আলমের এই ছোট শালা জাকির, একটু বেয়াদপ আছে। নাকি প্রেম করলে লোকজন বেয়াদপ হয়ে যায়? জিজ্ঞেস করলাম খাওয়ার কি আছে। বলে, বেনসন! বললাম আর কিছু নেই? শালার ব্যাটা কেয়ারই করল না। ফোনে কার সাথে জানি খাজাইরা আলাপ করতে ছিল। সেইটা করতেই থাকলো। ‘... এই তুমি ফোন ধর না কেন? রাগ করেছ? বললাম তো আমি আসলে সেদিন...” শালার তো দেখি বিরাট বাড় বাড়ছে। ব্যটা মুদির দোকানদার। তার উপর আস্ত ঢাকাইলা। কিন্তু প্রেম করার সময় গলা দিয়ে শান্তিনিকেতনী ভাষা গল গল করে বের হচ্ছে। অবশ্য মুদির দোকানী হয়েছে বলে যে শান্তি নিকেতনী ভাষায় প্রেম করতে পারবে না, তা কোথাও লেখা নেই। তাইলে এই কথা ক্যান মাথায় আসলো? বুর্জোয়া চিন্তাভাবনা মাথায় ঢুকলো নাকি! কিন্তু ‘বুর্জোয়া’ মানেই তো জানিনা ঠিক মত। এসব ভাবছি, এমন সময় জাকিরের লাইন গেল কেটে। “ধুশ শালা ট্যাকা শ্যাষ”, বলে বিরক্তি ভরে তাকালো আমার দিকে। আমি আবারো জিজ্ঞেস করলাম আর কিছু নেই? বলে ফ্লেক্সি আছে। ফ্লেক্সি করতে পারেন। মনে মনে বলি, ‘শালা শুয়োর! ফ্লেক্সি কি খাওয়ার জিনিস? ফ্লেক্সি করলে খিদা যাইবো? ধরে এমন চাপকানি লাগামুনা!!’ অবশ্য দোকানে যে কিছু নেই সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ফ্রীজের মধ্যে কিছু আছে কিনা সেটা জানতেই এত কথা। নিরাশ হয়ে বলি, দে বিশটাকা ফ্লেক্সি করেই দে। মানিব্যাগ থেকে বিশটাকা বের করতে করতে খাটের তলায় টিনের বাক্সে আর কত বাকি থাকলো মনে মনে তার হিসেব করি। খিদের জ্বালায় হাত কাঁপা শুরু হয়েছে ততোক্ষনে।
আমার এই এক দোষ। খিদে মোটেই সহ্য হয়না। হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়। সেবার ইংরেজী ক্লাসে স্বরোচিত ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ প্যারাগ্রাফ পড়ে শোনানোর সময় হাতপা এমন কাঁপা কাঁপি শুরু হল, সাথে শুরু হল পোলাপাইনের হাসা হাসি। ছেলেরা ভাবলো, ‘হা হা, গেরামের পুলা’। সহ পাঠিনীরা ভাবল তাদের রূপের হল্কার সামনে দাঁড়িয়ে আমার এই অবস্থা। স্যার বলল, কি খবর ইয়াং ম্যান? তোমার হাত পা তো দেখি বস মানতেই চাইছেনা। প্যারাগ্রাফ পড়া আমার ততক্ষনে লাটে উঠেছে। মনে মনে ভাবি কি উত্তর দেব। ডেইলি সকালে যে না খেয়ে ভার্সিটিতে আসি সেইটা? নাকি নার্ভাস হয়ে মুতে দেওয়ার জোগাড় হয়েছে সেইটা? কোনটা কম লজ্জা? মুখ ফসকে বলে বসি, “খিদে লাগিছে”। সেই গ্রাম্য অসংস্কৃত ভাষা শুনে আরেক দফা হাসির রোল বয়ে যায়। স্যার বলেন, ‘ইয়ং ম্যান, প্রতিদিন সকালে এক গ্লাস দুধ, কয়েক পিস পাউরুটি আর একটা ডিমপোচ খেয়ে আসবা। চলো, ক্লাস শেষে আমরা একসাথে নাস্তা করব’। স্যার স্নেহ করল নাকি করুণা করল ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। কাপা পায়ে নিজের বেঞ্চে গিয়ে বসি। তখনো হলে উঠিনি। সাবলেট থাকি কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারে। সকালের নাস্তা- একচামচ চিনি আর কয়েক গ্লাস পানি...। ঢাকা, তখনো নতুন শহর।
প্রতিবার চরম খিদে লেগে হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হলে এসব কথা মনে পড়ে। যেমন পড়ছে এখন। তার মধ্যে আলমের দোকানটাও ফাঁকা। অবশ্য এই ফক ফকা দশার জন্য আলমকে দোষ দেওয়া যাবে না। কার্ফিউ নাকি চুয়াল্লিশ ধারা টাইপের কিছু একটা জারি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। তাই দোকানের সাপ্লাই বন্ধ। দুপুরে ডাইনিংয়ের খাওয়াটাও হয়নি ঠিকমত। আলু ভর্তা ডাল টাইপের কিছু ছিলো। টেবিলে আমার সামনে বসে ছিল সবুজ। রুগ্ন কৃশকায় একটা ছেলে। দেখে জহির রায়হানের কথা মনে পড়ে।... একবার পুরোনো বাংলা সিনেমা দেখছিলাম বাসায়। “রাজবন্দী দের মুক্তি চাই...” টাইপের একটা স্লোগান হচ্ছে। বাবা বলল, ‘দেখ, জহির রায়হানের ফিগারটা দেখ। মিছিলের আর লোকগুলোকেও দেখ। কি বুঝলি? ম্যাল নিউট্রেশন, মাস ম্যাল নিউট্রেশন। আমাদের সময় আমরা বুঝতামই না যে পুষ্টিকর কিছু খাওয়া দরকার। ডাল, ভাত, আলু... মারো সপাসপ। এমনকি সামর্থ থাকলেও এর চেয়ে বেশি কিছু খেতো না কেউ’। সবুজ ছেলেটাও সপাসপ ডালভাত মারছে। দেখে মনে হচ্ছে না জানি কি মহোচ্ছব। এই ছেলেটাই গ্রামে থাকতে তার কিষাণ দেওয়ার কাহিনী বলেছিল একদিন। সে এক মজার গল্প... ধান কাটতে কাটতে কখন যে আইল পার হয়ে পাশের জমিতে চলে গেছে খেয়ালই নেই। পাশের জমির মালিক আবার মহাজন টাইপ। গুন্ডা লাইঠাল পোষে...
ডাইনিংয়ে যে পনের বিশজন খাচ্ছিল তাদের চেহারা সুরত দেখে সেই সাদাকালো সিনেমার মিছিলের কথা মনে পড়ে গেল। আমার অবশ্য তখন তেমন একটা রুচি হচ্ছিল না। তার উপর দুয়েক মুঠ খাওয়ার পরই মুখের মধ্যে একটা তেলাপোকার ঠ্যাং পেয়ে গেলাম। এমনিতে ঠ্যাং ঠুংএ আমার কিছু হয়না। আগে একদিন মাকড়শার ঠ্যাং শুদ্ধ সপাসপ মেরে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজকে কি যে হল? ‘ধুস শালা’ বলে উঠে গেলাম। অবশ্য তখনো মনে আশা ছিল বিকালের টিউশনি নিয়ে। পুরান ঢাকার টিউশনি। তার উপর স্টুডেন্টরা বনেদি পরিবার। স্টুডেন্টের রুমে একটা ছবির ফ্রেমে সাদাকালো ছবি টাঙানো। ছবিতে বঙ্গবন্ধুর সহ আরো কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। স্টুডেন্ট বলে, বঙ্গবন্ধুর পাশেই দাঁড়ানো যে লোকটা সে নাকি তার দাদা। দেশ স্বাধীনের সব প্লান প্রোগ্রাম নাকি তার এই পড়ার রুমে বসে বসেই করা! অবশ্য তার কথা বিশ্বাস যোগ্য। এবাড়ির গঠন গাঠনই আলাদা। ঢাকা শহরের এই একটাই মনে হয় বাড়ি যার উঠানে এখনো একটা কুয়া আছে। সেই কুয়ার পানি দিয়ে এখনো তারা কাপড় ধোঁয়। তবে আসল কথা হল বনেদি হবার কারণে এরা নাস্তাপানি দেয় ভাল। পুরাণ ঢাকার যাবতীয় ঐতিহ্যবাহী খানাপিনা তাই প্রায়ই নাস্তার প্লেটে চড়ে হাজির হয় আমার সামনে। যেদিন খুব বেশি খিদে লেগে যায়, সেদিন স্টুডেন্ট মনে হয় আমার চেয়ারা সুরত দেখে বুঝতে পারে। ‘স্যার, আমার আজকে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনিই খেয়ে ফেলেন’, বলে নিজের প্লেটটা আস্তে করে এগিয়ে দেয় আমার দিকে। আমি কিছুক্ষন ইতস্তত করি। তারপর একসময় ক্ষুধাই জয়ী হয়...
কিন্তু আজকের টিউশনিটাও মিস গেছে। ভার্সিটি একালায় টানটান উত্তেজনা। ধাওয়া ধাওয়ি আর ইট পাটকেল ছোড়া ছুড়ি হচ্ছে মাঝে মাঝেই। বাইরে বের হওয়া রিস্কি। ঘড়িতে বাজে রাত সাড়ে আটটা। আলমের দোকান থেকে নিজের রুমের দিকে ফিরতে থাকি। খিদে এমন জমেছে, আরেকটু পরে হয় খিদে মরে যাবে না হয় আমি। ডাইনিংএর সামনে দিয়ে যাচ্ছি এমন সময় হন্ত দন্ত হয়ে সামনে এসে পড়ে মুঞ্জুর, সাথে রাজু। মুঞ্জুর বলে, ‘এইতো তোরেই খুজতেছি। চল চল, এখনি বেরতে হবে’।... ‘কৈ যাবি বাইরে তো মারামারি’... ‘তোর রক্তের গ্রুপ ও পজিটিভ না? লাস্ট রক্ত দিছিস কবে?’... ‘এইতো মাস তিনেক হবে’... ‘তাহলেই হবে, চল রক্ত দেওয়া লাগবে’ ... ‘দোস্ত সকাল থেকে কিছু খাইনি চরম খিদে লাগছে। এর মধ্যে রক্ত দিলেতো পুরা মারা যাব’... ‘তাতে কি হইছে? বেশি করে পানি খা। পানি খাইলে খিদেও মরবে আবার সেই পানি যাবে তোর রক্তে মিশে। তখন রক্তও কম খরচ হবে’... ‘কিন্তু তাইলে এইটা দুধে পানি মেশানোর মত ভেজাল হল না!’... ‘আরে... রক্ত কখনো ভেজাল হয়না’
কি আর করা, ডাইনিং এর বেসিনে গিয়ে ঢক ঢক করে তিন গ্লাস পানি মেরে দিই। তারপর রওনা হই গ্রীন রোডের দিকে। রশীদ হলের এক গার্ডের স্ত্রীর পেটে টিউমার অপারেশন হবে আজ রাতেই। কিছুক্ষনের মধ্যেই তিন ব্যাগ রক্ত লাগবে। ভার্সিটির গ্যাঞ্জামের কারনে রক্ত যোগাড় করা যাচ্ছে না। আমরা তিন জন হলাম সেই লাইভ তিন ব্যাগ রক্ত। বাইরে মাঝে মাঝে দুয়েকটা টিয়ার সেল নিক্ষেপ হচ্ছে ঠুস ঠাস। রাজু বুদ্ধি করে একটা রুমাল ভিজিয়ে নিয়েছে। টিয়ার গ্যাস সামলাতে কাজে লাগবে।
রাস্তায় এদিক ওদিকে ইটপাটকেল আর ফাকা টিয়ার সেল পড়ে আছে। আমার খিদেটা মরে গেছে প্রায়। তবে তখনো হাত পা কাঁপছে। সেই সাথে কাঁপছে বুক। উত্তেজনায়। দাঙ্গা পুলিশ আর ছাত্রদের দুইপক্ষই তখন চুপচাপ। ময়দানে টান টান উত্তেজনা। আমাদের যেতে হবে, পলাশীর মোড়, নীলক্ষেত পেরিয়ে, কাটাবন হয়ে গ্রীন রোড। হাতে সময়ও কম। ছাত্রদের অংশ পিছনে রেখে আমরা যাচ্ছি নোম্যান্স ল্যান্ড হয়ে পুলিশ ব্যারিকেডের দিকে। হ্যান্ড মাইকে একজন অফিসার বলল হাত মাথার উপর তুলে আসতে। আমরা স্যারেন্ডার করার ভঙ্গিতে হেটে তাদের ব্যারিকেড পার হয়ে চলে গেলাম। অজানা কারণে পুলিশরা কেউ কিছু বলল না আমাদের।
একসময় পৌছে গেলাম ক্লিনিকে। হলের সেই গার্ড আর তার বৃদ্ধা মা উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। গার্ড বেচারার বয়স কম। নিজের খাকি ইউনিফর্ম পরে চলে এসেছে। উদ্বেগে তার ফর্সা মুখে কালো আর লালের ছায়া পড়েছে। বেচারাকে দেখে মায়া লাগছে। কতটাকাই বা আর বেতন পায়? এই এক অপারেশন করেই তো আর জীবনে সোজা হয়ে দাড়াতে পারবেনা। গরীব মানুষ ক্যান যে বিয়ে সাদি করে। এখন বোঝ ঠ্যালা। যাহ্, আবার যেই ‘বুর্জোয়া’ চিন্তা। গার্ডের মা ছোটখাট মহিলা। তার উপর বয়সের ভারে কেমন যেন কুজো হয়ে গেছে। আমরা তিনজন রক্ত দেব শুনে কষ্টে মষ্টে হেটে চলে আসে আমাদের দিকে। ছল ছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। তারপর কাঁপাকাঁপা একটা হাত উঠিয়েদেয় আমার মাথার দিকে। হয়তো আশির্বাদ করতে চায়, অথবা স্নেহ। তবে নাগাল পায়না। নিজের অতিরিক্ত উচ্চতা নিয়ে একটু লজ্জা পাই আমি। ওয়েটিং রুম ভর্তি লোকের সামনে সিনেমাটিক ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে এই অপরিচিত বৃদ্ধার স্নেহ নিতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগতে থাকে। বৃদ্ধা তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে আমার শার্টের হাতা ছুয়ে মায়াকাড়া কন্ঠে বলে ওঠে, ‘বাজান রে...’
আগেও রক্ত দিয়েছি অনেক বারই। মাঝে মাঝেই এ ধরণের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। একটু বিব্রত হই। এত সব মানুষের ভালবাসা আর দুয়া খুব একটা নাড়া দেয়না আজকাল। তবে বেখেয়ালে হৃদয়ের কোথাও হয়তো কিছু একটা পরিবর্তন করে দেয়...
ব্লাড স্ক্রিনিং এর জন্য আমরা এরপর ক্লিনিকের একটা এক্সটেনশনে যাই। এখানেও ওয়েটিং রুম। রুমে একটা টিভি। টিভিতে সি এস বি নিউজ। লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। ভার্সিটিতে তুমুল গোলমাল শুরু হয়েছে। দাঙ্গা পুলিশ এফ রহমান হলের প্রায় ঢুকে পড়েছে। ছাত্রদের চিৎকার, টিয়ারসেল ছোড়ার শব্দ, রাতের অন্ধকার, সোডিয়াম আলো সবকিছু মিলিয়ে এক নারকীয় দৃশ্য। লাইভ রিপোর্টার আবেগ ঘন কন্ঠে পরিস্থিতির বর্ণনা করছে। ওয়েটিং রুমের রি রি এসির বাতাসে সেসবের উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছেনা। সবাই কেমন যেন তামাশা দেখছে। রাজু আনুসাঙ্গিক কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত। জ্ঞানী মত একজন বলে উঠলো, ‘ভার্সিটির পোলাপাইন সব জংলী হয়ে গেছে। প্রপার শাসন দরকার। এইবার আর্মি গেছে না? পুরা টাইট করে ফেলবে’। দুয়েকজন মাথার নেড়ে সায় দিল, ঠিক্ ঠিক্। শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, বললাম, ‘ভাই আমরা ছাত্র। একটু আগে ভার্সিটি এলাকা থেকেই আসলাম। এখানে রক্ত দেওয়া হয়ে গেলে আবারো ফিরে যাব ঐখানেই’ হাত দুলে দেখাই টিভি স্ক্রিনের দিকে। সেখানে একটা ভয়াল দর্শন যন্ত্র দেখাচ্ছে। ট্যাঙ্কের মত। টিয়ার সেল ছোড়ার রিয়ট ভ্যান। মুঞ্জুর ঝাড়ি দিল, ‘যা জানেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না’। জ্ঞানী লোকটা মুখ কালো করে চুপ হয়ে গেল। ঠিকঠিক ওয়ালারা আবার মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক্ ঠিক্’।
ঘড়িতে সময় রাত দশটার একটু বেশি। হলের দিকে ফিরছি। তুমুল গোলমাল চলছে। কাটাবন থেকে পুলিশ ব্যারিকেডের দিকে যেতে থাকি। এই দিকটা আসলে ব্যারিকেডের পিছন দিক। আমাদের আসতে দেখে হ্যান্ড মাইকে একজন কমান্ড করে, ‘হল্ট’। তারপর আবার আগের মত মাথার উপর হাত তুলে এগিয়ে যাই তাদের দিকে। মারামারির আসল ফ্রন্ট তখন আর বেশি ভিতরের দিকে চলে গেছে। এদিকে আছে শুধু ব্যাকআপ পুলিশরা। একজন তার অস্ত্র তাক করল আমাদের দিকে। আর কয়েকজন ইতস্তত করতে থাকে আমাদের মাইর দিবে কিনা! একজন সিনিয়র অফিসার গোছের কেউ বলে, ‘যেতে দাও’ এর পর আমরা হাত উপরে রেখেই এগিয়ে যাই। আমাদের আশে পাশেও ইট পাটকেল এসে পড়ছে মাঝে মাঝেই। কয়েকজন দাঙ্গা পুলিশ আবার সেগুলো তুলে ছুড়ে মারছে ছাত্রদের দিকে। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্সের পাশে একটা স্ট্রেচার। স্ট্রেচারে কম বয়সী একটা ছেলে শুয়ে আছে। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে। কপালের কাছে কেটে গেছে ভয়ঙ্কর ভাবে। স্ট্রেচারের মাথার দিকটা প্রায় ভেসে গেছে রক্তে। ছেলেটার গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম। পুলিশরা এত বাচ্চা হয়!! এই ছেলের বয়স তো আমাদের চেয়ে কম মনে হচ্ছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একে তো মনে হয় রক্ত দেওয়া লাগবে। রক্তের গ্রুপ কি? এসময় আরেকজন দৌড়ে আসে। তারও মুখের কাছে কেটে গেছে ভাল মত। একটা ব্যান্ডেজ টাইপের কিছু চেপে ধরে আছে। এরও বয়স কম! ওদিকে ছেলেদের হল থেকে চিৎকার অথবা আর্তচিৎকার শোনা যাচ্ছে। রিয়ট ভ্যান হলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রায়। সামনে আরেক পুলিশ স্ট্রেচারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা আদিবাসী মনে হয়। আমাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ‘আপনারাতো শিক্ষিত মানুষ, এমন করেন কেন?’ তার চোখের দিশেহারা দৃষ্টি মাথার ভিতর গেথে যায়। আমি ভাবি, কি করলাম? করছে তো এরাই! তার পর ভাবি, আসলেই কি? অজ্ঞান ছেলেটার মাথার রক্ত থামছে না। স্ট্রেচার অ্যাম্বুলেন্সে উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ তার চেহারার সাথে হলের গার্ডের চেহারাটা মিলে যেতে থাকে। আরেকটা দরিদ্র বৃদ্ধা বলে ওঠে, ‘বাজান রে...’
একটু টলে উঠে রাজুর কাধে হাত দেই। টুপ টাপ দুয়েকটা ইট এসে পড়ে আসে পাশে। বিরতিহীন ভাবে টিয়ারসেলের কামান চলতেই থাকে। আমরা ব্যারিকেড পার হই। মাথার উপর দিয়ে অনেক কিছুই উড়ে যেতে থাকে সাই সাই করে। কখনো ইট কখনো টিয়ার সেল। সেই বৃদ্ধার দুয়াতেই কিনা কোন কিছুই আঘাত করে না গায়ে। শুধু চোখ পুড়তে থাকে। পুড়তে থাকে ফুসফুস। হৃদয় ও কি পোড়ে সেই সাথে?... আমরা ঢুকে যাই ছাত্র এলাকায়। এখানে আহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। শুধু পার্থক্য হল এখানে কোন অ্যাম্বুলেন্স নেই। আহতরা অন্যদের কাঁধে ভর করে ময়দান ত্যাগ করছে। কয়েকজনের ক্ষত মারাত্বক। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একজনকে বললাম, এদেরকে হাসপাতালে নিতে হবে তো। কেউ একজন বলল, না হাসপাতালের ভর্তি করা যাবেনা। তাহলে কেস খাবে। শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই ফিরে আসতে হবে। এপাশ থেকে রাতের সোডিয়াম আলোয় দাঙ্গা পুলিশদের বিভৎস কোন জন্তুর মত দেচ্ছে। ঠুস ঠাস আর সমস্বরে হৈ চৈ চলছেই। হঠাৎ পাশের একটা ছেলের মাথায় একটা টিয়ার সেল এসে লাগে। উবুড় হয়ে পড়ে যায় সে। কেউ একজন সেই ধোয়াউদ্গিরণী টিয়ার সেলটা তুলে ছুড়ে মারে দূরে। ঝাজালো ধোঁয়ায় নিঃস্বাস নেওয়াই দায় হয়ে পড়েছে ততক্ষনে। তাকানো যাচ্ছেনা। চোখে পানি জমায়, নাকি ভুতুড়ে সোডিয়াম আলোর কারণে ঠিক জানিনা। ছেলেটার জামা সেই হলগার্ডের খাকি ইউনিফর্মমের মত লাগে কিছুটা। মাথা কেটে রক্ত পড়ছে প্রচুর। আচ্ছা এরও কি রক্ত লাগবে? রক্তের গ্রুপ কি?
প্রচন্ড ক্ষুধা, রক্তদানের ক্লান্তি, নাকি বিষাক্ত গ্যাসে নিঃশ্বাস নেবার কারণে জানিনা। মাথার মধ্যে কি যেন একটা হয়ে যায়। সেই উদ্বিগ্ন কমবয়সী গার্ড... সদ্যকৈশরউত্তির্ণ আহত পুলিশ... সাদা জামার কৃশকায় ছেলে... হলের ম্যাল নিউট্রেশনে ভোগা ছাত্রদের চিৎকার... টিয়ার সেল, সেই সাদাকালো সিনেমার মিছিলের হাজার রুগ্ন হাতপা... রাজবন্দীদের মুক্তি...রক্ত...সিরিঞ্জ...পানি...রক্ত কখনো ভেজাল হয়না... সব কিছু ছাপিয়ে শত শত মা হাত বাড়িয়ে আর্ত বলে ওঠে, ‘বাজান রে...’
সেবার মুঞ্জুর আর রাজু হলে নিয়ে গেছিল আমাকে...
পরিশিষ্ট
পাশ করে বের হয়ে গেছি আমরা সবাই।
মুঞ্জুর আর রাজুঃ ছাত্রাবস্থায় ছিল স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন বাঁধনের একনিষ্ট কর্মী, এখন একটা বড় ফোন কম্পানির ইঞ্জিনিয়ার।
সবুজ(ছদ্দনাম)ঃ ছেলেটা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে উচ্চ শিক্ষার্থে।
আমিঃ এইতো আছি আশে পাশেই। ভার্সিটি জীবনের কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম আপনাদের সাথে। অল্পকিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের কারণে এই অকারণ রক্তপাত, দুপাশথেকেই দেখার দুর্ভাগ্য হয়েচ্ছিল আমার। অবশ্য স্মৃতিবিভ্রাট অনেককিছুই ভুলিয়ে দিয়েছে এতদিনে...