মুসলিম উম্মাহ্,
জেনে রাখুন, ইসলামের ভিত্তিগুলো এবং ঈমানের রুকনগুলো মুসলমানদের অন্তরে মজবুত করা গেলে তারা দুনিয়া ও আখেরাতে নিরাপত্তা লাভ করবে। “যারা ঈমান এনেছে, কিন্তু তাদের ঈমানের সাথে যুলুম (শির্ক) মিশ্রিত হয়নি তাদের জন্যই নিরাপত্তা। আর তারাই হল সুপথপ্রাপ্ত।”[সূরা আনআম ৬:৮২] প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা ও সুস্থ জীবন কোন অবস্থায় লাভ করা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না ব্যক্তি আল্লাহ্কে রব্ব (প্রতিপালক) হিসেবে স্বীকৃতি না দিবে, ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ না করবে এবং মুহাম্মদ (সাঃ)কে নবী ও রাসূল হিসেবে না মানবে। “যে নর বা নারী ঈমান থাকা অবস্থায় কোন সৎকর্ম করে আমি তাকে উত্তম জীবন দান করব।”[সূরা নাহল ১৬:৯৭] “আর যারা ঈমান আনে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে মুহাম্মদের প্রতি অবতীর্ণ সত্যে বিশ্বাস করে, আল্লাহ্ তাদের মন্দ কর্মসমূহ মার্জনা করেন এবং তাদের অবস্থা ভাল করে দেন।”[সূরা মুহাম্মদ ৪৭:২]
মুসলিম উম্মাহ্,
সন্দেহ নেই নিরাপত্তা সুখী জীবনের জন্য অনস্বীকার্য। বরঞ্চ মানব জাতির যে কোন সুকর্ম, সুআশা বাস্তবায়নের জন্য নিরাপত্তা একান্ত প্রয়োজন। গোটা মানব সমাজ এ মহান লক্ষ্য অর্জনে সদা তৎপর। বরঞ্চ তারা এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যায়। এর জন্য তারা তাদের বুদ্ধি ও অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। নিরাপত্তার এই মহান মহিমার কারণে আল্লাহ্ তাআলা তার পবিত্র কালামপাকে নিরাপত্তার নেয়ামতের কথা উল্লেখ করে বলেন, “অতএব তারা যেন এই ঘরের (কাবার) মালিকের ইবাদত করে। যিনি তাদেরকে ক্ষুধায় আহার দিয়েছেন এবং ভয় থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।”[সূরা কুরাইশ ১০৬:৩-৪] আল্লাহ্ তাআলা তার ঘরের প্রতিবেশীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, “তারা কি দেখে না, আমরা (মক্কাকে) একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল বানিয়েছি। অথচ তাদের চর্তুপার্শ্বস্থ মানুষের উপর হামলা হয়।”[সূরা আনকাবুত ২৯:৬৭] আল্লাহ্ হিজরবাসীদের সম্পর্কে বলেন, “তারা পাহাড় কেটে নিরাপদ বাসস্থান বানাত।”[সূরা হিজর ১৫:৮২]
মুসলিম উম্মাহ্,
মানুষের ‘নিরাপত্তার চাহিদা’ খাদ্য ও বস্ত্রের চাহিদার উপর প্রাধান্যযোগ্য। কারণ নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয় তাহলে খাদ্যের রুচি থাকে না, ঘুমের চাহিদা থাকে না, সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভবপর হয় না। এ কারণে ইব্রাহীম খলিল (আঃ) তাঁর দোয়ার মধ্যে খাদ্যের জন্য দোয়া করার আগে নিরাপত্তার জন্য দোয়া করেছিলেন। তিনি বলেন, “হে আমার প্রতিপালক, এই শহরকে আপনি নিরাপদ এলাকায় পরিণত করে দিন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ্র প্রতি ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে তাদেরকে ফল-ফলাদি দিয়ে জীবিকা দিন।”[সূরা বাকার ২:১২৬] আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দোয়ায় সাড়া দিয়ে বলেন, “আর যে ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ।”[সূরা আলে ইমরান ৩:৯৭] তিনি আরো দোয়া করেন, “হে আমার প্রতিপালক, আমি আমার বংশের কিছু সদস্যকে আপনার পবিত্র গৃহের নিকটে এক চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি।”[সূরা ইব্রাহীম ১৪:৩৭] আল্লাহ্ তাআলা তার দোয়ায় সাড়া দেন এবং এ শহরকে সভ্যতা-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু বানান, মুসলমানদের মিলনভূমিতে পরিণত করেন। “এবং যখন আমি কাবাগৃহকে মানবজাতির জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদস্থল বানালাম।”[সূরা বাকারা ২:১২৫] নিরাপত্তা ও ঈমানের মাধ্যমে মানুষ ঐক্যমতে পৌঁছতে পারে, জীবনের শোভা বিকশিত হয়, উম্মাহ্র ঐক্য সংঘটিত হয়, ন্যায় বিস্তার লাভ করে, ঈমানের নিদর্শনগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে, জীবন-জীবিকা সহজলভ্য হয়। নিরাপত্তা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সুখ। যে ব্যক্তি তার আবাসস্থলে নিরাপদ, শারীরিকভাবে সুস্থ এবং দিনানিপাত করার মত খাদ্য তার কাছে মজুদ আছে পৃথিবীর সকল সুখ যেন তার ঘরেই রয়েছে।
নিরাপত্তার এই নেয়ামত অর্জনের জন্য কতগুলো উপায় গ্রহণ করতে হবে। সর্বপ্রধান উপায় হল- ব্যক্তির বিশ্বাসকে সংশোধন করা। শিরক থেকে ঈমানকে পুতঃ পবিত্র করা এবং আমলকে সুন্দর করা। “তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসনকর্তৃত্ব দান করবেন। যেমন তিনি শাসনকর্তৃত্ব দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের ধর্মকে বুলন্দ করবেন, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং ভয়-ভীতির পরিবর্তে তাদেরকে শান্তি দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না।”[সূরা নূর ২৪:৫৫] নিরাপত্তা অর্জনের আরেকটি উপায় হচ্ছে- নেতার আনুগত্য করা এবং ঐক্যমত পোষণ করা। “হে ঈমানদারেরা, তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্র, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের নির্দেশকর্তাদের। আর যদি কোন বিষয়ে তোমরা মত বিরোধ কর তাহলে সে বিষয়ের ফয়সালা আল্লাহ্ ও রাসূলের কাছ থেকে গ্রহণ কর; যদি তোমরা আল্লাহ্র প্রতি ও শেষদিবসের প্রতি ঈমানদার হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর এবং উত্তম নিষ্পত্তি।” [সূরা নিসা ৪:৫৯] এছাড়া নিরাপত্তা অর্জনের আরেকটি উপায় হল নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। নেয়ামতের শুকরিয়া করলে নেয়ামত স্থায়ী হয়, নিরাপত্তা অটুট থাকে। নিরাপত্তা অর্জনের আরেকটি উপায় হল- অপরাধী ও পাপাচারীকে দমন করার জন্য আল্লাহ্র তাআলার পক্ষ থেকে নির্ধারিত ফৌজদারী দণ্ডবিধিগুলো বাস্তবায়ন করা। যারা মানুষের রক্ত নিয়ে, ইজ্জত আব্রু নিয়ে হোলি খেলায় মেতে উঠে; যাদের অন্তরে ঈমানী চেতনা অত্যন্ত ক্ষীণ; ওয়াজ-নসিহত ও ভীতির উদ্রেককারী বক্তৃতা যাদেরকে অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য যথেষ্ট নয় এদেরকে প্রতিরোধ কল্পে আল্লাহ্ তাআলা বিভিন্ন মাপের দন্ড, কিসাস (হত্যার বদলে হত্যা) এবং শাস্তিমূলক বিভিন্ন আইন নাযিল করেছেন। যেন এসব অপরাধীদেরকে দমন করা যায়। নিরাপত্তা অর্জনের আরেকটি উপায় হল - সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা। কারণ সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজের নিষেধ অপরাধের মাত্রাকে সীমিত রাখে, মানুষের চরিত্রকে সুরক্ষা করে, ইজ্জত-আব্রুর হেফাযত করে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এই উম্মতের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। বরং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করা এই উম্মতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। “তোমরাই সর্বোত্তম জাতি তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণে বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।”[সূরা আলে ইমরান ৩:১১০] সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধের মাধ্যমে এই উম্মত পৃথিবীতে কর্তৃত্ব লাভ করবে। “তাদেরকে যদি আমি জমিনের ক্ষমতা দেই তাহলে তারা নামাজ কায়েম করে, যাকাত দেয়, সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে। আর সকল বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্র ইখতিয়ারে।”[সূরা হজ্ব ২২:৪১]
নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। এর ফলাফল অত্যন্ত বিপজ্জনক। আল্লাহ্ মাফ করুক যদি কোথাও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তাহলে সেখানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। কেউ কারো কথা শুনে না। নিরপরাধ মানুষের রক্ত নিয়ে হোলি খেলা চলে, নারীদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়, শিশুদেরকে হত্যা করা হয়, ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হয়। নিরাপত্তা না থাকলে সেখানে জুলুম-অত্যাচার বেপরোয়া বেড়ে যায়, ন্যায়বিচার থাকে না, অজ্ঞতা-মূর্খতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, শান্তির পরিবর্তে সবর্ত্র ভয়ভীতি বিরাজ করে, সচ্ছলতার পরিবর্তে অভাব-অনটন দেখা দেয়। আল্লাহ্ আমাদেরকে ও আপনাদেরকে এমন দুরবস্থা থেকে হেফাযত করুন।
ও মুসলিম উম্মাহ্, ও মুমিন ভায়েরা,
এ কারণে আমাদের ধর্মে নিরাপত্তা বিঘ্নিতকারী, বিশৃঙ্খলা ও গোলযোগ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ব্যাপারে কঠোর ধমকি এসেছে। “নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা দুষ্কৃতিকারীদের কর্মকে পূর্ণ হতে দেন না।”[সূরা ইউনুছ ১০:৮১] জেনে রাখুন, আমরা সচরাচর নিরাপত্তার যে অর্থটা বুঝে থাকি ইসলামের দৃষ্টিতে নিরাপত্তার অর্থটা অত সংকীর্ণ নয়। । বরঞ্চ আমাদের ধর্মে নিরাপত্তার অর্থ অনেক ব্যাপক। মানবজাতির দ্বীন ও দুনিয়ার যাবতীয় প্রয়োজনের নিরাপত্তা সাধনকে অর্ন্তভুক্ত করে ইসলামে নিরাপত্তার মর্মার্থ। চাই মানবজাতির সে প্রয়োজন হোক বস্তুগত অথবা ভাবগত। অথবা সে প্রয়োজন হোক কোন ব্যক্তি বিশেষের কিংবা কোন জনগোষ্ঠীর। অথবা সে প্রয়োজন হোক শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের কিংবা মুসলিম-অমুসলিম সকলের।
ইসলামে নিরাপত্তার শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ব্যক্তির বিশ্বাসের নিরাপত্তা। ব্যক্তির সুমহান ইসলামী বিশ্বাসকে (আকীদা) ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী সকল বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারনা থেকে হেফাযত করা। যেন সেসব কুফরী বিশ্বাস ব্যক্তির বিশ্বাসকে পাল্টে দিতে অথবা ত্রুটিযুক্ত করতে না পারে। আর তা বাস্তবায়ন করা যাবে এককভাবে আল্লাহ্কে উপাস্য হিসেবে গ্রহণের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে এবং ইসলামী শরীয়ার পরিপন্থী সবকিছু বর্জনের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে। এছাড়া ইসলামে নিরাপত্তার আরেকটি শাখা হলো- আত্মার নিরাপত্তা। ইসলাম ব্যক্তির আত্মাকে নিরাপদ রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আত্মাকে পরিশুদ্ধ করার মাধ্যমে এবং উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা দূর করার মাধ্যমে। বাস্তবে তা সম্ভব হবে এক আল্লাহ্র উপাসনা করা, তাঁর বিধানে সন্তুষ্ট থাকা, তাঁর দেয়া অনুশাসন মেনে চলা এবং তার দরবারে ধর্ণা দেয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে (আল্লাহ্র একত্ববাদে) এবং তাদের অন্তর আল্লাহ্র যিকিরে (স্মরণে) প্রশান্তি লাভ করে। জেনে রাখ; আল্লাহ্র যিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।”[সূরা রাদ ১৩:২৮] নবী করিম (সাঃ) বলেন, “হে বেলাল, নামাজের মাধ্যমে আমাদেরকে প্রশান্তি দাও।”[মুসনাদে আহমাদ ২৩১৩৭নং] মুসলিম তো সদা আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথে কাজ করে। আল্লাহ্র প্রতি ভয় ও তাঁর উপর আশা তার এ যাত্রা পথে গতির সঞ্চার করে। সে তো বিশ্বাস করে “নিশ্চয় আল্লাহ্ মুহসিনদের (সৎকর্মশীলদের) আমল বিনষ্ট করেন না।” বরঞ্চ সে বিশ্বাস করে তার আমলের প্রতিদান তার জন্য সংরক্ষিত আছে এবং কিয়ামতের দিন তাকে তার প্রাপ্য প্রদান করা হবে। ইসলামে নিরাপত্তার আরেকটি শাখা হলো- চরিত্রের নিরাপত্তা। আর তা অর্জন করতে হবে সমাজকে সৎচরিত্র ও উত্তম আদর্শের শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে। শালীনতা, লজ্জা-শরম ইত্যাদির তরবিয়ত দেয়ার মাধ্যমে এবং যাবতীয় দুঃশ্চরিত্র ও বেহায়াপনা থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে। এছাড়া ইসলামে নিরাপত্তার আরেকটি শাখা হলো- পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। আর তা অর্জন করা সম্ভব হবে বৈধভাবে ও শরীয়তস্বীকৃত পন্থায় সাব্যস্ত হওয়া সম্পর্কগুলোকে মজবুত করার মাধ্যমে। পরিবার ও সমাজের সদস্যদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে। “তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।”[আদাবুল মুফরাদ, আলবানী: সহীহ] পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, মেহমান ও প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করা, ইয়াতীম-মিসকীনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং সামাজিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে।
মুসলিম উম্মাহ্, নিরাপত্তার আরেকটি শাখা হলো- রাজনৈতিক নিরাপত্তা। ইসলামের দৃষ্টিতে রাজনৈতিক নিরাপত্তার অর্থ হল- মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য নিশ্চিত করা, তাদেরকে একতাবদ্ধ রাখা, এক কাতারে শামিল রাখা এবং যে বা যারা তাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে বাধার প্রাচীর গড়ে তোলা। বিশেষতঃ যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে তখন উম্মাহ্র উচিত তার নেতৃবর্গের সাথে হাতে হাত রেখে একতাবদ্ধ থাকা যেন উম্মাহ্ তার শত্রুর চক্রান্ত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মুসলিম নেতৃবর্গের উচিত শত্রুর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্ক থাকা, চৌকষ ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে যে কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া। কারণ আজ উম্মাহ্ শত্রুর লক্ষ্যবস্তু। উম্মাহ্র শত্রুরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কতগুলো মতভেদ তৈরী করে উম্মাহ্কে দোষারোপ করতে চায়। যেন তারা উম্মাহ্র আভ্যন্তরীণ বিষয়ে সহজে হস্তক্ষেপ করতে পারে। সুতরাং শত্রুর ষড়যন্ত্র থেকে সাবধান! সাবধান! ইসলামে নিরাপত্তার আরেকটি দিক হলো-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। একটি সুদৃঢ়, মজবুত, সুদ ও জুলুমমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ইসলাম কতগুলো সুমহান নীতিমালা প্রদান করেছে। ইসলামী অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল- এটি আদর্শিক (আকীদা) ক্ষেত্রে অথবা বিধি-নিষেধ আইনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ইসলামী আইনের (শরীয়ার) উপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণতঃ বলা যায় ইসলামী শরীয়া ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ব্যক্তিকে সীমাবদ্ধ কিছু স্বাধীনতা দিয়েছে। ব্যক্তির উপর যাকাত দেয়া ফরজ করেছে এবং বিশেষ কিছু ব্যক্তিবর্গের ভরণ-পোষণ দেয়া ব্যক্তির উপর অবধারিত করে দিয়েছে। ইসলামী শরীয়া ব্যক্তিকে ভাল কাজে সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করে। যেসব ব্যবসায়িক লেন-দেন সুদভিত্তিক, প্রতারণানির্ভর, জুয়াসংশ্লিষ্ট অথবা যে লেনদেনের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণ করা হয় সেসব লেনদেনকে ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। পণ্যের দোষ লুকিয়ে লেনদেন করাকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। যে লেনেদেনের বিনিময়কৃত পণ্য অথবা বিনিময় মূল্য অথবা বিনিময়ের সময়কাল অজ্ঞাত ইসলাম সেসব লেনদেনকেও হারাম বলেছে। কোন পণ্যের মালিক হওয়ার আগে তা অন্যের কাছে বিক্রয় করে দেয়া ইসলামে বৈধ নয়। অনুরূপভাবে বিক্রেতা যে সামগ্রী ক্রেতার কাছে সমর্পণ করতে সক্ষম নয় এ ধরনের লেনদেনও হারাম। এসব বিধিনিষেধ শুধুমাত্র সমাজকে রক্ষা করার জন্য। যেন সমাজের এক শ্রেণী অপর শ্রেণীকে খেয়ে ফেলতে না পারে। বর্তমানে আমরা যে অর্থনৈতিক ধ্বসের কথা শুনছি তা একমাত্র ইসলামী শরীয়াকে লঙ্ঘন করার কারণে। নিশ্চয় আল্লাহ্ তাআলা সুদকে হারাম করেছেন এবং তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে, “তিনি সুদকে নিশ্চিহ্ন করবেন।”[সূরা বাকারা ২:২৭৬] ইসলামী শরীয়ার স্বতঃসিদ্ধ কথা আল্লাহ্ তাআলা সুদকে নিশ্চহ্ন করবেন, সুদকে ধ্বংস করবেন। এমন কিছু মানুষ আছে তাদেরকে আপনি যদি বলেন- ‘সুদ হারাম’, ‘সুদী কারবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্তঃরায়’ তারা গোলমাল লাগিয়ে দিবে এবং একথাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করবে। আর এ ব্যক্তিগুলোই আজ তাদের দুচোখ দিয়ে অর্থনৈতিক ধ্বস নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করছে। বড় বড় কোম্পানী ও ব্যাংকগুলোতে আজ যে দেউলিয়াপনা দেখা দিয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ্র আইনকে লঙ্ঘন করার কারণে। মুসলিম উম্মাহর উচিত আল্লাহ্র আইনের দিকে ফিরে আসা এবং আল্লাহ্র বিধানের আলোকে তাদের অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। যেন আল্লাহ্ তাদের ধর্ম, তাদের সম্পদ ও তাদের অর্থনীতিকে নিরাপদে রাখেন। নিঃসন্দেহে আজ উম্মাহ্র শক্তিশালী অর্থব্যবস্থা ও সফল বিনিয়োগের বড় প্রয়োজন। এজন্য মুসলিম দেশগুলোর মাঝে পারস্পারিক সহযোগিতা গড়ে উঠা উচিত। যেন মুসলিম উম্মাহ্র অর্থনীতি শক্তিশালী হয় এবং বিধর্মীরা আমাদেরকে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়। এ অর্থ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে শরীয়ার মৌলনীতির ভিত্তিতে। যা প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়, দয়া ও অনুগ্রহের ভিত্তিতে।
মুসলিম উম্মাহ্,
ইসলামে নিরাপত্তার আরেকটি দিক হলো- চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারনার নিরাপত্তা। মানুষের জানমালের চেয়ে তার বিবেক-বুদ্ধির গুরুত্ব কম নয়। একদল চোর যেমন মানুষের ধন-সম্পদ চুরি করে বেড়ায় ঠিক তেমনি বড় বড় চোরেরা মানুষের বিবেক চুরি করে। ইসলাম মুসলমানদের চিন্তাচেতনা ও ধ্যানধারনাকে হেফাযত করার দায়িত্ব নিয়েছে। এজন্য ইসলাম বাড়াবাড়ি ও শৈথল্য থেকে বারণ করেছে। পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন থেকে নিষেধ করেছে। বরং ইসলাম ভারসাম্য রক্ষা করার মহানবাণী নিয়ে আগমন করেছে। “আমরা তোমাদেরকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানিয়েছি।”[সূরা বাকারা ২:১৪৩] ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে তাদের সমাজ নিরাপদে থাকবে এবং সমাজের সদস্যরা পারস্পারিক সহযোগিতার ভিত্তিতে কল্যাণের কাজে এগিয়ে যাবে। নিরাপত্তার আরেকটি শাখা হলো- নিরাপদ প্রচার। কারণ নতুন নতুন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আবিষ্কার হওয়ার মাধ্যমে আজকের বিশ্বে মিডিয়ার ক্ষেত্রে যে বিশাল বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে এগুলো উম্মাহর পিঠে এক একটি নতুন বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। এগুলোর অনিষ্ট থেকে রক্ষা পেতে হলে ইসলামী বিধি-বিধানকে আরো ঘনিষ্টভাবে আঁকড়ে ধরা আবশ্যক। কারণ এগুলো হচ্ছে উম্মুক্ত প্রচার মাধ্যম। এগুলোর মাধ্যমে নানারকম বিভ্রান্ত ধ্যানধারনা ও চিন্তাচেতনা সম্প্রচার করে বিপরীতপ্রান্তের শ্রোতা ও দর্শককে প্রভাবিত করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। এ কারণে এসব মিডিয়ায় তুলে ধরা প্রোগ্রামগুলোকে অত্যন্ত সাবধানতার সাথে গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে এসব মিডিয়া নিরবে সন্ত্রাসী কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যাকে অনেকে বলেন “ইলেক্ট্রনিক সন্ত্রাস”। এ মিডিয়াগুলো ব্যক্তি ও সমাজের সর্বনাশ করে ছাড়ছে। কতগুলো কল্পিত, বানোয়াট ও বিধর্মীদের কাছ থেকে ধারকৃত চরিত্রকে উপস্থাপন করার মাধ্যমে এ মিডিয়া সমাজে সবধরনের অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। সেজন্য উম্মাহ্র সদস্যদেরকে সঠিক জ্ঞান দিতে হবে, এসব মিডিয়ার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করতে হবে এবং এর দ্বারা প্রতারিত হওয়া থেকে সমাজকে বাঁচাতে হবে। মুসলিম বিশ্বের আলেম-ওলামা, দায়ী ইলাল্লাহ্, ইসলামী চিন্তাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষকদেরকে আমি আহ্বান জানাই- আপনারা এ মিডিয়াগুলোকে সত্য প্রচারে ব্যবহার করুন, বাতিলকে প্রতিহত করুন। এ মিডিয়ার মাধ্যমে জাতিকে সঠিক পথের নির্দশনা দিন।
প্রবন্ধটি ১৪২৯ হিজরীতে আরাফার ময়দানে প্রদত্ত খোতবা থেকে সংকলিত ও অনুদিত।