বাংলা ব্লগিংয়ের শুরুর দিকেই বেশ কয়েকবার শব্দ হিসেবে ব্লগের ব্যবহার হবে নাকি এর বঙ্গানুবাদ হবে তা নিয়ে আলোচনা করেছেন ব্লগাররা। কয়েকজন ব্লগার ব্লগের জন্য নতুন শব্দ প্রস্তাব করেছেন। সেই প্রস্তাব জনপ্রিয় হয়নি। বাংলা শব্দভান্ডারে নতুন শব্দ হিসেবেই যুক্ত হয়েছে ব্লগ। কেবল ব্লগ নয়, যারা ব্লগে লেখেন এবং মন্তব্য করেন তাদের বলা হচ্ছে ব্লগার। এই শব্দগুলো এখন বহুল ব্যবহৃত শব্দ হয়ে গেছে। পরবর্তীতে ব্লগকেন্দ্রিক শব্দগুলোকে ক্রিয়াপদ হিসেবেও ব্যবহার শুরু হয়েছে। যেমন ব্লগ লেখা বা ব্লগ করাকে অনেকেই এখন বলছেন ‘ব্লগানো’, আবার ব্লগের কোন পোস্টে কমেন্ট করাকে বলছেন ‘কমেন্টানো’। ব্লগের বাংলা কী হওয়া উচিত এমন আলোচনা তুলে ধরা একটি পোস্টে ব্লগার হিমু লেখেছেন, “ব্লগকে আমরা খুব দ্রুত আপন করে নিয়েছি। অন্যত্র যখন বাংলা কমিউনিটি ব্লগিং মোটে শিশু, তখন আমরা সেই কয়েকজন "ব্লগ" শব্দটিকেই শুধু গ্রহণ করিনি, একে ক্রিয়াপদে নিয়ে গেছি, ব্লগানো, পোস্টানো ইত্যাদি দিয়ে। এটি বহুলচর্চিতও। এমনই অসংখ্য, মজাদার সব স্ল্যাং, প্রবচন, বাগধারা চলে এসেছে ব্লগকে কেন্দ্র করে। ব্লগ শব্দটাকে বাংলা করা, আমার কাছে তাই মনে হয়, অপ্রয়োজনীয়।”
ব্লগের ভাষা এবং নতুন শব্দ ব্যবহার কবিতার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ব্লগার রুখসানা তাজীন। তার মতে, ব্লগারদের লেখা থেকেই ভাষার নতুন শাখা জন্ম নিচ্ছে।(রুখসানা তাজীন, ব্লগের ভাষা, সামহ্যোয়ানইন ব্লগ, জানুয়ারি ২০০৮) রুখসানা তাজীনের কবিতার কিছু অংশ পড়লে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
বাঃ, সবাই কেমন "পোস্টায়" দেখ সরল গরল ঢঙের।
"প্লাসায়" কেহ দেয়নাতো প্লাস, ব্রাত্যজনের ভীড়ে,
অই, কে বা ধরো লিখবে পুরো, সময় যে ভাই বেড়ে।
"আপুনি" তাই আপুমনির শর্টকাট নিকনেম,
ও, "গদাম লাথি" শোননি হায় ছি ছি কী শেম।
ভাই "খিয়াল কইরা" পড়ো যদি "ব্লগারু"দের কমেন্ট,
"ব্যান" খাচ্ছে দেখবে যখন তখন , কখনো "টপরেট"।
আবার, সকল নামের লেজ রয়েছে যেমন ধরো "নাদু"
"প্রচু" "মডু" "অনু" "মানু" এরাই যদুমধু।
তা, "ছাগু" ধরো বিশেষ প্রাণী তাড়ায় সবাই মিলে,
আবার "ধইন্যা পাতা" পেতেও পারো উৎসাহটা দিলে।
কয়, ফারুকী ভাই, চিনলেনা হায়, "ব্যাচেলর"এর জনক
"হয়যে ভাষার বদল সদাই, নয় নাড়িয়ে টনক।
ভাষাবিদের গোলটেবিলে হয়না ভাষার খসড়া,
এই, প্রান্তজনেই ঠিক করে দেয় ভাষার আগাগোড়া।"
তাই, অধম আমি রোজ গিলে যাই ব্লগারগণের লেখা,
ধরো, এখান হতেই জনম নিলো ভাষার নতুন শাখা।
কমিউনিটি ব্লগিংয়ের কল্যানেই হয়তো বাংলা ভাষার ব্লগগুলোতে প্রচুর নতুন নতুন শব্দ তৈরি হচ্ছে। একজন ব্লগার নতুন কোন শব্দ ব্যবহার করলে তা অন্যান্য ব্লগারদের ব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ব্লগের ভাষার ক্ষেত্রে নতুন নতুন সমাসবদ্ধ পদ তৈরি, সন্ধিবদ্ধ শব্দ তৈরি, বড় শব্দকে সংক্ষিপ্তকরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা কমিউনিটি ব্লগ এভাবেই নিজস্ব ভাষারীতি পেয়ে গেছে। ব্লগারদের ব্যবহৃত ভাষা বাইরে থেকে পড়লে যে কারও কাছেই অদ্ভূত মনে হবে। ব্লগেই একটি পোস্ট লেখে ব্লগের ভাষা নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ব্লগারদের কাছে। ব্লগার পটল জানিয়েছেন ‘ব্লগীয় ভাষায় বিশেষত রম্য ও বিনোদনমূলক পোস্টের ক্ষেত্রে শব্দের নানান রূপ দেখা যায়। এখানে বিষয়বস্তুটাই প্রধান। সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস ও অন্যান্য বিষয়ে ভাষার মাধূর্য সঠিকভাবেই অনুসরণ করতে ব্লগাররা সচেষ্ট থাকে।’ (পটল, বাংলা ব্লগ- সংস্কৃতি, রাজনীতি, সম্ভাবনা, ভাষা, সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, ডিসেম্বর ২০১১)। ব্লগীয় ভাষা নিয়ে ফাহমিদুল হক লিখেছেন-“ব্লগ কমিউনিটির একটা নিজস্ব ভাষাশৈলী দাঁড়াচ্ছে। এটা প্রমিত বাংলা যেমন নয় তেমনি মুদ্রণমাধ্যমে বা সমসাময়িক সাহিত্যে কিছু তরুণ লেখকের কাছে আদর পাওয়া ‘পূর্ববঙ্গীয় ভাষা’ও নয়। ব্লগের ভাষায় আঞ্চলিকতার ছোঁয়াচ আছে, তবে শেষ পর্যন্ত তা আঞ্চলিক নয়। সেলফোন-সংস্কৃতি, বিজ্ঞাপন ও এফএম রেডিওর মাধ্যমে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া ‘ডিজুস ভাষা’ও নয় সেটা। এ এক পৃথক ‘ব্লগীয় ভাষা’। এতে প্রমিত ও কথ্য সব ধরনের ভাষারূপেরই মিশেল রয়েছে। একে কখনো মনে হবে ভাষিক অনাচার, আবার একটু খোলামনে দেখলে এর এক অদ্ভূত অনানুষ্ঠানিক সৌন্দর্য ও রস রয়েছে। দুটি শব্দকে সংযোগ করে দেওয়া বা নব নব সমাসবদ্ধ পদ সৃষ্টি করা এই ভাষাসংস্কৃতির অংশ। আবার বড়ো বড়ো নামকে সংক্ষেপে ডাকাই ব্লগীয় ভাষার রীতি।” (ফাহমিদুল হক, বাংলা ব্লগ কমিউনিটি : মতপ্রকাশ, ভার্চুয়াল প্রতিরোধ অথবা বিচ্ছিন্ন মানুষের কমিউনিটি গড়ার ক্ষুধা, যোগাযোগ, ডিসেম্বর ২০১০)
ব্লগের শব্দ ও ভাষা প্রবণতা লক্ষ করা যাক।
যুক্তাক্তর প্রবণতা – মনটা > মন্টা, মন চায় > মন্চায়/ মুঞ্চায়, ব্যাপর না> ব্যাপার্না
ইংরেজি শব্দের ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার – ব্লগিং করা > ব্লগানো, কমেন্ট করা >কমেন্টাইছি, ক্লিক করুন> ক্লিকান, পোস্টাইলাম> পোস্ট প্রকাশ করলাম
সংক্ষিপ্ত ব্যবহার – হাসতে হাসতে পড়ে গেলাম > হা হা প গে
অপভ্রংশ - চরম >চ্রম, খারাপ> খ্রাপ
ব্লগের ভাষা নিয়ে নানা অভিযোগও রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন ইচ্ছামতো কিংবা প্রচলিত শব্দের বিকৃত করে ব্লগের ভাষা অনাচার হয়ে উঠেছে। এছাড়া ব্লগের ভাষায় গালাগালিপূর্ণ শব্দযুক্ত থাকার অভিযোগও কেউ কেউ করেন। স্ল্যাং শব্দের ব্যবহার বাংলা ব্লগের বাইরেও রয়েছে। অভ্র বসু তার ‘ বাংলা স্ল্যাং - সমীক্ষা ও অভিধান’ নামের বইটিতে স্ল্যাং ব্যবহারের বেশ কিছু কারন চিহ্নিত করেছেন। কারণগুলোর মধ্যে আছে- ১. হৈ হুল্লোড় অথবা ফুর্তি প্রকাশ ২. মজা করার জন্য ৩. ভাষার অভিনবত্ব সৃষ্টি এবং একঘেয়েমি পুনরাবৃত্তি দুর করার জন্য ৪. ভাষাকে সরস করা জন্য ৫. বিশেষ ভাবে স্বতন্ত্র বা নিজস্বতা দেখানোর জন্য এবং দৃষ্টি কাড়ার জন্য ৬. বক্তব্যকে টানটান, সংক্ষিপ্ত এবং চাঁচাছোলা করার জন্য ৭. নানারকম দুঃমোচনে বিশেষত প্রেমের সম্পর্ক ভাঙন বা মারাত্মক শারীরিক অসুস্থতা বা কঠোর কোন শাস্তির কারনে ৮. প্রথাগত পরিবেশ বা সভার গাম্ভীর্য ও অতিরিক্ত মাত্রা ভাঙার জন্য ৯. যে বিষয়গুলো নিয়ে ট্যাবু কাজ করে সে বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় স্ল্যাং প্রয়োগের বাড়তি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ১০. বক্তা-শ্রোতা বা লেখক-পাঠকের মধ্যে সম্পর্ক স্পষ্ট করতে ১১. অপমান, হেয় বা তাচ্ছিল্য করার জন্য ১২. ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে অথবা খোঁচা বা খোঁটা দিতে ১২. ভাষাকে তাৎক্ষনিক , সময়োপযোগী ও বিষয়মুখী করে তুলতে ১৩. বিরক্তি , ক্ষোভ, অসোন্তষ বা রাগ প্রকাশের ক্ষেত্রে স্ল্যাং ব্যবহার হয়। ব্লগার মামুন ম. আজিজ মতে, বাংলা ব্লগে ৫ এবং ৭ কারণগুলোর প্রভাব রয়েছে। (মামুন ম. আজিজ, স্ল্যাং ব্যবহারের পোষ্টমোর্টেম, সামহ্যোয়ারইন ব্লগ, মার্চ ২০০৮)
বাংলা ব্লগে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হচ্ছে কেন? ব্লগীয় ভাষা সৃষ্টির পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে। এক্ষেত্রে ব্লগকে একটি চলমান মিডিয়া হিসেবে ধরে নেওয়া যাক। বিভিন্ন অঞ্চলের ব্লগাররা ব্লগসাইটে চলমান নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লেখছেন। সেই লেখায় কিছু কিছু আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার হচ্ছে। ফলে একে অপরের মিথস্ক্রিয়ায় নতুন নতুন শব্দ তৈরি হচ্ছে। মজা করার জন্য অনেক ব্লগার প্রচলিত একটি শব্দকে ভিন্নভাবে লেখছেন বা ভেঙ্গে লেখছেন। যেমন ধন্যবাদ বলতে বাংলা ব্লগে ব্যবহার করা হয় ‘ধইন্যাপাতা’। ব্লগে যেহেতু প্রতিনিয়তই নতুন নতুন লেখা আসছে এবং তার প্রতিক্রিয়া মন্তব্য আকারে আসছে সুতরাং ব্লগারদের প্রচুর ‘কনটেন্ট’ তৈরি করতে হয়। পোস্টে মন্তব্য করতে কিংবা মন্তব্যের জবাব দিতে দিতে একঘেয়েমি পেয়ে বসে ব্লগারদের। একঘেয়েমির পুনরাবৃত্তি দূর করতেও নতুন নতুন শব্দ তৈরি হচ্ছে। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে গিয়ে বাংলা ব্লগে প্রচলিত শব্দের ভিন্ন ব্যবহার হয়েছে। যেমন কেউ ইংরেজি ভাষায় পোস্ট দিলে বলা হয়েছে ‘আংড়েজি পোস্ট’। এছাড়া ব্লগ রাজনীতির কারণেও স্ল্যাং আকারে প্রচুর নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছে বাংলা ব্লগে।
প্রশ্ন উঠতে পারে ব্লগে তৈরি হওয়া এইসব শব্দের কি কোন গুরুত্ব আছে? এসব শব্দ কি অভিধানে ঠাই করে নিবে নাকি কেবল ব্লগেই বিচরণ করবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর এরইমধ্যে আসা শুরু করেছে। অনেক ব্লগার এখন তাদের ব্যবহারিক জীবনেও ব্লগে ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করছেন। ২০১১ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারির অনলাইন সংস্করণে নতুন যোগ হওয়া শব্দের তালিকায় আলোচিত শব্দটি হলো 'ব্লগেবল'। যেসব বিষয় নিয়ে ব্লগ লেখা যাবে সেগুলোকেই বলা হয় ‘ব্লগেবল’। ফলে দেখা যাচ্ছে ব্লগে ব্যবহৃত কিছু কিছু শব্দ অভিধানেও স্থান করে নিচ্ছে। বাংলা ব্লগের ক্ষেত্রে এমনটা অবশ্য এখনও হয়নি। তবে ভবিষ্যতে বাংলা ব্লগের কিছু কিছু শব্দ অভিধানে ঠাই নিবে এমনটা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। এছাড়া ব্লগে যে ভাষারীতির বিস্তার হচ্ছে তার সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলাপের সময় বোধহয় এখনও আসেনি। বাংলা ব্লগিংয়ের ইতিহাস মাত্র কয়েক বছরের । ফলে ভাষারীতি বা ভাষাশৈলী এখনও তৈরি হচ্ছে ব্লগারদের মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে।