নেপোলিয়ন বোনাপার্ট পড়ুয়া ছিলেন। সময় পেলেই তিনি বই পড়তেন। একবার সমুদ্রপথে ভ্রমণের সময় তিনি ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়েন। সেসময় তিনি জাহাজের কেবিনে বসে বই পড়ছিলেন। এক নাবিক এসে ঝড়ের কথা বলতেই তিনি তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, একমাত্র ঈশ্বরই পারেন আমাদের এই বিপদ থেকে বাঁচাতে। তাই এই মুহূর্তে আমার কাজ হলো বইটি পড়ে শেষ করা। কারণ যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ জ্ঞান আহরণ করা কর্তব্য।
সৈয়দ মুজতবা আলী জ্ঞান আহরণের দুটি উপায়ের কথা বলেছেন। এক দেশ-বিদেশ ভ্রমণ, দুই বই পড়া। যেহেতু ভ্রমণ সবসময় সবার পক্ষে সম্ভব নয় সেহেতু বই পড়াটাই শ্রেয় বা সহজ। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বাঙালি রাশিফল এবং ব্যাংকের চেক বই ছাড়া আর কোনো বইই মনোযোগ দিয়ে পড়ে না। এমনকি পাঠ্য বইও নয়! বাঙালি শেয়ার মার্কেটে গিয়ে ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, পকেটের পয়সা খরচ করে প্রেমে পড়তে পারে, প্রেমিকার পিছু নিতে গিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে ম্যানহোলে পড়তে পারে, চায়ের টেবিলে অবলীলায় জাতির ভবিষ্যত পড়তে পারে কিন্তু বই পড়া তার কর্ম নয়। তবে আশার কথা এই যে, বাঙালি বই পড়া শিখছে। এবং এই শেখাটা অনেকটা বাধ্য হয়ে। আপনি এখন জানতে চাইবেন, সেটা কীভাবে? বলছি।
বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, অনুবাদ সব বিষয়েই বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু এগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে বইগুলো গড়ে ভালো বিক্রি হয়, সেগুলো হলো রান্না শেখার বই! একশ টাকায় একশ পদের রান্না। সঙ্গে এক আইটেম ফাও। আর কী চাই! বাঙালি স্বামী দেখছে তাকেও তো খেয়ে-পড়ে বাঁচতে হবে। সুতরাং কেনো রান্নার বই। বাঙালি যুবক ভাবছে ক্যারিয়ার তো তাকেও গড়তে হবে। সুতরাং কেনো স্বপ্ন ছোঁয়ার কৌশল। রূপচর্চার বইই বা বাদ যাবে কেন? সুতরাং এ বিষয়ক বইও বেশ ভালো বিক্রি হয়।
আপনি হয়তো এবার রেগে গিয়ে বলবেন, তাহলে কী কাব্য, সাহিত্য এগুলো বিক্রি হয় না? হয়, আলবাৎ হয়। কিন্তু সেই হওয়াটা হাওয়ার মতো। চোখে পড়ে না। সিডনি স্মিথ একবার বলেছিলেন না, ঘরের কোনো আসবাবপত্রই বইয়ের মতো সুন্দর নয়, সমঝদার বাঙালি বিষয়টি বুঝে গেছে।
প্রকাশকেরাও বুঝেছেন, বইয়ের ব্যবসা মানেই ফেব্রুয়ারির বইমেলা। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বছরের আর কোনো সময় বই বিক্রি হলে হতে পারে কিন্তু বই প্রকাশ করা যাবে না। নাছোড়বান্দা লেখকের চাপেই হোক অথবা ব্যবসার খাতিরেই হোক বই প্রকাশ করতে হবে বইমেলাতেই। তাতে প্রেসে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের জ্যাম লাগে লাগুক, বাঁধাইখানায় এক বইয়ের মধ্যে আরেক বইয়ের ফর্মা ঢুকে যায় যাক তবুও বইমেলাতেই বই প্রকাশ করতে হবে। এবং এভাবে করতে গিয়ে যেখানে প্রকাশকের ঘাম ছুটে যাচ্ছে সেখানে প্রুফ দু’এক জায়গায় ছুটে গেলে এ আর এমন কী! না প্রকাশক, না লেখক কেউ কেয়ার করছেন না। অথচ ভুল ওষুধের মতো ভুল বইও যে সমান ক্ষতিকর এ কথা আমরা আর কবে বুঝব? এখন এই প্রকাশকদের কাছে আপনি যদি জানতে চান, এতো বই প্রকাশ করেন কেন? উত্তর মিলবে না। উত্তর আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি বহুভাবে। সরল অংকের মতো উত্তর মিলতে গিয়েও শেষপর্যন্ত মেলেনি।
ফেব্রুয়ারি এলেই লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, পাঠক এমনকি যারা পাঠক নন তারাও বইমেলার কল্যাণে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে মিডিয়ায় কথা বলার সুযোগ পান। সুযোগটি লেখক যেমন নেন, প্রকাশকও নেন। ভাবতে অবাক লাগে, পেঙ্গুইনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার অ্যালেন লেন জীবনে এতো সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কিনা জানি না, অথচ আমাদের প্রকাশকেরা ফেব্রুয়ারিতে সাক্ষাৎকার দেন প্রতিদিন। এদেশে লেখককে রয়্যালটির টাকা দেওয়ার চেয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া অনেক সহজ।
অনেক তরুণ লেখকের মুখে শুনেছি বলেই কথাটি এভাবে বলা। প্রকাশক হয়তো বলবেন, বই বিক্রি হয় না। রয়্যালটির টাকা কীভাবে দেব? সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো, তাহলে বইমেলা এলেই তাড়াহুড়া করে এতো বই প্রকাশ করছেন কেন? বই প্রকাশের আগে পান্ডুলিপি যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি কি আপনি গুরুত্ব সহকারে করেন নি? প্রকাশক বই প্রকাশ করতে না চাইলে লেখকের যেমন সাধ্য নেই তাকে দিয়ে বই প্রকাশ করানোর, তেমনি লেখক-প্রকাশক চুক্তিপত্র ব্যাতীত লেখক পান্ডুলিপি দিতে না চাইলে প্রকাশকের সাধ্য নেই সেই পান্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশ করার। সুতরাং উভয় পক্ষকেই সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটা যেমন বই কিনে দেউলিয়া হওয়ার যুগ তেমনি বই প্রকাশ করেও দেউলিয়া হওয়ার যুগ। প্রকাশক এবং তরুণ লেখক উভয়ের জন্যই কথাটা সত্য।
অমর একুশে বইমেলা এবার অতীতের তুলনায় ব্যাতিক্রম। এবারের বইমেলা শুধুমাত্র প্রকাশকদের মেলা। এখন কথা হলো, যদি ভালো মানের সাহিত্য, দার্শনিক তত্ত্বমূলক গ্রন্থ, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস প্রভৃতিবিষয়ক বই যতক্ষণ নিয়ে নির্ভুল, সুলিখিতভাবে প্রকাশিত না হয় তাহলে শুধুমাত্র প্রকাশকদের মেলাই হোক অথবা সুশৃঙ্খল মেলাই হোক তাতে জাতির কোনো উপকার হবে না। কারণ আর যাই হোক জঙ্গল থেকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন পাওয়া গেলেও বই জঙ্গল থেকে একসময় উঁইপোকা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। ইতালীয় প্রবাদে আছে, খারাপ বইয়ের চেয়ে নিকৃষ্টতর তস্কর আর হয় না। অন্যদিকে ইংরেজি প্রবাদ বলছে, ভালো বই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু আজ এবং চিরকালের জন্য। ভালো বই তৈরির দায়িত্ব প্রকাশকদেরকেই নিতে হবে। বই জঙ্গল থেকে পাঠককেই খুঁজে বের করতে হবে গ্রন্থ ফুল। আর এখানেই এসে যায় বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব-কথা। কারণ মেলার পরিসর বাড়িয়ে পাঠককে ঘুরে, দেখে, পড়ে, বুঝে বই কেনার সুযোগ করে দিতে হবে। বাংলা একাডেমী এবারের মেলা প্রকাশকদের বইমেলায় পরিণত করেছে। সাধুবাদ তাদের প্রাপ্য। কিন্তু এই উদ্যোগ তখনই পূর্ণতা পাবে যখন আমাদের এই প্রাণের মেলা প্রকাশকের সঙ্গে পাঠকের মেলাতেও পরিণত হবে।