চট্টগ্রাম সফর নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখা হচ্ছে না । তারপরে জানতে পারলাম অত সাধের ল্যাপটপটা নষ্ট, ঠিক করা যাবে না । সুখের কথা তখন কলমে (পড়ুন কী-বোর্ডে) আসে না । তবু ভাল স্মৃতিগুলোকে আগলে রাখাটাই জীবন । আর ওটা করতে না পারলে বোধকরি জীবনকে উপভোগ করার মুহূর্ত কমে যাবে । খেয়াল করে দেখবেন যতটা ভাল সময় কাটান তার ঢের বেশি সেগুলোর স্মৃতি রোমন্থন করি আমরা, বোধ করি সেটাই স্বাভাবিক । দুই বা তিনটে ছোট ছোট পর্বে আমার আর বন্ধু ফারহানের চট্টলা ঘুরে আসার একটা ধারাবিবরণী লিখব । আমি লেখালিখিতে পটু নই । তাই বিরক্তির উদ্রেক হওয়াটা অস্বাভাবিক না । সেক্ষেত্রে আগেই মাফ চাচ্ছি । ধারাবাহিক এই লেখাটির নাম শখ করে রাখছি 'চাটগাঁর ডায়েরি' । আজকে লিখছি প্রথম পর্ব । ঢাকা থেকে যাওয়াটার কথা আর চাটগাঁর প্রথম দিনকার কথা লিখব বলে মনস্থির করেছি । স্মৃতিশক্তির ব্যাপারে আমি বরাবরই একটু অদক্ষ । সেদিক থেকে ফারহান আমার নামে হয়ত মামলা করবে না আমি ভুল করলে । ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে খুশিই হব ।
আমার বোধকরি কখনো আগে থেকে পরিকল্পনা করে চট্টলা ঘুরতে যাওয়া হবে না । কোথাও আজ পর্যন্ত পরিকল্পনা করে যাওয়া হয় নাই । যেমন ধরুন এই ছুটিতে যাওয়ার কথা সিলেট আর কুয়াকাটা । আর্থিক দৈন্যদশা কোনটিই করতে দিল না । বন্ধুরা রাগ করে আছে হয়ত । তবে এসব রাগের ভাল দিক হল খুব দ্রুত মাফ পাওয়া যায় । জীবনের সবক্ষেত্রেই যদি হত ! এই দেখেছেন লেখার কথা চট্টলা সফর নিয়ে, লিখছি এসব বাজে কথা । আমার অনেক দোষের এই একটা । প্রচুর কথা বলি । প্রায় সবটাই বাজে, আমাকে চেনে মাত্রই এসব কথা লোকে জানে । যাক সে কথা, কোথাও যাওয়া হবে না বলে বসে বসে মাছি মারছি উত্তপ্ত ঢাকা শহরে । হঠাৎ এক সকালে ফারহানের ফোন । বলে, "সিলেট ট্যুরের হল কী?" । বললাম ল্যাপটপ ঠিক করাতে হাজার তিনেক টাকা লাগবে যেটা আমার ট্যুরের জন্য বরাদ্দ টাকার পুরোটাই খেয়ে ফেলছে । কিছুদিন অপেক্ষা না করলে এ অধম যেতে পারবে না । ফোন রেখে দিল ফারহান । কিছুক্ষণ পর আবার কল করে বলে, "চিটাগাং যাবি ? ফুফু ডাকতেসে বহুদিন । একজন নিয়ে যাওয়ার অনুমতি আছে । যাওয়া-আসা ছাড়া কোন খরচ নাই ।" আমি মহা সংকটে । কারণ এই যাওয়া আসার টাকাটাও পকেটে নাই । স্টুডেন্ট একটা পড়াই বটে তবে মাস তিনেক সে টাকা দেয় না । বড়লোকি সবই করে, আমার টাকার ক্ষেত্রে তাদের নজর নাই । তারপরও এসুযোগ ছাড়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার । তাই সম্মতি দিয়ে বসলাম তখনি । জানলাম সেরাতেই রওনা হব । বাধ্য হয়ে নিপো ভাইকে ফোন । আমার সব বিপদের ফোনকল । ভাইয়ের কাছে বড় মুখ করে বললাম এক হাজার টাকা দেন, বরাবরের মত এবারও আমার আবদার তিনি রাখলেন । আরও দরকার এক হাজার টাকা । এটা অবশ্য ম্যানেজ করা কঠিন ছিল না । আমার ভাই নিশান ভাইয়াকে ফোন দিয়ে বলতেই আরও হাজার খানেক টাকা জোগাড় করা গেল । পকেটে ছিল চারশ টাকা আর কিছু খুচরো । এই করে আমি গেলাম সন্ধ্যের দিকে ফারহানের বাসা । খেয়ে দেয়ে আব্দুল্লাহপুর থেকে বাসে উঠব বলে গেলাম । বলে রাখি ফারহানের পকেটও আমার থেকে খুব বেশি ভারি ছিল না । আব্দুল্লাহপুর গিয়ে দেখি ইউনিক পরিবহণের কাউন্টার ওখানে নেই । বাধ্য হয়ে শ্যামলীতে টিকিট কাটা । অতীতের মত এবারও তাদের সার্ভিস ছিল যাচ্ছেতাই । বান্দরবন গেছিলাম একবার শ্যামলী বাসে । সেবার তাদের গাড়ি মাঝপথে নষ্ট হয়েছিল, এবারও ! বরাবরের মত এবারও চট্টগ্রাম যাওয়াটা আমার জন্য ক্লান্তিকর ছিল ।
ভোর ছটার দিকে পৌঁছালাম মীরসরাই । ফারহানের ফুফুর বাড়ি । ফুফু বেশ মজার মানুষ । ফুফা আবার শিক্ষক মশাই । কলেজে পড়ান অর্থনীতি ! চাকরি করেছেন গ্রামীণ ব্যাংকে । আমার আব্বুও করত একসময় । নাম বলতেই চিনে ফেললেন । সে বিশাল গল্প ! সেদিনের প্ল্যানে ছিল খৈয়াছড়া ঝর্ণা, মুহুরি প্রজেক্ট আর মহামায়া রাবার ড্যাম । ফারহানের ফুফাত ভাই আবরার যাবে আমাদের সাথে খৈয়াছড়া ঝর্ণা, যদিও স্থানীয় হবার সুবাদে সে এরমধ্যেই তিন চার বার দেখে ফেলেছে এই ঝর্ণা । সকালে ভরপেট খেয়ে বের হলাম খৈয়াছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে । মীরসরাই থেকে প্রথমে লেগুনায় করে ঝর্ণার এলাকা(নামটা মনে নেই), তারপর সিএনজিতে করে পাহাড় পর্যন্ত যাওয়া । এ পর্যন্ত সমস্যা হয় নি । তারপর মাইল দুয়েক হেঁটে ঝর্ণার পাদদেশে যাওয়া । কিন্তু এটা হল তিন নম্বর ঝর্ণা । আরও আটটা ঝর্ণা আছে । দুর্গম আর সাথে আবরার থাকাতে যাওয়া হয় নি আর । গোসল করেছি । ঝর্ণার পানির সব থেকে ভালদিক হল সেটা খুব ঠাণ্ডা । সে রোদতপ্ত দিনে আমাদের কাছে তা স্বর্গীয় মনে হচ্ছিল । স্বর্গের মত সুন্দরও জায়গাটা । হাঁটছিলাম, একে তো দুর্গম কিন্তু পাহাড়ের সৌন্দর্য কষ্টটা গায়ে মাখতে দিচ্ছিল না । পাহাড়ের একটা ব্যাপার আছে । এটা আপনাকে ডাকবে । খুবই ভয়ানক সে ডাক । আপনার যেতে ইচ্ছে করবে খুব । ভাগ্যিস আবরার ছিল, না হলে অনভ্যস্ত শরীরে পাহাড় বেয়ে উঠতে গিয়ে লঙ্কারাণ্ড হয়ে যেত । খুব করে মন চাচ্ছিল যে যাই, তবে যাওয়া হয় নাই । আমার সাথে এই হাঁটাহাঁটি আর ঝর্ণায় গোসল করার সুবাদে আবরারের ভাল একটা সম্পর্ক হয় । ওর ই বা কী দোষ? নিজের ভাই সারারাস্তা ফোনে কথা বললে আমার সাথে কথা বলা ছাড়া উপায়ও ছিল না ! ফারহান পারলে গোসলের সময়ও ফোনে কথা বলে । ছেলেটা গত এক বছরে বদলেই গেল পুরোটা ।
ঝর্ণা থেকে ফেরত আসার সময় বোঝা গেল পথ কতটা বড় ছিল । এবার তো আর ঝর্ণায় গোসল করার মুলোটা সামনে ঝুলোনো ছিল না । পথটা তাই স্বাভাবিকভাবেই বড় মনে হচ্ছিল । আবার ফুফুর বাড়ি । দুপুরে পোলাও মাংস খেয়ে কোনরকম বিশ্রাম না নিয়েই মহামায়া পার্ক আর মুহুরি প্রজেক্ট দেখব বলে বের হওয়া । মুহুরি প্রজেক্ট অনেক দূর । মীরসরাই থেকেও যেতে প্রায় ঘণ্টাদুয়েকের মত লেগে গিয়েছিল । চারপাঁচবার গাড়ি পরিবর্তন আর সোনাগাজীতে মানুষ খুন হওয়ার ঘটনাটাও বোধ করি কিছুটা প্রভাব রেখেছিল । সবাই যেতে মানা করে । আমরা না শুনে আগাতেই থাকি । তবে গিয়ে বুঝি না গেলে বড্ড মিস হয়ে যেত । মুহুরি প্রজেক্ট এমন আহামরি কিছু না । ড্যাম মতন কিছু একটা আছে মাতামুহুরি নদীর উপর । নদী শাসনের উদাহরণ বলতে পারেন । এক পাশে নদী খরস্রোতা, আরেক পাশে তা বোঝার উপায় নেই । বায়ুবিদ্যুতের কিছু উইন্ডমিল ছিল । তবে কতটা কাজ করে তা দেখে বোঝার উপায় নেই । তাহলে মুহুরিপ্রজেক্ট না গেলে কেন মিস করা হত? কারণ বাতাস । নির্জলা বাতাস । এত বাতাস যে আপনার জায়গাটা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করবেই না । তারউপর আসার আগে ফুফা বলছিলেন যে কেন এটা আসলে চট্টগ্রামের ভেতর পড়া উচিত, ফেনীতে না । ফুফু কিন্তু এটা নিয়ে মজা করতে ছাড়ে নি ! সেখানে গেলে জীবন নিয়ে ভাবগম্ভীর কথা বলতে ইচ্ছে হবে । আমরাও তেমন কিছু করেছি । কী করেছি? সেলফি তুলেছি । অনেক ছবি তুলেছি । এটাই আমাদের জীবনকে নিয়ে গুরুগম্ভীর হওয়া । এর বেশি কিছু করতে পারার কথাও না ।
কোথায় কে খুন হয়েছে, সে গল্প শুনলাম । ওটা করতে করতে সন্ধ্যে হয়ে গেল । দেরীটা বোধ করি ইচ্ছে করেই করা । বাতাসটা বড্ড ভাল লাগছিল। তারউপর মানুষগুলো কষ্ট করে মাছ ধরছে অমন খরস্রোতা নদীতেও ! দেখছিলাম আর ভাবছিলাম একদিন ওয়াইফাই না থাকলে আমরা জীবন কেন ভাল না তা নিয়ে কষ্ট পাই ! কষ্ট আমরা জানিও না, করা অনেক পরের কথা । সেদিন আর মহামায়া যাওয়া হয়নি, স্বাভাবিক কারণেই । সেটায় গেছি তার পরের দিন । গিয়েছি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথের পাহাড় আর তার শিখরের নিষিদ্ধ শিব মন্দিরেও ।জান নিয়ে ফেরত আসতে পেরে আমরা দুজনই খুব খুশি । সে গল্প পরের পর্বে । (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০১৬ সকাল ৮:৪৫