এক ঝলক শীতের হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে গেল গাছের কালো পাতাগুলোকে, আর ওদের দুজনকেও। কারও পরনেই শীতের পোশাক ছিল না যে। গায়ের ওড়নাটাকে আরও ভালো করে শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে নিল ইমু। সে তাকিয়ে ছিল রাহিতের দিকে, আর রাহিত তাকিয়ে ছিল অস্তগামী সূর্যের দিকে। রাহিতের চোখেও কিছুটা সূর্যের লাল। ইমু বলল,
-কাল রাতে ঘুমাও নি তুমি?
সে কথা রাহিতের কানে ঢুকল কিনা সেটা ঠিক বোঝা গেল না। কারণ- ইমুর প্রশ্নের উত্তরে সে বলল,
-উঁ।
উঁ। উঁ কী? এটা কোন উত্তর হল? হয় হ্যাঁ বলবে, নয়তো না। তা না করে সে বলছে উঁ। ইমু বড় করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। একমাত্র কবি আর বিজ্ঞানীরাই বোধ হয় পাশে নারী রেখে এমন অন্যমনস্ক থাকতে পারে। সে শুনেছিল, কোন এক বিজ্ঞানী নাকি সিগারেট মনে করে প্রেমিকার আঙ্গুল দু ঠোঁটে চেপে ধরেছিল। ইমু বলল,
-আমি একটা প্রশ্ন করেছি। শুনতে পেয়েছ সেটা?
সে রাহিতের গায়ে আলতো ঠ্যালা দিল। রাহিত একটু চমকে উঠে বলল,
-হ্যাঁ, কী বলছিলে? আবার বলো।
-তুমি কোথায় আছো?
-কেন, তোমার পাশে!
-তা আমার মনে হচ্ছে না।
-একটা কবিতা নিয়ে ভাবছিলাম। স্যরি।
-স্যরি বলার দরকার নেই। জিজ্ঞেস করছিলাম, তুমি কাল রাতে ঘুমিয়েছ কিনা।
-না, ঘুমানোর সময় পেলাম কই? সারা রাত বসে বসে পান্ডুলিপির কাজ শেষ করলাম।
-হুঁ। জমা দিচ্ছ কবে?
-দেখি, আজ একবার যাব সায়েম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। প্রচ্ছদ নিয়ে কথা বলব। রিপন ভাই দুটো প্রচ্ছদ করে দিয়েছেন। সায়েম ভাই যেটা পছন্দ করবেন সেটাই ফাইনাল করব।
-সায়েম ভাইকে তুমি এত শ্রদ্ধা কর কেন? কী আছে তার মধ্যে?
-আছে মানে? সায়েম ভাই না থাকলে আমার কবিতার বই ছাপা হত কখনো? সবাই তো টাকা চায়। একমাত্র সায়েম ভাই রিস্ক নিতে পছন্দ করেন। আমাকে ভালোও বাসেন খুব।
ইমু অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-আমিই শুধু কেউ না।
বলেই নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত্রির দিকে এগুলো বলে বোঝা গেল না ইমু কাঁদছিল কিনা। কিন্তু ধরা গলাটা খুব টের পাওয়া গেল। রাহিত বলল,
-কী বললে?
-না, কিছু না।
-কিছু একটা বললে তো।
-হুঁ। বলেছি।
-কী? সেটা আবার বলো?
-কিছু না বলেছি।
রাহিত খুব অবাক হল। এই মেয়েটা মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত আচরন করে। কিছুই বুঝতে পারে না রাহিত। এই মনে হয়, ইমু হয়তো তাকে পছন্দ করে; এই মনে হয়, না। ইমুর জন্যেও যে তার মনে কিছুটা দুর্বলতা আছে সেটা কি ইমু বুঝতে পারে? পারে না হয়তো। ইমু বলল,
-তোমার নোটখাতা লিখে দিয়েছি। পরীক্ষার সময় উগরে এসো শুধু। তোমার তো আর টেক্সট বইয়ে মন দেবার সময় নেই। সারাদিন ঘাড় গুঁজে রাখো কবিতায়।
-আমার নোটখাতা মানে! তোমারই তো নোটখাতা। তুমি শুধু দয়া পরবশ হয়ে আমাকে পরীক্ষায় পাশ করানোর চেষ্টা করছ।
ইমু একটু হাসল। বলল,
-কিন্তু ফার্স্ট ক্লাসটা আমিই পাব। আর তুমি শুধু পাশই করবে। এর পরেও সেটা খুব একটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
-হুম। কী আর করা। আমি বাজে ছাত্র যে। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাইনি, মাস্টার্সে পেলে তো আমি বাংলাদেশের বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে যাব।
-মাস্টার্সে পাওয়া আরও সোজা। কিন্তু তুমি পাবে না।
-হুম। তোমার জন্য সোজা আরকি। আমার জন্য না। সেদিন ইসমাইল স্যার ক্লাসে কী বললেন মনে নেই?
রাহিত একটু হাসল, যে হাসিটা অন্তত একবার না দেখলে ইমুর ভালো লাগে না। কিন্তু রাত হয়ে গেল বলে হাসিটা আর দেখা গেল না। রাহিত উঠার জন্য তাগাদা দিল। বলল,
-চলো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
ইমু চমকিত হল। আরে! সত্যি বলছে নাকি? রাহিতের এসব মনে থাকে না কখনোই। সে তার নিজের ধ্যানে থাকে। কথা শেষ হবার পর দুজন বিদায় নিয়ে দুদিকে চলে যায়। ইমু একাই বাসায় ফেরে, আর রাহিত আরও কিছুটা সময় টই টই করে এদিক-সেদিক ঘোরে। আজ কি হল তার? ইমু মুখে দরকার নেই বলল, কিন্তু মনে মনে আসলে চাইছিল রাহিত তাকে পৌঁছে দিক বাসায়। তাতে আরও কিছুটা সময় তার সঙ্গে কাটানো যাবে। রিক্সায় গা ঘেঁষে বসে থাকা যাবে। রাহিতের গায়ের বুনো গন্ধ পাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে তার রাহিতের গালে চুমু খেতেও ইচ্ছে করে। হাত দিয়ে মাথার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে ইচ্ছে করে। কিছুটা সময়ের জন্য তাকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কাঁদতে ইচ্ছে করে। এগুলো মনে হলে কিছুটা লজ্জাও পায় ইমু। তাদের সম্পর্কটাই যে আসলে তেমন নয়। হতে চায়, আবার হয় না।
রিক্সায় দুজনের তেমন কথা হচ্ছিল না। ব্যাপারটা কেমন যেন অস্বস্তিকর। দুজন বন্ধু পাশাপাশি বসে আছে, কিন্তু কেউ কোন কথা বলছে না। অথচ দুজন মানুষ বন্ধু হলে বলার মতো অনেক কথাই থাকা উচিত, বা থাকে। রাহিত নীরবতা ভাঙার জন্য অথবা বলার জন্যই বলল,
-ইমু, তোমার কোন প্রেমিক আছে?
ইমু বলল,
-হঠাত এই প্রশ্ন?
-এম্নিই জানতে চাইলাম। তোমার সঙ্গে এত দিনের পরিচয়, অথচ আমার মনে হয়, আমি তোমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না।
-তা, হঠাত এই রকম একটা তথ্য জানতে চাইলে?
-এম্নিই।
-না, আমার তেমন কেউ নেই।
-ও।
ইমুর নিজের দেয়া উত্তরটা ঠিক পছন্দ হল না। সে কি সত্য বলল? তার তেমন কেউ নেই, তা তো ঠিক নয়। রাহিত তো আছে। হয়তো গোপনে গোপনে আছে, কিন্তু আছে তো। তার আফসোস হল। সে তো বলতে পারত, “আছে একজন।” রাহিত হয়তো তখন জানতে চাইত সে কে। তখন বেশ বলে ফেলা যেত। কিংবা হয়তো এই ভেবেই বলল না যে, রাহিত এর পর আর কিছুই জানতে চাইত না। ইমুর মনে হল, এমনকি হতে পারে যে, রাহিত প্রেমিকের জায়গায় নিজেকেই ভাবছে? তাই যদি হয়, তাহলে হতাশ হয়েছে নিশ্চয়ই। রাস্তার হলুদ বাতির আলোয় চট করে একবার মুখটা দেখে নেয়া যেত। কিন্তু ইমু তাকাতে পারল না। তাকালেই রাহিতের চোখে চোখ পড়ে যেত তার। আরও কিছুক্ষণের জন্য গভীর নীরবতা নেমে আসলো দুজনের মাঝে। এই নীরবতা ভাঙল রিক্সাওয়ালা ভাই।
-আপা, কই নামবেন?
-এই যে, সামনে, মোড়ে।
মোড়ে নেমে গেল ইমু। রাহিতও নেমে গেল তার সাথে সাথে। ইমু অবাক হল,
-তুমি নেমে গেলে যে?
রাহিত একটু অপ্রস্তুত হল,
-তাই তো! আমি কেন নামলাম।
রাহিত দাঁড়িয়ে রইল। আজ তার কেন জানি দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। ইমু বাসার গেইট পর্যন্ত পৌঁছালে তবেই সে যাবে। সে ইমুকে ডাকল পেছন থেকে।
-কী, বল।
-তোমার হ্যান্ডব্যাগে কাগজ আছে কোন?
-হ্যাঁ, তোমার জন্য যে নোটস এনেছিলাম, সেগুলো তো দেয়া হল না। এই নাও।
ইমু ব্যাগ থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে দিল। রাহিত আধাআধি লেখা হয়েছে এরকম একটা পৃষ্ঠা টেনে নিল। সেখান থেকে না লেখা অংশটুকু ছিঁড়ে নিয়ে ইমুর কাছে কলম চাইল। কলম পেয়ে সে খুব দ্রুত কাগজটাতে লিখল,
“তোমাকে ভালো লাগে।”
কাগজটা ভাঁজ করে ইমুর হাতে দিয়ে বলল, “বাসায় গিয়ে খুলবে। এখন না। আর এই নোটগুলো তোমার ব্যাগে ভরে ফেল। এগুলো এখন নেব না।”
ইমু “ঠিক আছে” বলে বাসার গেইটের দিকে দ্রুত হেঁটে গেল।
বাসায় গিয়ে কাগজটা খুলে ভীষন ভাবালুতায় আক্রান্ত হল সে। এটা তো একটা সামান্য বাক্য। এই বাক্যটা তো রাহিত এর আগে আরও বহুবারই বলেছে। তাহলে আজ আবার কাগজে লিখে দেয়ার কী প্রয়োজন হল? তাহলে কী রাহিত অন্য কিছু লিখতে চেয়েছিল? ইমু হাসল। রাহিতের ফোনে কল দিল সে। রাহিত ফোন রিসিভ করল না। হঠাৎ করে তার একটু লজ্জা লাগছে যেন। কিছুটা ভয় ভয়ও করছে। ইমু রাগ করেনি তো? হয়তো ফোন রিসিভ করলেই তার রাগী রাগী গলা শোনা যাবে, “এই, এটা কী লিখেছ তুমি?” ইমুর কল শেষ হতে না হতেই সায়েম ভাই ফোন দিলেন,
-রাহিত, এদিকে একবার আয় তো।
-কোথায়?
-শাহবাগ।
-আছি কাছাকাছি। অপেক্ষা করেন।
শাহবাগে সায়েম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হল রাহিতের। সায়েম ভাই তাকে নিজের মোটর সাইকেলে তুলে নিলেন। রাহিত কিছুই জানতে চাইল না। সায়েম ভাইয়ের কাছে কিছু জানার প্রয়োজন নেই তার। এই মানুষটা যা বলবে তাই করবে সে। যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকেই চলে যাবে। জনবহুল শহরের হলুদ আলোয় মৃদু শীতের বাতাস কেটে ছুটে চলল সায়েম ভাইয়ের প্রতিদিনের সঙ্গী। বাতাসে রাহিতের লম্বা চুল বেয়াড়া হয়ে উঠেছে। ইমু বহুবার বলেছে এই চুল ছেঁটে ছোট করতে। লম্বা চুলে নাকি তাকে মাস্তানের মতো দেখায়। কিন্তু সে ছাঁটে নি। রাহিতের একবার মনে হল, কাল চুলগুলো ছেঁটে ইমুর সামনে গেলে কেমন হয়? এই মনে করেই সে মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। সায়েম ভাই বললেন,
-হাসছিস কেন রে এভাবে? প্রেমে পড়েছিস নাকি?
-আপনি এর মধ্যে আমার হাসিও দেখে ফেলেছেন? আপনি কে সায়েম ভাই?
সায়েম ভাই সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,
-তোর পান্ডুলিপি শেষ হয়েছে?
-হুম।
-কালই জমা দিয়ে দিস।
-দেব।
-কোথায় যাচ্ছি, জানতে তো চাইলি না।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-বিবর্ণ বিকেলের বাসায় যাচ্ছি। নিমন্ত্রণ আছে তার বাসায়। আরও অনেক লেখক আসছেন সেখানে। কী রকম আড্ডা হবে বুঝতে পারছিস তো?
-হুম। বিবর্ণ বিকেল তো হুমকি পেয়ে গেছেন ইতোমধ্যে। আপনি আবার তার বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন।
-হুম, তা করছি। শুধু যে তার করছি তা তো না, আরও অনেকেই আছেন এরকম।
সায়েম ভাই হঠাত মোটর সাইকেল থামালেন। রাস্তার পাশেই একটা টং দোকান দেখেই হয়তো।
-চল, চা খাওয়া যাক।
-চলেন।
তাদের পাশাপাশি আরও একটা মোটর সাইকেল থামল। সেখানেও দু’জন আরোহী। চার জনেই চার কাপ চা নিল হাতে। এক পাশে সাত-আট জনের একটা জটলা। তারা হৈ-হুল্লোড় করছে। এক জনের হাতে গীটার। গীটারওয়ালা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গান করছে, “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা ক’জন নবীন মাঝি, হাল ধরেছি...” জটলার অন্যান্যরা থেকে থেকে সুর মেলাচ্ছে মূল শিল্পীর সাথে। উপভোগ্য পরিবেশ। সায়েম ভাই নিঃশব্দে চা শেষ করে বললেন,
-বুঝলি, নবীনরাই পারবে হাল ধরতে। এই দেশের মোড় ঘুরবেই একদিন।
রাহিতও আশাবাদী হল এই মর্মে যে, একদিন সত্যিই এ দেশের মোড় ঘুরবে। সব অন্ধকার ঘুচে যাবে। তাদের পাশাপাশি বসা আরোহী দুজনের মুখে কোন কথা নেই। একজন একটু দূরে গিয়ে নিচু স্বরে কথা বলল কারো সঙ্গে। ফিরে এসে আবার পাশাপাশি বসল। কিন্তু তারা তখনো চুপচাপ ছিল। সায়েম ভাই চায়ের বিল মিটিয়ে দিয়ে বললেন,
-চল, যাওয়া যাক। দেরী করা সাজে না আর।
তখন ইমুর ফোন এল। রাহিত ফোন রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে কান্নার শব্দ। সে বিহ্বল হয়ে গেল।
-কাঁদছ কেন, ইমু? কোন সমস্যা?
-তুমি ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল।
-আমি সায়েম ভাইয়ের সঙ্গে আছি।
-আমি এখন তোমাকে একটা কথা বলব।
-বল।
-আচ্ছা, এখন না। কাল সরাসরি বলব। এই কথা চোখে চোখ রেখে বলতে হবে।
-না, ইমু। এখন বল। আমার এখন শুনতে ইচ্ছা করছে।
-উঁহু। কাল।
-ইচ্ছে করেই কি অপেক্ষায় রাখছ?
-হুম।
ইমু লাইন কেটে দিল।
সায়েম ভাই মটর সাইকেলে স্টার্ট দিতে যাবেন, এমন সময় লোকগুলোকে দেখতে পেল রাহিত। সামনে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতও দূরে নয়। কোন ছায়ামূর্তি নয় তারা, তবুও যেন ছায়া ছায়া। সবারই মুখ বাঁধা কালো কাপড়ে। রাহিত পেছনে তাকাল। দু’জন দাঁড়িয়ে। তাদেরও মুখ বাঁধা। তাদের হাতে চকচক করছে, কী ওগুলো, ছোরা?
সামনের মানুষগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল সায়েম ভাইয়ের ওপর। হায়েনাও কি এত হিংস্র হয়? মানুষগুলোর চোখ দেখে রাহিতের মনে হল, হায়েনার চোখও হয়তো এত হিংস্র হয় না। সে তো কেবল জীবনের প্রয়োজনে, টিকে থাকার তাগিদে শিকার করে। রাহিত চিৎকার করল,
-কেউ আছেন? আমার সায়েম ভাইকে বাঁচান। আমার সায়েম ভাই...
কিন্তু খুব দুর্বল হল সেই চিৎকার। চিৎকারের সাথে সাথে লাল হয়ে গেল রাহিতের শাদা শার্ট। হলুদ আলোয় লাল রঙকে ঠিক লাল মনে হয় না। রাহিত দেখল, একপাশে নিথর হয়ে পড়ে আছে সায়েম ভাইয়ের লাল হয়ে থাকা দেহ। একেবারে স্পষ্ট লাল রঙটাই দেখল সে। সায়েম ভাই কি মারা গেছেন? হয়তো।
রাহিতের চোখের সামনে সব কিছু ধূসর হতে থাকে। আশেপাশে আবছা মুখ, আবছা অবয়ব, কারা এরা? কোন ভাই? কোন বন্ধু? সে ভালো করে তাকাতে পারে না। তার চোখের সামনে ইমুর কোমল মুখটা ভেসে ওঠে একবার। কী যেন বলতে চেয়েছিল মেয়েটা। সেই মুখের পাশে আরও একটা মুখ। সে চিনতে পারল, এটা তার মায়ের মুখ। এইতো বাবাও আছেন। এরা এত কান্না করছে কেন? এরা এখানে কোথা থেকে এল? দূরে কে গান করছে এত সুরেলা কণ্ঠে? মিতু নাকি? আরে, ফোকলা দাঁতে কে হাসে এটা? এটা তো সে নিজেই! সে নিজেকে কেন দেখতে পাচ্ছে? ঐ তো, বিলে শাপলা তুলছে সে আর মিতু। আধাআধি শাপলা নিয়ে যাবে সে। না দিলে বিপিন স্যারকে দিয়ে মার খাওয়াবে। বিপিন স্যার খুব রাগী। এক থাপ্পড় দিয়ে কান নষ্ট করে দেবেন তিনি। বিপিন স্যারের মুখটাও দেখতে পেল সে। সে এসব কেন দেখছে? রাহিতের ব্যথাবোধ ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে আসতে থাকে। তার মাথার ভেতর একটা কবিতা তৈরি হয়। কিন্তু আহা! কে লিখবে কবিতাটি? কে ওখানে? কোন বন্ধু, কোন স্বজন কি আছে? এইতো ইমু এসেছে। তার হাতে কাগজ আর কলম। রাহিত ভরসা পায়। সে বলল,
-ইমু, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
-এসব কথা রাখ, কবিতাটা ঝটপট বলে ফেল।
-এটাই কবিতা। এত সুন্দর কবিতা আর শুনেছ?
ইমু হাসতে থাকে। কী সুন্দর সেই হাসি! ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল ...
ইমু হাসি থামিয়ে বাগড়া দেয়,
-কবিতাটা বল তো। লিখে ফেলি।
রাহিত বলল,
-লেখ। “আমাকে হত্যার পূর্বে আরও কিছু শিল্পীত হোক তোমাদের ছুরি...”
-তারপর?
-লেখ,
“রঙিন রঙের বাষ্পে ভরে যাক মাছেদের জঙল, সরোবর
শিকারী খুঁজে পাক ধনুকের তীর, পিপাসিত পাখি প্রসবন
সমুদ্রকামী বণিক নিক জাহাজ ও লবণ
আমাকে হত্যার আগে জলাভূমি জলে যাক
ধারালো নদীতে শানিত কৃপাণ ছুরিকা
পাতায় সবুজ ঘুম, বৃক্ষের শাখা
আমাকে হত্যার আগে হত্যাই শিখে নাও
গোখরোর ললাটে কিছু মধু, মমতা ভাসাও
প্রস্তুত হোক চোখ, নখ, দাঁতাল শহর
গতিকে স্থির করো, নিভু মোম মৃত্যুর ওপর
কিছুকাল জলে নামো, জলে থামো
গচ্ছিত হোক পাহাড়, পাথর ও নুড়ি
স্লোগান, সাইরেন, সমূহ সমবায়
আমরণ ঢেকে ছিল, খুলে দাও পাতাল ও পুরী
নিপুণ আকাশ মাপো, তারা ও তীরের ফলা
হত্যাই সঠিক যদি খুলে দাও সমস্ত তালা!
খুলে দাও...খুলে...দাও...খুলে...”
রাহিতের চোখের সামনে সব কিছু আরও ধূসর হতে থাকে।
( গল্পে ব্যবহৃত কবিতার কবির নাম- খান রুহুল রুবেল। তিনি প্রথম লাইনের জন্য অনুমতি দিয়েছিলেন; আমি পুরো কবিতাটি দিয়ে দিলাম। কবি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন কিনা জানি না।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১১:৪৪