একটা ম্যারম্যারে বাতি জ্বালিয়ে অনেকক্ষন ধরে আমি বসে আছি আমার চেম্বারে। জোরালো বাতি হলে আসলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না। চেম্বারে সারাদিন কেউ আসে নি, কেউ আসাটা জরুরী। আমারো তো পেট চালাতে হবে। হেলান দিয়ে বাতিটার দিকে তাঁকিয়ে থাকি আমি। বাতিটার চারপাশের দেয়ালটা কেমন জানি কালো হয়ে গেছে। চারপাশের দেয়ালগুলোর রঙ ও একদম মরে গেছে। অবশ্য তা ঠিক করে কোনো লাভ আসলে হবে না। আমার সামনের টেবিলে একটা খাতা এবং কলম। টেবিলের পাশে একটা বালতি। দূরে এক বিশাল আলমারী। পাশের ঘরের দরজাটা ভেজানো। আজকে ঘরটাতে তালা লাগানো হয় নি। চাবিটা ড্রয়ারের ভেতর পড়ে আছে কিন্তু উঠে গিয়ে দরজা লাগাতে বড্ড আলসেমী লাগছে। দরজাটার একটু ফাঁক দিয়ে ঘরের অন্ধকারগুলোকে বেশ দেখা যাচ্ছে। আমি গুন গুন করে একটু গান তোলার চেষ্টা করি।
দু'বার হাই তোলার পর দরজায় কড়া নাড়ানোর শব্দ শূনতে পাই। গলার স্বরটাকে একটু চড়িয়ে বলি "ভেতরে আসুন"।
যে ভেতরে প্রবেশ করে সে মধ্য বয়স্ক এক লোক। বসতে বলি তাকে। "বলুন আপনার কি সমস্যা" এ বলে দুহাতের আঙ্গুল গুলো একসাথে মিলিয়ে একটু গম্ভীর ভাব আনি চেহাড়াতে। লোকটিকে দেখলাম একটু উশ-খুশ করছে সেই তখন থেকে। এক হাত দিয়ে পেট চেপে আছে। আমি ভাবলাম লোকটি কি অসুস্থ। একটা পা বেশ পাগলের মত নাড়াচ্ছে সে, মুখের অংগভঙ্গী মুহূর্তের মধ্যেই পালটে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারি সে উচ্চ পর্যায়ের সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি। বললাম, "প্লীজ বালতিটি ব্যবহার করুন" বলতে না বলতেই সে ভক ভক করে বমি করে ফেলে। আমি হতাশ দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে দেখি বালতির পাশেই মেঝেতে সে তার দুঃখগুলো হরবর করে মুখ থেকে ফেলছে। পেট চেপে হাঁটু গেরে সে যখন তার কালো কালো দুঃখ গুলো ফেলতে থাকে আমি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি। কারণ তীব্র বাজে গন্ধে আমার ঘরটা ভরে গেছে ইতিমধ্যে। কিছুক্ষন পর সে শান্ত হয়ে বসে চেয়ারে, বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। দুঃখগুলো বহুদিন ধরে বেশ জ্বালাচ্ছিলো। আপনার পারিশ্রমিক আমি আপনার একাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি বলে সে মুহূর্তেই তার ভারিক্কি চালে ফিরে আসে। হন হন করে সে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। আমার তখন রাগে সারা গা রি রি করতে থাকে। কিন্তু এই তো আমার পেশা। আমি সোজা কথায় চেম্বারে সবার দুঃখ জমা নিয়ে থাকি। আমি তাদের দুঃখ ফেলার আস্তাকূড়। সে দিন আমার চলে যায় নাকে মুখে রুমাল বেঁধে ঘর পরিষ্কারের কাজে। এত্ত বাজে দুঃখ বহুদিন হলো এ চেম্বারে আসে নি। দুঃখ গুলো পরিষ্কার করে পাঠিয়ে দেই পাশের তালাবদ্ধ ঘরটিতে।
ছোটবেলা থেকেই মানুষ আমাকে তাদের দুঃখ বলে হালকা বোধ করতো তাই স্বাভাবিক ই আমার চারপাশে সর্বদাই অনেক বন্ধু বান্ধব থাকতো। আমি জানতাম আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার ভালো থাকতো এই ভেবে যে সবাই আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু একদিন আমি বুঝতে পারলাম যে আসলে সবাই আমাকে নয় আমার এই ক্ষমতাকে ভালোবাসে কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ভেবে দেখলাম পড়ালেখাতে আমি কখনোই ভালো ছিলাম না বরং আমি এই পেশাতেই ঢুকে পড়ি না কেনো!! বেশ হবে। আমার দিন ভালোই চলে যায়, আমি আমার চেম্বার বা বাসাটিকে সাজিয়েছে বড্ড রঙ্গীন করে। অন্তত বাইরে থেকে তাই ই মনে হয়। প্রচন্ড রঙ চঙ্গা এই বাড়ীটির নাম দিয়েছি আমি আনন্দ-বাড়ি। বেশ নাম বটে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটা চলা করি সারা শহরে, দোকানে গিয়ে অনেক কিছু কিনে ফেলি কারণ আমার মনে কোনো দুঃখ নেই, আমি কিনতেই পারি। খাবার দোকানে গিয়ে কিনে ফেলি ইচ্ছে মতো মিষ্টি-পেস্ট্রি-আইসক্রিম। মনের খুশীতে পেস্ট্রি খেতেই পারি আমি। হাঁটতে হাঁটতে ব্রীজ থেকে সূর্যাস্ত দেখি আমি। ফেরার পথে বিভিন্ন সুগন্ধী কিনে আনি আমি।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে একবার চেম্বারে উঁকি দিয়ে আসি আমি, এখনো বাজে ভক ভক গন্ধে ভরে আছে ঘরটা। লোকটার বিবেক বুদ্ধির কথা ভেবে আমার রাগ হতে থাকে আমার। বালতিটা কি আমি এমনে এমনে রাখি, কেনো যে এরা এমন হয়। এই ভেবে রুম স্প্রে দিয়ে ঘরের চারপাশে স্প্রে করে আসি আরেকবার। আশা করি সকাল হতে না হতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে পারিশ্রমিক ভালোই দিয়েছে ভেবে একটূ আনন্দিত হই। আসলেই আমার মনে কোনো দুঃখ নেই। সেই পরিচিত গানটি গুন গুন করে তোলার চেষ্টা করে আমি। জীবনটা সুন্দর বৈকি।
এভাবে দিনকাল ভালোই চলে যায় আমার। তবে মাঝে মাঝে সবার এতো দুঃখ দেখে বড় অনুশোচনা বোধ করি আমি। সবার এতো দুঃখ সমস্যার মাঝে আমার আনন্দিত হতে কুন্ঠিত বোধ হয়। তবে তা ক্ষনিকের জন্যই। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা বন্ধু হলে বেশ হতো। কিন্তু বন্ধুত্ব হতে হলে দুঃখ বিনিময় করতে হয়, কিন্তু দুঃখ বিনিময় করার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমার জন্ম হয়েছে দুঃখ নেবার জন্য। কিন্তু একপেশে দুঃখ নিতে থাকলে সে আর বন্ধু থাকে না সেও আমার এক পেশেন্ট হয়ে পড়ে। তা যাক সে কথা, এসব ছাই পাশ ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরি আমি। কিন্তু আজ দূর থেকে দেখতে পেলাম বাড়ির দোতালার জানালা দিয়ে কালো কালো কিছু বের হয়ে আসছে। কিছু গোলমেলে মনে হচ্ছে, এ ভাবতে ভাবতে আমার মনে পড়ে গেলো আজো মনে হয় আলসেমী করে দরজাটিতে তালা লাগানো হয়নি। আতঙ্কে আমার মেরুদন্ড দিয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে যায়। আমি ছুটতে শুরু করলাম। যদি দুঃখ গুলো ছাড়া পেয়ে যায় তাহলে বড্ড খারাপ হবে, বড্ড খারাপ। দু'বার হোচট খেয়ে পড়ে যাই শক্ত রাস্তায়। হাত-পা ছড়ে যায় এখানে ওখানে কিন্তু অসব দেখার সময় নেই এখন। হাতের মালপত্র রাস্তায় ফেলে ছুটি আরো জোরে। সদর দরজা হা করে খোলা, আসবাবপত্রের সাথে ক'বার ধাক্কা খেয়ে আমি আমার চেম্বারে ঢুকি। দেখতে পাই সারা চেম্বার জুড়ে কালো দুঃখের ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে, আশে পাশের জানালা দিয়ে লক লক দুঃখের শিখা গুলো বের হতে চাচ্ছে। আমার শোবার ঘর, বসার ঘর সব দুঃখে ছেয়ে গেছে, এমন কেনো হলো আমি বুঝতে পারি না। এত খামখেয়ালী কাজ আমি করতে পারি তা আমি ভেবে পাই না। এসব কিছুর মাঝে আবিষ্কার করি একজন বসে আছে আমার চেম্বারে খুব স্বাভাবিক ভাবে। আমি চিতকার করে বলতে থাকি এ কি! আপনি চলে যান। এক্ষুনি চলে যান। বড় বিপদ হবে আপনার। দুঃখগুলো ছড়িয়ে পড়লে আরো বিপদ হবে, এ ভেবে দরজা জানালাগুলো দ্রুত বন্ধ করতে থাকি আমি। কি করবো ভেবে পাই না সহসা। হঠাত লোকটি খুব শান্তভাবে বলে উঠে, “দুঃখ গুলোকে আমি ছেড়ে দিয়েছি বেশ করেছি। এগুলো শহরে ছড়িয়ে পড়ুক, সবাই দুঃখ হতাশায় জর্জরিত হউক। বেশ হবে তখন। আপনি নিজেকে কেনো বিশেষ কেউ ভাবতে চান? আপনি কি শহরের ত্রানকর্তা? মোটেও না। ওরা আপনাকে পেয়ে বসেছে আপনি কি বুঝেন না? ওদের দুঃখ কোনোদিন শেষ হবে না। ওদের দুঃখ বয়ে বেড়ানোর তো আপনি কেউ না। ওরা মরুক ওদের দুঃখ নিয়ে।” আমি ভাবলাম লোকটা কি পাগল নাকি? পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে কি এখানে স্থান নিলো। এই ঝামেলা আমি কি করে সামলাবো ভেবে মনে মনে গাল পাড়তে থাকি। ঘরের পাখাগুলো ছেড়ে দেই, তীব্র বাজে গন্ধে গা গুলিয়ে আসে আমার, বছর বছর ধরে জমানো দুঃখগুলো আমার চোখ-কান-মুখ দিয়ে প্রবেশ করতে চায় যেনো। আমার খুব অসুস্থ বোধ হয়। আমাকে কেউ বাঁচাতে আসবে না এ ভেবে আমি হতাশ হই। আমার চোখ বেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো এক ফোঁটা দুঃখ গড়িয়ে পড়ে। দুঃখটি অন্য দুঃখগুলোর সাথে মিশে যেনো ম্যাজিকের মত কাজ করে। সবকিছু যেনো মিলিয়ে যায় একদম। আমি বুঝতে পারি আমার দীর্ঘ আনন্দিত জীবনে এক ফোঁটা দুঃখ যেনো মিশে গেলো।
ভয়ংকর লোকটিকে পরের দিন ই হাত-পা বেঁধে পাগলাগারদে নিয়ে যায় ডাক্তার রা। আমার সাক্ষাতকার নেয় সাংবাদিকরা। আমাকে নিয়ে বির বির আলোচনা করে সবাই। আমার চেম্বারে লোক আসা কমে যায়, একদিন টের পেলাম বহুদিন কেউ আসেই না। এ ভেবে আমার খারাপ লাগে না। দিন রাত সুগন্ধী গুলো ব্যবহার করি আমি কারণ ও দিনের পর থেকে আমার শরীর থেকে ভুর ভুর করে বিশ্রী দুঃখের গন্ধ পেতে থাকি আমি। মাঝে মাঝে বেশ অসহনীয় লাগে সবকিছু। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। এসব ব্যাপারে ভড়কে গেলে চলবে না আমার।
একদিন আমি বুঝতে পারি এ শহরে আমার প্রয়োজন শেষ হয়েছে। আমি শহর ছাড়িয়ে এক গ্রামে গিয়ে আমার ছোট্ট চেম্বার গড়ে তুলি। ম্যারম্যারে আলোতে আবার পরবর্তী পেশেন্টের অপেক্ষা করতে থাকি। সাথে ব্যবহার করতে থাকি সুগন্ধী গুলো ইচ্ছেমতো। এরপর আবার কেউ কড়া নাড়ে। আমি দ্রুত সবকিছু ড্রয়ারে রেখে ভারিক্কী চালে বলে ফেলি “ভেতরে আসুন।”
*এটা নিয়ে গতকাল রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় লেখতে ইচ্ছে হয়েছিলো। বরাবরই ভালো কিছু জিনিসের আইডিয়া আসবে ঘুমোতে যাওয়ার আগে। ঘুম থেকে উঠলে দেখলাম পড়ে আছে কিছু উচ্চিষ্ট। যা অবশিষ্ট আছে তা নিয়েই তাড়াহুড়ো করে লেখে ফেললাম এটা। ধৈর্য্য দিন দিন কমে গেছে, এক বসায় না লেখতে পারলে হয়তো যা ছিলো তাও ও যেতো। -_-
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৬ রাত ৮:৪৪