আমাদের নিয়ে বিমানটা সম্ভবত স্থানিয় সময় ভোর ৪টায় ল্যান্ড করে, বাহির হতে হতে প্রায় ৬ টা এবং কোম্পানির প্রতিনিধির জন্য অপেক্ষা করতে করতে ঘড়িতে তখন ১১টা বেজে গেছে।
আমাদের কোম্পানিতে আজকের ফ্লাইটে আমরা ৪জন আসলাম (সোহেল, শাহীন, রুমন আর আমি), সবাই একি ট্রেনিং সেন্টার থেকে পরীক্ষা দিয়ে এসেছি কিন্তু হাজার হাজার ছাত্রের মাঝে আমাদের ৪জনের পূর্ব পরিচয় ছিলনা যদিও এয়ারপোর্ট নেমে আমাদের ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে আড্ডার ছলে।
আগের পর্বে উল্লেখ করেছি আমাকে নেওয়ার জন্য এক মামা এসেছিল, আর অন্যদের মাঝে সোহেলকে নেয়ার জন্য ওর ভাই আর চাচা এসেছে রুমন আর শাহীনকে নেওয়ার জন্য কেও আসেনি। যে যাকে নিতে আসোক, কোম্পানির প্রতিনিধি না আসা পর্যন্ত কেও যেতে পারবনা সবাইকে কোম্পানির প্রতিনিদির সাথেই যেতে হবে হয়ত মামা চাচা বা ভাই সাথে যেতে পারবে।
সকাল ৯টার দিকে প্রচন্ড ক্ষিদা লেগে গেছে, এক প্রকার পেটের ভিতর মারা মারি চলছে। যে করেই হোক কিছু খেয়ে পেট শান্ত করতে হবে।
সোহেলের ভাই এবং চাচা সোহেল এবং রুমন কে নিয়া গেল কিছু খাওয়াতে, আমি আর শাহীন বসে থাকলাম নিশ্চুপ হয়ে। যদিও আমার মামা এসেছি কিন্তু উনার সাথে আজকে প্রথম দেখা তাই খাবারের কথা লজ্জায় বলতে পারছিনা।
সোহেল এবং রুমন দুইজনেই খাবার খেয়ে ফিরে এসেছে, রুমন অবশ্যক এসে কোকের একটা ক্যান আমার হাতে দিল তাতে অর্ধেক কোক ছিল। ভাল খারাপ চিন্তা না করেই ডকডক করে গিলে ফেল্লাম কোকটা।
মামা হয়তো আমার ড্রিংক গলদ করনের ভাব দেখে বুঝতে পারছে প্রচন্ড ক্ষিদা পেয়েছে, উনি পাশের একটা পুলু ফাষ্ট ফুড থেকে আমার এবং শাহীনের জন্য দুইটা ব্রেড আর অরেন্জ জুস নিয়ে এল। আমি ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই গপাগপ মেরে দিলাম।
কোম্পানির প্রতিনিধির সাথে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম, এখানে গাড়ি বলতে বাংলাদেশে পিক-আপ ব্যান এখানে "লরি" বলা হয়। পিছনে আমরা ৭ জন বসলাম ড্রইভার সাহেব ছোটে চলছেন, আমি চারপাশের মনোরম দৃশ্য দেখছি আর কোন কোন অংশের সাথে বাংলাদেশের মিল খুজে পাচ্ছি। লরির পিছনে বসে গল্পের ছলে জানলাম প্রতিদিন কাজে যেতে হবে এই রকম লরির পিছনে বসে, বৃষ্টি হলে মাঝে মাঝে ড্রাইভাই নাকি প্লাষ্টিকের ক্যানভাস দেই নতুবা ভিজে ভিজে যেতে হয় অথবা আসতে হয় (বর্তমানে সরকারি ভাবে প্রতিটা কোম্পানিকে লরির উপরে কাভার দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এবং সব লরিতে এখন কাভার আছে)।
আমাদের নিয়ে গাড়িটা দ্রত চলছে, আমরাও পুরানদের সাথে আড্ডার বিষয় বস্তু আরো দ্রুত পরিবর্তন করছি।
এয়ারপোর্ট থেকে বাহির হতেই দেখলাম বড় করে লেখা "সিঙ্গাপুরে স্বাগতম" চারপাশে বাহারি ফুল গাছ দিয়ে সাজানো রাস্তা, মনে করলাম সম্ভবত এয়ারপোর্ট এরিয়া বলেই এমন করে সাজানো কিন্তু দেখলাম সারা সিঙ্গাপুরই এমন করে ছবির মত সাজিয়ে রেখেছে। কখনো কখনো যখন আমাদের গাড়িটা হাইওয়ের ফ্লাইওভারে উঠে তখন চার পাশে মনে হয় সবুজে সমারোখ একটা বাগান, আসলে সিঙ্গাপুরে প্রচুর পরিমানে গাছ লাগানো আছে যার জন্য একটু ওপর থেকে দেখলেই মনে হবে কোন এক বনের মাঝে দিয়ে আপনার গাড়িটা চলছে।
প্রায় ৪৫ মিনিট পরে আমরা এসে পৌছলাম আপার ওয়েল রোডের টেলিও মেডিকেল সেন্টারে, এখানে আমাদের শারীরিক পরীক্ষা করানোর পরে নিয়ে যাওয়া হবে কোম্পানির অফিসে।
আমরা সবাই যেখেতু বাংলাদেশ থেকেই মেডিকেল করে এসেছি তাই তেমন কোন চিন্তা লাগছিলনা, কিন্তু আমাকে যখন চোখের পরীক্ষা করে অন্য একটা রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হল তখন আমি চিন্তিত হয়ে পরলাম । এই সমস্যায় আমি একাই পরলাম বাকি তিন জনের কোন সমস্যা পেলনা, তাই তারা নিচে ওয়েটিং রুমে বসে আছে আর আমি ডাক্তারের জন্য কন্সালট্যান্ট রুমে অপেক্ষা করছি।
কিছুক্ষর পর ডাক্তার আসল, চোখের অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষা করে একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিলেন তাতে লেখে -০.৫০ একটা ল্যান্স ব্যবহার করতে হবে।
আমি এখন মেডিক্যাল ফিট সার্টিফিকেট নিয়ে নিচে আসলাম, সবাই তখন জিজ্ঞাসা করছিল কেন আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
মেডিক্যাল পর্ব শেষ করে আমার সবাই লরির কাছে আসলাম, এবার লরিতে বসার মত জায়গাও খালি নেই। ড্রাইভার আমাদের চার জনের জন্য চারটা ম্যাট্রেস, বালিশ, পাতলা কম্বল এবং সেফটি সু কিনে নিয়ে আসল, তাতেই অর্ধেকের বেশি জায়গা কাভার হয়ে গেছে।
এখন আমাদে সাথের রুমন ড্রাইভারে পাশেে ছিটে বসল আর আমরা ৬ জন পিছনে বসে সেই পূর্বের আড্ডা আবার শুরু করলাম।
ম্যাট্রেস বলতে আবার ফাইভ ষ্টার হোটেলের ম্যাটস মনে করে বইসেন না, কোন রকম ১.৫ ইন্চি পূরুত্বের একটা ফোম যা অনেকেই প্রথম দিনই ফেলে দেয়। আমরা যেখেতো নতুন তাই এতেই আরাম করে ঘুমানোর চেষ্টা করতাম যদিও সপ্তাহ শেষ না হতেই আমরাও ফেলে দিয়েছি।
এবার আমাদের যাত্রা কোম্পানির অফিসে, সেইখানেই আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। কোম্পানির ম্যানেজারের সাথে বেতন নিয়ে কথা বর্তা সাথে এক বছরের চুক্তি করা, যদিও দেশ থেকেই এই বিষয় গুলি শেষ করে দেওয়া হয়েছে তবুও আমাদের একটা ফরমালিটি মেইনটেন করতে হবে।
লরিটা এসে অফিসের সামনে থামল, (এখন সঠিক ঠিকানাটা মনে করতে পারছিনা, শুধু এতটুকু মনে আছে গ্যালাং লরং ৩) আমরা ৪জন ড্রাইভারের সাথে অফিসে গেলাম অন্যরা নিচে লরিতে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ম্যানেজার "চেংপেং" করে আমাদের কি যেন বল্ল কিছুই বুঝলাম না, কথা শেষে ১০০ ডলার করে দিল (এই ডলার কিন্তু ফ্রী না লোন হিসাবে দিল, পরের মাসের বেতন থেকে কেটে নেবে) এবং অনেক কাগজে স্বাক্ষর নিল। কাগজ গুলি পড়ার মত সময় দিলনা তাই কি লিখা ছিল কিছুই জানিনা, শুধু অন্ধের মত স্বক্ষর করে আসলাম।
দেশ থেকে ৪৭ ডলার নিয়ে এসেছিলাম আর এখন পেলাম ১০০ ডলার, সব মিলিয়ে আমি এখন ১৪৭ ডলারের মালিক। মু হা হা হা
লরিতে এসে অপেক্ষা করছি আর পাশের মনোরম দৃষ্যগুলি উপভোগ করছি, অনেক সুন্দর একটা পার্কের পাশে আমাদের লরিটা পার্কিং করা পার্কের পাশেই মেট্রো রেল লাইন যা দিয়ে ২/৩ মিনিট পর পরই মেট্রো রেল ছোটে চলছে। এটাই আমার জীবনের প্রথম মেট্রো রেল দেখা, কেমন যেন একটা নতুন খেলনা দেখছি। কত সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো একটা শহর, আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্তার কথা বলতে হবে বলে মনে হয়না এইটা সবাই যানেন সিঙ্গাপুরের রাস্তায় ভাত রেখে খাওয়া যায় (রাস্তার পরিষ্কারের উদাহরন এইভাবেই দেয়া হয়)।
বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন একটা ঝিমুনি চলে আসল, এমন সময় গোফওয়ালা ড্রাইভার এসে বল্ল "মাকান" এর কথা (মাকার মানে খাবার)।
আমরা ৭ জন ছোটলাম ক্যান্টিনের দিকে, ক্যালাং এমআরটি ষ্টেশনের পাশেই একটা মুসলিম ক্যান্টিন সবাই ঐখানেই বসলাম।
কেউ বল্ল খাসির মাংস আর বিরানি কেউ কারি চিকেন বিরিয়ানি আর আমি চাইলান ফ্রাই চিকেন সাথে সাদা ভাত, ঐ খাবারের দাম ছিল ৪ ডলাম। আমার খাবারের বিলটা মামা দিয়েছিল আর সোহেলের বিল ওর ভাই কিন্তু রুমন আর শাহীন নিজেদের বিল নিজেরা দিল।
খাবার পরিবেশন ছিল একটা প্লাষ্টিকের প্লেটে কলাপাতার উপরে ভাত, যেন সেই ৩০/৪০ বছর পূর্বের দিনে গ্রামে নাকি কলা পাতাতে লোকজন ভাত খেত।
মামা বল্ল কলা পাতার খাবার নাকি উন্নত মানের এবং দামও বেশি, নিজেরা যখন রান্না করব বা কম দামের ক্যান্টিন থেকে খাব তখন নাকি সাধারন কাগজে খাবার দেওয়া হবে।
খাবার শেষে সাধারন টেপের পানিই খেলাম তবে কেমন জানি একটা ব্লিসিং পাওডারের কড়া গন্ধ করছিল, শাহীন ১.৫ ডলার দিয়ে ১৫০০ এমএল এর একটা পানির বোতল কিনলে আমি ওর সাথে শেয়ার করি।
খাবার পর্ব শেষ করে আমরা লরিতে এসে বসে থাকলাম, দেখতে দেখতে ঘরির কাটা ৩টা পার হয়ে গেছে। কিছুক্ষন পরেই ড্রাইভার আসল এবং আমাদের নিয়ে চল্ল থাকার জায়গাতে, থাকার জায়গাযে কত খারাপ একবার নিজের চোখে না দেখতে বিশ্বাস করতে পারবেন না।
কাকিবুকি এভিনিও ৩ তে একটা হোষ্টেলে আমাদের থাকার জায়গা দেওয়া হল (বর্তমানে এই হোষ্টেলটা ভেঙ্গে হাউজিং বোর্ডের কার পার্ক করা হয়েছে), মেটালের ৩ তলা বিল্ডিং আমাদের রুম ২য় তলাতে দেওয়া হল। ডাবল বেড অর্থাৎ উপরে একজন নিচে একজন, একরুমে ৩২ জন থাকার ব্যবস্থা।
মালপত্র সব রুমে রেখে নিচে আসলাম, এবার মামার বিদায়ের পালা। যদিও উনি আমার একটু দূরের মামা, তারপরও মনে হচ্ছিল উনি আমার কত কাছের আপন তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। হোষ্টেলের কিছু লোক আছে যারা খাবার সাপ্লাই দেয়, মামা এদের সাথে কথা বলে খাবার ঠিক করে দিলেন। মাসে ১১০ ডলার দিতে হবে, সকালে ২টা পরটা সাথে ভাজি বা ডাল দুপুরে সবজি মাছ এবং রাতে মাংস আলু ভর্তা আর ডাল।
ততক্ষনে কিছু কিছু লোক কাজ শেষ করে যার যার রুমে ফিরছে, আর আমরা নতুন এসেছি হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই কাজে জয়েন করব। ভাবনার জগত থেকে ফিরিয়ে দিল মামার কথা, বিদায় নিয়ে চলে যাবে এমন সময় ৩০ ডালার আমার পকেটে দিল যদিও আমি নিতে চাইনি তারপরও এক প্রকার জোর করে দিয়ে গেল।
মামা চলে গেল আমি বড্ড একা, সোহেলের ভাগ্য ভাল ওর ভাই এবং কাকা দুইজনই এই হোষ্টেলে থাকে।
সন্ধ্যার পরে আমাদের রুমে খাবার দিয়ে গেল, রাতের খাবারটা কিছুটা ভাল তার উপর বাঙ্গালী রান্না সুতরাং খাবার খেতে কোন সমস্যা হয়নি। আমরা চারজনই গোসল করে এশার নামাজ পরে খেতে বসলাম, কেন জানি কেহই অর্ধেকের বেশি খেতে পারিনি। কেমন জানি একটা অস্থির অস্থির ভাব কাজ করছিল, দুপুরে অফিসের নিচে বসে বাড়িতে কিছুটা সময় মামার মোবাইলে কথা বলেছিলাম। মায়ের গলাটা কেমন যেন বসে গেছে, নিশ্চয় দুইদিন খুব কান্না কাটি করেছে। যদি নিজের মোবাইল থাকতো তাখলে এখন একটা কল করতাম বাসায়, কিন্তু নিজের মোবাইল না থাকাতে ইচ্ছে থাকলেও কথা বলার কোন পথ নেই।
আমরা চারজন হোষ্টেল থেকে বাহিরে এসে পাশের খোলা একটা মাঠে বসে গল্প করছি, কিছুটা সময় পর চারজনই নিরব হয়ে শুয়ে থাকলাম মাঠের সবুজ ঘাষের উপরে। মনটা কেমন যেন করে উঠছে, মনে হচ্ছে আমি বুঝি এখন ইচ্ছে করলেই মায়ের কাছে যেতে পারবনা বাবার সাথে গল্প করতে পারবনা। মুক্ত আমি কেমন জানি একটা বিশাল খাচায় বন্ধি।
চোখের সামনে ভেসে উঠছে মায়ের মলিন মুখটা যাকে আমি কথা দিয়েছিলাম ১বছর পর দেশে ফিরব, বাবার অসহায় চাহনিটা যা আমাকে অপরাধি করে ফেলছে। ছোট ভাইয়ের হঠাৎ বোবার মত দাড়িয়ে থাকা, সবার ছোট্ট বোনটা তার পকেট থেকে একটা জ্বাল চকলেট দিয়ে বলেছিল বাসে উঠলে মুখে দেওয়ার জন্য কেননা আমি বাসে বমি করি তাই। বড় আপা জড়িয়ে দরে কাদঁছিল পাশে দাাড়ানো ছোট আপা ফুফিয়ে উঠছিল বার বার, তাদেরকে আমি এক প্রকার ধমক দিয়ে এসেছি যাতে না কান্না করে। ছোট বোন যার সাথে সব সময় ঝগড়া করতাম, তাকেও কেমন মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলাম ভাল করে লেখা পড়া করতে। কেমন যেন একটা সবার অবিভাবক হয়ে গিয়েছিলাম সেই সময়টা, সবাই কাঁদছে আমি সবাইকে শান্তনা দিচ্ছি।
তনিটার কথা খুব মনে পরছে, যার সাথে ছোট্ট ছোট্ট কোন বিষয় নিয়েও বড় বড় ঝগড়া করতাম। আবার এক মুহুর্ত না দেখলে পাগল হয়ে যেতাম। সেই ঝগড়াটে তনিটাও সেইদিন কেমন মলিন স্বরে আমার সাথে কথা বল্ল, বিদায় দিতে গিয়ে হঠাৎ করেই জড়িয়ে দরে চিৎকার করতে থাকল।
সময় চলে যাচ্ছে দ্রুত, আকাশে একটা চাঁদ আলো ছড়াচ্ছে কিন্তু বৈদ্যুতিক আলোর জন্য কেমন যেন নিজের প্রকৃত সুন্দর্যটা ফুটিয়ে তুলতে পারছেনা।
আমি অপলক নয়নে তাকিয়ে আছি নিঃস্ব চাঁদটার দিকে, কেমন জানি নিজেও একা হয়ে গেলাম এই চাঁদের মত............................
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ২:৩৭