বান্দরবনের প্রথম দিন হিসেবে আমাদের সকালে যেতে যে গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার কারণে দেরি হয়ে গিয়েছিল তা ইতোমধ্যে আপনাদের বলা হয়ে গেছে । তো, গাড়ি ঠিক হয়ে গেল । সমস্যা হল তখনো কারো পেটে কিছু পড়ে নি । সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে বলে বেশির ভাগ দোকানে নাস্তা শেষ । যা হোক অনেক ঘুরে খাওয়ার একটা বিহিত করতে পারলাম । প্রত্যেকের ভাগ্যে দুটো করে মোটে পরোটা জুটল । তা-ই সই । খেয়ে দেয়ে গাড়িতে করে যাচ্ছি, পথের মধ্যে এক দলের সঙ্গে দেখা । তারাও আমাদের সাথে যেতে চায় । আমাদের উদ্দেশ্য নীলগিরি, তাদেরও বোধ করি তাই । খরচ কিছুটা কম হবে বিধায় আমরাও আর না করিনি । তাছাড়া তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একটু বেশি দামে গাড়িটা ঠিক করে ফেলেছিল লোকমান । ওটাও পুষিয়ে নেবার ব্যাপার ছিল । এরা সবাই চাটগাঁর মানুষ । একজন ছিল সারাক্ষণ কথা বলত । বেশিরভাগই অপ্রোয়জনীয়। আমরা কিছু শুকন খাবার নিয়ে উঠেছিলাম, তারাও ।
আমরা জানতাম রাস্তায় তিন ঘণ্টা কাটাতে হবে । রাস্তার অবস্থা সম্পর্কে কোন ধারণা আমাদের ছিল না । আর রাস্তার পাশের সৌন্দর্য সম্পর্কে কোনই ধারণা ছিল না । বিশালতার একটা বিভীষিকাময় সৌন্দর্য আছে । অদ্ভুত সে ভ্রমণ, অদ্ভুত সে অনুভূতি । চালক যেভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল তাতে সারারাত গাড়িতে কাটানো আমাদের অনেকেই খারাপ বোধ করছিল । মাথা ঘুরে যাবার-ই কথা । আঁকাবাঁকা পথ, তারউপর সোজা তো যাচ্ছে না, যাচ্ছে পুরো উপর দিকে । মাঝে মাঝে একসাথে দুই তিনবার বাঁক খাচ্ছে । সহজ নয় কিন্তু । তারউপর আমাদের সঙ্গীদের একজনের কথা সেশ-ই হচ্ছিল না । কথা বলতেই আছে, বলতেই আছে । এদিকে আমরা বিশালতা দেখে মুগ্ধ হতেই আছি । একবার এপাশে তো আরেকবার অপর পাশে । আমার কানে এখনো মেহরাবের কথাটা ভাসছে, " দোস্ত আসলেই বাংলাদেশে বন মাত্র ৮ ভাগ?" ওর দোষ-ই বা আপনি কি করে দেবেন, যে দিকে তাকাচ্ছি ওইদিকেই শুধু সবুজ আর সবুজ । ভাল লাগাটা শেষ-ই হচ্ছিল না । আপনার বিরক্তি এসে যাবে, তবু ভাল লাগাটা যাবে না । আর ঐ বিশাল সবুজের মাঝে যখন সরু নদীটা দেখতে পাবেন, তখন আপনি চাইলেও ঐ সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না । ভাল লাগাটা বেড়ে যাবে তখনই যখন দেখবেন ওর মাঝে কিছু ঘর আছে, ঐ ঘরে কিছু মানুষ থাকছে ! কিছুক্ষণ পর পর আদিবাসী দের কেউ কেউ আমাদের হাত নাড়িয়ে হাসছে, কেউ কেউ আমরা যে গাড়িতে যাচ্ছি ওটা দেখে আবার হাসতে হাসতে হেঁটে যাচ্ছে । কখনো বা দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ি গরুর দল, কখনো রাস্তার পাশেই পাহাড় বেয়ে পড়া জলপ্রপাতের ছোট্ট স্রোত ।
আমার চোখে এখনো ভাসে অনেক দিন পর দেখতে পাওয়া মাছরাঙা, বা নাম না জানা বর্ণিল ঐ পাখি । কেন আমাদের দেখতে পেয়েও উড়ে যায় না ওরা, তাও মাথায় আসে নি । ভাল লাগাটা বাড়তেই থাকে যখন দেখি পাহাড়ের গায়ে বেয়ে বেয়ে আমরা অনেকটা উপরে উঠে গেছি । বুঝতে পারি ঠাণ্ডা হিমেল বাতাসটা যখন মুখে ঝাপটে লাগে । আমাদের কোন কিছুই আর আগের সাথে মিলে না । আমরা তো শুধু বিশালতা দেখতে চেয়েছিলাম । এই ছোট বিষয়গুলো যে দাগ কেটে রাখবে তা বুঝিনি । আমরা ঐ মানুষগুলোর হাসির কারণ খুঁজে পাইনি । হেঁটে অতটা পথ গিয়েও ওরা হাসতে পারছে । এখন সন্ধ্যের সময় গাড়িতে চড়েও যখন ঐ হাসি পাই না, তখন ধাঁধায় না পড়ে কোথায় যাব বলেন?
যা হোক তিনটে পুলিশ ক্যাম্পের পর আসল কাঙ্ক্ষিত নীলগিরি । ততক্ষণে তিন ঘণ্টা চলে গেছে । সত্যি বলতে আমাদের যাত্রার সময় একটা পর্যায়ে কেউই আর ঘড়ি দেখছিল না । প্রতিজন ৫০ টাকা দিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে মোটে এক ঘণ্টা সময় পেয়ে গেলাম নীলগিরি দেখতে । আগে জানা ছিল না এটা সামরিক স্থাপনা । জানলাম, দেখলাম । অপার শব্দটা আগে জানা ছিল, এবার অনুধাবণ করলাম প্রথম । যে দিকে দেখি অসীম, মাথার উপর সূর্য, তবু কিছুক্ষণ থেমেই ছিলাম । লোকমানের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দরকার ছিল, নিল কিছুটা সময় । তারপর লেগে গেলাম দেখতে, নূর আর মেহরাব বেশি ব্যাস্ত ছবি তুলতেই, লোকমানের ক্যামেরা, তাই ওকেও যোগ দিতে হল । আমিও লেগে গেলাম, যদিও এই বদখত চেহারা নিয়ে তা কতটুকু সমীচীন তা ভাবতে যাই নি । সপরিবারে এসেছিল এক সুন্দরী নারী । আমাদের কারো চোখ এড়ায় নি এটা হলফ করে বলতে পারব এখনো । ঐখানে আরো ভাল লাগছিল ওকে বোধ করি । ঘুরে গিয়ে দেখি হেলিপ্যাড আছে । যাওয়ার রাস্তাটা ঠিক করছে বিধায় আর যাওয়া হল না ওদিকটায় । বাসায় ফোন দিলাম । ওরকম জায়গা থেকে প্রতিদিন তো আর কল দেয়া যায় না !
এবার ফিরতি পথের পালা । যাবার সময় একটা লেখা মতন দেখলাম পিক ৬৯, বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু স্থান, জানতাম না ওটা সম্পর্কে । কারো জানা থাকলে বিস্তারিত জানাবেন । অনেকটা পথ যেতে হবে ভাবতেই শরীর ছেড়ে দিচ্ছিল । চিম্বুক পাহাড়ে তাই আর কেউ নামতেই চাইল না । আমি কিছুটা গিয়ে আবার ফেরত আসলাম । একা একা কি আর ভাল লাগে? ওখানে থেমে বরং কলা খেল সবাই । সস্তা, খেতেও খারাপ না । এরপর গিয়ে থামলাম শৈল প্রপাতে । একটুআধটু মুখ ধুয়েই আমাদের সকল আগহ শেষ হয়ে গেল । তেমন কিছু নেই, বা আগে এর থেকেও বড় প্রপাত দেখেছি বলে টানলনা, বুঝলাম না । ওখানে কিছু দোকান ছিল, আপু আগে থেকেই বলে দিয়েছিল কি মাতি আর কোন কাঠের কথা । ফোন দিতেই বলে দিল, আমিও কিনে নিলাম । এরপর দেখি মেহরাব আর লোকমান কিনতে ব্যাস্ত । নূর কি কিনল বুঝতেই পারলাম না । তবে লোকমান আর মেহরাব ভাল খরচ করেছে । খোদা ওদের খরচ সার্থক করুক । এবারে আবার একটানা যাত্রা । হোটেল পৌঁছানোর পর কারো শরীরে আর কিছু বাকি নেই । গোসল করে, একটু রেস্ট নিতেই দেখি ঘড়িতে ৫ টা বেজে পেরিয়ে গেছে । খেতে পাব না ধরে নিয়ে হোটেলের রেস্তোরাঁয় গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই বলল আছে । খিদের কারণে কিনা না জানি না, খেতে বড্ড ভাল লেগেছে । মুরগি, আলু ভর্তা, সবজি, ডাল আর লেবু । ওহ! সারাদিনের ওরকম ঘুরে খাওয়াটা রহমত ছিল ।
এবার গেলাম সাঙ্গু নদীতে । গোসল করার কোন উপায় নেই । নদীর পানি অস্বচ্ছ । তাই পাড়ে বসে গেলাম । নূর তো শুয়েই গেল নৌকার উপর । গান গাওয়া শুরু হয়ে গেল । বুঝতে পারছিলাম না কেউ খারাপ গাইলেই পানির ছটা এসে লাগছিল গায়ে । কেউ কেউ তো কত তত্ত্ব পর্যন্ত আবিষ্কার করার পথে, তখন শেষকালে দেখা গেল শ্যালো মেশিনের পাইপের যান্ত্রিক ত্রুটির ফসল ছিল ওটা, তবে খারাপ গানের সময়-ই কেন বারবার পানি আসছিল তা ব্যাখ্যাতীত এখনো!
সন্ধ্যের ঐ সময়টা বেশ লেগেছিল । যেতে ইচ্ছে করছিল না কারোই । অমন সন্ধ্যে কতদিন পর পেলাম তা গুনতে গিয়ে বারবার ভুলে যাচ্ছিলাম !
(চলবে)