somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হরর গল্পঃ যাত্রী

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাসে বাসায় ফিরছি উত্তরা থেকে। যাব সেই নারায়নগঞ্জ। জসিমের সাথে আড্ডাটা এমন জমেছিল যে কখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়িয়েছে, খেয়ালই করিনি। তড়িঘড়ি এসে যে বাসটা পেলাম সেটাই মনে হয় শেষ বাস। যাত্রী আমি ছাড়া মাত্র একজন বুড়োমত মানুষ। পিছনের দিকে বসে ঢুলছে। আমি বসেছি ড্রাইভারের পিছনের সিটটাতে। ড্রাইভার প্রায় উড়িয়েই নিয়ে যাচ্ছে বাস। ভয় হলো আবার ভিড়িয়েই না দেয় কোথাও। শুনশান রাস্তাটা সামনে বিছিয়ে আছে। তার আবার জায়গায় জায়গায় স্ট্রিটলাইট ফিউজ হয়ে গাঢ় অন্ধকার জমেছে। গাড়িতে আমি ছাড়া আর একজন মাত্র যাত্রী। এক বুড়ো চাচা পিছনের সিটে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। সামনে ড্রাইভারের পাশের সিটে হেল্পার বসে বিড়ি টানছে। ড্রাইভারের সাথে টুকটাক কথা কানে আসছে।


হঠাৎ হার্ডব্রেকের ধাক্কায় সামনে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে আবছা আঁধারে। একজন হাত উঠিয়ে বাসটাকে থামিয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানকার লাইটও ফিউজ। এই জায়গাটাতেই বনানী গোরোস্থান। এতরাতে এরকম জায়গায় কেউ দাঁড়াতে পারে? সাহস আছে বলতে হবে। নির্জন জায়গা। একটা কুকুরও নেই আশেপাশে। নেহায়েতই শহর, না হলে শিয়ালের ডাক শুনতে পেতাম নির্ঘাৎ। যাত্রী দেখে ড্রাইভার বাস দাঁড় করালো। শেষ ট্রিপে যা যাত্রী পাওয়া যায় তাইই লাভ। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। আবছা আঁধারে ঠিক বুঝতে পারলাম না মহিলা, না কি পুরুষ। বাসে উঠলে পর দেখলাম কালো লুঙ্গি পরা একটা শুটকোমতন লোক। মুখটা মাফলারে ঢাকা। গ্রামের লোক বোঝাই যায়। না হলে ঢাকায় কি এমন শীত যে মাফলার পরতে হবে? সাথে সাদা থানে আপাদমস্তক জড়ানো এক মহিলা। আকারে একেও শুকনা পাতলাই লাগল। লম্বা ঘোমটার কারনে এর চেহারাও বোঝা গেল না। আসলে আমিই ঠিকমত তাকাইনি। কৌতুহল হয়নি আর কি। দেখলাম আমাকে অতিক্রম করে গিয়ে বসল বুড়োটার ঠিক পাশের সিটে। গরীব লোক, দেখলেই বোঝা যায়। পিছনে চাচামিয়ার নাক ডাকা চলছে। যেন নিজের বিছানাতেই ঘুম দিচ্ছে। আমি আবার সামনে তাকালাম। হাত পা ছড়িয়ে বসা - আরাম।


বাস চলছে। কন্ডাকটর আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। বাসটা লম্বা। সিটগুলো উঁচু উঁচু। আর ঢাকার টিপিক্যাল বাসগুলো যেমন হয়, লাইট একটা জ্বলছে গেটের কাছে। ড্রাইভারের মাথার ওপর আরেকটা। বাকি পুরো বাস আলোহীন। হয় লাইট নষ্ট না হয় নিভিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝে স্ট্রিট লাইটের আলো ঝলকে উঠছে বাসের ভেতরের আঁধারকে। তখন দু এক মুহূর্ত দেখা যায় বাসের ভেতরটা। ঘড়ি দেখলাম। পৌনে একটা বাজে। আরও আধঘন্টাটাক লাগবে আমার বাসায় পৌঁছাতে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকলাম। পনেরটা নোটিফিকেশন। একটা প্যারানরম্যাল আর ভৌতিক গ্রুপে যুক্ত আছি। গতকাল একটা হরর গল্প পোস্ট দিয়েছিলাম সেখানে। বেশিরভাগ নোটিফিকেশনই সেটার কমেন্ট। গ্রুপে ঢুকে দেখি একটা গল্প পোস্ট করেছে একজন। রাতের বাসে বাড়ি ফেরা নিয়ে তার একটা গল্প। আরে..! মজার তো। আমিও এখন রাতের বাসে বাড়ি ফিরছি। সাবলীল বর্ণনা। একটানে পড়ে ফেললাম। ভালই লিখেছে। এমনকি গায়ে একটু কাঁটাও দিয়ে উঠল।


পড়তে পড়তেই 'হোঁত' করে একটা শব্দ শুনলাম মনে হলো। তারপরই 'মট' করে একটা শব্দ। দুটো শব্দই সেই রাতের খালি বাসে অস্বাভাবিক শোনালো। হঠাৎ বাসের ভেতরটা কেমন নির্জন মনে হলো। না...ইঞ্জিনের শব্দ তো আছে। ঠিক বলতে পারব না কি, কিন্তু মনে হচ্ছিল কি যেন নেই। তারপরই খেয়াল হলো, আরে, পিছনের চাচার নাকডাকা তো শোনা যাচ্ছে না। ওঠার পর থেকেই শুনে যাচ্ছিলাম তো। অভ্যাসের মত হয়ে গিয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম একবার। দেখি কখন যেন ওই শেষের দুই যাত্রী সিট বদলে বুড়ামিয়ার পাশে গিয়ে বসেছে। খালি বাসে এক সিটে কেন চাপাচাপি করে বসলো? অদ্ভুত ব্যাপার। আমি আবার বসে পড়লাম। চোখ ফেরালাম মোবাইলের স্ক্রিনে। কিন্তু মনটা কেমন যেন করতে লাগল।


কিছুক্ষন বিরতিতে এবার অন্য একটা ক্ষীন শব্দ কানে এলো। ফ্ল্যাপ..ফ্ল্যাপ...চপ..চপ...কিছু ছেঁড়ার শব্দের মত। তারপর মনে হলো, মুখ খুলে কিছু চিবিয়ে খেলেও এরকম চপ...চপ শব্দ হয়। এবার উঠে দাঁড়ালাম সিট ধরে। পিছনে তাকালাম ভাল করে। ব্যাপারটা কি। হেল্পারটা আবার এরমধ্যে নতুন যাত্রীদের ভাড়া নিতে এগিয়ে গিয়েছে। এই সময় কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল একসাথেই। হেলপার ড্রাইভারকে পিছনের লাইটটা জ্বালিয়ে দিতে বলল। ড্রাইভার জ্বালিয়ে দিতেই লোকটা উঠে দাঁড়াল। আর আমারও চোখ পড়ল ঠিক ওদের চেহারার ওপর। আজ এতদিন পরও সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। শিউরে উঠি আর ভাবি সত্যিই কি দেখেছিলাম? আর কিই বা দেখেছিলাম?


বুড়োটা মাথা সোজা করে বসে আছে এখনও। বরং বলা ভাল সোজা করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সিটের ওপর দিয়ে বুকের ওপর থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে পেলাম। বুড়োটার মুখটা ঝুলে পড়েছে। আর সেই মুখ বিভৎসভাবে ক্ষত বিক্ষত। দুপাশেই গলা থেকে কান পর্যন্ত মাংস নেই। যেন হিংস্র জানোয়ার কামড়ে খেয়েছে। তার দুপাশে বসা দুজন। কিন্তু এরা মানুষ? এই মুহূর্তে যা চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করছি তা কোন মানুষের চেহারা হতে পারেনা। লোকটার মাফলার এখন সরানো। মহিলাটার ঘোমটাও পড়ে গেছে। ফ্যাকাশে সাদা চেহারা। মনে হচ্ছে চুনকাম করা। দুজনের মুখের কষ বেয়ে রক্তের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। তাজা, টকটকে লাল রক্তে মুখের চারপাশ মেখে গেছে। লোকটা আমার দিকে তাকাল। উফ...! কি ভয়ানক সেই চাহনি! চোখ দু'জোড়া কুচকচে কালো। যেন কালো গহবর। শুধু দেখলাম, মনির জায়গাটায় দুটো লাল বিন্দু। নরকের গভীরতম স্তর থেকে উঠে আসা পিশাচ যেন। মহিলাটা তখনও ব্যস্ত নরমাংস ভোজনে। আমার চোখের সামনেই কচ করে এক কামড়ে পেয়ারা কাটার মত বুকের এক খাবলা মাংস তুলে নিল। তারপর সেও মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আমাদের দিকে। সেই মুখে ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ হাসি। স্তম্বিত, আতংকিত আমি ঠকঠক করে কাঁপছি নিদারুন বিভিষিকাময় এই দৃশ্য দেখে।


হেল্পার ছেলেটা আমার পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তার অবস্থাও আমার মত। তোতলাতে তোতলাতে দোয়া দরুদ পড়ার চেষ্টা করছে। আমাদের পা যেন পাথরের মত ভারী। হেল্পার তার সব শক্তি জড়ো করে ঘড়ঘড়ে গলায় চিৎকার করে উঠলঃ ওস্তাদ...পালান...রাক্ষস! সেই অমানুষিক চিৎকার শুনে ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়েছিল নিশ্চয়ই। এরপরই দড়াম! আমি শুধু অনুভব করলাম বাসটা সেই প্রচন্ড গতির মধ্যেই একবার টাল খেয়ে গেল। তারপর প্রচন্ড জোরে একটা ঝাঁকুনিতে আমি সেট থেকে উড়ে গিয়ে পড়লাম সামনের উইন্ডস্ক্রীনে। এরপর....এরপর সব অন্ধকার! জ্ঞান হারাবার আগ মুহূর্তে শুধু দেখলাম বাসের ছাদে নখ বাধিয়ে দুটো পিশাচই পেন্ডুলামের মত দুলছে। এরপর আর কিছু মনে নেই।


আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন রাত কয়টা, জানি না। ভাগ্যক্রমে বাসটা একটা বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে একসিডেন্ট করে। বিকট শব্দে সেইখানকার বাসে ঘুমিয়ে থাকা হেল্পাররাই আমাদের উদ্ধার করে। আমার ডান হাত আর বাম পা ভেঙ্গেছিল। হেল্পারেরও মাথা ফাটা আর পা ভাঙ্গা। অশেষ সৌভাগ্য আমার। কারন ড্রাইভার বাঁচেনি। বিদ্ধস্ত বাসের ভেতর থেকে লোকজন আমাদের উদ্ধার করে। সেই সাথে খুঁজে পায় কোমরের ওপর থেকে হাড় বের করা একটা অর্ধেক কংকাল।


(সমাপ্ত)


#গদ্যতাড়না
#ভৌতিক
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৩২
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×