১৯৫০ সালে একটা আমেরিকান বি-৩৬ বোম্বার প্লেন প্রশিক্ষণ চলাকালীন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় বিধ্বস্ত হয়। সেসময় বিমানটা একটা মার্ক ফোর পারমাণবিক বোমা বহন করছিল। বিধ্বংসী ক্ষমতার কথা বললে এই বোমাটা আর ১৯৪৫ সালে নাগাসাকিতে ফেলা বোমা- একই মানের ছিল। বিমানের বেঁচে যাওয়া ক্রু’দের ভাষ্যমতে তারা নিরাপদেই বোমাটা আগেই জেটিসন (বিপদকালীন সময়ে জাহাজ/প্লেন থেকে ভার কমাবার জন্য পণ্য নিক্ষেপ করা) করে ফেলে, আর মাঝ-আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়।
এই দুর্ঘটনাটি সর্ব প্রথম ‘ব্রোকেন অ্যারো’ বা ভাঙা তীর নামে পরিচিত হয়ে উঠে। ইউএস মিলিটারির টার্ম অনুযায়ী ‘ব্রোকেন অ্যারো’ হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত দুর্ঘটনার কেতাবি নাম। বেশ কয়েক দশক ধরে একটাই প্রশ্ন বার বার উত্থাপিত হচ্ছিল- বোমা কি আসলেই সাগরের উপর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল? নাকি কানাডিয়ান জঙ্গলের বুকে হারিয়ে গিয়েছিল?
জাপানে পারমাণবিক বোমা ফেলার পাঁচ বছর পর, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা চাইছিল পারমাণবিক যুদ্ধের নতুন যুগে প্রবেশ করতে। কনভেয়ার বি-৩৬ ‘পীসমেকার’ ছিল সর্বপ্রথম ইন্টারকন্টিনেন্টাল বোম্বার, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে পারমাণবিক বোমা বহন করবার ক্ষমতা ছিল এটির। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক এয়ার কমান্ড (এসএসি) চাইছিল বোমাসহ নতুন প্লেনগুলো বাজিয়ে দেখতে।
পরীক্ষামূলক বোম্বিং-এর বারোটা বাজল যেভাবে
বেশ কয়েক মাস ধরে তদবির-টদবির আর অনুরোধের পর এসএসি’র কর্তারা দেশের অ্যাটমিক কমিশনের কাছ থেকে একটা মার্ক ফোর বোমা ধার নেয়। অবশ্য বোমা থেকে প্লুটোনিয়াম কোর আগেই সরিয়ে রাখা হয়েছিল। তবে বোমায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইউরেনিয়াম আর কনভেনশনাল বিস্ফোরক ছিল তখনও। তবে ভয়াবহ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাবার ক্ষমতা ছিল না বোমাটার।
দিনটি ছিল ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি ১৩। ফ্লাইট ২০৭৫ নামের একটা বি-৩৬ বোম্বার ফেয়ারব্যাংক্স, আলাস্কায় অবস্থিত এইলসন এয়ার ফোর্স বেজ থেকে উড়াল দেয়। ক্রু হিসেবে ছিল মোটমাট ১৭ জন। পরীক্ষামূলক ফ্লাইটটির উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় কোনো শহরে বোমা ফেলতে হলে কীভাবে কী করতে হবে তা যাচাই করে দেখা। বি-৩৬ এর যাত্রাটা ছিল ৫,৫০০ মাইলের; আলাস্কা থেকে মন্টানা হয়ে স্যান ফ্র্যান্সিস্কো। স্যান ফ্র্যান্সিস্কো-ই ছিল বোমা বর্ষণের কাল্পনিক লক্ষ্যস্থল। নকল বোমাবাজি করে বি-৩৬ অবতরণ করবে টেক্সাসের কার্সওয়েল এয়ার বেজে।
তবে পরিকল্পনা মোতাবেক চলল না সবকিছু। উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই বোম্বারের ফিউসিলাজে বরফ জমাট বাঁধতে শুরু করল, বরফের বাড়তি ওজন সামলাতে গিয়ে ইঞ্জিন হিমশিম খেতে লাগল। বি-৩৬ প্রতি মিনিটে ৫০০ ফিট করে নেমে যাচ্ছিল।
চাচা আপন প্রাণ বাঁচা
ক্যাপ্টেন হ্যারোল্ড ব্যারি আর তার ক্রু’রা খুব দ্রুত কাজে নেমে পড়ল। মিলিটারি প্রটোকল অনুযায়ী তাদের প্রথম কাজ ছিল পারমাণবিক বোমা কিংবা বোমার যন্ত্রাংশ যেন শত্রুদের হাতে গিয়ে না পড়ে সে ব্যবস্থা নেয়া। সে জন্য তাদের হাতে একটাই উপায় ছিল- বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়া। কিন্তু যখন ব্যারি’র কো-পাইলট ‘’স্যালভো” বাটনে চাপ দিল বোমা অবমুক্ত করার জন্য, কিছুই ঘটল না। আতঙ্কিত কো-পাইলট আবার চাপ দিল, এবার মার্ক ফোর বে ডোর দিয়ে পিছলে নেমে গেল, রওনা দিল প্রশান্ত মহাসাগরের উদ্দেশ্যে।
ক্রু’দের রিপোর্ট অনুযায়ী সাগরের উপরেই বোমাটা বিস্ফোরিত হয়েছিল।
প্রটোকল ফলো করবার পরপরই ব্যারি মাটিতে আছড়ে পড়তে যাওয়া প্লেনকে অটো পাইলটে দিয়ে সাগরমুখী কোর্স সেট করে দেন। তারপর তিনি আর তার দলবল ঝাঁপ দেন প্লেন থেকে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার উপকূলে অবস্থিত প্রিন্সেস রয়াল আইল্যান্ডের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় প্যারাশুটিস্টরা। ওদিকে পরিত্যক্ত বিমানটা আরও ২০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়, কোর্স থেকে সরে গিয়ে আছড়ে পড়ে গভীর জঙ্গলে অবস্থিত মাউন্ট কোলোগেট-এ।
নিখোঁজ হল বোমা আর বিস্ফোরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রু
তাৎক্ষনিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডিয়ান মিলিটারির একটা যৌথ ফোর্স বিশাল আকারে সার্চ-অ্যান্ড-রেসকিউ মিশনে নেমে পড়ে। জমাট বাঁধা উপকূলবর্তী অঞ্চলে খোঁজাখুঁজিতে সাহায্য করতে অংশ নেয় ৪০টি এয়ারক্রাফটও। তাদের সম্মিলিত প্রাণান্তকর চেষ্টার বদৌলতে ১২ জন ক্রু’কে জ্যান্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। এদের একজন গোড়ালি ভাঙা অবস্থায় গাছের মাথায় প্যারাশুট আটকে উল্টো হয়ে লটকে ছিল। কিন্তু বাকি পাঁচজন ক্রু’কে খুঁজে পাওয়া গেল না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে দলের ওয়েপনিয়ার (পারমাণবিক বোমা অ্যাক্টিভেট করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি) ক্যাপ্টেন থিওডোর শ্রেইয়ারও ছিলেন।
ইউএস মিলিটারি উদ্ধারকৃত ক্রু’দের প্রত্যেকের জবানবন্দী নেয়, আর তাদের সবাই ক্যাপ্টেন ব্যারির বক্তব্যকে সমর্থন জানায় এক বাক্যে- বিমান বিধ্বস্ত হবার আগেই মার্ক ফোর নিরাপদ ভাবে বিস্ফোরিত করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে, খোঁজাখুঁজি চলতে থাকে, কারণ ফ্লাইট ২০৭৫ এর ভগ্নাবশেষ উদ্ধারই ছিল ক্রু’দের কথা যাচাই করে দেখবার একমাত্র রাস্তা।
হাজার চেষ্টার পরও ইউএস এয়ার ফোর্সের দলটি ডুবে যাওয়া প্লেনের নাম-নিশানাও খুঁজে পেল না। তারা অনুমান করে নিল প্লেনটি প্রশান্ত মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু তিন বছর পর, একটা কানাডিয়ান সার্চ পার্টি প্লেনের ভগ্নাবশেষ খুঁজে পায় মাউন্ট কোলোগেটের চূড়ায়। দলটি তখন এক নিখোঁজ তেল সন্ধানকারীকে খুঁজছিল।
এরপর এয়ার ফোর্স আরও তিন-তিন বার লোক পাঠায় দুর্গম পাহাড় থেকে প্লেনের দেহাবশেষ উদ্ধার করবার জন্য। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাদের আশাহত হতে হয়। প্রতিকূল আবহাওয়া আর ভয়ঙ্কর রকমের দুর্গম অঞ্চল ঠেকিয়ে দেয় তাদের অভিযান। অবশেষে, ১৯৫৪ সালে একটা ছোট ডেমোলিশন ক্রু’র দল বি-৩৬ পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়, মূল্যবান ও গোপন যন্ত্রপাতির অবশিষ্ট ধ্বংস করে ফেলে তারা।
হারানো বোমাকে ঘিরে গড়ে উঠে অসংখ্য গুজব
ডেমোলিশন ক্রু’দের রিপোর্ট ছিল টপ সিক্রেট, হারিয়ে ফেলা আণবিক বোমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যই দিনের আলোর মুখ দেখেনি। ভগ্নাবশেষে কি এমন কোনো সূত্র ছিল যেটা দেখে বোঝা যায় যে আছড়ে পড়বার আগে আসলেই বোমাটা নিক্ষেপ করা হয়েছিল কি না? শক্ত যুক্তিপ্রমাণের অভাবে নানা ধরণের গুজব ভেসে বেড়াতে শুরু করে বাতাসে। কী ঘটেছিল মার্ক ফোরের কপালে? আর এতসব জল্পনা-কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সেই ক্যাপ্টেন শ্রেইয়ার, নিখোঁজ ওয়েপনিয়ার।
কয়েকটি অনির্ভরযোগ্য সূত্র অনুযায়ী একাধিক অনুমান করা যায় বোমার ভাগ্যে আসলে কী হয়েছিল। প্রথমত, একটা গুজব ছিল যে মাউন্ট কোলোগেটের চূড়ায় একজনের দেহাবশেষ পাওয়া গিয়েছিলে। সেই লাশ যদি শ্রেইয়ারেরই হয় তাহলে? ওয়েপনিয়ার একজন প্রাক্তন এয়ারলাইন পাইলট ছিলেন, তিনি হয়তো প্লেনটাকে আলাস্কায় ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করছিলেন, যেখানে বাকি সবাই নিজের প্রাণ বাঁচানোতেই ব্যস্ত ছিল।
কন্সপিরেসি থিওরির জ্বলন্ত উনুনে তেল ঢালে আরেকটা দাবি। সেটা হচ্ছে- প্যারাশুটে ঝুলন্ত অবস্থায় ক্যাপ্টেন ব্যারি নাকি নিজে দেখেছেন যে প্লেনটা ডান দিকে তীক্ষ্ণ মোড় নিচ্ছে। গল্পটা আরও ডালপালা মেলতে শুরু করে। বোমাটা নাকি প্লেন থেকে খসেই পড়েনি, শ্রেইয়ার বোম্বারটাকে নিরাপদে এয়ার ফোর্স বেজে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।
তবে সেনাবাহিনী কোনো গুজবকেই আমল দেয়নি। পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীতে বহু পর্যটক আর নবীন গোয়েন্দা চেষ্টা করেছে ফ্লাইট ২০৭৫ এর ধ্বংসাবশেষ নিজ চোখে দেখবার। উদ্ঘাটন করতে চেয়েছে বি-৩৬ এর রহস্যের।
অদ্ভুত আবিষ্কার
২০০৩ সালে জন ক্লিয়ার ওয়াটারের নেতৃত্বে একটা দল ক্র্যাশ সাইটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দলটি গঠিত হয়েছিল কানাডার পারমাণবিক কার্যক্রম ও হারানো পারমাণবিক বোমার ইতিহাস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে। তাদের লক্ষ্য ছিল নিজ চোখে দেখে নিশ্চিত হওয়া। প্রথমে দেখে তাদের মনে হয়েছিল ১৯৫৪ সালের ডেমোলিশন ক্রু’রা ধ্বংস করতে কিছু বাকি রাখেনি। কিংবা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আসতে থাকা চোরা স্বভাবের পর্যটক আর অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীদের কবলে পড়ে কিছুই পাওয়া যাবে না।
আর ঠিক তখুনই তারা একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে।
ডেমোলিশন ক্রু’রা মোটামুটি সবই গুঁড়ো করে ফেললেও বোম্ব বে’তে বোমা আটকে রাখার শেকল (বম্ব শ্যাকল)- যেটা দিয়ে প্লেনে বোমা আটকে রাখা হয়- সেটা বিস্ময়কর ভাবে অক্ষত আছে। ক্লিয়ারওয়াটার আর তার দল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে- যদি বোমাটা প্লেনের সাথেই আছড়ে পড়ে থাকে, আর যেহেতু বম্ব শ্যাকল এরকম বহাল তবিয়তেই আছে তবে ভাঙাচোরার মাঝে বোমার টুকরো-টাকরা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তা ছিল না।
প্রচলিত ব্যাখ্যাটাই হয়তো সত্যি ছিল- বিস্ফোরিত মার্ক ফোরের অবশিষ্টাংশ আশ্রয় নিয়েছে সাগরের বুকে। আর এভাবেই সূচনা ঘটে আমেরিকার ইতিহাসের প্রথম ব্রোকেন অ্যারো’র।
হতে পারে ফ্লাইট ২০৭৫ এর আছড়ে পড়াটা ছিল প্রথম ব্রোকেন অ্যারো। কিন্তু শেষ না। ক্লিয়ারওয়াটার লেখেন যে, পারমাণবিক যুগে প্রবেশের প্রথম ২৪ বছরেই আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন- দুই রাষ্ট্র মিলে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় হারিয়েছে কিংবা বাধ্য হয়ে ফেলে দিয়েছে ২৩টি পারমাণবিক বোমা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:১৭