সকাল বেলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে ভবের আলী কুকুরটিকে প্রথম দেখতে পায়। গেটের গোড়ায় কুকুরের কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে থাকাটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। ফলে ভবের আলী বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু একটু পরেই হকার যখন পত্রিকা দিতে এসে তার পুরনো সাইকেলটি গেটের সামনে দাঁড় করিয়ে নাক চেপে ধরে কলিং বেলে চাপ দেয়, সে দৃশ্য ভবের আলীকে না ভাবিয়ে পারে না।
পত্রিকা নেয়ার জন্য নয়, অনেকটা কৌতূহলী হয়েই ভবের আলী নিচে নেমে আসে। গেট খুলে দাঁড়াতেই ওয়াক শব্দে মুখের মধ্যে জমে থাকা পেস্টের সাদা ফেনা উগড়ে দেয় রাস্তার ওপর। ভবের আলী আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। গেট লাগিয়ে যে গতিতে সে নেমে এসেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ গতিতে উঠে আসে বারান্দায়।
কী বিশ্রি গন্ধ রে বাবা!
বদরুলকে ডাক দিতে গিয়ে পেটের ভেতরটা পুনরায় গুলিয়ে ওঠে ভবের আলীর। সাতসকালে উটকো ঝামেলা! কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু কী করা উচিত হঠাত্ করে কোনো কিছুই মাথায় আসে না তার। কেউ মারা গেলে প্রথমে নিকটাত্মীয়দের খবরটা জানানো উচিত। যদিও এখন পর্যন্ত মৃত কুকুরটির আশপাশে কোনো কুকুর দেখেনি সে। এখানে কুকুর না হয়ে কাক হলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। এতক্ষণে কাকের হাট বসে যেত আশপাশে বাড়ির ছাদে, জানালার কার্নিশে কিংবা ডিশ লাইনের তারের ওপর। বিনা তারেই তারা জেনে যায় সমগোত্রীয় কারো মৃত্যুর খবর।
এমন অনেক বারই দেখেছে ভবের আলী। মৃত কাককে শেষ বিদায় জানাতে জীবিতরা কা কা শব্দে কীভাবে বাতাসে মাতম তোলে। কুকুরদের সমাজে এই নিয়ম রয়েছে কিনা ভবের আলীর জানা নেই। তারা জীবনের শুরু এবং শেষ এই দুই নিয়ে খুব একটা ভাবে বলেও মনে হয় না। এ দেশে কুকুরের জাতটাই এমন, খাঁটি বহেমিয়ান। নইলে দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে কুকুরটা তার বাড়ির সামনে এসে নির্লজ্জের মতো মরে পড়ে থাকবে কেন?
ভবের আলীর একবার মনে হয় ঘটনাটা আগে থানায় জানানো দরকার। পরক্ষণেই পুলিশের স্বভাবের কথা মনে হতেই ভাবনাটা বাতিল করে দেয় সে। থানা-পুলিশের ঝামেলায় সে যেতে চায় না। কারণ পুলিশ সম্পর্কিত তার অজ্ঞতাজনিত অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়।
এইতো সেদিন তাদের ফ্যাক্টরি থেকে শিপমেন্টের জন্য গার্মেন্টস পণ্য রেডি করা হচ্ছিল। সেখান থেকে কয়েক কার্টন সরিয়ে ফেলার এক পর্যায়ে একজন ধরা পড়ে গেল। একেই বলে সিসি ক্যামেরার তেলেসমাতি। চোরকে ঘিরে ছি ছি রব উঠল। কিন্তু সে ব্যাচারা তথৈবচ। দোষ স্বীকার তো করলোই না, উল্টো হি হি করে হাসে।
সোহেল সাহেব কিউসি দেখেন। অনেক কিছুই তাকে কন্ট্রোল করতে হয়। সেই সোহেল সাহেবও হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, হবে না, ঘাগু চোর। কোয়ালিটি ভালো। পুলিশে খবর দেন।
থানায় ফোন করা হলো। পুলিশ দুদিনের মধ্যে চোরাইমাল উদ্ধারের আশ্বাস দিয়ে চোরকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে হ্যাচকা টানে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে গেল। কিন্তু হায়! একদিন যায়, দুইদিন যায় চোরাইমাল আর উদ্ধার হয় না। উল্টো কিছুদিন পর সেই চোরকেই এলাকায় বীরদর্পে ঘুরতে দেখা গেল। ফ্যাক্টরির লোকেরা আরও দেখতে পেল যে, পুলিশের সোর্স এবং সেই চোরের গায়ে ফ্যাক্টরির চুুরি যাওয়া জামাগুলোই শোভা পাচ্ছে। ভবের আলীর অনেকদিন মনে হয়েছে, ‘শার্টগুলো সে থানা থেকে কত দিয়ে কিনেছে?’ কথাটি জিজ্ঞেস করবে কিন্তু সাহস হয়নি।
সোহেল সাহেব তো এ ঘটনা শুনে হেসেই অস্থির। একদিন সুযোগ পেয়ে লাঞ্চ আওয়ারে সে পুলিশ নিয়ে সহকর্মীদের একটা চুটকিও শুনিয়ে দিল।
এক মৌলভীর বাড়ির পাশে একখণ্ড জমি ছিল। জমির বিষয়ে বেচারা খুবই স্পর্শকাতর। গ্রামের মানুষ বিষয়টি ভালো করেই জানে। তাই স্বজ্ঞানে কেউ তার জমিতে পা দিত না। একদিন ফজরের আজানের পর জমির ঠিক মাঝখানে নড়াচড়ার শব্দ শুনে মৌলভীর মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল।
কিয়ারে হিয়ানে! কোন হালারে তুই, এই বিয়ান রাইত তুই আমার ক্ষ্যাত নাশ কইরবার লাই আইছত? কতা কছ না কিল্লাই?
মৌলভী জিগার ডাল ভেঙে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে দেখে এক গ্রাম্য পুলিশ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসেছে। এ সময় তার মৌলভীর ডাকে সাড়া না দেয়াটাই স্বাভাবিক। উল্টো পুলিশ দেখে মৌলভীর সাড়াশব্দই থেমে গেল। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়ে সে জিগার ডাল এগিয়ে দিয়ে বলল, ও আন্নে নি! হাগেন ছার, লাঠিত ভর দিয়া আরাম কইরা বইসা হাগেন।
এ গল্প ভবের আলী ছাত্রজীবনেই শুনেছে। পুলিশের সঙ্গে সাধারণের সম্পর্ক এখন আর ওরকম নেই। তবে পুলিশের সঙ্গে দুর্নীতিবাজদের একটা সম্পর্ক আছে একথা ভবের আলী বিশ্বাস করে। নইলে সেদিন ওই চোর হাতেপায়ে ধরে বারবার বলবে কেন, আমারে মাইরেন না। আমারে পুলিশে দিয়া দেন।
চোর-পুলিশ মাসতুতো ভাই কথাটি কী এ কারণেই বলা? কে জানে!
পুলিশ নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে পারছে না ভবের আলী। সে অনেক ভেবে সিটি করপোরেশনে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিল।
একবার, দুইবার, তিনবার রিং হলো কিন্তু ওপাশ থেকে সাড়া পাওয়া গেল না। ভবের আলী জানে ভোট না এলে এদের সাড়াশব্দ খুব একটা পাওয়া যায় না। তাই নাছোড়বান্দা হয়ে চতুর্থবার রিং করল সে। এবার কাজ হলো। ওপাশ থেকে ব্যস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কাকে চাই?
জি, মানে সুনির্দিষ্ট কাউকে চাচ্ছি না।
তাহলে ফোন করেছেন কেন?
একটা বিষয় জানাতে চাই।
এটা পত্রিকা অফিস না।
একটা কুকুর ...
কুকুর দিয়ে আমরা কী করব?
আপনারা আসলে বেওয়ারিশ কুকুর ...
মুখ সামলে কথা বলবেন।
সরি, আপনি যা ভাবছেন আমি তা মিন করিনি।
কী মিন করে কথাটা বললেন শুনি?
আমার বাসার সামনে একটা কুকুর মরে পড়ে আছে।
দেখুন, আমরা বছরে একবার বেওয়ারিশ কুকুর নিধন করি বটে কিন্তু সেটা মেয়র সাহেবের খুব কাছের কেউ কুকুর দ্বারা আক্রান্ত হলে। এ বছর এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই আপাতত বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ে আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই। তাদের পরিবার পরিকল্পনা নিয়েও আমরা ভাবছি না।
ঠাস করে ফোন রেখে দেয়ার শব্দ হতেই ভবের আলী বিরক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বদরুলকে দিয়ে কুকুরটি মাটি চাপা দেবেন। বদরুল মহা বদ। বদ ছেলেরা এ ধরনের কাজ ভালো করতে পারবে। বদরুলকে ডেকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নির্ভার হলেন ভবের আলী।
এর ঠিক আঠারো ঘণ্টা পর ভবের আলীর বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্তব্যরত তরুণ পুলিশ অফিসারের জট পাকানো জেরার মুখে মুখ থুবড়ে পড়লেন তিনি।
আপনার কেন মনে হলো কুকুরটি বেওয়ারিশ? জানেন এটা কার কুকুর? ওকে, বেওয়ারিশ যখন মনে হয়েছে তখন আঞ্জুমান মফিদুলে খবর দিলেন না কেন? এট লিস্ট পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে একটা বিজ্ঞাপন দিতে পারতেন। তাছাড়া এটা স্বাভাবিক মৃত্যু না হত্যা সেটা আপনি নিশ্চিত হলেন কীভাবে? মৃতের পোস্ট মর্টেম না করেই তড়িঘড়ি করে কবর দেয়ার মানে কী? এবং সবচেয়ে সন্দেজনক হলো আপনার বাসার সামনেই কুকুরটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল কেন?
ভবের আলী বুঝতে পারে না বেওয়ারিশ একটা মৃত কুকুরের সঙ্গে তরুণ পুলিশ অফিসারের এতগুলো কেন-এর সম্পর্ক ও উদ্দেশ্য কী? তাহলে কী মৃতের নিকট আত্মীয় হিসেবে পুলিশকে খবর না দিয়ে কোথাও ভুল করে ফেলেছেন তিনি? প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায় ভবের আলী। চোখের সামনে চুয়ান্ন ধারা ছাড়া সে আর কিছুই দেখতে পায় না।