somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অদ্ভুত সেই বিছানা

০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





বগলী কবর বলে এক ধরণের কবর আছে।


সচরাচর যে ধরণের কবর আমরা দেখি, আয়তাকার বক্সের মতো ঘনকাকৃতির, সেটাকে বলে সিন্দুকী কবর। এর গভীরতা মানুষের নাভি পর্যন্ত। কবরে মৃতদেহটি শোয়ানোর পর আয়তক্ষেত্রের কর্ণ (ওপরে থেকে নিচ) বরাবর সারি সারি বাঁশের টুকরো রেখে দেহটাকে ঢেকে দেয়া হয়। তার ওপরে থাকে বাঁশেরই চাটাই। সবার ওপর মাটি ফেলে সমান করে দেয়। পিরামিডের মতোই কবরে ওপরে উঁচু অংশটি (যেটা দেখে মনে হতে পারে যে এর নিচেই দেহটি আছে) আসলে শুধুই একটা চিহ্ন। যতদিন না বাঁশের লেয়ারটা পচে ভেঙ্গে না যাচ্ছে ততদিন এর নিচের ফাঁকা জায়গাটায় দেহটি রয়ে যাবে।


বগলী কবরের ব্যাপারটাও একদমই এইরকম। পার্থক্য কেবল দুটো জায়গায়। কবরের পশ্চিম দিকটার নিচে একটা বাড়তি খাঁজ তৈরি করা হয় যেখানে মৃতদেহটা ঢুকিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় পার্থক্য হলো, এই খাঁজ বরাবর মেঝের লেভেল কিছুটা ঢালু করা থাকে। এতে যেটা হয় মৃতদেহ খাঁজের মধ্যে শোয়ানোর পর সেটি পশ্চিম দিকে এমনিতেই কাত হয়ে যায়। এটাই মুসলিম রীতি কবর দেয়ার।


বগলী কবর তখনি খোঁড়া সম্ভব যখন মাটিটা তুলনামূলকভাবে শক্ত। নইলে ওই যে খাঁজটা পায়ের চাপে ভেঙে পড়তে পারে নিচের দিকে। একারণেই বাংলাদেশের কিছু জায়গাতেই কেবল এই ধরণের কবর দেখা যায়।


কবরে এই বর্ণনাটা দেয়া হলো পাঠিকাদের বোঝানোর জন্য। কারণ বাংলাদেশে ইসলামি রীতি এবং সামাজিক নিয়ম অনুসারে মেয়েরা কবরস্থানে যান না এবং যেতেও পারেন না। তবে পুরুষরা সম্ভবত একবার হলেও প্রসেসটা দেখেছেন।


তবে কবর নিয়ে আপনাদের শেখানোর জন্য এটা লিখছি না। আমি আসলে আপনাদের একটা দৃশ্য দেখাতে চাই।


একজন মাকে গতকাল আমি দেখছিলাম, খুব নির্জন, লম্বা লম্বা ঘাসে ঢাকা একটা কবরস্থানে বসা অবস্থায়। সেখানে নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে একটা কবর; আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর কবর। কবরও যে একটা আর্ট হতে পারে, সেটা গতকাল মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছি।


মধ্যরাতে তার সতের-আঠারো বয়সের একমাত্র সন্তান যে ছেলেটি সে ঘুমের মধ্যে মারা গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক, স্ট্রোকের কারণ অজানা। ছেলেটি আর দশটা সুস্থ স্বাভাবিক ছেলের মতোই। শান্ত, চুপচাপ, নিরীহধরণের এবং নিজের মধ্যে কিছুটা গুটিয়ে থাকা একজন। ছেলেটির বাবা কোভিডের সময়ে মারা গিয়েছিলেন। এটা ছিল কেবল মা আর ছেলের সংসার।


সেই মা দেখলেন তার নাড়িছেঁড়া একমাত্র ধনকে সাদা কাপড়ে মোড়া অবস্থায় সেই খাঁজটায় শুইয়ে দেয়া হচ্ছে। এরপর যখন একের পর এক বাঁশের টুকরো লম্বা দেহটাকে ঢেকে দিচ্ছিল, মা সেটা এক দৃষ্টিতে দেখছিলেন। চাটাই দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো সবটুকু। এরপর মাটি ফেলে সমান করে দেয়া হলো। পুরোটা সময়ে মা গলায় শেষবার তাঁর ছেলেটার গা থেকে খুলে নেয়া ছেলের গায়ের ঘ্রানমাখা নীল রঙের ফুলছাপ ফুলহাতা শার্টটা জড়িয়ে রেখেছিলেন; একবারের জন্যও চোখ সরাননি কবরের দিক থেকে।


আমি এই পুরো দৃশ্যটা দেখলাম, সবার পিছনে দাঁড়িয়ে।


আমি আসলে মাকে দেখছিলাম, দাফন দেয়াটা না। আমার জীবনের অন্যতম ভয়াবহ এবং একই সাথে কষ্টের কোন দৃশ্যের কথা যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কোনদিন, সেটা হবে এই বিশ মিনিট। আমি বুঝেশুনেই ‘ভয়াবহ’ বিশেষণটা আগে লিখেছি। কারণ ওই সাদা কাপড়টার আড়ালে অবচেতনভাবেই যেই মুহূর্তে আইমানকে শুয়ে থাকাটা কল্পনা না করে পারিনি (মস্তিষ্ক খুবই খারাপ একটা অঙ্গ কখনও কখনও)। এজন্যই অব্যাখ্যাত একটা আতংক হচ্ছিল। এর পর আচমকা কান্নার ধাক্কাটা এলো, যেটা এতক্ষন, সেই সকাল থেকে আসেনি।


কবরস্থানটির গায়ের সাথে একটা ছোট্ট ছিমছাম মসজিদ। নীল মিনারটা অনেকটা দূর থেকেও দেখা যাবে। ব্যস্ত সপ্তাহের মধ্য দুপুরেও সেখানে কেবল পাখির ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কবরস্থানটাও ছোট। লম্বা ঘাসে ঢাকা, আগেই বলেছি। কয়েকটা বড় গাছ এদিকওদিক ছড়ানো। সামনের সরু পিচঢালা রাস্তাটা এঁকেবেঁকে বিছিয়ে রয়েছে।


আমি হয়তো এরকম একটা জায়গাতেই শেষ বিশ্রাম নিতে চাইব। গাছের পাতারা পরম আদরে ঝরে পড়বে আমার কবরের ওপর আর সারাদিন গান শোনাবে পাখিরা। রাতের আকাশ কখনও দেখাবে তারাদের, কখনও গোল্লাগোল্লা মেঘেরা দল পাকিয়ে খেলবে, কখনও ঝরবে বৃষ্টি। ব্যাস, আর কিচ্ছু নেই। সবটুকু চুপচাপ, একা। বাড়তি শব্দ বলতে কেবল গা ঘেঁসে পরম মমতায় বন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটার মিনার থেকে ভেসে আসা আজানের সুর।


যেই মুহূর্তে এই কথাগুলো মনে এলো, আমার অনুভূতিগুলোও কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। একজন মা বা বাবার মনের মধ্যে এইরকম দৃশ্য দেখা, এই জায়গায় বসে বসে – ব্যাপারটা আসলে কীরকম? সেটা কল্পনা করা সম্ভবত কারও পক্ষেই সম্ভব হবে না কোনকালেই।


এমন না যে ওই দৃশ্য দেখে আমার কোন বিশেষ উপলব্ধি হয়েছে অথবা জীবনবোধ এদিকওদিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি শুধু ওই মাকে বোঝার অক্ষম চেষ্টা করছিলাম। বোকারা এরকমই করে। অথবা ওইরকম একটা জায়গায় ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে সবাই বোকা হয়ে যায়।

মৃত্যুর সময় পাশে কেউ থাকবে না, এর চেয়ে ভয়াবহ বোধ হয় আর কিছুই নেই। শেষ বিদায় নেয়ার সময় অন্তত কোনো একজন মানুষকে বলে যাওয়া দরকার। নিঃসঙ্গ ঘর থেকে একা একা চলে যাওয়া যায় না, যাওয়া উচিত নয়।এটা হৃদ্য়হীন ব্যাপার। - এই কথাটা হুমায়ূন আহমেদের। কিন্তু কথাটা যে কতটা তীব্র সেটা এখন কিছুটা বুঝতে পারছি। সেই ছেলেটা তো একাই ঘুমাতো, নিজের আলাদা ঘরে। মা তাকে ডেকে ডেকেও যখন সাড়া পাননি, তখন গিয়ে গা ছুঁয়েছিলেন।


যে ছেলেটি মারা গিয়েছে তার নাম রাইয়াত, রাইয়াত শাহরিয়ার; আমার বড়ছেলে আইমানের বন্ধু। একসাথে সেই কেজি-ওয়ান থেকে পড়েছে। আগামী এপ্রিলে ওর এ-লেভেল পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। এখন সবটাই পাঁচফুট মাটির নিচে অতীত। ওর মা আমাদের কাছাকাছি বয়সী। কবরের পায়ের দিকটায় চুমু দিতে দিতে তাঁর বলা একটা কথা আপনাদের বলি:

‘বাবা, তুমি আব্বুর পাশে ঘুমাও। আমি না থাকলে তোমারে কে দেখবে – সবাই বলত তো। এখন আর সমস্যা নাই। আমি আসতেছি চল্লিশ দিনের মধ্যেই, এই জায়গাটায়।‘


#ট্রিবিউট_টু_রাইয়াত_শাহরিয়ার

(ছবিদুটো বগলী কবর বোঝানোর জন্য। কবরটার মূল সৌন্দর্যের বিন্দুমাত্র ধরতে পারিনি। পরম সৌন্দর্য এবং চরম বিষাদ যে একসাথে আসতে পারে, সেটারও একটা উদাহরণ।)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ দুপুর ১২:১৮
১১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আইলো আইলো আইলোরে, রঙ্গে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:৪৮


ভোরের আলোয় রঙিন হওয়ার দিন
পহেলা বৈশাখ এসেছে বাংলার দোরগোড়ায়—রাঙা চেলি কাপড়ে মোড়া এক সকাল, যার হাত ধরে ফিরে আসে প্রাণের ছন্দ। আকাশে লাল সূর্যের আভা, হাওয়ায় মিষ্টি কাঁচা আমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সংক্ষেপে তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:২০

ইসলামী শরীয়া মোতাবেক সংক্ষেপে তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

তালাক হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণিত হালাল কাজগুলোর একটি। পারিবারিক জীবনে বিশেষ অবস্থায় কখনও কখনও তালাকের প্রয়োজনীয়তা এড়ানো যায় না বিধায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতাঃ ঈশান কোনে ঝড়

লিখেছেন ইসিয়াক, ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:০৪


মেঘ গুড়গুড় মেঘ গুড়গুড়

ঈশান কোনে ঝড়।

বাতাস তোড়ে ঘূর্ণিপাকে

ধুলো মাটি খড়।

পাখপাখালি ব্যস্ত চোখে

খুঁজছে আশ্রয়।

বিপদাপন্নর চোখে মুখে

অজানা শঙ্কার ভয়।

কড়কড়াকড় বাজ পড়ছে

আলোর ঝিলিকে।

প্রলয় কান্ড ঘটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৪৩২ বয়স!

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১১:৩৪



বাংলা নববর্ষ নিয়ে অতি উচ্ছ্বাস -
উন্মাদনা বিশেষত যারা একদিনের জন্য নিখাঁদ বাঙালি হয়ে 'মাথায় মাল' তুলে রীতিমতো উত্তেজনায় তড়পাতে থাকেন তাকে খাস বাংলায় বলে ভণ্ডামি!

বাংলা বর্ষপঞ্জিকা আমাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত-বাংলাদেশে আলাদা দিনে বাংলা নববর্ষ কেন?

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৫:৪৪

ভারত-বাংলাদেশে আলাদা দিনে বাংলা নববর্ষ কেন?


বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ আসে ইংরেজি মাসের ১৪ এপ্রিল। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলায় ১৫ এপ্রিল উদযাপন করা হয় উৎসবটি। যদিও ১৯৫২ সন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×