আলাস্কার পশ্চিম থেকে গ্রিনল্যান্ডের পূর্ব পর্যন্ত পুরো এলাকাটা দখল করে রেখেছে সমুদ্র। বরফে ঢাকা বিশাল এই এলাকা জুড়ে ইনুইট (ইন-উ-আত্) জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। গাছপালা জন্মায় না সেখানে, কেবলমাত্র কঠিন সহ্য ক্ষমতার অধিকারী মানুষ আর প্রাণীই এই দুর্গম জায়গায় টিকে থাকতে পারে।
বর্তমানে উত্তর আমেরিকার অন্তর্গত সুমেরু বাসীদের এস্কিমো’র বদলে ইনুইট ডাকা হয়।
পৃথিবীর উত্তর অংশটা দখল করে রেখেছে উত্তরমেরু বা আর্কটিক এবং এই আর্কটিক তিন মহাদেশজুড়ে বিস্তৃত। উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, আর আর ইউরোপ। আর্কটিকে ভূমি বা জমির পরিমাণ মোট জায়গার তিন ভাগের এক ভাগেরও কম, বাকিটা আছে উত্তর মহাসাগরের জিম্মায়। উত্তর আমেরিকার আর্কটিকে হাজার বছর ধরে বাস করে আসছে ইনুইটরা। এরা আসলে একদম প্রথম দিকের সাইবেরিয়ান মানুষদের বংশধর। নেটিভ আমেরিকানদের তুলনায় পৃথিবীর সাথে এদের পরিচয় হয় অনেক দেরিতে। বেরিং প্রণালী পার হওয়ার পরে তারা উত্তর আমেরিকার আর্কটিকে স্থায়ী হয়, সেই সাথে গড়ে তোলে নিজেদের এক অনন্য সংস্কৃতি। এর আগে সাইবেরিয়া এবং চীন থেকে যেসব অভিবাসী এসেছিল, তাদের অনেকে উত্তর আমেরিকার অভ্যন্তরে স্থায়ী হয়, কেউ যায় আরও দক্ষিণে। যেখানে অবস্থিত দক্ষিণ আমেরিকা।
আর্কটিক সার্কেলের উপরে সূর্যের আলো কখনও সরাসরি পড়ে না। প্রতি বছর যে বরফ গলে, তার পরিমাণও অত্যন্ত নগন্য। ফলে ভূ-গর্ভস্থ বরফের পরিমাণের হেরফের হয় না তেমন একটা। দক্ষিণ আর্কটিকে শীত থাকে বছরের ছয় মাস, বাকি ছয় মাস চলে বসন্ত, গ্রীষ্ম আর শরতের রাজত্ব। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সূর্য থাকে দিগন্তরেখার নিচে, আর্কটিক সে সময় ঢাকা থাকে গাঢ় অন্ধকারে। শীতের সময় আর্কটিকের বেশিরভাগ জায়গাতেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা থাকে, জানুয়ারিতে গড় তাপমাত্রা হয় মাইনাস ৩০ ডিগ্রী ফারেনহাইট থেকে মাইনাস ১৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। উত্তরে যদি কেউ ভ্রমণ করে, শীতের স্থায়িত্ব বাড়তে থাকে ক্রমশ। আর্কটিকের একদম উত্তরে শীত স্থায়িত্বকাল সেপ্টেম্বর থেকে জুন, টানা নয় মাস।
ধর্ম ও পুরাণ
১৫০০ শতাব্দীর দিকে ইউরোপীয়ানদের সংস্পর্শে আসার সময় থেকে ইনুইটরা প্রাথমিক ধর্মীয় বিশ্বাস ধারণ করত আর ইউরোপীয়ানদের মতোই প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগাত। সে সময় কোনমতে টিকে থাকাটাই মুখ্য ছিল, অনাহারে থাকার আতঙ্ক বিরাজ করত প্রায় সময়ই। এক বা একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা তাদের পূজা করার ধারণা ইনুইটদের কাছে অপরিচিত ছিল। তারা বিশ্বাস করত, প্রকৃতিই তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। প্রাকৃতিক শক্তিই তাদের আর বাকি দুনিয়ার মানুষের চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্য রক্ষা করে।
গ্রিনল্যান্ড আর কানাডার ইনুইটদের কাছে সৃষ্টি সম্পর্কে কোনো পুরাণের কথা শোনা যায়নি। আলাস্কার মানুষ বিশ্বাস করত র্যাভেন বা দাঁড়কাক-ই হচ্ছে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। আলাস্কায় প্রচলিত দাঁড়কাক সম্পর্কিত গল্পের সাথে নেটিভ আমেরিকান দাঁড়কাকের গল্পের মিল পাওয়া যায়। অন্যদিকে কানাডা আর গ্রিনল্যান্ডে পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কিত কিছু সাদামাটা ধরণের পুরাণ চলে এসেছে মানুষের মুখে মুখে। তবে দাঁড়কাকের গল্পের সাথে কোনো মিল নেই সেসব পুরাণের।
গ্রিনল্যান্ড আর কানাডার ইনুইটদের পুরাণের উৎপত্তির সময় সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনো ধারণা নেই। মানুষের জন্ম হবার আগে পশুপাখিরা মানুষের মতোই কথা বলত কিংবা আচরণ করত- এমনটা দেখা যায়নি তাদের গল্পে। এর থেকেই বোঝা যায় যে পুরাণের গল্প ছিল খুব কম। অবশ্য একটা গল্প আছে সেডনা; সমুদ্রের সমস্ত প্রাণীর জন্মদাত্রীকে নিয়ে। কানাডা আর গ্রিনল্যান্ড জুড়ে সেডনার গল্পের নানান রূপ প্রচলিত আছে, সেটা এতই বেশি যে অন্য কোনো গল্প না থাকাতেও পুষিয়ে গেছে এক সেডনা’র কাহিনী দিয়েই।
আরেকটা জনপ্রিয় গ্রিনল্যান্ড/কানাডীয় গল্প আছে চন্দ্র আর সূর্যের উৎপত্তি নিয়ে। গল্পটা দুই ভাই-বোনের। তারা বাড়ির বাইরে সারাক্ষণ মশাল হাতে একে অন্যকে তাড়া করে বেড়াত। মেয়েটার হাতে থাকতো উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত মশাল আর ছেলেটার হাতে নিভু নিভু আলো। ভাই আর বোন আকাশে জায়গা করে নেয় একসময়। তারপর মেয়েটা সূর্য আর ছেলেটা চাঁদের রূপ ধারণ করে।
আর্কটিকবাসীদের মুখে ট্রান্সফরমার বা দেহ রূপান্তরকারী; যারা বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে সক্ষম এমন কোনো চরিত্রের গল্প শোনা যায়নি। আলাস্কায় শুধু নায়ক চরিত্রে সেই দাঁড়কাকের গল্পই প্রচলিত।
ইনুইটরা বিশ্বাস করত প্রতিটি প্রাণীরই নিজস্ব আত্মা রয়েছে। সেই আত্মা তাদের দৈহিক শক্তি আর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রভাবিত করে, এমনকি শারীরিক অবয়বও এই আত্মার উপর নির্ভর করে। কেউ মারা গেলে তাদের দেহের আত্মা তারায় আশ্রয় নেয় আর স্পিরিট বা সাহায্যকারী আত্মায় পরিণত হয়। অন্যদিকে, পশু-পাখি মারা গেলে তাদের আত্মা পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে বিরাজ করে।
নিত্যজীবনে ইনুইটরা স্পিরিট বা আত্মাদের ব্যাপারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম মেনে চলত। প্রাণী শিকার করা ও পশুর মৃতদেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে নির্দিষ্ট বাধা-নিষেধ ছিল। ইনুইটরা স্পিরিটদের সম্মানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করত। দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারে, এমন কোনো আচরণ প্রদর্শন করা একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং পরিবহন ব্যবস্থা
ইনুইটরা বছরের একটা সময় থাকত শীতকালে বসবাসের উপযোগী বাড়িতে, আর বাকি সময়টুকু কাটাত গ্রীষ্মকালীন বাড়িতে। গ্রিনল্যান্ড আর কানাডায় ইনুইটরা ইগলু বা বরফের চাঁই দিয়ে বানানো বাড়িতে থাকত। সেসব বাড়ি তৈরি করা হতো জমাট বাঁধা সাগরের উপর। আবার অনেকে শীতকালে মূলভূমিতে অবস্থিত পাথরের তৈরি বাড়িতে বাস করত। আলাস্কার ইনুইটরা থাকত মাটি খুঁড়ে বানানো আংশিক ভূ-গর্ভস্থ বাড়িতে।
আর্কটিক জুড়ে ইনুইটদের বাড়ির ভিতরে মাটি থেকে উঁচু কাঠ বা পাথরের প্লাটফর্ম দেখা যেত। প্লাটফর্মগুলো দেয়াল ঘেঁষে বানানো হতো। বাসার সবার বসা বা শোয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো এটি। ঠাণ্ডা মেঝে থেকে বাঁচার চমৎকার একটি ব্যবস্থা এই প্লাটফর্ম। বলগা হরিণ কিংবা সীলের চামড়া দিয়ে প্লাটফর্মগুলো ঢেকে রাখা হতো। আর এই বেঞ্চসদৃশ প্লাটফর্ম পরিবারে যার যার অংশ আলাদা থাকে, কার কোন অংশ সেটা বোঝানোর জন্য লণ্ঠন রেখে দেয়া হতো সেখানে।
মাংস রাখা হতো বাড়ির বাইরের ছাউনিতে, কিংবা কাঠ দিয়ে বানানো তাকে। এই তাকগুলো ক্ষুধার্ত প্রাণীদের নাগালের বাইরে থাকত। পরিবার সাধারণত গঠিত হতো বাবা-মা আর এক-দু’টো সন্তানকে ঘিরেই। অবশ্য দাদা-দাদি কিংবা অবিবাহিত ভাই-বোনও থাকলে তাদের সাথেই বাস করত বাকিরা। বিয়ে হবার পর মেয়েরা শ্বশুর-শ্বাশুড়ির বাড়িতে গিয়ে উঠত। যার কারণ হচ্ছে পুরুষরা তাদের পারিবারিক শিকারের এলাকা ছেড়ে আসে না। এজন্যই নবদম্পতির মধ্যে নতুন জায়গায় গিয়ে আলাদা বাস করার প্রচলন নেই ইনুইটদের মাঝে।
ইনুইটরা গ্রীষ্মকালীন শেল্টার বানাত। এই শেল্টার গুলোর কাঠামো তৈরি করা হতো কাঠ কিংবা তিমির হাড় দিয়ে। কাঠামোটি সীল কিংবা বলগা হরিণের চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। শিকারে বেরিয়ে বিশ্রামের জন্য এই শেল্টার গুলো বেশ কাজে দিত ইনুইট পুরুষদের।
পুরুষরা শিকার করত কায়াকে চড়ে। কায়াক হচ্ছে একধরণের লম্বা, সরু নৌকা। যাত্রী বহন করার সুবিধা নেই এতে, স্রেফ একজনের উপযোগী করে বানানো হতো। নৌকার ফ্রেম তৈরি হতো কাঠ কিংবা তিমির হাড় দিয়ে। আর নৌকা সীলের চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হতো। অন্যদিকে, পরিবারের সদস্যদের যাতায়াত কিংবা রসদপত্র বহনের জন্য ব্যবহৃত হতো উমিয়াক। উমিয়াকের গঠনশৈলী কায়াকের মতোই, কিন্তু আকারে গোল আর সীলের বদলে ব্যবহৃত হয় সিন্ধুঘোটকের চামড়া।
কুকুরটানা স্লেজ গাড়ি রসদপত্র বহনের কাজে ব্যবহার করা হতো। তবে মাঝে মাঝে শিশু কিংবা বয়স্কদের টানার কাজেও স্লেজ গাড়ি ব্যবহৃত হতো। গাড়ির কাঠামো তিমির হাড় দিয়ে বানানো হতো, সীট থাকত বলগা হরিণের চামড়ায় মোড়ানো। খুব অল্প সংখ্যক পরিবারই একটার বেশি কুকুর পালত। কারণ বেশি সংখ্যক কুকুরের খাবারের বন্দোবস্ত করাটা বেশ দুঃসাধ্য। অনেক সময় দেখা যেত কুকুরের জায়গায় পরিবারের শক্ত-সমর্থ নারী বা পুরুষরাই স্লেজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ইনুইটরা হাড়, হরিণের শিং, সিন্ধুঘোটকের দাঁত দিয়ে ডার্ট, হারপুন, বর্শা তৈরি করে। ইনুইট মহিলারা সোপ স্টোন নামক এক ধরণের নরম পাথর খোদাই করে দরকারি তৈজসপত্র- রান্নার হাঁড়ি, বোল, নানারকম পাত্র বানাত। সীল আর সিন্ধুঘোটকের চামড়ার নিচে অবস্থিত চর্বি ব্যবহার করা হতো জ্বালানি হিসেবে। সোপ স্টোন থেকে তৈরি প্রদীপ জ্বালাতে বেশ কাজে দেয় এই চর্বি। তাছাড়া ধোঁয়া উঠে না বলে রান্না-বান্না, আলো জ্বালানো আর ঘর গরম করার কাজেও এই চর্বি চমৎকার জ্বালানির উৎস হিসেবে সমাদৃত।
সীলের নাড়িভুঁড়ি দিয়ে বানানো কাপড় হাল্কা আর পানিরোধক হয়। তবে গরম কাপড়- অ্যানারোক (পার্কা) আর প্যান্ট তৈরি হয় বলগা হরিণের পশম থেকে। শীত নিরোধক হিসেবে পশম দারুণ কার্যকর। তাছাড়া সীলের চামড়া দিয়ে বানানো বুট বেশ টেকসই হয়। পাখির হাড় দিয়ে সুঁই হয়, সুতোর যোগান আসে বলগা হরিণের লম্বা টেনডন থেকে।
ইনুইট স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে ছাড়া থাকতেই পারত না। সংসারে দু’জনের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পুরুষরা শিকারে গেলে নারীরা মন দিত রান্নায়, শিকার থেকে চর্বি ছাড়ানোয়, চামড়া সেলাই কিংবা সন্তানের যত্নআত্তিতে। পরিবার কিংবা সমাজ, যেটাই হোক না কেন; তারা পুরুষ শিকারীদের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল। ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়ে শিশুদের কদর ছিল না, অনেক সময় জন্মের পরপরই মেয়ে শিশুদের মেরে ফেলা হতো। যে কারণে ইনুইট সমাজে নারীর অনুপাতে পুরুষ সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। উপযুক্ত স্ত্রী পাওয়াটা খুবই কঠিন ছিল এ অবস্থায়। স্ত্রীর দখল পাবার জন্য অনেক সময় পুরুষরা একে অন্যকে খুন করত। স্ত্রীদের বিনিময় করা কিংবা ছিনিয়ে নেয়াটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ হিসেবে যে তাদেরও আবেগ-অনুভূতি আছে, সেসবের থোড়াই কেয়ার করত পুরুষরা।
তবে যার সাথেই বসবাস করুক না কেনো, ইনুইট নারীদের কাজ-কর্মে পরিবর্তন আসতো না। জীবন ধারণ করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হলেও ঘরে হাসি-আনন্দের অভাব থাকত না। ইনুইটরা সন্তানদের গভীর ভালোবাসতো, সুযোগ পেলেই জড়িয়ে ধরত কিংবা খেলাধুলা করত। ছেলেরা কিশোর বয়সেই শিকারে যাওয়া শুরু করত, আর বিশে পা দেবার আগেই বিয়ে। কিংবা খাবার জোগাড় করার সামর্থ্য হলেই জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নিত। মেয়েদের বিয়ে সাধারণত চোদ্দ বছর বয়সেই দেয়া হতো।
পুরাণের উৎস
১৯৬০ সালের আগে ইনুইটদের লিখিত আকারে কোনো ভাষা ছিল না। সেসময়েই গ্রিনল্যান্ড, কানাডা আর আলাস্কার মানুষদের জন্য লিখন পদ্ধতি তৈরি করা হয়। তবে বহু মানুষ এখনও তাদের স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই ভাষার উৎপত্তি এস্কিমো-অ্যালিউট ভাষা হতে। আলাস্কার পূর্ব থেকে শুরু করে গ্রিনল্যান্ডের উত্তর আর্কটিক পর্যন্ত ইনুইটরা ইনুপিয়াক (যা নুনাভুট, কানাডায় ইনুকটিটুট আর গ্রিনল্যান্ডে কালালিসুট নামে পরিচিত) ভাষায় কথা বলে। আলাস্কার মানুষ ইনুপিয়াক আর ইউপিক- দুই ভাষাতেই কথা বলে। তবে এই দুই ভাষার প্রচলন থাকলেও ভাষা দুটো একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক আর বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইনুইটদের গল্পগাথা সংগ্রহ করা শুরু হয়। এই কাজে ব্যাপক অবদান রাখেন তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিঃ কনুড রাসমুসেন, হেনরি রিঙ্ক আর ফ্রাঞ্জ বোয়াস। তারা চেয়েছিলেন বৃদ্ধ গল্প-কথকরা মারা যাবার আগেই গল্পগুলোকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে। রাসমুসেন আর রিঙ্ক- দু’জনেই গ্রিনল্যান্ড আর কানাডা ভ্রমণ করে বহু পুরাণ সংগ্রহ করেছেন। বোয়াস লিপিবদ্ধ করেছেন পূর্ব কানাডার গল্প। আজ পর্যন্ত তাদের সংগ্রহ করা গল্প গুলোই আমরা জানি। রাসমুসেন লক্ষ্য করেন যে, ইনুইটদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ গল্প-বলিয়ে হচ্ছে বৃদ্ধ শামানরা। তাদের কেউ কেউ রাসমুসেনের নোটবুক আর পেন্সিল দেখে চমৎকৃত হতো। এক শামান রাসমুসেনের লেখা দেখে বলেছিল, “আপনার কথা অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে; আমরা যেভাবে হরিণের মাংস খাই ঠিক সেভাবে দূর দেশের মানুষরা আপনার কথার দাগকেও খায়।”
শীতের দিনে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘরের ভিতর অলস বসে থাকতে হতো মানুষকে। গল্প-কথকরা এই সময়টাকেই কাজে লাগিয়ে বর্ণনা করত দুঃসাহসিক অভিযানের কাহিনী। তারা অনেক সময় রাতের পর রাত ধরে একটানা গল্প বলে যেত। আবার ইচ্ছে হলে মাঝপথে থেমে যেত। তারপর পরের দিন আবার সেখান থেকেই শুরু করত কিচ্ছা বলা। একেক গল্প-কথক বর্ণনা করত একেক ঢঙে, যাতে করে গল্পটা হয়ে উঠে আরও আকর্ষণীয় এবং মুখরোচক। এক অভিযাত্রী লক্ষ্য করেছিলেন যে, “…কিছু গল্প বলা হয় গানের সুরে সুরে কিংবা ছন্দ মিলিয়ে। সেই সাথে গল্পের সাথে মানানসই অঙ্গভঙ্গি করা তো আছেই। কেউ কেউ নানা রকম পাখি আর বন্য প্রাণী ডাক নকল করেও শোনাত।”
ইউরোপীয়ানদের সংস্পর্শ ও পরিবর্তন
১৫০০ সালের শুরুর দিকে, গ্রিনল্যান্ড আর কানাডায় আসতে শুরু করে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা, প্রাচ্যে যাবার জন্য উত্তর-পশ্চিম দিয়ে একটা পথ খুঁজছিল তারা। শতশত বছর ধরে অভিযাত্রীরা ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন আকাঙ্ক্ষিত রাস্তার খোঁজে। দীর্ঘদিন পার হবার পর তারা বুঝতে পারেন যে প্রাচ্যে যাবার পথ এখানে নেই। এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, “নেভিগেশনের ইতিহাসে তখনই বড় মাপের ব্যর্থতা সংঘটিত হয়েছে, যখনই এস্কিমো আর পশ্চিমাদের দেখা হয়েছে।”
১৭০০ সালের প্রথম ভাগে ডেনমার্ক গ্রিনল্যান্ড আর পূর্ব আর্কটিকের দখল নিয়ে নেয়। পঞ্চাশ বছর পর পশ্চিম আর্কটিকে আলাস্কা অধিকৃত হয় রাশিয়ার দ্বারা।
নেটিভ আমেরিকান আর ইনুইটরা বেরিং প্রণালী পার হবার বেশ পরে আরেকটা দল প্রণালী পেরিয়ে আসে। তারা অ্যালিউট নামে পরিচিত। আমি অ্যালিউটদের এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছি যাতে তাদের ইতিহাস আর গল্পগাথা কালের গর্ভে হারিয়ে না যায়। অ্যালিউটদের পূর্বপুরুষরা উনাঙ্গান দ্বীপে বাস করত। উনাঙ্গান হচ্ছে অ্যালিউশিয়ান দ্বীপমালার অন্যতম একটি। এই দ্বীপগুলো আলাস্কা পেনিনসুলা থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। অ্যালিউটদের নিজস্ব ভাষা ছিল। তাদের সমাজে জাতভেদ কঠোর ভাবে মেনে চলা হতো, দল প্রধানকে সর্দার বলা হতো। আর সেই সর্দারদের অধীনে দাসও থাকত।
১৭০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি, অ্যালিউটদের মাঝে রাশান অভিযাত্রীরা পা রাখে। অ্যালিউটরা সাদরে বরণ করে নেয় তাদের। তবে খুব শীঘ্রই বহিরাগতদের দাপট শুরু হয় দ্বীপ জুড়ে, পশম ব্যবসার জন্য তারা অ্যালিউট পুরুষদের জোর করে শিকারে নামায়। রাশানদের অত্যাচারের সাথে সাথে স্মলপক্স আর ইনফ্লুয়েঞ্জার থাবায় অ্যালিউটদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে আসে।
১৮৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে এই অঞ্চলটি যা বর্তমান আলাস্কার অন্তর্ভুক্ত; কিনে নেয়। এই এলাকায় অ্যালিউশিয়ান দ্বীপগুলোও ছিল। তের বছর পর, ১৮৮০ সালে গ্রেট ব্রিটেন পূর্ব আর্কটিকের দ্বীপপুঞ্জের মালিকানা কানাডার কাছে হস্তান্তর করে।
১৯৭৭ সালে আর্কটিকবাসীদের মধ্যে এক চমৎকার ঐক্যতার উদাহরণ দেখা যায়। তারা গ্রেট ব্যারোস, কানাডায় অনুষ্ঠিত এক সার্কামপোলার কনফারেন্সে একত্রিত হয়। আর্কটিকের জনসাধারণ- পশ্চিমে আলাস্কা থেকে পূর্বে গ্রিনল্যান্ডবাসী সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এখন থেকে তারা এস্কিমো শব্দটির বদলে ইনুইট ব্যবহার করবে।
১৯৬০ সালে কানাডার সরকার নুনাভুট অঞ্চলকে অধীকৃত করে নেয়। ইনুকটিটুট ভাষায় নুনাভুট অর্থ হচ্ছে “আমাদের ভূমি।” ইনুইটরা বর্তমানে কানাডার সরকারি দপ্তরে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছে। ভবিষ্যতে বনজসম্পদ সংরক্ষণ ও পরিচর্যার দায়িত্বও তাদের উপর ন্যস্ত হবে। আর তখন নুনাভুটে শিকার আর মাছ ধরার অনুমতি মিলবে।
নুনাভুটে ইনুকটিটুটের প্রায় সাত ধরণের উপভাষা থাকলেও, কানাডায় বসবাসকারী ইনুইটরা গ্রিনল্যান্ডবাসী প্রতিবেশীদের সাথে কথা চালাচালি করতে কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয় না। কয়েক দিন বা সপ্তাহ শুনলেই আলাস্কান প্রতিবেশীদের মুখের ইউপিক-ও কব্জা করে ফেলতে পারে তারা। (গ্রিনল্যান্ডে, ইউরোপ আর ইনুইটদের মিশ্র রক্তের বাবা-মার সন্তানদের “গ্রিনল্যান্ডারস” বলে ডাকা হয়।)
বর্তমান
বর্তমানে ইনুইটরা কানাডিয়ান, আমেরিকান বা অন্যান্য ভিনদেশী নাগরিকদের মতোই জীবনযাপন করে। ঐতিহ্যবাহী ইনুইট জীবনধারা খুব অল্পই দেখা যায়।
সীল, তিমি আর সিন্ধুঘোটক শিকার করা এখনও গ্রিনল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় পেশা হিসেবে বিদ্যমান। (অবশ্য বর্তমানে শিকার চামড়া নয়, মাংসের জন্যই করা হয়) গ্রিনল্যান্ডে মৎস শিল্প জীবিকা নির্বাহের গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম। দ্বীপের সর্বদক্ষিণে গ্রিনল্যান্ডারদের অনেকেই ভেড়ার খামার দিয়েছে।
আলাস্কাতে মাছ ধরা অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে সমাদৃত। ট্যুরিজম, পেট্রোলিয়াম উত্তোলন আর মাইনিং-এর উন্নতির ফলে বহু স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। অবশ্য কেউ কেউ পুরনো পশু শিকার করে আর মাছ ধরেই জীবন চালিয়ে নিচ্ছে।
নারী-পুরুষরা সোপ স্টোনে ইনুইটদের ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন সমূহ খোদাই করে ফুটিয়ে তোলে। হাঁড়ি-পাতিল বানানোর জন্য অবশ্য এখন সোপ স্টোন ব্যবহৃত হয় না। তার বদলে ইনুইট শিল্পীরা পাথরে খোদাই করে নানান গিফট আইটেম তৈরি করে যার চাহিদা রয়েছে বিশ্বজুড়ে। পাথরে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয় পুরুষদের হারপুন ছুঁড়ে মাছ ধরার দৃশ্য, কায়াকে বসে থাকা শিকারী কিংবা অ্যানারোকের হুডে শিশুদের বসিয়ে রাখা নারী। সীল, তিমি, সিন্ধুঘোটক ইত্যাদি প্রাণীর ছবিও ফুটিয়ে তোলে দক্ষ শিল্পীরা। আর্কটিকের এসব প্রাণী আর মানুষের ছবি মনে করিয়ে দেয় ইনুইটদের সমৃদ্ধশালী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা।
বাপ-দাদার ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছে খুব কমই ইনুইটই। এখন তারা ছোট ছোট শহরে বাস করে, যার বেশির ভাগের অবস্থান সুমেরুর দক্ষিণাঞ্চলে। ইনুইটদের ঐতিহ্যবাহী বাড়ির জায়গা দখল করেছে কাঠের তৈরি ঘর-বাড়ি। কুকুর টানা স্লেজের বদলে আধুনিক ইনুইটরা ব্যবহার করে স্নো-মোবাইল। তেলের প্রদীপের বদলে ইলেক্ট্রিক বাতি এসেছে, ঘর গরম করার জন্য সেন্ট্রাল হিটিং সিস্টেমও ব্যবহৃত হয়। আমদানিকৃত খাদ্য দিয়েই চাহিদা মেটানো হয় আর বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ একটা মাধ্যম হচ্ছে টেলিভিশন।
বর্তমান সময়ে, ইনুইট শিশুরা তাদের ভাষা আর আচার-আচরণ শেখে স্কুলে। শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে গল্প বলা এখনও একটা গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। পুরনো আমলের গল্পকে জিইয়ে রেখে আমরা আর্কটিকের ইতিহাসকে স্মরণ করে চলেছি
উৎস
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ গুগল
তথ্যঃ ইভলিন ওলফসন রচিত "ইনুইট মিথলজি" (আদী প্রকাশন হতে প্রকাশিতব্য)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১৯ রাত ২:১৮