হামা ভাই অথবা হাসান মাহবুব ভাই,
আপনার ‘মন্মথের মেলানকোলিয়া’ কিতাবখানা আরও আগেই পাঠ করেছি। একখানা রিভিউ লেখার কথা ভেবে চুপ মেরে ছিলাম। নিঃস্পৃহতা নয়, অপারগতা। আলস্য আমাকে এগুতে দেয় না মোটেই। এমন আত্মবিধ্বংসী প্রণয় ঈশ্বরের কাছে চাইনি আমি। শেষমেশ প্রেমিককে উপেক্ষা করে বসেই গেলাম। রিভিউ কিভাবে লিখতে হয়, লিখতে গিয়ে কোন কোন বিষয়ে আলোকপাত করতে হয়, কিংবা রিভিউ লেখার আদৌ কোন নিয়ম আছে কিনা, এসব আমি জানি না। বই রিভিউ আমি লিখি না সচরাচর। সমালোচনা তো দূর অস্ত। ‘এভাবে’ লিখলে ভালো হত, সেকথা আমি বলব না। কেননা- লেখক আপন ভুবনে এবং সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। কাজেই, এখানে আমি যা যা লিখব, সেসব নিতান্ত একজন পাঠক হিসেবেই আমার ভালো লাগা বা মন্দ লাগা।
আপনার উপন্যাসের কাহিনী অগ্রসর হয়েছে দুটো আলাদা রেখায়, সমান্তরালে। সমান্তরাল রেখা তো মেলে না কোথাও। কিন্তু এটা যেহেতু উপন্যাস, কোথাও না কোথাও মিলবে, মেলাতে হবে; কিন্তু কিভাবে মেলে বা আপনি মেলান, উপন্যাসটা পড়ে গিয়েছি মূলত সেই কৌতূহল থেকে। ত্রিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ছিল ধীর, সেখান থেকে পঞ্চাশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মোটামুটি চলমান আর পঞ্চাশ পৃষ্ঠার পর পড়েছি টানা। মাঝে মাঝে আপনি এত দীর্ঘ বাক্য লিখেছেন যে, কাব্যসুষমামন্ডিত হলেও গতিময়তা ব্যহত হচ্ছিল কিছুটা। সেরকম একটা বাক্য এখন মনে পড়ছে--
“এরিকা প্রসঙ্গে সবার কথোপকথনে গভীরতার অভাবের অনুযোগ তুলে সে যখন তৃপ্তিভরে তার জ্ঞান ত্যাগ করে উত্থিত ফ্ল্যাশিজমের অধিকার আদায় করে নিয়ে নিজের রাগ মোচন করছিল, তখন অন্য অনেকের মতো এরিকা...না, কাজলীও মুগ্ধ নয়নে চেয়ে ছিল তার দিকে।”
‘কাজলী’ নামের একটি মেয়ে, যে কিনা একা, ভঙ্গুর আর নিজেরই একাকীত্বের গ্লানির বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রামশীল এবং বিট্টু নামের একটি কুকুর, যার মনিবও ঠিক কাজলীরই মতো একলা এবং বেদনাগ্রস্ত, এই দু’জনই মূলত উপন্যাসের দুই প্রধান চরিত্র। কাহিনী এগিয়েছে সমান্তরালে, আবার পড়তে পড়তে দেখা গেল, ঠিক সমান্তরাল নয় তো, তারা তো একসাথেই আছে। মানব জীবন আর পশু জীবন কখনো কখনো একই রকম, সেটা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন আপনি। একটা সময় কিন্তু কাজলী, বিট্টু এবং বিট্টুর মনিব মিরু তিনজনই একই সরলরেখায় এসে দাঁড়ায়।
কাজলীর মানসিক ভারসাম্যহীনতা হলো কেন? নিজের জীবনের অভাব-অনুযোগ-আকাঙ্ক্ষা থেকেই মূহুর্তেকের একটা ঘটনার সাক্ষী হয়েই এতো বেশি আক্রান্ত হলো হয়তো। আবার, বাবার প্রতারণা, জন্ম-স্বীকৃতি না পাওয়া মিরুও মূলত ভালোবাসাপ্রবণ একলা কিশোর। বিট্টুকে মানবিক গুণে গুণান্বিত করার, ভালো বাবা করে তুলতে চাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা মূলত পিতার প্রতি তার প্রতিশোধ স্পৃহা থেকেই উৎসারিত। কাজলী, মিরু, বিট্টু --এক সময় দেখি, সকলেই একা। প্রশ্ন জাগছিল, আপনি কি আসলে একটা একাকীত্বের গল্পই বলতে চেয়েছেন? উপন্যাসের উপসংহারে গিয়ে আমার প্রশ্নেরও সংহার হলো। না, আপনি আসলে একটি ভালোবাসার গল্পও বলেছেন। মিরু নামক ছেলেটির তার কুকুরের জন্য নিখাদ ভালোবাসা, কিংবা কুকুরটির ভালোবাসা তার সঙ্গিনী আর ছানাদের জন্য-এসব থেকেই তা স্পষ্ট। কিন্তু হোঁচট খেতে হলো কাজলীর সিদ্ধান্তে। এমন কিছুর জন্য আমি সত্যিই প্রস্তুত ছিলাম না। পাঠকের প্রত্যাশা বা অনুমান ডিঙোনো লেখকের কৃতিত্বই বটে। তবু এই সমাপ্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে বিস্তর। কাল পরিক্রমায় অনেকের অনেক প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে হতে পারে। সেগুলোর জন্য আপনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত আছেন। তবে, যদি নিছক কাহিনীর নিরিখে বিচার করি, তবে এটা তেমন কিছুই নয়। কাজলীর মতো মানসিক ভারসাম্যহীন একটা মেয়ে যে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারে।
আরেকটু গভীরে যদি যাই? কাজলীর আসলে প্রয়োজন ছিল শুধু লম্বা একটা ছুটি। সেই ছুটি অফিস তাকে দেবে না। তো, সেও ছাড়ার পাত্রী নয়। সেই ছুটি ম্যানেজ করার জন্য সে নিল আবিশ্বাস্য এক সিদ্ধান্ত। শুধু একটি ছুটির জন্য একজন মানুষের এত বড় একটি সিদ্ধান্ত ভয়াবহ, যত অভিনবভাবেই সেই আয়োজন সে করুক না কেন। কিন্তু আমাদের প্রোটাগনিস্ট কাজলী অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। তার আছে কলমের প্রতিভা, সৃষ্টির তাড়না এবং সমূহ অস্থিরতা। (এখানে বলে রাখি, কাজলীর হঠাৎ নিজের লেখকসত্ত্বা আবিষ্কার করাটা উপভোগ করেছি বেশ) কাজলীকে স্পর্শ করে শব্দের মাধুর্য, তার কলম থেকে অবচেতনে নির্গত হয় আশীর্বাদের মতো বাক্যপুষ্প। সেই সত্ত্বাকে সে হারিয়ে যেতে দিতে চায় না। তার অন্তর্গত হাহাকার তাকে বাধ্য করে পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দিতে। অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা কাজলীর বিজ্ঞপ্তিও হয় একেবারেই অন্য অনেকের চেয়ে আলাদা। এমনই সেটা, প্রচুর সাড়া পায় কাজলী। অনেকেই উদগ্রীব হয় কাজলীর সঙ্গী হওয়ার জন্য। কিন্তু কাজলীর চোখে ধরা পড়ে তাদের লালসা। তাদের কাউকেই তার কাছে মহৎ বলে মনে হয় না। সঙ্গী হতে চাওয়া পুরুষদের কেউ কাজলীর জন্ম পরিচয়, শিক্ষা, পেশা, সামাজিক মর্যাদা কিছুই জানতে চায় না। জানতে চায় না তার ভেতরের মানুষটিকেও। মনে হতে পারে, শিক্ষা, পেশা, জন্ম পরিচয় এসব তো ক্ষুদ্র ব্যাপার, নিরর্থক সামাজিকতা। যারা এসব উপেক্ষা করে ব্যক্তিকে গ্রহণ করতে পারে, তারাই তো মহানুভব। কিন্তু সে সকল আলোচনা এবং সম্ভাবনার অবকাশ আপনি রাখেননি। শুধুমাত্র একটি বিজ্ঞপ্তির বিপরীতেই আপনি তুলে এনেছেন সেই লালসার ছবি। পুরুষ সম্প্রদায়ের একজন হয়ে এভাবে প্রকাশ করতে সাহস লাগে। আপনি সেই সাহস দেখিয়েছেন। ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু পুরুষদের এক অংশের ভোগপ্রবণ মানসিকতায় সমগ্র পুরুষ সম্প্রদায়ের ওপর কাজলীর এই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়াকে বড় বেশি সরল আর একপেশে লাগল, যেখানে আবার সে তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। তবে কিনা কাজলীর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ঐ নোংরা পুরুষদের প্রতি আপনার মেটাফোরিক অবজ্ঞাটা ছিল উপভোগ্য। কোন এক মহাজ্ঞানী সেদিন বলছিল, মানুষ নাকি প্রেম আর ভালোবাসার মতো বিষয়গুলো এনেছে যৌনতাকেই জাস্টিফাই করার জন্য। আপনি তাদের মুখেও ঝাঁটা দিয়েছেন।
পুরো উপন্যাসটা আপনি লিখেছেন আপনার ছোট গল্পের ঢঙে। কথোপকথন কম এবং অনেক বেশি বর্ণনামূলক। এটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। তবে, ছোট পরিসরের উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই স্টাইল উপভোগ্য হলেও, বড় পরিসরে এটা হয়ত ক্লান্তিকর লাগত। চরিত্র চিত্রন নিয়ে দুটো কথা বলি। মনে হলো, এই উপন্যাসে আপনার মনোযোগের সর্বোচ্চটা আপনি ব্যয় করেছেন বিট্টুর পেছনে। ওকে অনেক যত্ন করে তৈরি করেছেন আপনি। কুকুরদের জীবনাচরণ নিয়ে স্টাডি করেছেন বোঝাই যায়। সেই হিসেবে কাজলীকে একটু মলিন লেগেছে। উপন্যাসে মানুষ এবং মহাশক্তির যে সম্মেলন সেটা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সেখানে আপনি আপনার ব্যক্তিগত দর্শন প্রয়োগ করেছেন হয়তো। স্রষ্টাকে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য নিতে হয় তার সৃষ্টিরই। সেই সম্মেলনে দেবতা আর তার সৃষ্টিকুল মিলে নির্ধারণ করে কাজলীর ভবিষ্যত। গদ্যকার হাসান মাহবুবের পাশে কবি হাসান মাহবুব যথেষ্ট পরিমাণেই উপস্থিত এখানে।
কাজলীর বাস্তব থেকে কল্পনায় যাওয়া আবার কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসার অংশগুলোয় আমার প্রিয় সাহিত্যিকদের একজন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে পাওয়া যাচ্ছিল। তাতে অবশ্য আমি কিছু মনে করিনি। সচেতনে বা অবচেতনে প্রিয় কোন লেখকের লেখার ধরন-ধারণে প্রভাবিত হয়নি এমন লেখক খুঁজে পাওয়া কঠিনই। অবশ্য সচেতনেইবা বললাম কেন, প্রভাবিত মানুষ অবচেতনেই হয়। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে আপনি যে আপনার নিজস্ব গদ্যভঙ্গি তৈরি করেছেন, এটা প্রসন্ন করে আমাকে। হুমায়ূন আহমেদীয় বলয়ের বাইরে আছেন আপনি, এটা বেশ স্বস্তির কথা। আরও কী কী যেন বলবার ছিল, মনে পড়ছে না এখন। পরে মনে হলে আবার বলব।
শেষ অংশটুকু পাঠকের জন্য। মেলার দু-চারদিন আছে। যদি পরিচিত হতে চান কাজলীর সঙ্গে, যদি জানতে চান কী এমন অভিনব বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল কাজলী, যেটা পড়ে অনেক পুরুষ সাড়া দিয়েছিল কাজলীর আহ্বানে; কী এমন সিদ্ধান্ত কাজলী নিয়েছিল, যেটা ভেঙে দিতে পারে পাঠকের মানসিক প্রস্তুতি বা প্রত্যাশা, তবে বইটা আপনাকে পড়তে হবে। হয়ত নতুন কোনো উপলব্ধি, নতুন কোন প্রশ্ন পেলেও পেতে পারেন। বইটা পাবেন চৈতন্য প্রকাশনীর স্টলে। স্টল নং- ৬০৪-৬০৫। বইটা রকমারিতে অর্ডার করেও কেনা যাবে।
মন্মথের মেলানকোলিয়া
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:০৮