যত দিন যাচ্ছে ততোই যেন আলাউদ্দিনের ক্ষিধে আরও বেড়ে যাচ্ছে। বছর বছর তার সংসারে লোকজন বেড়েই চলেছে। তার উপর রোজগারপাতিও মন্দ। এখন এত ক্ষিধে পেলে চলবে কী করে?
মোশারফ মিয়ার দুই খানা সিএনজি ট্যাক্সির একটিতে সে ভাড়া খাটে। দৈনিক রোজগারের টাকা থেকে মোশারফ মিয়াকে তার দিয়ে দিতে হয় পাঁচশ’ টাকা। এই টাকা বাঁধা। রোজগার যেমনই হোক, পাঁচশ টাকাই দিতে হবে। পাঁচশ’ দিয়ে বাদবাকী যা থাকে তা আলাউদ্দিনের। সেই হিসেবে আলাউদ্দিন দৈনিক দুশো’ কি তিনশ’র বেশি টাকা নিতে পারে না। এই বামনীর চরে সিএনজি ট্যাক্সিতে চড়বে কে? লোকজন তিন-চার মাইল পথ স্বাচ্ছন্দেই হেঁটে পাড়ি দিতে পারে এখানে। অভ্যেস। তাই সস্তাতেই যাত্রী উঠাতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে অন্য এলাকা থেকে অচেনা লোক আসে। তখন তার ভালো আয় হয়। বিশ টাকার ভাড়া সে পঞ্চাশ টাকা বলে বসতে পারে। একেবারেই নতুন কেউ হলে আরও বেশি চাইতে পারে। তখন সোজা রাস্তা ফেলে যতটা সম্ভব ঘুরনো রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করে সে। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা একটা সুপারির কণা জিহ্বা দিয়ে খুঁচিয়ে বের করার চেষ্টা করতে করতে এরকম একজন যাত্রী পাওয়ার জন্য মনে মনে বহু প্রার্থনা করতে থাকে সে। কিন্তু, এরকম যাত্রী পাওয়া তো দূরের কথা, আজ এলাকার কাউকেও পাওয়া যায় না। দুপুর ঘনিয়ে আসার আগেই আলাউদ্দিনের ক্ষিধে পেয়ে যায়। সে একটা সস্তার বিড়ি কিনে টানতে থাকে। ক্ষিধেটা যদি কিছুটা মরে- এই আশায়। দুপুরে বাড়িতে যাবে খেতে। বউ শাক-পাতা যা কিছুই রান্না করুক না কেন, সোনামুখ করে খেয়ে আবার রাস্তায় নেমে পড়বে সে। বামনী বাজারে নতুন একটা ভাতের হোটেল হয়েছে। দুপুর হলে ভুর ভুর করে মাছ-গোশতের গন্ধ আসে। খুব ইচ্ছে থাকলেও আলাউদ্দিনের গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ার সাহস হয় না। বড় দুই ছেলে স্কুলে যায় তার। তাদের খাতা-কলম কেনার টাকা পেটে ঢুকানোর কোন মানে হয় না। কিন্তু এই যে দুপুরের আগেই ক্ষিধে পেয়ে যায় তার, এটার কোন সুরাহা হয় না। দোকানে ঝুলতে থাকা বনরুটি আর কলার দিকে তাকিয়ে পেটে পাক দিয়ে ওঠে আলাউদ্দিনের, কিন্তু সে কেনে না। সংসারে টাকাটা যত বেশি দিতে পারবে ততোই ভালো। পেটে ক্ষিধে নিয়ে বামনী বাজারের তেমুহনীতে ট্যাক্সির সীটে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকে সে। একবার কোনরকমে ঘুমিয়ে পড়তে পারলেই হল; যাবতীয় ক্ষিধে থেকে মুক্তি। যদিও পেটে ক্ষিধে থাকলে ঘুমও আসে না, এটাও সে জানে।
শীতের দুপুরের মৃদু রোদ একসময় কেমন করে যেন আলাউদ্দিনের ক্ষিধেকে পরাজিত করে ঘুম পাড়িয়ে দেয় তাকে। ঘুমের ভেতর ছাড়া ছাড়া বেশ কয়েকটা স্বপ্নও দেখে সে। সবই খানাপিনা বিষয়ক স্বপ্ন। একটা স্বপ্নে তার বউ আর ছেলে-মেয়েরাও আছে। বউয়ের পরনে একটা নতুন শাড়ি। শাড়ির রঙ কমলা। সে খুব সাজুগুজু করেছে- কানে সোনার দুল, লম্বা চুলে লাল রঙের ফিতে দিয়ে বেনী করা, আবার ঠোটে লিপস্টিকও আছে। ছেলে-মেয়েদের সবার পরনে নতুন পোশাক। সবাই খেতে বসেছে। সামনে উপাদেয় খাবার-দাবার। আলাউদ্দিন আয়েশ করে আস্ত একটা মুরগীর রান উঠিয়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করবে এমন সময় স্বপ্ন ভেঙে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, বেশ শব্দ করেই। বাস্তবে যা খাওয়া হয় না, তা স্বপ্নেও খেতে মানা?
রাস্তার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত সচকিত হয়ে ওঠে সে। একজন মহিলা দুটি ছোট মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে আসেন ট্যাক্সির দিকে। তিন জনের পরনেই চকমকে পোশাক। দেখে বোঝা যায়, ঘর থেকে এরা খুব সাজুগুজু করেই বের হয়েছিল। হয়তো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে, তাই তিন জনেরই সাজগোজ মোটামুটি বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। মেয়ে দুটির চুলের ক্লিপ খুলে পড়ে যাচ্ছে। ফ্রকের গলা একদিকে হেলে আছে। আর মহিলাটির শাড়ির কুচির অবস্থাও নাজুক। যে কোন মূহূর্তে বেচারীর শাড়ির কুচি খুলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আলাউদ্দিন ট্যাক্সির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
-কই যাইবেন?
-আহাদ মিয়ার বাড়ি যাবেন?
কথা শুনে আলাউদ্দিন বুঝে ফেলে এরা শহর থেকে এসেছে। হয়তো চেনে না কিছুই। আলাউদ্দিন আহাদ মিয়া নামের কাউকে চেনে না। তবু সে কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে বলে,
-কোন আহাদ মিয়ার বাড়ি? এই এলাকায় ম্যালা আহাদ মিয়া আছে, বইন।
-তিনি আমেরিকায় থাকেন। একটা বড় বাড়ির মালিক। তাঁর ছেলেদের দোকান আছে গঞ্জে।
-কোন গেরাম?
-চাঁদের চর।
-ঐটা তো ম্যালা দূর। চান্দের চরে গিয়া আবার আহাদ মিয়ার বাড়ি খোঁজ করতে অইব। আপনে চিনেন বাড়ি? আমি চান্দের চর বাজার পর্যন্ত যামু। ঐখান থেইকা আপনে রিসকা নিয়া চইলা যায়েন।
-দেখুন ভাই, দুইটা বেজে গেছে। এখন কোথায় আমি রিকসা নিয়ে আহাদ মিয়ার বাড়ি খুঁজব, বলেন?
-আইচ্ছা উঠেন। আগে চান্দের চর বাজার যাই। ম্যালা দূর আছে, বইন। ট্যাকা দিয়েন বুজ কইরা।
মহিলা সম্মতি জানালেন যে, তিনি ন্যায্য ভাড়াই দেবেন।
আলাউদ্দিন ফুরফুরে মেজাজে ট্যাক্সিতে স্টার্ট দেয়। বহু রাস্তা ঘুরিয়ে আগন্তুকদের সে চাঁদের চর বাজার নিয়ে আসে। বাজারে নেমে সে কয়েক দোকানে জিজ্ঞেস করে যে, ‘আম্রিকান’ আহাদ মিয়ার বাড়ি কোনটা। কয়েকজন বলে দিল কোন রাস্তায় কীভাবে যেতে হবে। তবু আহাদ মিয়ার বাড়ি খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হল তাকে। দেখা গেল, মহিলা যেরকম বড় বাড়ির কথা বলেছেন, এরকম বাড়ি বেশ কয়েকটাই আছে। তবে যখন বললেন যে, সেটা একটা বিয়ে বাড়ি, তখন খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া গেল। গেইটের বাইরে সিএনজি থামিয়ে আলাউদ্দিন বলল,
-নামেন, বইন। তাত্তাড়ি ভাড়াডা দ্যান। যাইগা।
মহিলাটি পার্স খুলে দুটো কচকচে একশ’ টাকার নোট আলাউদ্দিনের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। আলাউদ্দিন কোন কথা না বলে তাড়াতাড়ি টাকাটা পকেটস্থ করে। কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা করলেও করতে পারে। পঞ্চাশ টাকার রাস্তা সে ঘুরিয়ে এনে দুশো’ টাকা রেখেছে। আলাউদ্দিন চলেই যেত। হঠাত মেয়ে দুটি বলে উঠল,
-আপনি আমাদের সাথে খাবেন?
আলাউদ্দিন মহিলার দিকে তাকাল। কোন সাড়া না পেয়ে বলল,
-না গো, মা জননীরা। আমি যে বেদাবাতী।
মেয়ে দুটির একটি মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-মা, বেদাবাতী কী?
-মানে, উনার কোন দাওয়াত নেই।
-উনাকে বল আমাদের সঙ্গে খেয়ে যেতে।
-কিন্তু মা, যাদের বাড়িতে বিয়ে, তারা যদি না চান, আমি কীভাবে বলি?
মহিলাটিকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়। কিন্তু মেয়ে দুটি কাঁদতে শুরু করে। যে কোন কারনেই হোক, আলাউদ্দিনকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তাকে তাদের সঙ্গে খেতে বসতে হবে এখন।
মহিলা আমতা আমতা করে বললেন,
-কিছু মনে করবেন না, ভাই। ছোট মেয়ে তো।
আলাউদ্দীনের মনে ক্ষীন আশা ছিল, মহিলা হয়তো তাকে খেয়ে যেতে বলবেন। বিয়ে বাড়ির খাবারের সুগন্ধে তার পেটে আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে পাক দিয়ে ওঠে। সে বলল,
-না বইন, মনে করার কী আছে।
মেয়ে দুটি কান্না আরও বাড়িয়ে দেয়। হৈ- হট্টগোলের ভেতর থেকে তখন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা একজন পুরুষ বেরিয়ে আসেন। তিনি এগিয়ে এসে মহিলাকে সালাম দিয়ে ভেতরে যেতে বলেন। মেয়ে দুটির কান্নার কারণ জানার পর আলাউদ্দীনকে খেয়ে যাবার অনুরোধ করেন। আলাউদ্দীন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। সত্যিই বলছে কি? পাঞ্জাবী পরা লোকটি তাকে দ্বিতীয়বার বলার পর সে বিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। মেয়ে দুটি দুই পাশ থেকে আলাউদ্দিনের দুই হাত ধরে রাখে। তাকে তাদের সঙ্গেই খেতে বসতে হবে।
খাবার টেবিলেও মেয়ে দুটি তার দুই পাশে বসল। নিজেকে ঝকমকে পোশাক পরা মানুষগুলোর মধ্যে খুব বেমানান লাগতে থাকে তার। নতুন অতিথিদের মতো করে তাকেও খাবার দেয়া হল- ডিম, রোস্ট, গরুর ঝাল মাংস, মাছের নরম ভাজা, খাসির রেজালা। আলাউদ্দীন শুরুতেই মুরগির রোস্ট তুলে নেয়। পোলাও এর সঙ্গে রোস্টের ঝোল মাখিয়ে মুখে দিতেই তার মনে হয়, কত ভালো হত, যদি একটা পলিথিনে করে তার ভাগের খাবারটা সে বাড়ি নিয়ে যেতে পারত। শাক-পাতা খেতে খেতে ছেলে-মেয়েগুলোর জীবন বিভীষিকাময় হয়ে গেছে। ছোট মেয়েটা মুরগির সালুন খুব পছন্দ করে। এক টুকরো রোস্ট তার পাতে তুলে দিলে কেমন আনন্দ হত, সেটা ভেবে আলাউদ্দীনের চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু এখানে কে দেবে তাকে একটা পলিথিন? তাও আবার এইসব নতুন অতিথিদের ভীড়ে কি চাওয়া যায় যা ইচ্ছা তা? খেতে যে দিয়েছে তাই তো অনেক। ক্ষিধেয় পেটের নাড়ীভুড়ি উলটে আসছিল তার। তবু, বামনী বাজারের নতুন ভাতের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে যে খাবার সে বহুদিন ধরে খেতে চেয়েছে, তার চেয়েও ভালো স্বাদ-গন্ধের খাবার মুখে দিয়েও বড্ড বিস্বাদ লাগে আলাউদ্দীনের।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৫