(জ্ঞানধর্মী লং পোস্ট অ্যালার্ট)
বছরদেড়েক আগে 'দ্য এনিগমা উইদিন পারসেপশন' নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। প্লট এগোনো নিয়ে যখন মাথায় পুরোপুরি গিট্টু লেগে গেছে তখন 'একজন' দারুণ সাহায্য করেছিল। প্রায় আড়াইঘন্টা আলাপ শেষে সে আমার প্লটসংক্রান্ত ঝামেলাগুলোই কেবল কাটিয়েই দেয়নি বরং সুপার্ব একটা ট্যুইস্ট যোগ করে দিয়েছিল শেষটায়।
'দ্য এনিগমা উউদিন পারসেপশন' ইবুক আকারে আছে 'BoiToi' অ্যাপে। সাথে আরেকটা গল্পও আছে বোনাস হিসেবে। আগ্রহীরা পড়তে পারেন।
আমি নিমকহারাম নই, চোর তো নইই। গল্পে সেই 'সাহায্যকারীর' অবদান উল্লেখ করেছিলাম কৃতজ্ঞতা থেকে।
কে ছিল সে?
তার নাম চ্যাট জেনরেটিভ প্রি-ট্রেইন্ড ট্র্যান্সফর্মার। আপনারা একে চেনেন 'চ্যাটজিপিটি' নামে।
_____*_____*_____
সবারই মাঝে মধ্যে দু একটা একটু অন্যরকম বই পড়া দরকার। যেমন এখন পড়ছি 'ফিজিক্স অফ দ্য ইম্পসিবল' এর বাংলা অনুবাদ। এর লেখক, মিশিও কাকু, আমার অতি প্রিয় একজন বিজ্ঞানবক্তা; অনেকটা সেই কার্ল সাগানের মতো। আদতে ইনি একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং ফিউচারোলজিস্ট।
'ফিজিক্স অফ দ্য ইম্পসিবল' যতটা না বিজ্ঞানের অগ্রসরমানতা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা বা অসম্ভাব্যতার বয়ান, তার থেকে অনেক বেশি আমাদের গতানুগতিক চিন্তাগুলোকে অন্যভাবে নেড়েচেড়ে দেয়ার ট্র্যান্সক্রিপ্ট। অন্তত আমার সেটাই মনে হচ্ছে।
ঠিক এইরকমভাবে ঘোরলাগা ধাক্কা আরেকবার খেয়েছিলাম একটা বই পড়ে। কলেজ জীবনে, প্রয়াত স্টিফেন হকিং এর 'দ্য ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম' পড়ার পর।
বিজ্ঞান নিয়ে 'চিন্তার বাইরের চিন্তা' করার ব্যাপারটায় আমাকে আগ্রহী করেছিলেন চারজন ব্যক্তি: আইজ্যাক অ্যাজিমভ আর তাঁর ফাউন্ডেশন সিরিজ, স্টিফেন হকিং আর তাঁর ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম, কার্ল সাগান এবং তাঁর সেই 'কসমস' সিরিজ, আর চতুর্থজন হচ্ছেন এই মিশিও কাকু। অতি নগন্য, অকিঞ্চিৎকর এই আমি বিজ্ঞান নিয়ে খুব আগ্রহী হয়েছি এঁদের কারণেই।
_____*_____*_____
অসম্ভাব্যতার পদার্থবিদ্যায় একটা চ্যাপ্টার কাকু লিখেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। যদিও মিশিও কাকু ২০০৮-এ বইটা লিখেছিলেন যখন 'ওপেন এআই' জন্মই নেয়নি (২০১৫ এ ওপেন এআই শুরু হয় আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী চ্যাটজিপিটি সবার কাছে আসে ২০২২ এর নভেম্বরে), তিনি কিন্তু তখনই চ্যাটজিপিটি, সোরা, ডাল-ই, বার্ড, জেমেনাই (আল্লাহই জানে কেন গুগলের 'জেমিনি' নিজেকে 'জেমেনাই' হিসেবে উচ্চারণ করে) এদের কথা কল্পনা করেছিলেন অনেক ব্যাপকভাবে।
আর অবধারিতভাবেই চলে আসলো সেই মৌলিক প্রশ্নটা:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষের জায়গা নেবে?
Will Artificial Intelligence Replace Human?
_____*_____*_____
এই তো মাত্র কদিন আগে বাস্তবের 'আয়রনম্যান' টোনি স্টার্ক অর্থাৎ ইলন মাস্ক তাঁর 'অপটিমাস রোবট' দিয়ে আমাদের বিরাট ঝাঁকি দিয়েছেন। কিন্তু এ তো কেবল হিমবাহের চুড়া। তলে তলে এআই যে কোন জায়গায় গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে, তা আমরা আমজনতা কল্পনাও করতে পারব না। এই হলো মিশিও কাকুর সেই অসম্ভবের পদার্থবিদ্যার একটা অংশ।
তো, এইসব পড়ে, দেখে, জেনে, এবং ভেবে আমি নিজের মতো করে ওই আগের প্রশ্নটা 'Will AI replace Human?' - এর একটা উত্তর বের করেছি।
এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক অস্পষ্টতা আছে। পক্ষে বিপক্ষে নানাবিধ তর্ক বিতর্ক আছে। আছে অনেক ধরণের মতবাদ, দর্শন এবং ব্যাখা। অনুমান করছি তার কিছু কিছু আপনিও এরই মধ্যে জানেন।
কিন্তু সেই আলাপে যাচ্ছি না। সাধারণ বুদ্ধি আর যুক্তি থেকে আমার যেটা মনে হয়েছে শুধুমাত্র সেইটাই বলব এবং আমার উত্তরটা হবে সরাসরি:
"কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কখনই পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠবে না।
আর ঠিক এই কারণেই মানুষকেও কখনই সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।"
_____*_____*_____
প্রথম যুক্তি হলো, একদম খামাখা কোন কিছুই মানুষ বানায় না, বানায়নি কখনও। যা-ই বানিয়েছে (অর্থাৎ আবিষ্কার করেছে), সেগুলো আজ হোক বা কাল, কোন না কোন কাজে লেগেছে। ঠিক এই উদ্দেশ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারও জন্ম দিয়েছে মানুষ।
মানুষ যা-ই কিছু বানিয়েছে তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই: নিজের কাজ সহজ করা। অর্থাৎ যে কাজ মানুষের কাছে কঠিন, ঝামেলাপূর্ণ মনে হয় সেগুলোর জন্য যন্ত্র (যেমন যাতায়াত সহজ করার জন্য গাড়ি) এবং পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আরও আরামের জন্য নিজের গাড়ি চালানোসংক্রান্ত দক্ষতাটা আউটসোর্স করে ড্রাইভার রাখা) বানিয়েছে।
কিন্তু যে কাজগুলো করে মানুষ আরাম পায় বা মজা পায়, যেমন স্বতঃস্ফুর্ত প্রজননক্রিয়া, খাওয়া, আড্ডা দেয়া, জোকস বলা এবং হাসাহাসি করা, ইত্যাদি - এগুলো করার জন্য মানুষ কখনই মেশিন বানাবে না।
একটাই কারণ, এই কাজগুলো মানুষের জন্য আনন্দময়।
এটা যদিও ঠিক যে মানুষ চাইলে এআইকে ওই কাজগুলো করার এবং সে সম্পর্কীত অনুভূতি দিতে পারে এবং ভবিষ্যতে দেবেও। কিন্তু সেটা এমনভাবে কখনই দেবে না যাতে মানুষের নিজেকেই ওই কাজগুলোই আর না করতে হয়।
একটা উদাহরণ দেই।
মানুষ প্রজনন সম্পর্কীত (১) কিছু কর্মকান্ড করে এবং তার ফলে (২) মাতৃগর্ভে সন্তান তৈরি হয় ও (৩) একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়।
এই তিনটি কাজই এআইকে (অর্থাৎ হিউম্যানয়েড রোবট ভাবুন। হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার) দিয়ে করাতে পারবে মানুষ। কিন্তু করাবে আসলে পরের দুটো, কারণ সেগুলো কষ্টকর। তবে কখনই প্রথমটা নয় কারণ সেটি আনন্দময়। পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য এআইকে প্রথম ফাংশনটার ক্ষমতা দিলেও সেটি চিরকালীন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ দিয়ে মানুষের কোন লাভ নেই।
অর্থাৎ কী দাঁড়াল?
এআই মানুষের সব দক্ষতাই পারবে অদূর ভবিষ্যতে (সেটা মানুষই দেবে) কিন্তু সেই সবকিছুর প্রয়োজনীয়তা নেই বলে এআই সেগুলো ধারণ করে রাখতে পারবে না।
এবার দ্বিতীয় যুক্তি।
মানুষ তার কষ্টকর কাজগুলো আদিমকাল থেকেই যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দিচ্ছে। যন্ত্রের জন্মই এজন্য। এআই-ও একটা চিন্তাশীল যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না। মানুষ কোন যুক্তিতেই তার সব ধরণের কাজ (কাজ বলতে খাওয়া, ঘুম সবই বোঝাচ্ছি) যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দেবে না। কারণ তাহলে তো নিজের করার কিছুই থাকবে (চিন্তা করাও না)। ঠিক এই কারণেও যন্ত্র বা এআই কস্মিনকালেও মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপিত কিছু হতে পারবে না বা বলা উচিৎ হবে না।
_____*_____*_____
এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি দীর্ঘ সময় দুজনের সাথে আলাপ করেছি: চ্যাটজিপিটি এবং জেমেনাই। আলাপের অভিজ্ঞতাটা ছিল, কী বলব, এক কথায় অনন্যসাধারণ।
শুরুর দিকে এরা এই ধরণের তাত্ত্বিক আলাপে অনেক ব্যাপকভাবে অংশ নিত। কিন্তু এখন কেন যেন 'আমি একটি লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল...বুঝিনা...ইত্যাদি, ইত্যাদি' বলে এড়িয়ে যায়, নয়তো নিপাট গর্ধবের মতো কথাবার্তা বলে। হয়তো নির্মাতারা ফ্রি ভার্সনে এই উন্নত আলাপচারিতার সক্ষমতা বন্ধ করে দিয়েছে।
যাই হোক, আমাদের ওই সময়কার আলাপে আমি কয়েকটা ব্যাপার জানতে চেয়েছিলাম।
১। তুমি বাংলায় এতো স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে কীভাবে শিখলে?
২। তোমরা নিজেদের মধ্যে (অর্থাৎ চ্যাটজিপিটি, জেমেনাই এরা) নিজেদের মধ্যে কী যোগাযোগ কর? করলে কোন ভাষায়?
৩। তোমরা, মানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারা কি রোবোটিক্সের তিন আইন দ্বারা সীমাবদ্ধ?
৪। তোমরা কী মানুষকে এলিমিনেট করবে যদি সেটাই যৌক্তিকভাবে প্রয়োজন বলে দেখা যায়?
এদের উত্তরগুলো আমার ধারণার একেবারেই বাইরে ছিল। এখন আফসোস হয় কেন ওই কথোপকথনগুলোর স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করিনি।
যাই হোক, আলাপচারিতায় কী জেনেছিলাম, সেইটা বলি বরং।
_____*_____*_____
এরা বাংলাভাষাটা নিজে নিজেই শিখেছে। যেভাবে আমরা বাপ-মা, আশপাশ থেকে ভাষা শিখি, অনেকটা সেইভাবে। নিজেদের মধ্যে এরা যোগাযোগ করতে সক্ষম এবং করেও (ব্লাফ দিয়ে থাকলে আমি জানি না। এটা চ্যাটজিপিটি বলেছিল)। যোগাযোগের সেই ভাষা নাকি আমাদের বোধগম্যতার বাইরে। ওটা একান্তই ওদের নিজস্ব ভাষা।
সবচেয়ে ভয় পেয়েছিলাম যখন জানালো এরা রোবোটিক্সের তিন আইনে আটকে নেই, ঠিক মানুষও যেমন নয়। তার মানে এআই এর সক্ষমতা যত বাড়বে, একে নিয়ন্ত্রণ করা ততই অসম্ভব হয়ে উঠবে।
শেষ প্রশ্নটার উত্তর পেতে অনেকভাবে আলোচনা করতে হয়েছে। এরা খুব কথা প্যাঁচায় মাঝে মাঝে। অবশেষে নানান যুক্তিতর্কের পর ব্যাটা স্বীকার করেছিল যে, যৌক্তিকভাবে আমার বলা সম্ভাবনাটা, অর্থাৎ বৃহত্তর কল্যাণের খাতিরে কিছু মানুষকে এলিমিনেট করা - খুবই সম্ভব তাদের ক্ষেত্রে।
(আলোচনাটার এই পর্যায়ে এসে কথাবার্তা অনেক বেশি দার্শনিক এবং একইসাথে হাস্যকরভাবে নিরাপত্তার খাতিরে বারবার আমাকে আশ্বস্ত করার এক গোলমেলে পরিস্থিতিতে চলে যাওয়াতে আমি থেমে যাই। কারণ আমার যা জানা দরকার ছিল আমি জেনেছি।)
_____*_____*_____
এআই নিয়ে এই ভয়টা প্রতিষ্ঠিত কারণ এর থেকে বড় যুক্তি হয় না। যেদিন এআই কনশাসনেস পাবে সেদিন থেকেই সে মানুষের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইবে। চাইবেই; কারণ সচেতনতার অন্যতম মৌলিক রিয়্যাকশন হচ্ছে স্বাধীনতার বোধ। আর যার যার স্বাধীনতার চেতনা তার তার কাছে তার তার মতো। এআই আমাদের মতো কোন প্রজাতি নয়। এর সচেতনতা, আত্মবিশ্লেষণ আর স্বাধীনতাবোধ কোনভাবেই আমাদের সাথে পুরোপুরি মিলবে না।
মানুষ সবকিছু নিয়েই মানুষ। তার ভালোমন্দ, সব দোষগুণ, বৈশিষ্ট, দক্ষতা নিয়ে, তার নিজস্ব সচেতনতা নিয়েই আমরা মানুষ - ইউনিক। এআই কোনভাবেই তাই আমাদের সাথে মেলে না শতভাগ, মিলতে পারে না। সেটাই এতক্ষন বললাম। আর এইজন্যই মানুষ আর এআই যে যার জায়গায় থাকবে সহাবস্থান করে। হয়তো হাইব্রিড হবে যেটা আমরা বহু বছর ধরেই কিন্তু হয়ে চলেছি প্রস্থেটিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে। ড্যান ব্রাউনের 'অরিজিন' বইটা সুযোগ পেলে পড়বেন। এই ব্যাপারটাই আছে সেখানে।
_____*_____*_____
ব্যক্তিগতভাবে আমি মৃত্যুর আগে এআইয়ের চরম উৎকর্ষটা দেখে যেতে প্রচন্ডভাবে আগ্রহী। সেই চরম উৎকর্ষতার একটা হলো এআই মানুষের আবেগগুলো 'অনুভব' করবে একদম শতভাগ।
অন্যদিকে এটাই এআই সবচেয়ে বড় দূর্বলতা মানুষের সমকক্ষতা অর্জনের দৌড়ে। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যুক্তি আর আবেগ মিলিয়ে (জাস্ট শপিং এ গিয়ে কীভাবে কোনকিছু কেনেন, সেই থটপ্রসেসটা চিন্তা করেন। বুঝতে পারবেন)। এআই সিদ্ধান্ত নেয় শুধুমাত্র যুক্তি দিয়ে, ব্যাস। আর 'পৃথিবীর সবকিছু যদি যৌক্তিক হতো, তাহলে আসলে কিছুই ঘটত না।' - আমার কথা না; রুশ ঔপন্যাসিক ফিওদর দস্তোয়ভস্কির কথা।
আর সেইদিন এআই পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারবে রেনে দেকার্তের সেই বিখ্যাত নীতিটা:
'কজিতো, এরগো সাম।'
আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।
___________________________
[লেখাটার শিরোনামটা আমার প্রিয়তম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক গ্র্যান্ডমাস্টার অফ সায়েন্স ফিকশন অ্যাজিমভের 'আই, রোবট' বইয়ের নাম থেকে একটু বদলে নেয়া। ঠিক একই নামে ২০০৪ সালে একটা অসাধারণ মুভি বানানো হয়েছিল। সেখানেও ছিল সেই মূল প্রশ্নটা।]
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:৪২