ইফতেখারের এই এক সমস্যা। কোন কিছুই ঠিক মত করতে পারেনা। আর পারলেও ঠিক কনফিডেন্স পায়না। বিশেষ করে যুথীর সামনে। এই যেমন আজ। বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছে। কলিংবেল চাপবে নাকি ফিরে যাবে, সেই দ্বিধা-দ্বন্দে। নিজের বাসায় ঢোকা নিয়ে এত বিব্রত হবার আসলে তেমন কিছু নেই। কিন্তু সমস্যা করেছে হাতের প্যাকেট টা। প্যাকেটের মধ্যে যে জিনিস। এটা দেখলে যুথীর তুলকালাম বাধানোর সমুহ সম্ভবনা।
ঘটনার শুরুটা করেছে হাসান। মহা বান্দর পোলা! ওর কাছে আইডিয়া চাইতে যাওয়াই ভুল হয়ে গেছে। আগের দুইবার আনিভার্সারী ডেট ভুলে যুথীর কাছে চরম প্যাদানী ধাতানী খেয়েছে। তাই এবার অনেক আগে থেকেই ফেসবুক, অর্কুট, টুইটার বিভিন্ন যায়গায় হাজার ধরনের আলার্ম সেট করে রেখেছিল। দুদিন আগে থেকেই সেই সব আলার্ট ওয়ার্নিং পেয়ে তার টনক নড়ে গেছে। কিন্তু এই দিনটাকে কিভাবে স্বরণীয় করে রাখা যায়? সেই বুদ্ধিতো আর কিছুতেই মাথায় আসেনা! অগত্যা সরনাপন্ন হয়েছে হাসানের। পোলাডা এত্ত ফাউল! ধরে নিয়ে গেল তাদের সন্ধ্যাকালীন আড্ডায়। বলে আয় তোর ব্যচেলর হুড হারানোর তৃতীয় শোক দিবস আগে পালন করে নিই। তারপর আর কি! কিছুক্ষন ধোয়া টানা আর পানীয় গ্রহন। ইফতেখার এইসব ছেড়ে দিয়েছে সেই তিন বছর হল। বলল এসব খাবেনা। সবাই রীতিমত ‘রে রে’ করে উঠলো। সিহাব তো অতি পুলকে একপেগ ড্রাই জীন ঢেলেইদিল ইফতেখারের গায়ে! ইফতেখার শেষে রেগেমেগে হাসান কে বলল, ‘তোরে আমি কি বললাম আর তুই শালা আমারে কোথায় নিয়ে আসলি। ধুরো, থাক তোরা! আমি গেলাম’। সিহাব বলে উঠল, ‘কোথায় নিয়ে আসলি, মানে? শালা বিয়ে করছস আর আর পুরা বঊ এর আচলের তলায় গিয়া ঢুকসস। আবাল কোথাকার’। একজন বলল ‘আচল না ব্লাউজ’!!
অবস্থা বেগতিক দেখে হাসান টেনে বাইরে নিয়ে আসলো ইফতি কে। ‘ওদের কথায় কিছু মনে করিস না দোস্ত। পেটে মাল পড়ছে তো। তাই একটু ইয়ে হয়ে আছে’। ইফতেখার একটু শান্ত হল যেন। হাসান বলতে থাকলো, ‘তোর আনিভার্সারির জন্য জব্বর এক প্লান করছি। এইযে এইটা নিয়ে যা’ বলেই বাশপাতা কাগজের একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিল। ইফতি হাতে নিয়েই বুঝলো ভিতরে বোতল! বলল, ‘তোর মাথা খারাপ হইসে!! এই জিনিস নিয়ে বাসায় যামু কেমনে বউতো পুরা কাইট্টা ফালাইবো আমারে!’
তারপর হাসান আস্বস্ত করল যে কিছুই হবেনা। বরং বিয়ের আগে তাদের জীবনে কত মজা ছিল তার একটু ছোয়া তার বৌকেও দিয়ে দেওয়া যাবে। একটু নাকি ভিন্নতা আসবে। তার পর বিরক্তির সাথে বলল, ‘বিয়ে করা পাবলিকরা মনে হয় কাবিন নামায় সাইন করার সময় বোরিং নামায় ও সাইন করে ফেলে!! নাইলে বিয়ে করলে একটু ইয়ে টিয়েও করা যাবেনা এমন কথা মাথায় আসে কেমনে? এই প্যাকেট নিয়ে গেলে কাইট্টা ফালানোর কোন সম্ভবনা নাই। বরং জমবে আরো!!’
এইসব কুমন্ত্রনা শুনেই প্যাকেট হাতে দরজার সামনে এসে হাজির আমাদের ইফতেখার। এখন তো মনে হচ্চে এইসব হাবিজাবি এর চেয়ে একতোড়া ফুল নিয়ে আসলে হাজার গুন ভাল হত। ফিরে গিয়ে ফুল নিয়ে আসবে কিনা বুঝতে পারছেনা। তখন আবার হাসান এর কথা মনে হল। বেচারা মাইন্ড করবে। আর আসুক নাহয় একটু ভিন্নতা। ফি আমানিল্লা। বলে কলিং বেল চেপে দিল সে।
সারাদিন কয়েকবার কথা হলেও আনিভার্সারির প্রসঙ্গই তুলেনি যুথী। দেখতে চায় এবার ইফতি কি করে। কি আর করবে। নিশ্চই নতুন কোন ভেড়ামী। তাও কিছু করলেই মাফ। আর যদি মনেই না থাকে। তাইলে খবর আছে। ব্যাগ প্যাক করাই আছে। এখনি মা কে ফোন করবে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য। কলিং বেলের শব্দ শুনে দরজার দিকে এগোয় সে।
ইফতেখারের হাজার রকম বোকামির সাথে যুথী পরিচিত বললে ভুল হবে। কারন নিত্য নতুন বোকামি করায় ইফতির কোন জুড়ি নেই। তবে প্রতিবারই তার মুখে এক ধরনের চোর চোর ভাব চলে আসে। এই ‘ভাব’ ভাল ভাবেই চিনে যুথী। তাই দরজার ওপাশে একটা চোর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে একটু খুশিই হল সে। আটলিস্ট ভুলে তো যায়নি। কিন্তু পরমুহুর্তেই চোরটা কি চুরি করেছে সেটা জানায় ব্যস্ত হয়ে উঠল। ইফতি নিজের দুই হাত পিছনে রেখে দিয়েছে। কিছু একটা লুকাচ্ছে যেন। ফুল নাকি? ফুল হলে দারুন হয়! কিন্তু তারপরও ইফতিকে ঝাড়ি দিতে হবে। ফুলে যুথীর আলার্জি... এইসব হাবিজাবি বলে। নাইলে চোরটার ভাব বেড়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা কপট রাগমিশ্রিত হাসি নিয়ে ইফতিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ব্যাপার হাতে কি?’ ইফতির তখন অক্কা পাবার দশা। আমতা আমতা ‘ইয়ে... মানে..’ করতে করতে প্যাকেট টা দিল যুথীর হাতে! ফুল না দেখে প্রথমে একটা ধাক্কা খেল যুথী। তার পর হাতে নিয়ে যখন বুঝলো ভিতরে বোতল আর তার সাথে ইফতির গায়ে হোমিওপ্যাথি মার্কা গন্ধ। এইসব দুইএ দুইএ চার করে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো সে।
‘কি!! তুমি বারে গেছিলা?’ বলে কাছে এগিয়ে আসলো সে। কিছু একটা শুকলো যেন! তার পর বলল, ‘গিলেও তো এসেছো পেট ভরে। দূর হঊ! বের হউ এক্ষনি। কোন মাতাল টাতাল এর ঠাই নাই আমার বাসায়’। ইফতেখার কাচুমাচু হয়ে যায়। যুথী ঝাড়তেই থাকে, ‘শুধু গিলেছ নাকি আরো কিছু করে এসেছ। ওসব যায়গায় তো মেয়ে মানুষও নাকি থাকে। তাদের নাচ টাচ দেখে আসনি? একটু ধরে দেখনি? শুয়েও তো এসেছ মনে হয়। তোমরা তো শুকরের জাত! এইসব না করলে এই জিনিস হজম হবে কি করে? আর কত্ত বড় সাহস বাসায় ও নিয়ে এসেছ...’ ইফতেখারের হাতে দিয়ে দেয় সে প্যাকেট টা। মুখ চলতেই থাকে, ‘...নাচ দেখে কি খুব ভাল লেগে গেছে? আমি কি এখন এইটা খেয়ে একটু নেচে দেখাবো?...’ কথার ব্রাশ ফায়ার চলতেই থাকে। এদিকে জাত পাত তুলে গালি খেয়ে ইফতেখারেরও মেজাজ খারাপ হয়েছে। সে তো নির্দোশ! হাসান শালাই না...! সে আমতা আমতা করে বলল, ‘মানে আজ একটা বিশেষদিন তো তাই...’
ইফতির কথা শুনে একটু থামলো যুথী। ‘বিশেষ দিন বলে তুমি মাল টেনে বোতল হাতে বাসায় চলে আসবা!!’ যদিও দিনটা ইফতির মনে আছে দেখে সে একটু খুশি। ইফতি আমতা আমতা করে, ‘না মানে ভাবলাম...’। যুথী ভাবে নিশ্চই আবার হাসানের কাছ থেকে কোন আইডিয়া নিয়ে এসেছে। বলে, ‘তুমি ভাবলা, নাকি হাসান ভাবলো?’ ইফতি পাংশু মুখে বলল, ‘ইয়ে... হাসান...’ এর পর আর কোণ কথাই শুনলো না যুথী। বলল, ‘শোন এইসব খেয়ে আমাদের বাবু কে ছোবেনা বললাম। বুঝলা? কালকেও ছোবে না’... ‘কিন্তু আমিতো খাইনি’
আর কোন কথাই শোনে না যুথী। গজ গজ করতে করতে বোতল নিয়ে ফেলে রান্না ঘরের ময়লার বাক্সের কাছে। টেবিলে খাবার রাখাই ছিল। ইফতি খেয়ে দেয়ে একসময় চলে আসে তাদের বিছানায়। সেখানে একপাশে কোলবালিশ দিয়ে ইফতির জন্য যায়গা আলাদা করে অন্যপাশে শুয়ে আছে যুথী আর তাদের আট মাসের ছেলেটা। ইফতি যাতে বাবুকে ছুয়ে না ফেলে তার জন্য কোলবালিশ। যুথী একবার ভেবেছিল বাবুকে অন্যপাশে দিয়ে নিজে আগলে রাখবে। যাতে মাতালটা ছুয়ে না ফেলে। কিন্তু বাবু যদি পড়ে যায়? সেই ভয়ে আবার মাঝখানে শুইয়েছে। এখন অন্য দিকে মুখ করে আছে নিজে। বাবু ঘুমায়। ইফতেখার একটু উশখুশ করতে করতে এক সময় শুয়ে পড়ে তার নিজের যায়গায়। তার পরও তার উশখুশানি চলতেই থাকে।
অনেকক্ষন ঝিম মেরে থাকার পর, হাত বাড়িয়ে যুথীর পিঠে টোকাদেয় সে। এই টোকার অর্থ যুথী জানে। নষ্টামীর সাধ হয়েছে ইফতির! ইফতির হাতে জোরে একটা চিমটি কেটে দেয় সে। তার পর এদিকে ফিরে চেক করে, বাবুকে ছুয়ে ফেললো কিনা। ইশারায় বুঝিয়েও দেয় বাবুকে না ছোয়ার কথা! ইফতি আবারো হাত দেয়। আবারো চিমটি। চিমটি আর টোকার বিনিয়ময় চলতেই থাকে। মাঝখানের প্রাচীর এর উপর দিয়ে। একসময় ইফতি বেশ আশাবাদী হয়ে ওঠে। বড় ঝগড়াঝাটির পর এইসব জমে ভালো!! যত বড় ঝগড়া, তত জমজমাট ব্যবসা! এগিয়ে প্রায় উঠেই পড়ে কোলবালিশটার উপর। ঝুকে প্রায় ছুয়ে ফেলতে চায় যুথীকে। ততক্ষনে যুথীও এদিকে ফিরে গেছে। আর তখনি একটা সর্গীয় কন্ঠ হেসেওঠে। তার বাবা মায়ের এইসব নষ্টামির চেষ্টা দেখে! হাসি শুনে যুথীর মাথা থেকে এক ধাক্কায় সব নষ্টামির উবে যায়। ইফতি একটু হতাশই হয় যেন। আর প্রবল পিতৃস্নেহে তাকিয়ে থাকে তাদের মাঝে হঠাৎ জেগে ওঠা এই দুষ্টু স্নেহের প্রাচীরের দিকে।
একসময় বাবু আবার ঘুমায়। যুথী ইফিতিকে টেনে নিয়ে আসে রান্না ঘরে রাখা সেই বোতলের দিকে। তারপর এক সময় বলে, ‘এই শোন, আমরা কিন্তু কাল বাবুকে ছোব না। সকালেই ফোন দিব মা কে...’
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০০৮ সকাল ১১:০০