় সংস্কার করতে বাধ্য হয়। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার কেন্দ্রীয় অর্থনীতিকে বিকেন্দ্রীকরণ ও বেসরকারীকরন করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানীগুলো ভারতে ঢোকার অনুমতি পায়। অন্যান্য খাতের মত পরিবর্তন আসে গনমাধ্যমেও। সে বছরই সিএনএন, স্টার টিভি, এমটিভি ভারতীয়দের শোবার ঘরে প্রবেশ করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল স্থবির। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সমতা ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর পরিকল্পনায় সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের সম্বন্বয় ছিল যাতে ভারত একই সাথে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করার পাশাপাশি আত্মনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে উঠে। কিন্তু তার এ দর্শনের দরুন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দৌরত্ম্য খুব বেড়ে যায়। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠে লাইসেন্স বিক্রির প্রতিষ্ঠান। ঘুষ আর উপর মহলের পরিচয় ছাড়া কোন কাজ উদ্ধার করা ছিল অসম্ভব। অতি রক্ষনশীল ব্যবস্থার দরুন ভারতের বাজার ভরে উঠে নিম্মমানের দেশীয় পন্যে। বিদেশী পন্যের সাথে প্রতিযোগিতা না থাকায় পন্যের মান ভাল করার কোন চেষ্টা করা হতো না। পন্য উৎপাদনে সরকারী পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত ধাঁচের পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার আদলে তৈরী করা। ফলে কারখানা গুলোও সেই পরিমান পন্যই উৎপাদন করত যা পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে খাপ খেত। পরিকল্পনার বেশী বা কম পন্য উৎপাদন ছিল অপরাধ।
নেহেরুর সমতা ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সবার ভেতর যে মানসিকতার প্রয়োজন ছিল তা ভারতের সব অংশে একই রকম ছিল না। তার দেখা সমতা ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন হয়ত একক জাতির কোন দেশে সম্ভব। ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গিতে রয়েছে ব্যাপক মত-পার্থক্য। তাই হয়ত ভারতের ক্রমবর্ধমান শহুরে মধ্যবিত্তদের কাছে আমেরিকান বা ইউরোপীয় পন্য ব্যবহার হয়ে দাঁড়িয়েছিল আভিজাত্যের প্রতীক। মার্কিন মুল্লুকের বড় বড় শপিং মল ভারতের মধ্যবিত্তদের জন্য ছিল স্বপ্ন ও অগ্রগতির মাপকাঠি।
নব্বইয়ের অর্থনৈতিক উদারীকরন ভারতের শহুরে এলাকাগুলোকে বদলে দিল। লেভিস জিনসের মত নানা ব্র্যান্ডের বিদেশী পন্য গলির দোকানেই সহজলভ্য হয়ে উঠে। যে টেলিভিশন ছিল দুটো সরকারী চ্যানেলে সরকারী কাজের ফিরিস্তি প্রকাশের জায়গা, তা হঠাৎ করেই বিনোদনের এক মহা জগৎ এ পরিনত হল। ক্যাবল টিভি এসে গেল সাধারনের হাতের নাগালে। নেতাদের বক্তব্যগুলো রিমোট টিপে সরিয়ে দিয়ে দর্শকরা দেখতে থাকে ভিন্ন চ্যানেলে প্রচার হওয়া বেওয়াচ কিংবা বোল্ড এন্ড বিউটিফুলের মত অনুষ্ঠানগুলো। নেশা ধরানো বিনোদন আর পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ ভারতীয় মধ্যবিত্তদের জীবন বোধকেই পাল্টে দিতে শুরু করে।
নব্বই এর দশকে ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে দাঁড়াল বছরে গড়ে ৭ শতাংশেরও বেশী। এর সাথে তাল মিলিয়ে মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতা দিন দিন বাড়তে শুরু করে। এই মধ্যবিত্তের সংখ্যা নেহাতই ফেলনা ছিল না। অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের ভোগের আকাঙ্খাও বাড়তে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে টানা পোড়ন দেখা দিল ভারতীয় সমাজে। ঐতিহ্যগত ধ্যান ধারনা আর মূল্যবোধের সাথে সংঘর্ষ শুরু করে ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের ভিন্ন ভিন্ন মানুষরা। মূল্যবোধ রক্ষার চেয়ে ভোগের আনন্দ বড় হয়ে উঠায় মধ্যবিত্ত সমাজে দেখা দেয় পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কঘটিত নানা সমস্যা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি। কাজের চাপ, অবসাদ, ভোগের অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বিবাহ বিচ্ছেদ - যা এতদিন কেবল পশ্চিমা সভ্যতার একার সমস্যা ছিল তা ভারতীয় সমাজে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। পরিবর্তিত হতে থাকে পরিবারিক মূল্যবোধ, নারীর ভূমিকা, নারী-পুরুষ সম্পর্ক। পরিবর্তনগুলো ভাল না খারাপ হয়েছে তার ব্যাখা করার জায়গা এটি নয়। কিন্তু পরিবর্তনগুলো যে হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আর এই পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজে উগ্রবাদিতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। ধর্মান্ধ এবং ধর্মহীনতার উভয় দিকে উগ্রতা বৃদ্ধি পায়।
১৯৯২ এর ডিসেম্বরে হিন্দু মৌলবাদীরা উত্তর ভারতের বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে। যে জায়গায় মসজিদটি ছিল সে জায়গার ঐতিহাসিক ব্যাখা নিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছিল। বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ভারতের সবচেয়ে কসমোপলিটন শহর মুম্বাইও তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র লুকিয়ে রাখতে পারেনি। দু’বারের দাঙ্গায় পুরো শহরটা ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়। সরকার নিযুক্ত শ্রীকৃষ্ণ কমিশন এর রিপোর্ট অনুসারে দাঙ্গায় ৯০০ মানুষ নিহত এবং ২০৩৬ জন আহত হন। ৫০০০০ এর অধিক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। বিশ্বায়ন ভারতীয় সমাজের অনেক জায়গায় চাকচিক্য আনতে পারলেও ভারতীয় সমাজের ভেতর বয়ে চলা ধর্মীয় বিদ্বেষ, দারিদ্র্যতা, দূনীর্তিকে দূর করতে পারে নাই। বরং এরা যেন সুযোগ পেলেই আরও জোর কদমে বেরিয়ে আসে। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক হিসেবে গর্ব করা ভারতীয়রা এখন প্রায়ই একটা প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। একজন আর্দশ ভারতীয় কাকে বলে?
শাহরুখ খানের সিনেমাগুলো এ প্রশ্নের একটা উত্তর যেন ভারতীয়দের দেবার চেষ্টা করে। শাহরুখ তার সিনেমা চরিত্রগুলো বিশেষ করে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে (১৯৯৫), দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭), কুচ কুচ হোতা হ্যায় (১৯৯৮), কাভি খুশি কাভি গাম (২০০১), কাল হো না হো (২০০৩) দিয়ে ভারতের নতুন প্রজন্মের কাছে ভারতীয় পরিচয়ের এক নতুন সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছে। এ সংজ্ঞায় একজন ভারতীয় পূর্ব আর পশ্চিমের এক মিশ্রন যিনি পশ্চিমের কাছ থেকে গ্রহন করছেন আধুনিকতা আর অন্তরে লালন করছেন ভারতীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। একজন ভারতীয়কে যে কোন একটি বেছে নেবার প্রয়োজন নেই। যা প্রয়োজন তা হল দুটোর পরিমিত সংমিশ্রন। তাই দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে সিনেমায় শাহরুখের চরিত্র রাজ একজন লন্ডনে জন্ম নেওয়া ভারতীয় যে হার্লে-ডেভিডসনের জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে বিয়ার খেতে ভালবাসে। লন্ডনের বাইরের পৃথিবী সে চেনে না। কিন্তু ইউরোপে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের এ ভারতীয় ছেলেটিই ভারতীয় নারীর সম্মান রক্ষার দর্শন মেনে চলে। সিনেমার গল্পে মাতাল হওয়া হিরোইনকে দূর্বল মূহুর্তে পেয়েও কোন যৌন সম্পর্ক বা অশালীন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকে রাজ। পশ্চিমের কাঠামোকে গ্রহন করার সময় ভারতীয়রা যেন তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও ধ্যান-ধারনাকে বিসর্জন না দেয় - তাই যেন অভিনয়ের মাধ্যমে শাহরুখ প্রচার করে বেড়ায়। শাহরুখ নতুন সহস্রাব্দের সেই আইকন যে নতুন প্রজন্মকে বিশ্বায়নের সাথে স্থানীয় মূল্যবোধকে সম্বন্বয় করে মেনে চলার আহবান জানায়।
শাহরুখ ভারতীয় আর্দশের পাশাপাশি নতুন ভোগবাদী ভারতীয় সমাজের মুখপাত্র হিসেবেও নিজেকে উপস্থাপন করেছে। শাহরুখ খানই প্রথম কোন বলিউড সুপার স্টার যে পন্য বিক্রির বিজ্ঞাপনে নিয়মিত অংশ নিয়েছে। পেপসি থেকে শুরু করে ঘড়ি - এমন কোন পন্য নেই যার বিজ্ঞাপন বা প্রচারনায় শাহরুখ উপস্থিত হয়নি। স্যাটেলাইট চ্যানেল নির্ভর টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে ভারতীয়দের শোবার ঘরে প্রতিনিয়ত শাহরুখের উপস্থিতি শাহরুখ খানকে নিছক ফিল্ম সুপার স্টার থেকে একটা স্বতন্ত্র ব্র্যান্ডে রুপান্তর ঘটিয়েছে।
১৯৫৫ এ মুক্তি পাওয়া শ্রী ৪২০ মুভির জনপ্রিয় একটি গানের কথা ছিল -
আমার জুতো জাপানী
পরনের প্যান্ট বিলেতী
মাথার টুপিটা রাশান
তবে হৃদয়টা ইন্ডিয়ান
১৯৫৫ সালের ভারতে মামুলী বিদেশী জিনিষপত্রের ব্যবহারও ছিল এক আভিজাত্য। এক স্বপ্ন। এখনকার ভারতীয়রা ভাবতেই পারে না এগুলো কখনও আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। মারলিন মনরোর মতই শাহরুখও তার সময়কালের প্রতীক। তার সময়কালের মানুষরা তার মত করেই বেড়ে উঠার স্বপ্ন দেখেছে। শাহরুখের সম সাময়িক ভারতীয়দের স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্খা গুলোর সংমিশ্রনের প্রতীক শাহরুখ খান।
(শাহরুখ খান এন্ড দ্যা সিডাকটিভ ওয়াল্ড অব ইন্ডিয়ান সিনেমা থেকে অনুদিত।)