কবি শামসুর রাহমান : স্মৃতি-অনুভবে
বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠকবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন মানে বাঙালির আনন্দের একটি দিন। আমাদের প্রজন্মের সৌভাগ্য যে তাঁকে চাক্ষুষ করেছি। আমরা মাইকেলকে দেখিনি, রবীন্দ্রনাথকে দেখিনি, নজরুলকে দেখিনি, জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব-সুধীন-অমিয়-বিষ্ণুকে দেখিনি, সুকান্তকে দেখিনি, জসীমকে দেখিনি, কিন্তু রাহমান-সুনীল-শক্তি-বিনয়-মাহমুদকে দেখেছি। নিজের দশকের শীর্ষস্থানীয় তো বটেই নিজের সময়ের বড় কবি হিসেবেই তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। কেবল কবিতা নয়, শিশুসাহিত্য, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধসাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি ব্যাপক সাফল্যের নজির রেখে গেছেন।
শামসুর রাহমান চলমান রাজনীতির প্রায় সকল গণমুখী কর্মসূচির সঙ্গে একাত্ম হয়ে কবিতা লিখেছেন। গণমানুষের কবি হিসেবে তিনি সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু এই রাজনীতিমনস্কতাকে কেউ কেউ দলীয় সমর্থন মনে করে তাঁর সমালোচনা করেছেন। তবু তিনি বিশ্বাসের প্রতি অটল ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ভারতে গিয়ে অবস্থান করেননি বলে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এক কবি মাঝেমধ্যে কটাক্ষ করে কথা বলেন। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে কী করেছেন, আর শামসুর রাহমান অবরুদ্ধ বাংলাদেশে বসে কী করেছেন, তার তুলনা করলেই 'ম্যাঁও' ধরা পড়ে। শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে কবিতা লিখেছেন, তা-ই এখন ইতিহাসের অমূল্য দলিল হিসেব বিবেচিত। বন্দিশিবিরের বাসিন্দা শামসুর রাহমান-ই প্রগতিকামী মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে রয়েছেন। আর মুক্তিযোদ্ধা দাবিদার কবিদের কেউ কেউ প্রতিক্রিয়াশীলদের দলে নাম লিখিয়ে দিব্যি আরাম-আয়েস খুঁজছেন। একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী কোনও কোনও কবি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে গল্প ফেঁদে বেড়াচ্ছেন।
১৯৯৭ সালে পাক্ষিক 'অন্যদিন' পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ শুরু করি। ফেব্র“য়রি শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধা লেখকদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন রচনার উদ্যোগ নিই। পঞ্চাশের কবি শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদ, ষাটের কবি রফিক আজাদ ও মাহবুব সাদিক এবং সত্তরের কবি আবিদ আনোয়ারের সাক্ষাতকার গ্রহণের পরিকল্পনা করি। রাহমানভাই আমাকে বলেন, 'তুমি যে অর্থে মুক্তিযোদ্ধা বলছ, আমি তা নই। আমি অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করি নাই, কবিতা হাতে যুদ্ধ করেছি।' রাহমানভাই সাক্ষাৎকার দিলেন না। আমার পরিকল্পনার কথা জেনে ষাটের এক কবি ও সাংবাদিক আমাকে ডেকে বললেন, 'তোমার প্রতিবেদনের পরিকল্পনাটি ভালো। কিন্তু আমিও যে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, আমার সাক্ষাৎকারও তো নিতে পারো।' তিনি চাকরি করতেন এমন একটি পাক্ষিক কাগজে আমি একসময় অল্পবিস্তর লেখালেখি করেছি। কিন্তু তাঁর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি না জানা থাকায় বরং লজ্জা পেয়ে যাই। আমি তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন লেখা একটি কাগজ দিই এবং সাক্ষাৎকারটি লিখিত আকারে দিতে অনুরোধ করি। তিনি পরেদিন বাসায় যেতে বলেন। ইতোমধ্যে আমি মাহবুব সাদিককেও লিখিত প্রশ্নমালা দিয়েছি। তিনি পরের দিন বইমেলা থেকে তাঁর উত্তর সংগ্রহ করার কথা বলেন। সেই কবি-সাংবাদিকের বাসা থেকে তাঁর লিখিত বক্তব্য সংগ্রহ করে মেলায় আমি মাহবুব সাদিকের বক্তব্য সংগ্রহের জন্য যাই। মেলায় একটু খুঁজেই দেখা পাই সাদিকভাইয়ের। তিনি লিখিত সাক্ষাতকারের কপিটি আমার হাতে তুলে দেন। তারপর দু'জনে মেলায় ঘুরতে থাকি। একসময় তিনি বলেন, 'আর কারো কি জবাব পেয়েছেন?' আমি বলি, 'হ্যাঁ, আপনাদের আরেক কবিবন্ধু লিখে দিয়েছেন।' ওই কবির নাম শুনেই তিনি চমকে উঠলেন। বললেন, 'দেখি ও কী লিখেছে?' আমি পকেট থেকে আগের পাওয়া কাগজখানা দিই। তিনি তৎক্ষণাৎ পড়ে আমাকে ফেরত দেন এবং নিজের লেখাটা একটু দেখতে চান। বলার ভঙ্গিটা এমন যেন ওতে আরো কিছু তথ্য যোগ করবেন। আমি লেখাটি বাড়িয়ে দিতেই তিনি ছো মেরে নিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে মেলার ঘাসে ছড়িয়ে দিলেন। এবং মেলার গেটের দিকে দ্রুত বেগে পা ছোটালেন। আমি পেছন পেছন দৌড়ে যাই। তিনি মেলার বাইরে চলে গেলেন এবং বাসার দিকে ছুটলেন। সাদিক ভাইকে কখনো উত্তেজিত হতে দেখি নি। আমার কোনো আচরণে এই প্রতিক্রিয়া হবে ভাবতে পারিনি। আবার প্রকৃত কারণটাও বুঝতে পারছি না। তাই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তিনি এবার শান্ত ভঙ্গিতে বলেন, 'ও যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়, তাহলে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে চাই না। তাই আমার সাক্ষাৎকার ছিঁড়ে ফেলেছি। যান এব্যাপারে আর আমি কথা বলব না। পারলে রফিক আজাদকে জিজ্ঞেস করুন'। সাদিকভাই চলে গেলেন। আমি ওই কবি-সাংবাদিকের আগবাড়িয়ে সাক্ষাৎকার দেয়ার রহস্য বুঝতে পারলাম। অগত্যা, আমি ওই প্রতিবেদন রচনা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু আমার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে জানান দিতে চাওয়া ওই কবি-সাংবাদিক ক্ষেপে রইলেন। ঝোঁপ বুঝে কোপ দিতেও ছাড়েননি তিনি। আমি একসময় কবি রফিক আজাদের কাছে ওই ঘটনার কথা পাড়ি। তাঁর সাথে উনি যুদ্ধে ছিলেন কিনা জানতে চাই। রফিক ভাই বলেন, 'দেখ ভাই, যারে ক্ষমা করে দিছি। তার কথা বলা উচিত হবে না। এটা আমার নীতিতে নাই। তুমি অন্য কারো কাছ থেকে জেনে নিও।' আমার বুঝতে আর বাকি থাকে না মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবস্থান কী ছিল। কিন্তু আজ সেই বিষয়ে বলার জন্য নয়, শামসুর রাহমানের কথা বলার জন্যই ওই ঘটনা মনে পড়ল। কবি শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ না নিলেও তিনি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আর যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয় নেয়াকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে জাহির করেন কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত শক্তিশালী করেন তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা বলতে আমার বিবেকে বাঁধে। তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা বললে তো ভারতে আশ্রয় নেয়ার কারণে আমার মতো ৩/৪ বছরের বালকও মুক্তিযেদ্ধা বলতে হবে।
'বন্দিশিবির থেকে' ছাড়াও প্রতিটি কবিতায় রয়েছে দেশ-ভাষা-মানুষের মুক্তির কথা। জাতির ক্রান্তিলগ্নে তিনি বালিতে মুখ লুকিয়ে থাকেননি, কলম হাতেই ছুটে গেছেন রাজপথে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সত্তরের অন্যতম প্রধান কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও কবি মোহন রায়হানের আহ্বানে গঠন করেছেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি হিসেবে শামসুর রাহমান স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। এশীয় কবিতা উৎসবের নামে ধামাধরা কবিদের আস্ফালন বন্ধ করেছেন। পরিনামে দৈনিক বাংলার সম্পাদকের চাকরি ছাড়তে হয়েছে। তবু পিছপা হননি। তাঁর নেতৃত্বে সারা দেশের কেবল কবিরা নন, সংস্কৃতিকর্মীরা সমবেত হয়েছেন। এরশাদের পতনের আন্দোলনে শামসুর রাহমানের নেতৃত্বও আমরা সম্মান জানাই। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জাতীয় কবিতা পরিষদ এখনো সক্রিয় রয়েছে, প্রতিবছর উৎসবের মাধ্যমে কবিতাকর্মীদের ঐক্য বজায় রাখছে। এই পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করি।
শামসুর রাহমানের মৃত্যু আমার কাছে অকালমৃত্যু বলে মনে হয়েছে। হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গিয়ে একবারও মনে হয়নি তিনি ঘরে ফিরবেন না। কবি হারিসুল হকের কাছে পাওয়া তথ্য থেকে মনে হতো, দুএকদিন বিশ্রামের পরেই ঘরে ফিরে যাবেন, বসবেন তাঁর লেখার টেবিলে। কিন্তু না, সকল প্রত্যাশাকে মিথ্যে প্রমাণ করে তিনি অনন্তের পথে চলে গেছেন। তাঁর মরদেহ দেখতে আমি যাইনি। ঘরে বসে তাঁর কাব্যসমগ্র পাঠ করেছি, তাঁর ছড়াসমগ্র পাঠ করেছি, প্রবন্ধে বই পাঠ করেছি। এই তিন বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ লিখে যুগান্ত, জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজে পাঠিয়েছে। মৃত্যুর পরের শুক্রবার তা ছাপাও হয়েছে। কলকাতার 'কবিসম্মেলন' পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ওই তিনপ্রবন্ধের তথ্যের সমন্বয়ে একটি প্রবন্ধ। কিন্তু তাঁকে নিয়ে ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতিই না বলা রয়ে গেল। সময় পেলে একদিন প্রকাশ করা যাবে মহান এই কবির সঙ্গে অন্তরঙ্গ কিছু স্মৃতির বয়ান। আপাতত একটা স্মৃতির কথা বলি। রাইটার্স ক্লাব যেবছর তাঁকে 'কবিশ্রেষ্ঠ' উপাধি দেয়, ওইদিন তাঁর জন্মদিনে অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম। শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে মঞ্চে উঠে কানে বললাম, ‘রাহমান ভাই, আপনি আমার মাত্র ৩৮ বছরের বড়। আমিও তেইশে অক্টোবর’। রাহমানভাই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। এবং তাঁর অভিভাষণের সময় আমার জন্মদিনের কথা উল্লেখ করে আমাকেও শুভেচ্ছা জানালেন। শামসুর রাহমান আমার ৩৮ বছরের বড়। কবি হিসেবে তিনি ৩৮ গুণ বড়! রাহমানভাইয়ের জন্মদিন মানে আমার তো বটেই। পৃথিবীর যেকোনো কবির জন্মদিন। শুভ জন্মদিন কবি শামসুর রাহমান!
আলোচিত ব্লগ
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।
ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন